বিংশ শতাব্দীর পদার্থবিজ্ঞানে স্টিফেন হকিং একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। আজকের দিনে পুরো বিশ্বের পদার্থবিজ্ঞানীরা কণাবাদী মহাকর্ষ নামের যে তত্ত্ব নিয়ে কাজ করছেন, হকিং তার অন্যতম পথিকৃৎ। কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোল নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে তিনি দেখান, তথ্য হারিয়ে যাওয়ার একটি ব্যাপার ঘটে, যাকে আমরা বলি ব্ল্যাকহোল ইনফরমেশন প্যারাডক্স। এটি আসলে আইনস্টাইনের মহাকর্ষতত্ত্বের সীমাবদ্ধতাকেই প্রকটভাবে তুলে ধরে। ব্যাপারগুলো ভালোভাবে বোঝার জন্য গোড়া থেকে শুরু করা যাক।
বস্তুজগতে যা কিছু ঘটে তার মূলে রয়েছে চার ধরনের মিথস্ক্রিয়া। প্রতিদিনকার জগতের বিদ্যুৎ-চুম্বক ও মহাকর্ষীয় মিথস্ক্রিয়ার সঙ্গে আমরা পরিচিত। মহাকর্ষীয় মিথস্ক্রিয়ার কারণে আমরা ওজন টের পাই, বৃষ্টির জল নিচের দিকে পড়ে, চাঁদ পৃথিবীকে ও পৃথিবী সূর্যকে আবর্তন করে ইত্যাদি। নিত্যনৈমিত্তিক জীবনে আমরা আর যত ধরনের বল অনুভব করি, যেমন জুতার সঙ্গে মেঝের ঘর্ষণ, মাংসপেশিতে টান কিংবা ভিড়ের মধ্যে ঠেলা-ধাক্কা, এগুলোর মূল কারণ বিদ্যুৎ-চুম্বক মিথস্ক্রিয়া। দিঘির জলে জ্যোত্স্নার স্নিগ্ধ প্রতিফলন কিংবা নিয়ন বাতির মায়াবী আলোর কথাই বলুন আর ভয়ংকর অগ্নিকাণ্ড কিংবা গগনবিদারী বজ্রপাতের কথাই বলুন—এগুলো সবই হয় এই মিথস্ক্রিয়ার কারণেই।
এ ছাড়া আছে সবল নিউক্লীয় ও দুর্বল নিউক্লীয় মিথস্ক্রিয়া। এগুলো শুধু পরমাণুর কেন্দ্রিন (নিউক্লিয়াস) বা তার চেয়েও ক্ষুদ্র পরিসরে কাজ করে বলে দৈনন্দিন জীবনে এদের অস্তিত্ব সরাসরি টের পাওয়া যায় না। কিন্তু মৌলিক পদার্থের গঠন ও রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় এদের ভূমিকা অপরিসীম। সবল নিউক্লীয় মিথস্ক্রিয়ার কারণে পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রোটনেরা একসঙ্গে আটকে থাকতে পারে। এটি না থাকলে হাইড্রোজেন ছাড়া আর কোনো মৌলিক পদার্থ থাকত না, কাজেই কার্বনভিত্তিক জীবনও থাকত না। দুর্বল নিউক্লীয় মিথস্ক্রিয়ার নাম শুনে একে তুচ্ছ মনে করা ভুল হবে। পরমাণু নিউক্লিয়াসের তেজস্ক্রিয় বিটা ক্ষয় ঘটে এর কারণেই। সূর্য নামের যে বিশাল পারমাণবিক চুল্লি আমাদের শক্তি জোগায়, তার জ্বালানি পোড়ার প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে দুর্বল নিউক্লীয় মিথস্ক্রিয়া।
মহাকর্ষকে বাদ দিয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে বিদ্যুৎ-চুম্বক, সবল নিউক্লীয় ও দুর্বল নিউক্লীয় মিথস্ক্রিয়ার ব্যাখ্যা আমরা ভালোভাবেই জানি। এ জন্য যে তাত্ত্বিক কাঠামো ব্যবহার করা হয় তার নাম কণাবাদী ক্ষেত্রতত্ত্ব।
