লাইগোর ডিটেক্টরে ১৪ সেপ্টেম্বর যে তরঙ্গ ধরা পড়েছিল, তা ছিল দুটি দানবীয় ভরের কৃষ্ণগহ্বরের একীভূত হওয়ার ফল। ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন বছর ধরে কল্পনাতীত বহুদূরের পথ পেরিয়ে এই মহাকর্ষ তরঙ্গ পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছিল। আর এই কৃষ্ণগহ্বর দুটি ছিল দুটি ভারী নক্ষত্রের ধ্বংসাবশেষ। এককালে সুপারনোভা বিস্ফোরণ হয়েছিল নক্ষত্র দুটির। এ ধরনের কোনো নক্ষত্রের ভাগ্যে এ রকম বিস্ফোরণ হলে তার কেন্দ্র চুপসে যেতে শুরু করে। আসলে এই চুপসে যাওয়ার কারণেই সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটে বলে ধারণা করা হয়। নক্ষত্রের কেন্দ্রের ক্রমাগত সংকোচনের কারণে এর মহাকর্ষের টান তীব্র হয়। একসময় মহাকর্ষ এতই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে কোনো কিছু, এমনকি আলোও সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। এভাবেই জন্ম হয় কৃষ্ণগহ্বরের।
প্রাকৃতিকভাবে কৃষ্ণগহ্বর কালো ও ক্ষুদ্রাকৃতির। তবে পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং তাত্ত্বিকভাবে দেখিয়েছেন, কৃষ্ণগহ্বর আসলে কালো নয়। সেখান থেকেও বিকিরণ বেরিয়ে আসে। এটিকে বলা হয় হকিং রেডিয়েশন বা হকিং বিকিরণ। পরীক্ষামূলকভাবে এই বিকিরণ এখনো শনাক্ত করা যায়নি। এদিকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত কৃষ্ণগহ্বর–সংক্রান্ত সব প্রমাণই ছিল পরোক্ষ। মহাকাশের কোনো অদৃশ্য বস্তুকে ঘিরে সাধারণ কোনো নক্ষত্র বা নক্ষত্রগুলোকে খুবই জোরে পাক খেতে দেখা যায়। কিন্তু ২০১৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত হওয়ার পর পুরো দৃশ্যপট পাল্টে গেল। কারণ, মহাকাশের দুটি ভারী বস্তু একীভূত হওয়ার কারণে এ রকম ঘটনা শনাক্ত করা যাবে, তা আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব থেকে অনেক আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল। কাজেই মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্তের সঙ্গে সঙ্গে প্রমাণ হলো যে কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব সত্যি সত্যিই আছে।
১৪ সেপ্টেম্বর লাইগোর ডিটেক্টরে আঘাত হানা মহাকর্ষ তরঙ্গের উৎপত্তি অসাধারণ ভারী দুটি কৃষ্ণগহ্বরের সংঘর্ষ। কৃষ্ণগহ্বর দুটির ভর ছিল আমাদের সূর্যের তুলনায় যথাক্রমে ২৯ গুণ ও ৩৬ গুণ বেশি। সুপারনোভা বিস্ফোরণে নক্ষত্র দুটির অধিকাংশ পদার্থ মহাকাশে ছিটকে পড়েছিল। তুলনামূলক অতি অল্প পরিমাণে পদার্থ সংকুচিত হয়ে ওই কৃষ্ণগহ্বর দুটির জন্ম হয়েছিল। জ্যোতিঃপদার্থবিদদের হিসাব অনুযায়ী, কৃষ্ণগহ্বরের জন্ম হওয়ার আগে যে নক্ষত্র ছিল, সেগুলোর ভর ছিল আমাদের সূর্যের চেয়ে অন্তত ৩০০ গুণ বেশি। এ রকম ভারী নক্ষত্র মহাবিশ্বে বিরল। কাজেই তাত্ত্বিকভাবে বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে, এই প্রথম প্রজন্মের নক্ষত্রগুলোর জন্ম হয়েছিল মহাবিস্ফোরণের পরপরই। সেদিক থেকে আমাদের সূর্য হলো তৃতীয় প্রজন্মের নক্ষত্র। এ ধরনের নক্ষত্রের জন্ম হয় আগের দুই প্রজন্মের অনেক বড় বড় নক্ষত্রের ধ্বংসাবশেষ থেকে। কাজেই লাইগোর ওই কৃষ্ণগহ্বর দুটি যদি একেবারে প্রথম পর্যায়ের নক্ষত্রের ধ্বংসাবশেষ হয়ে থাকে, তাহলে বহু আদিম কিছু আবিষ্কারের মতো ঘটনাই এটি।
