ইলেকট্রনিক পাঠশালা - ১
নিজেই বানান থার্মোমিটার
সাইকেল চালাতে শিখতে হলে কেবল তত্ত্ব শিখলেই হয় না, সত্যিকারে চালিয়েই শিখতে হয়। একইভাবে ইলেকট্রনিকস শিখতে হলে তত্ত্বের পাশাপাশি হাতে-কলমে সার্কিট তৈরি করতে হয়। সার্কিটের বিভিন্ন বিন্দুতে পরিমাপ করে তত্ত্বের সঙ্গে তার মিল-অমিলের কারণ চিন্তা করে খুঁজে বের করতে হয়। আবার কেবল সার্কিট তৈরিই নয়, কীভাবে তাকে খোলসবন্দী করে অন্য সবার ব্যবহারের উপযোগী করা যায়, তা-ও শিখতে হয়। নইলে ওই সার্কিট কোনো কাজে আসবে না। এ পাঠশালায় তাই কিছু কাজের সার্কিট বানানো শিখব। সেই সঙ্গে তার প্রয়োগ ও প্রয়োজনীয় তত্ত্বও ধাপে ধাপে আলোচনা করব। তাতে একসঙ্গে সব কটি দিকই শেখা হয়ে যাবে।
পর্ব: ১
থার্মিস্টর ব্যবহার করে একটি উত্তাপ পরিমাপক যন্ত্র
আজকে থার্মিস্টর (Thermistor) নামে একটি ইলেকট্রনিক সেন্সর ব্যবহার করে একটি তাপমাত্রা পরিমাপক যন্ত্র বা থার্মোমিটার বানাব। শরীরে জ্বর মাপার জন্য ১ নম্বর ছবিতে দেখানো ইলেকট্রনিক থার্মোমিটার আজকাল ব্যবহার করা হয়। এর মূলেও রয়েছে একটি থার্মিস্টর, যা এর সরু মাথায় লাগানো আছে। Thermal ও Resistor, এ দুটি শব্দের অংশবিশেষ নিয়ে থার্মিস্টর নামটি তৈরি করা হয়েছে। নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে তাপের সঙ্গে এর রেজিস্ট্যান্সের (রোধ) কিছু ব্যাপার রয়েছে। দুই ধরনের থার্মিস্টর বাজারে পাওয়া যায়: এনটিসি (NTC- Negative Temperature Coefficient ) ও পিটিসি (PTC-Positive Temperature Coefficient)। নাম থেকেই কিছুটা আন্দাজ করা যায়, প্রথমটিতে তাপমাত্রা বাড়ার কারণে রেজিস্ট্যান্স কমবে আর দ্বিতীয়টিতে বাড়বে। তবে এনটিসি থার্মিস্টর আবিষ্কার হয়েছে আগে, মাইকেল ফ্যারাডে ১৮৩৩ সালে সিলভার সালফাইডে এ ধরনের আচরণ পর্যবেক্ষণ করে লিখে রেখেছিলেন। তবে এর প্রায়োগিক ব্যবহার শুরু হয়েছে অনেক পরে, ১৯৩০-এর দিকে। এনটিসি থার্মিস্টর মূলত একটি সেমিকন্ডাক্টর। তাপমাত্রার সঙ্গে এর মানের পরিবর্তনের বিষয়গুলোও মোটামুটি পরিষ্কার এবং তা গাণিতিক সমীকরণে ফেলা যায়। তাই তাপমাত্রা পরিমাপে এগুলোই সাধারণত ব্যবহৃত হয়। কিন্তু পিটিসি থার্মিস্টর আবিষ্কৃত হয়েছে পরে। তাপমাত্রার সঙ্গে এর মানের পরিবর্তনের বিষয়গুলো একটু জটিল এবং সহজ গাণিতিক সমীকরণে ফেলা যায় না। তাই এগুলো তাপমাত্রা নির্ণয়ে অতটা ব্যবহৃত না হয়ে সার্কিটের বিভিন্ন প্রতিরক্ষায় ব্যবহৃত হয়। আজকের পাঠশালা সীমাবদ্ধ থাকবে এনটিসি থার্মিস্টরের মধ্যে।