মহাকর্ষকে অনুভব করা যতই সহজ হোক না কেন, মৌলিক মিথস্ক্রিয়াগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে রহস্যময়। ভেবে দেখুন তো, ছোট্ট একটি বাচ্চা যখন দুধের বোতল আলতো হাতে ধরে রাখে, পৃথিবী নামের পুরো একটি গ্রহের মহাকর্ষ টান তার কাছে হার মানে কি না? এর কারণ, মহাকর্ষ আসলে অনেক দুর্বল-মৌলিক মিথস্ক্রিয়াগুলোর মধ্যে দুর্বলতম। এই দুর্বলতার কারণে ক্ষুদ্র পরিসরে মহাকর্ষের স্বরূপ বোঝা খুবই কঠিন। বৃহৎ পরিসরে আবার কিন্তু শুধু মহাকর্ষই বিরাজ করতে পারে এবং একে বোঝাও সহজ, কেননা অনেক অনেক বস্তুকণার সম্মিলিত মহাকর্ষ শক্তিশালী আকার ধারণ করে। বিদ্যুৎ-চুম্বক মিথস্ক্রিয়ার ক্ষেত্রে এ রকমটি ঘটে না, কারণ ধনাত্মক ও ঋণাত্মক দুই ধরনের বৈদ্যুতিক আধান থাকার জন্য মিথস্ক্রিয়াগুলো পরস্পরকে বাতিল করে দেয়। অন্যদিকে পারমাণবিক মিথস্ক্রিয়াগুলো বৃহৎ পরিসরে অকার্যকর।
মহাকর্ষকে বাদ দিয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে বিদ্যুৎ-চুম্বক, সবল নিউক্লীয় ও দুর্বল নিউক্লীয় মিথস্ক্রিয়ার ব্যাখ্যা আমরা ভালোভাবেই জানি। এ জন্য যে তাত্ত্বিক কাঠামো ব্যবহার করা হয় তার নাম কণাবাদী ক্ষেত্রতত্ত্ব। এই তাত্ত্বিক কাঠামোর সাফল্য ঈর্ষণীয় এবং এটি নিঃসন্দেহে মানবজাতির শ্রেষ্ঠতম বুদ্ধিবৃত্তিক অর্জনগুলোর একটি। এটি যে কণাবাদী নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত, তা সাধারণ চিন্তায় অবোধ্য হলেও এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ নেই। কারণ এর সপক্ষে অজস্র প্রমাণ রয়েছে। এই কণাবাদী ক্ষেত্রতত্ত্বের অন্যতম মূল ভিত্তি হলো একত্বতা বা ইউনিটারিটি। ধরুন, কতগুলো কণা মিথস্ক্রিয়া করে অন্যকিছু কণায় রূপান্তরিত হলো। এটি ঘটার একটি সুনির্দিষ্ট সম্ভাবনা থাকবে। রূপান্তরের পরের কণাগুলো ভিন্ন হলে আবার ভিন্ন একটি সুনির্দিষ্ট সম্ভাবনা পাওয়া যাবে। সংখ্যাগুলো আলাদাভাবে যা-ই হোক না কেন, মোট সম্ভাবনার যোগফল হবে এক বা শতকরা এক শ। এটাই একত্বতা, যা বোঝা খুবই সহজ। একত্বতা থেকে আমরা প্রমাণ করতে পারি, তথ্য হারিয়ে যেতে পারে না। তথ্য উদ্ধার করা কখনো হয়তো সহজ, কখনো বা কঠিন হতে পারে, কিন্তু তথ্যের বিলোপ ঘটা অসম্ভব।
আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের আরেকটি মূল স্তম্ভ হলো আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। এটা বৃহৎ পরিসরে মহাকর্ষের আচরণ সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করে। এই তত্ত্বের মহিমা কালোত্তীর্ণ। মহাকর্ষ তরঙ্গের অধুনা শনাক্তকরণ এর শতাব্দীব্যাপী সাফল্যের মুকুটে আরেকটি পালক যোগ করেছে। কিন্তু আমরা নিশ্চিতভাবে জানি এই তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কারণ আইনস্টাইন তাঁর তত্ত্বে কণাবাদী নীতিকে কোনো স্থান দেননি। কণাবাদী কোনো তত্ত্বে সম্ভাবনার যে হিসাব আমরা মেলাই, আইনস্টাইন তাকে ‘ঈশ্বর পাশা খেলেন না’ বলে অবিশ্বাস করেছেন। ক্ষুদ্র পরিসরে আইনস্টাইনের মহাকর্ষতত্ত্ব তাই ভুল ফল দেবে। কাজেই সাধারণ আপেক্ষিকতাকে কণাবাদী নীতির আওতায় নিয়ে আসা দরকার। এ কাজটি সহজ নয়, কারণ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগতে বস্তুকণার যে শক্তি থাকলে মহাকর্ষ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে, সে শক্তি আমাদের আওতার অনেক বাইরে। কাজেই কণাবাদী মহাকর্ষের আচরণ নিয়ে পরীক্ষালব্ধ কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই এবং অদূর ভবিষ্যতেও তা পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এ বাধা কিন্তু অনুসন্ধিত্সু মানুষকে থামিয়ে রাখতে পারেনি।