সেকেন্ডের ১০ ভাগের ১ ভাগ লম্বা পালসটা ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন বছর ধরে ছুটে এসেছিল। অ্যাডভান্সড লাইগো যদি আর এক মাস পর চালু হতো, তাহলে সেটা মিস হওয়ার আশঙ্কা ছিল। বলতেই হবে, লাইগো টিমের কপাল ভালো।
এমনও হতে পারে, ওই কৃষ্ণগহ্বর দুটি পরস্পরকে ঘিরে আরও বিলিয়ন বছর ধরে ঘুরপাক খাচ্ছিল। এ সময় তারা মহাকর্ষ তরঙ্গ নিঃসৃত করছিল, যার ফল তাদের কক্ষপথের শক্তি শুষে নিয়েছিল এবং তার কারণেই তারা ক্রমান্বয়ে পরস্পর সর্পিলভাবে ঘুরপাক খেতে শুরু করে। তবে ওই মহাকর্ষ তরঙ্গে শক্তি ছিল অনেক কম। পৃথিবীতে শনাক্তযোগ্য যে মহাকর্ষ তরঙ্গ স্থান-কালের ভেতর দিয়ে ছুটে এসেছিল, তাকে অনেক বেশি শক্তিশালী হতে হবে। তার উৎপত্তি হয়তো হয়েছিল কৃষ্ণগহ্বর দুটি সর্বশেষ ১০ বা সেই পরিমাণ কক্ষপথে ঘুরপাক খাওয়ার সময়, যার ব্যাপ্তি ছিল প্রায় ১ সেকেন্ডের ১০০ ভাগের ১ ভাগমাত্র।
সেকেন্ডের ১০ ভাগের ১ ভাগ লম্বা পালসটা ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন বছর ধরে ছুটে এসেছিল। অ্যাডভান্সড লাইগো যদি আর এক মাস পর চালু হতো, তাহলে সেটা মিস হওয়ার আশঙ্কা ছিল। বলতেই হবে, লাইগো টিমের কপাল ভালো। তবে পদার্থবিদেরা ভাগ্যে বিশ্বাস করেন না। লাইগোর যন্ত্রপাতি ঠিকঠাক করার পরপরই ডিটেক্টরের জালে শিকার ধরা পড়ার অর্থ হতে পারে যে কৃষ্ণগহ্বরের একীভূত হওয়ার ঘটনা মহাবিশ্ব বিরল কোনো ঘটনা নয়। বরং এ ধরনের ঘটনা হয়তো হরহামেশাই ঘটছে। লাইগোর যন্ত্রে মহাকর্ষ তরঙ্গ ধরা পড়ার মাধ্যমে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে।
প্রথমবার কৃষ্ণগহ্বর একীভূত হওয়ার ঘটনা শনাক্ত হওয়ার পর এ পর্যন্ত আরও আটটি এ রকম ঘটনা শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যটা হলো ২০১৭ সালের ১৭ আগস্টের শনাক্তের ঘটনা। সেই তরঙ্গ বেশ দুর্বল ছিল এবং দীর্ঘমেয়াদি পালস ছিল, যা দুটি নিউট্রন স্টারের একীভূত হওয়ার কারণে সৃষ্টি হয়েছিল। সুপারনোভা বিস্ফোরণে কৃষ্ণগহ্বর ছাড়াও নিউট্রন স্টার তৈরি হতে পারে। কোনো নক্ষত্রের কেন্দ্র যখন নিজের মহাকর্ষের টানে চুপসে কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হওয়ার মতো যথেষ্ট ভারী থাকে না, তখন নিউট্রন স্টার গঠিত হয়। সাধারণত একটা নিউট্রন স্টারের আকার মাউন্ট এভারেস্টের মতো হতে পারে। সেগুলোর ঘনত্ব এত বেশি হয় যে একটি চিনির দানার মধ্যে যে পরিমাণ পদার্থ আঁটবে, তার পরিমাণ হতে পারে প্রায় গোটা মানবজাতির সমান।