এনটিসি থার্মিস্টর আবিষ্কার হয়েছে আগে, মাইকেল ফ্যারাডে ১৮৩৩ সালে সিলভার সালফাইডে এ ধরনের আচরণ পর্যবেক্ষণ করে লিখে রেখেছিলেন। তবে এর প্রায়োগিক ব্যবহার শুরু হয়েছে অনেক পরে, ১৯৩০-এর দিকে। এনটিসি থার্মিস্টর মূলত একটি সেমিকন্ডাক্টর।
বিভিন্ন ধরনের ও আকারের থার্মিস্টর পাওয়া যায় বিভিন্ন প্রয়োগের জন্য। এদের কিছু ২ নম্বর ছবিতে দেখানো হলো। প্রতিটি থার্মিস্টরের দুটি প্রান্ত রয়েছে, যার ভেতরের রেজিস্ট্যান্স পরিমাপ করতে হয়। ভিন্ন ভিন্ন মানের রেজিস্ট্যান্সবিশিষ্ট থার্মিস্টর পাওয়া যায়। থার্মিস্টরের দুই ধরনের সাংকেতিক চিহ্ন দেখানো হয়েছে ৩ নম্বর ছবিতে। ধরে নিচ্ছি, আপনি যেটি কিনবেন সেটি ১০ কিলোওহমের এনটিসি ধরনের। অর্থাৎ ২৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তার রেজিস্ট্যান্স হবে ১০ কিলোওহম। আর এর থেকে বেশি তাপমাত্রায় রেজিস্ট্যান্স কম হবে, কম তাপমাত্রায় বেশি হবে। আমাদের শরীরের তাপমাত্রায় এর রেজিস্ট্যান্স হবে প্রায় ৬ কিলোওহম। তবে আপনি যে থার্মিস্টরটি সত্যিকারে জোগাড় করতে পেরেছেন, সেটি ভিন্ন মানেরও হতে পারে। কিন্তু একই যুক্তি ও পদ্ধতি সেটিতেও ব্যবহার করা যাবে।
কীভাবে তৈরি করতে হবে
প্রথমত, থার্মিস্টরের দুটি খোলা প্রান্তের বেশির ভাগ অংশ চিকন প্লাস্টিকের টিউব বা স্লিভিং পরিয়ে ঢেকে দিতে হবে, যাতে একটির সঙ্গে অপরটি লেগে যেতে না পারে। বাজারে হিট শ্রিঙ্কেবল স্লিভিং (heat shrinkable sleeving) নামে এক বিশেষ ধরনের প্লাস্টিকের স্লিভিং পাওয়া যায়, যাকে গরম করলে সংকুচিত হয়। এটি এ কাজের জন্য আরও ভালো। এ স্লিভিংগুলো বিভিন্ন ব্যাসের হয়। থার্মিস্টরের প্রান্তের থেকে সামান্য বেশি ব্যাসের স্লিভিং নিতে হবে, যেন তা সহজে প্রান্তের ওপর টেনে পরিয়ে দেওয়া যায়। এর দুটি টুকরো থার্মিস্টরের খোলা দুটি প্রান্তের ওপর পরিয়ে দিয়ে গরম বাতাস দিলে স্লিভিং দুটো সংকুচিত হয়ে থার্মিস্টরের খোলা প্রান্ত দুটিকে শক্ত করে চেপে ধরে রাখবে। স্লিভিং গরম করার জন্য সাধারণত ‘হট এয়ারগান’ ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ঝালাই করার সোলডারিং আয়রনের গরম হওয়া গায়ের অংশ দিয়ে (সামনের ঝালাই করার অংশ নয়, সেটি বেশি গরম, স্লিভিং পুড়ে ফুটো হয়ে যাবে) স্লিভিংয়ের ওপর চারদিকে হালকাভাবে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে স্পর্শ করলেও কাজ হয়। এবার দুটি প্লাস্টিক ইনসুলেশন দেওয়া নমনীয় (ফ্লেক্সিবল) তারের মাথার তামার অংশ একটুখানি খুলে থার্মিস্টরের দুই প্রান্তের অল্প খোলা মাথায় ঝালাই করতে হবে।
থার্মিস্টরের দুটি খোলা প্রান্তের বেশির ভাগ অংশ চিকন প্লাস্টিকের টিউব বা স্লিভিং পরিয়ে ঢেকে দিতে হবে, যাতে একটির সঙ্গে অপরটি লেগে যেতে না পারে। বাজারে হিট শ্রিঙ্কেবল স্লিভিং (heat shrinkable sleeving) নামে এক বিশেষ ধরনের প্লাস্টিকের স্লিভিং পাওয়া যায়, যাকে গরম করলে সংকুচিত হয়।