১৯৭০-এর গোড়ার দিকে হকিং কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে কাজ করছিলেন। বলে রাখা ভালো যে আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুসারে কৃষ্ণগহ্বর হলো এমন কোনো মৃত তারা বা মহাবিশ্বের এমন কোনো এলাকা যেখান থেকে আলো বা অন্য কোনো কিছুই নির্গত হতে পারে না। কৃষ্ণগহ্বরের প্রচণ্ড শক্তিশালী মহাকর্ষ ক্ষেত্র তার চারপাশের স্থানকালকে অতিমাত্রায় বাঁকিয়ে ফেলে বলেই এমনটি ঘটে। হকিং ভেবে দেখলেন সাধারণ আপেক্ষিকতা ও কণাবাদী নীতির যুগপৎ প্রয়োগ করার জন্য কৃষ্ণগহ্বর একটি মোক্ষম জায়গা। শক্তিশালী মহাকর্ষক্ষেত্রের উপস্থিতিতে কণাবাদী ক্ষেত্রতত্ত্ব কী ফল দেবে?
হিসাব কষে তিনি দেখলেন যে কণাবাদী নীতির কারণে কৃষ্ণগহ্বর থেকেও সামান্য হারে আলো বা অন্য বিকিরণ নির্গত হতে পারে। আমরা একে বলি হকিং বিকিরণ। পরিমাণে সামান্য হলেও দীর্ঘকাল হকিং বিকিরণ করতে করতে একটি কৃষ্ণগহ্বর কালক্রমে উবে যেতে পারে। সমস্যা হলো হকিং বিকিরণ দেখে বলা যাবে না কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে কী ছিল। কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে এক কেজি ভরের কোনো পাথর কিংবা সোনাদানা কিংবা বিশ্বকোষের কোনো খণ্ড যা-ই পড়ে গিয়ে থাকুক না কেন, ফল একই হবে। কাজেই তথ্য হারিয়ে যাওয়ার একটি ব্যাপার ঘটবে। এটি কণাবাদী ক্ষেত্রতত্ত্বের একত্বতাকে সরাসরি লঙ্ঘন করে। একেই আমরা বলি কৃষ্ণগহ্বর তথ্য কূটাভাস বা ব্ল্যাকহোল ইনফরমেশন প্যারাডক্স।
আসলে হকিং এই ফলে উপনীত হতে যা ব্যবহার করেছেন, তা কণাবাদী মহাকর্ষের পুরোদস্তুর কোনো তত্ত্ব ছিল না, ছিল আইনস্টাইনের মহাকর্ষতত্ত্ব ও কণাবাদী নীতির সহজ একটি খিচুড়ি। কেতাবি ভাষায় এর নাম অর্ধচিরায়ত সন্নিকর্ষ বা সেমিক্ল্যাসিকাল অ্যাপ্রক্সিমেশন। এই রেসিপি সঠিক ফলই দেবে এমন কথা হলফ করে বলা যায় না। পদার্থবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার জ্ঞান দৃঢ়ভাবে ইঙ্গিত করে যে একত্বতা অলঙ্ঘনীয় এবং তথ্য হারিয়ে যেতে পারে না। কাজেই সাধারণ আপেক্ষিকতা ও কণাবাদী নীতির সম্মিলন ঘটিয়ে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ তত্ত্ব তৈরি করা দরকার, যাতে একত্বতা বজায় থাকে এবং তথ্যের সংরক্ষণ ঘটে। এই তত্ত্বই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিসরে মহাকর্ষের আচরণ সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করবে। কণাবাদী মহাকর্ষ বা কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি তত্ত্ব আমরা একেই বলি। হকিংয়ের কাজ তাই আইনস্টাইনের তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা ও কণাবাদী মহাকর্ষের পুরোদস্তুর একটি তত্ত্বের প্রয়োজনীয়তাকেই প্রকট করে তোলে। হকিং তাঁর কাজের মাধ্যমে অমর হয়ে থাকবেন।