নিউট্রন স্টার আর কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো, নিউট্রন স্টার স্থান-কালের মধ্যে কোনো তলাবিহীন গর্ত নয়; বরং সত্যিকার পদার্থ দিয়ে গঠিত একটা বস্তু। কৃষ্ণগহ্বর একীভূত হলে মহাকর্ষ তরঙ্গ ছাড়া আর কিছুরই সৃষ্টি হয় না। কারণ, নিজের আশপাশে থাকা সব ধরনের বস্তুই অনেক আগেই চেটেপুটে খেয়ে ফেলে কৃষ্ণগহ্বর। কিন্তু নিউট্রন স্টার একীভূত হলে শুধু মহাকর্ষ তরঙ্গই নয়, সেই সঙ্গে অতি উত্তপ্ত একটি অগ্নিগোলকও তৈরি হয়। ওই অগ্নিগোলক থেকে বেরিয়ে আসা বিকিরণ ২০১৭ সালের ১৭ আগস্টের পরও পর্যবেক্ষণ করা গেছে। ভূপৃষ্ঠে ও মহাকাশে স্থাপিত বিভিন্ন রকম আলোতে সংবেদনশীল প্রায় ৭০টি টেলিস্কোপে তা শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, সেখানে উচ্চশক্তির গামা রশ্মির তীব্র ঝলকও শনাক্ত করা গেছে। এভাবে এক ঢিলে মহাকাশের অনেকগুলো রহস্যের সমাধান করা সম্ভব হয়েছে।
জ্যোতির্বিদেরা অনেক আগে থেকেই জানেন, হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের চেয়ে ভারী মৌলগুলো নক্ষত্রের অতি উত্তপ্ত চুল্লি গঠিত হয়। নক্ষত্র যখন বিস্ফোরিত হয়, তখন এসব মৌল মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে প্রতিদ্বন্দ্বী সোভিয়েত ইউনিয়নের গোপন পারমাণবিক পরীক্ষার খোঁজখবর রাখতে মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। দেখা গেল, দিনে প্রায় একবার পৃথিবী থেকে নয়; বরং বাইরের মহাকাশ থেকে গামা রশ্মির ঝলক আসছে। এ ঘটনায় একই সঙ্গে হতবাক ও বিস্মিত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে এ আবিষ্কার গোপন রাখা হয়েছিল। গামা রশ্মির এই বিস্ফোরণ আবিষ্কারের ঘটনা জ্যোতির্বিজ্ঞান সমাজের কানে আসে ১৯৮০ সালের শেষ দিকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর, এই তথ্য আর গোপন রাখার কোনো প্রয়োজন পড়ল না। কাজেই পেন্টাগন তাদের কাছে আবর্জনার পর্বতের মতো জমে থাকা জ্যোতির্বিজ্ঞানসংক্রান্ত তথ্য-উপাত্তের বিশাল স্তূপ তুলে দেয় জ্যোতির্বিদদের হাতে। এককথায় সেগুলো ছিল বিস্ময়কর। ওই দশকে প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণ নতুন জ্যোতির্বিজ্ঞানসংক্রান্ত পরিঘটনার শক্তি আর সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়। আর ১৯৯০-এর দশকে অবশেষে নিশ্চিত হওয়া গেল, এসব গামা রশ্মির ঝলকের উৎপত্তি বহুদূরে। তখন ধারণা করা হয়েছিল, দুটি নিউট্রন স্টার একীভূত হলে সাধারণত এ ঝলক দেখা যায়। ২০১৭ সালের ১৭ আগস্ট মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত হওয়ার পর নাটকীয়ভাবে দেখা গেল, ওই ধারণাই সঠিক।
তবে গামা রশ্মি আরও কিছু ব্যাপার উন্মোচন করেছিল। বিভিন্ন পরমাণুর কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াস আলাদা আলাদা শক্তিতে গামা রশ্মি তৈরি করে। এটি বিভিন্ন ধরনের পরমাণুর অনন্য হাতের ছাপ সরবরাহ করে। গামা রশ্মিবিষয়ক জ্যোতির্বিদেরা এভাবে সোনার হাতের ছাপ দেখতে পান। নিউট্রন স্টারের একেকটা অগ্নিগোলকে যে পরিমাণ সোনা রয়েছে, তা পৃথিবীর মোট ভরের প্রায় ২০ গুণ। ভাবা যায়!