ঝালাই করার ব্যবস্থা না থাকলে তারের মাথার বেশ কিছুটা তামার অংশ বের করে, তা দিয়ে থার্মিস্টরের প্রান্তটিকে ভালো করে পেঁচিয়ে দিন। এর ওপর আঠা লাগানো ইনসুলেশন টেপ (ব্ল্যাক টেপ) জড়িয়ে সংযুক্ত খোলা অংশ দুটো আলাদাভাবে ভালোভাবে ঢেকে দিতে হবে। তবে এখানেও টেপ ব্যবহার না করে হিট শ্রিঙ্কেবল স্লিভিং ব্যবহার করাই ভালো। সংযুক্ত খোলা অংশ থেকে একটু লম্বা স্লিভিং কেটে নিয়ে এমনভাবে সংযুক্তির ওপর পরিয়ে দিতে হবে, যেন দুদিকের প্লাস্টিক ইনসুলেশনের কিছুটাও ঢেকে দেয়। এবার স্লিভিংটিকে গরম করলে সেটি সংকুচিত হয়ে ভেতরের প্যাঁচানো তারকে শক্ত করে চেপে ধরে রাখবে। ৪ নম্বর ছবিতে এ রকমটি দেখানো হয়েছে। তবে স্লিভিংয়ের টুকরো আগে থেকেই তারের ওপর ঢুকিয়ে একটু দূরে সরিয়ে রেখে ঝালাই করতে হবে। ঝালাই হয়ে গেলে সেটিকে টেনে খোলা অংশের ওপর নিয়ে আসতে হবে। ঝালাই করার সময় স্লিভিংটি বেশি কাছে থাকলে তাপে সেখানেই চেপে বসে যাবে, সংযুক্ত খোলা অংশের ওপর আর টেনে আনতে পারে না। আবার সব শেষে কেবল থার্মিস্টরের মাথাটি বাইরে রেখে দুটি প্রান্ত, সংযোগস্থল ও নমনীয় তারের কিছু অংশসহ পুরোটিকেই একটু বড় একটি হিট শ্রিঙ্কেবল স্লিভিং দিয়ে ঢেকে দেওয়া যেতে পারে। তাহলে এটি সুন্দর প্রোব (probe) হয়ে যাবে।
থার্মিস্টরের সংযোগ হয়ে গেল। এবার সম্পূর্ণ থার্মোমিটার তৈরির জন্য লাগবে ৫ নম্বর ছবির মতো একটি মাল্টিমিটার (multimeter)। থার্মিস্টরের দুটি প্রান্তে সংযোগ দেওয়া তারের অপর দুটি প্রান্ত থেকে যথেষ্ট পরিমাণে তামার তার খুলে বের করে নিতে হবে। সেটি মাল্টিমিটারের প্রোব দুটির খোলা প্রান্তের ওপর ভালোভাবে জড়িয়ে নাও। থার্মিস্টরের প্রান্ত দুটির কোনো বিশেষ দিকের বিষয় নেই, যেকোনো প্রান্ত প্রোবের যেকোনো প্রান্তের সঙ্গে লাগালেই চলবে। মাল্টিমিটারটির মাঝের সিলেকশন সুইচটি ঘুরিয়ে ১০ কিলোওহম রেজিস্ট্যান্স মাপা যায় এমন পয়েন্টে রাখতে হবে। ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রেজিস্ট্যান্স কত ওহম দেখাচ্ছে, খেয়াল করতে হবে। এবার থার্মিস্টরটিকে নিজের হাতের দুটি আঙুলের মধ্যে কিছুক্ষণ ধরে রেখে মিটারে রেজিস্ট্যান্সের মান দেখতে হবে। দেখা যাবে, তা ধীরে ধীরে কমে আসছে ও কিছুক্ষণ পর একটি স্থির মানে এসে দাঁড়িয়েছে। তাহলে কেবল এটুকু পরীক্ষা করেই বোঝা যাচ্ছে, তাপমাত্রার পরিবর্তন এ সহজ যন্ত্র দিয়ে মাপা সম্ভব। এভাবেই মাল্টিমিটার যুক্ত করে হয়ে গেল আপনার তৈরি ইলেকট্রনিক থার্মোমিটার।
(চলবে...)