জ্যোতির্বিদেরা অনেক আগে থেকেই জানেন, হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের চেয়ে ভারী মৌলগুলো নক্ষত্রের অতি উত্তপ্ত চুল্লি গঠিত হয়। নক্ষত্র যখন বিস্ফোরিত হয়, তখন এসব মৌল মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর সেগুলো একত্র হয়ে পরবর্তী প্রজন্মের নক্ষত্রের জন্ম হয়। তবে জ্যোতির্পদার্থবিদেরা প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা ৯২টি মৌলের উৎপত্তি বেশ ভালোভাবে শনাক্ত করতে পারলেও তারা সোনার উৎপত্তি সম্পর্কে জানতেন না। শেষ পর্যন্ত সেটাও জানা সম্ভব হলো। কাজেই আপনার কাছে যদি সোনার আংটি কিংবা হার থাকে, তাহলে মনে রাখবেন, এই পরমাণুগুলো গড়ে উঠেছে পৃথিবী গড়ে ওঠার অনেক আগে। আর সেটি গড়ে উঠেছে দুটি নিউট্রন স্টারের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট অগ্নিগোলকের ভেতরে।
লাইগো-ভার্গো টিম আগেই অনুমান করেছিল, ২০১৭ সালে তাদের ডিটেক্টরটা সংবেদনশীলতার দিক থেকে চরমে পৌঁছে যাবে। এর ফলে সেগুলো প্রথমবারের মতো কোনো নিউট্রন স্টারের একীভূত হওয়ার ঘটনাও শনাক্ত করতে পারবে। তাদের সে ভবিষ্যদ্বাণী শেষ পর্যন্ত সঠিক বলে প্রমাণিত হয়। তবে তারা একটি জিনিস বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল। সেটা হলো, প্রথম শ্রেণির কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব আছে, আর সেগুলো এতই শক্তিশালী যে তাদের ২০১৫ সালের তুলনামূলক কম সংবেদনশীল ডিটেক্টর দিয়ে খুব সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব।
লাইগোর প্রতিটি স্থাপনার ডিটেক্টরে লেজার লাইটকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এর অর্ধেক অংশকে ইন্টারফেরোমিটারের এক বাহুর একটা বায়শূন্য টিউবের মধ্য দিয়ে পাঠানো হয় এবং বাকি অর্ধেক পাঠানো হয় অন্য বাহুর মধ্যে।
লাইগোর এ পর্যন্ত প্রতিটি আবিষ্কারই অসাধারণ যন্ত্রপাতি দিয়ে করা হয়েছিল। অবশ্য লাইগোতে লেজার লাইট দিয়ে তৈরি প্রতিটি চার কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের রুলারের সংকোচন ও প্রসারণের কারণে পাশ দিয়ে চলে যাওয়া একটা মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত করা গেছে। প্রতিটি স্থাপনায় দুটি একই ধরনের রুলার বসানো হয়েছে, যাদের আকৃতি ইংরেজি এল অক্ষরের মতো। এগুলো আসলে ইন্টারফেরোমিটারের বাহু। এর নাম এ রকম হওয়ার কারণ হলো, এ যন্ত্রের মাধ্যমে ইন্টারফারেন্স বা ব্যতিচার পরিমাপ করে আলো যাওয়ার পথে অতিক্ষুদ্র পরিবর্তন মাপা যায়।
আলো, পানি বা অন্য যেকোনো কিছু হোক, দুটি তরঙ্গ যখন পরস্পরকে আবৃত করে এবং একটি তরঙ্গের চূড়া অপরটির চূড়ার সঙ্গে মিলে যায়, তখন সেগুলো পরস্পরকে জোরদার করে। একে বলা হয় গঠনমূলক ব্যতিচার। আর যখন একটি তরঙ্গের চূড়া অপরটির খাদের সঙ্গে মিলে যায়, তখন সেগুলো পরস্পরকে বাতিল করে দেয়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ধ্বংসাত্মক ব্যতিচার।
লাইগোর প্রতিটি স্থাপনার ডিটেক্টরে লেজার লাইটকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এর অর্ধেক অংশকে ইন্টারফেরোমিটারের এক বাহুর একটা বায়শূন্য টিউবের মধ্য দিয়ে পাঠানো হয় এবং বাকি অর্ধেক পাঠানো হয় অন্য বাহুর মধ্যে। প্রতিটি বাহুর শেষ প্রান্তে একটি আয়না রাখা হয়। এই আয়না আলোকে প্রতিফলিত করে উৎপত্তিস্থলে ফেরত পাঠায়। লেজার লাইটের এই দুই অংশ এরপর একত্র হয়। যন্ত্রের সাহায্যে এই আলোর উজ্জ্বলতা মাপা হয়। মূল ব্যাপার হলো, ইন্টারফেরোমিটারের একটি বাহু যদি অন্যটির তুলনায় সামান্যও প্রসারিত হয়, তাহলে আলোর তরঙ্গগুলো খাপে খাপে মিলবে না। একটি তরঙ্গের চূড়া যদি অন্যটির খাদের সঙ্গে মিলে যায়, তাহলে তরঙ্গ দুটি পরস্পরকে বাতিল করে দেবে। এতে উজ্জ্বলতা মাপা হলে তা শূন্য হবে। দুটি আলোকতরঙ্গ যদি সামান্যতমও পরস্পর থেকে দূরে থাকে, তাহলে সেগুলোর মিলনে আলোর উজ্জ্বলতায় সুস্পষ্ট পরিবর্তন দেখা দেবে। এভাবে একটা বাহুর লেজার রশ্মি দুটির তরঙ্গদৈর্ঘ্যে অতি ক্ষুদ্র পরিবর্তনও মাপা সম্ভব। এক মিলিমিটারের এক হাজার ভাগের এক ভাগ পরিবর্তন এভাবে মাপা সম্ভব।
চার কিলোমিটার দীর্ঘ বাহুতে এ রকম সামান্য পরিবর্তন মাপার ব্যাপারটা চিত্তাকর্ষক মনে হতে পারে। তবে ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর যে মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত করা হয়েছে, তার জন্য অতি ছোট পরিবর্তনও মাপার দরকার হয়েছিল। প্রতিটি বাহু পর্যায়ক্রমে প্রসারিত ও সংকুচিত হয়েছিল এক মিলিমিটারের হাজারতম ভাগ নয়; বরং তার পরিমাণ ছিল একটি পরমাণুর ব্যাসের ১০০ মিলিয়ন ভাগের ১ ভাগ। ১০ মিলিয়ন পরমাণু পরপর সাজালে একটা ফুলস্টপ বা একটি বিন্দু গঠিত হয়। এটা উপলব্ধি করলে বোঝা যাবে, মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত করাটা বিজ্ঞানীদের কত বড় অর্জন। সংকেতটা ছিল অতিসূক্ষ্ম ও দুর্বল। তার উৎসটাও ছিল বহুদূরের আর অনেক বড়। একইভাবে লাইগো ডিটেক্টরের সংবেদনশীলতাও ছিল অতিসূক্ষ্ম।
এত বড় অর্জনের পুরস্কারটাও যে অনেক বড় হবে, তাতে আর অবাক হওয়ার কী আছে। তাই ২০১৭ সালে পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলো মহাকর্ষ তরঙ্গ আবিষ্কারের জন্য। লাইগোর তিন প্রতিষ্ঠাতা জনক হলেন রেইনার ওয়েস, কিপ থর্ন ও রোনাল্ড ড্রেভার নামের স্কটিশ এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিসিস্ট। রোনাল্ড আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত ছিলেন। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, নোবেল পুরস্কার ঘোষণার মাত্র কয়েক মাস আগে মারা যান তিনি। তাই রেইনার, থর্নকে পুরস্কার ভাগ করে নিতে হয় ব্যারি ব্যারিশের সঙ্গে।
এখন লাইগো ও ভার্গোর সফলতার পর আমরা জ্যোতির্বিজ্ঞানের নতুন যুগের সূচনায় দাঁড়িয়ে আছি। রেইনার ওয়েস এ সম্পর্কে বলেন, ‘আমরা কৃষ্ণগহ্বর ও নিউট্রন স্টার সম্পর্কে জানি।
লাইগোর বর্তমান লক্ষ্য শুধু ডিটেক্টরের সংবেদনশীলতা বাড়ানো নয়, বরং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আরও ডিটেক্টর বসানো। মহাকাশে যেকোনো বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট মহাকর্ষ তরঙ্গের উৎস আরও সঠিকভাবে শনাক্ত করাই এর উদ্দেশ্য। অ্যাডভান্সড লাইগোতে এসব আবিষ্কারের পর ইউরোপিয়ান ভার্গোর যন্ত্রপাতিও কাজে নেমে পড়ে। জাপানের কামিওকা গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ ডিটেক্টর (কেএজিআরএ) ২০২০ সালে যুক্ত হয়েছে। ২০২৫ সালে ভারতেরও এ দলে যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে।
নিউট্রন স্টার ও কৃষ্ণগহ্বরের একীভূত হওয়ার ঘটনা লাইগো ও ভার্গোর পরীক্ষকদের আর অবাক করেনি। কারণ, তাঁরা এটা শনাক্ত করার আশা করেই মাঠে নেমেছিলেন। তবে মহাকর্ষ তরঙ্গ সম্পর্কে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ব্যাপারটা হলো, কেউ যা কল্পনাই করতে পারেনি, মহাবিশ্বে তেমন কিছু দেখার সম্ভাবনা তৈরি করেছে এটা। লাইগোর বিজ্ঞানীদের মতে, এটা তো কেবল শুরু। আরও অবাক করা ঘটনাও শিগগিরই উন্মোচিত হবে।
আমরা আলো থেকে শিক্ষা নিতে পারি। একসময় যেসব আলো চোখে দেখা যায়, শুধু সে সম্পর্কে জানতাম আমরা। এরপর জানা গেল, বিদ্যুৎচৌম্বকীয় বর্ণালির অতিক্ষুদ্র একটি অংশ আমরা চোখে দেখতে পাই। বাকি সিংহভাগ আমাদের চোখে অদৃশ্য। এর মধ্যে রয়েছে লাখ লাখ ‘রং’। কৃত্রিম চোখ দিয়ে মহাবিশ্বের দিকে তাকিয়ে এসব রং দেখা গেল—গামা রশ্মি, এক্স-রে, অতিবেগুনি, অবলোহিত, রেডিও তরঙ্গ ইত্যাদি। এর মাধ্যমে আমরা অনেক অপ্রত্যাশিত বিষয় আবিষ্কার করে বসলাম। একে একে গামা রশ্মি বাস্টার ও পালসার আবিষ্কৃত হয়। এরপর কৃত্রিম চোখে ধরা পড়ল কোয়াসার ও অতি ভারী কৃষ্ণগহ্বরও। এমনকি মহাবিস্ফোরণের অগ্নিঝলক বা মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশনও আবিষ্কার করেছি আমরা। অন্যান্য নক্ষত্রকে ঘিরে পাক খাওয়া গ্রহও আবিষ্কৃত হয়েছে এভাবে। এ পর্যন্ত প্রায় চার হাজার বহিঃসৌরজাগতিক গ্রহ খুঁজে পাওয়া গেছে।
এখন লাইগো ও ভার্গোর সফলতার পর আমরা জ্যোতির্বিজ্ঞানের নতুন যুগের সূচনায় দাঁড়িয়ে আছি। রেইনার ওয়েস এ সম্পর্কে বলেন, ‘আমরা কৃষ্ণগহ্বর ও নিউট্রন স্টার সম্পর্কে জানি। কিন্তু আশা করি, অন্যান্য পরিঘটনা সম্পর্কে জানা সম্ভব হবে। কারণ, এগুলোর কাছ থেকেও মহাকর্ষ তরঙ্গ বেরিয়ে আসে।’
ধরা যাক, আমরা এককালে কানে শুনতে পেতাম না, কিন্তু এখন সেই ইন্দ্রিয় ঠিক হয়েছে। আমরা এখন শুনতে পারছি। তবে আমাদের শ্রবণ এখনো অসম্পূর্ণ ও প্রাথমিক পর্যায়ের। এই শ্রবণক্ষমতার একেবারে শুরুতে আমরা বহুদূরের বজ্রপাতের শব্দও শুনতে পেরেছি। কিন্তু আমাদের এখনো পাখির গান বা গানের সুর বা শিশুর কান্নার মতো সূক্ষ্ণ শব্দগুলো শোনা বাকি। লাইগো, ভার্গো ও বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের মহাকর্ষ তরঙ্গ পরীক্ষা এই শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের সংবেদনশীলতা আরও বাড়িয়ে দেবে। মহাজাগতিক সিম্ফোনিতে এই ইন্দ্রিয় টিউন করার পর আমরা হয়তো আরও বিস্ময়কর ব্যাপার আবিষ্কার করে বসব। বিজ্ঞানীরা এখন সেই অপেক্ষাতেই বসে আছেন।