পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে যেভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়

২৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে এসেছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি ইউরেনিয়াম। ৫ অক্টোবর, বুধবার সেই জ্বালানি আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ৩৩তম সদস্য হিসাবে নাম লেখাচ্ছে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশের তালিকায়। কিন্তু কীভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় একটি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে? এই প্রক্রিয়ার বিস্তারিত জেনে নিন…

পড়ন্ত বিকেলে খেলায় ব্যস্ত শিশুরা। পেছনে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কুলিং টাওয়ার। পাকশী, ঈশ্বরদী, পাবনা।হাসান মাহমুদ

২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প এলাকায় সকাল থেকেই বিরাজ করছে চাপা উত্তেজনা। কারণটা সহজেই অনুমেয়। আগের রাতেই সুদূর রাশিয়া থেকে বিমানে করে ঢাকায় এসে নেমেছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইউরেনিয়াম ডাই-অক্সাইড জ্বালানি। এরপর সড়ক পথে প্রকল্প এলাকায় নিয়ে আসার পালা।

সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, আনসার, ফায়ার সার্ভিস, মেডিকেল টিম ও দেশি-বিদেশি বিকিরণবিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ দলের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে যাত্রা শুরু করে ফুয়েল বহনকারী কার্গো ট্রাকগুলো। সব ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা বজায় রেখে ধীর লয়ে এগিয়ে যেতে থাকে স্বপ্ন পূরণের পথে। অবশেষে মধ্য দুপুরে অবসান হয় সব প্রতীক্ষার। প্রকল্প এলাকায় প্রথমবারের মতো প্রবেশ করে ইউরেনিয়াম জ্বালানি। নির্মাণ কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশি-বিদেশি বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা পতাকা উড়িয়ে বরণ করে নেন তাঁদের।

এর মাধ্যমে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প হয়ে ওঠে নিউক্লিয়ার ফ্যাসিলিটি। তেত্রিশতম সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ ঢুকে যায় পরমাণুবিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশের তালিকায়। তবে এ সবই ছিল অনানুষ্ঠানিক। ৫ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার এই ইউরেনিয়াম ডাই-অক্সাইড আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেওয়া হবে বাংলাদেশের হাতে।

এ উপলক্ষ্যে চলুন জেনে আসা যাক পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ইউরেনিয়াম ব্যবহার করে বিদ্যুৎ তৈরির পুরো প্রক্রিয়ার খুঁটিনাটি।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সুউচ্চ চুল্লিতে কাজ করছেন শ্রমিকেরা। পাকশী, ঈশ্বরদী, পাবনা।
হাসান মাহমুদ

২.

একদম গোড়া থেকেই শুরু করা যাক। ফিশন বিক্রিয়ার নাম নিশ্চয় আপনারা শুনেছেন। যে প্রক্রিয়ায় একটি ভারী মৌলিক পদার্থের নিউক্লিয়াস ভেঙে দুটি ছোট নিউক্লিয়াস তৈরি হয়, তার নামই ফিশন। এ সময় আরো উৎপন্ন হয় কয়েকটি নিউট্রন ও বিপুল শক্তি। পুরো বিষয়টি কীভাবে ঘটে, তার একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসের কথাই ধরুন। কোনো নিউট্রন দিয়ে এটিকে আঘাত করলে নিউক্লিয়াসটি প্রথমে নিউট্রনকে শোষণ করে নেয়, তৈরি হয় একটি যৌগিক নিউক্লিয়াস। এরপর দুটি ঘটনা ঘটতে পারে। এক, খুব অল্প সময় পরে (১০-১৪ সেকেন্ড পর) যৌগিক নিউক্লিয়াসটি গামা রশ্মি বিকিরণ করে আবারও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় ফিরে যেতে পারে। নয়তো দুই, যৌগিক নিউক্লিয়াসটি ভেঙে তৈরি হতে পারে কম ভরের দুটি নিউক্লিয়াস (যাদের একটির ভরসংখ্যা হবে ১৩৭-এর কাছাকাছি, অন্যটির হবে ৯৫ এর কাছাকাছি)। সঙ্গে উৎপন্ন হতে পারে ২-৩টি নিউট্রন এবং প্রায় ২০৪ মেগা ইলেকট্রন ভোল্ট শক্তি। প্রথমটির চেয়ে দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটার সম্ভাবনা প্রায় ছয় গুণ বেশি। এভাবে ফিশন প্রক্রিয়ায় যেকোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ার চেয়ে ১০০ মিলিয়ন গুণেরও বেশি শক্তি উৎপন্ন হতে পারে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে শক্তি উৎপাদনের মূলে রয়েছে এই ফিশন বিক্রিয়া।  

ফিশন বিক্রিয়ার অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো চেইন বিক্রিয়া। অর্থাৎ, উপযুক্ত পরিবেশে একবার ফিশন শুরু হলে সেটি ক্রমাগত চলতেই থাকে। আগেই বলেছি, প্রতিটি ফিশন সংঘটনের পরে দুই থেকে তিনটি নতুন নিউট্রন পাওয়া যায়। এগুলো পাশের অন্য ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসকে ধাক্কা দিয়ে সহজেই আবারো ফিশন ঘটাতে পারে। দ্বিতীয় ধাপের ফিশন থেকেও উৎপন্ন হবে নতুন নিউট্রন এবং বিপুল শক্তি। সেই নিউট্রনগুলোও একই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি করতে থাকবে। এভাবে ধাপে ধাপে বাড়তে থাকবে ফিশনের ব্যাপ্তি এবং উৎপাদিত শক্তির পরিমাণ।

এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো। প্রতি ধাপে উৎপন্ন নিউট্রনের সব কিন্তু ফিশনে অংশ নেয় না। বেশিরভাগই বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় অপচয় হয়। সঠিকভাবে নকশা করা হলে প্রতিটি ফিশন থেকে কমপক্ষে একটি নিউট্রন পাওয়া যেতে পারে, যেটি কিনা আরেকটি ফিশন ঘটাবে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে চেইন বিক্রিয়া চলমান রাখার সম্পূর্ণ কাজটি করা হয় রিঅ্যাক্টরে। সেখানে সব ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করেই ঘটানো হয় ফিশন। নয়তো অনিয়ন্ত্রিত ফিশন ডেকে আনতে পারে ভীষণ বিপদ! নিচের ছবিতে চেইন বিক্রিয়ার মূলনীতি দেখানো হয়েছে।

ফিশন চেইন বিক্রিয়ার মূলনীতি

 ৩.

রিঅ্যাক্টরে ভারসাম্যপূর্ণ চেইন বিক্রিয়া কিন্তু চাইলেই বজায় রাখা যায় না। এর জন্য বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়। এই লক্ষ্যে প্রথমেই আমাদের মনোযোগ দিতে হবে সেখানে ব্যবহৃত জ্বালানির দিকে। এদেরকে রিঅ্যাক্টরে ব্যবহারের উপযোগী করে তুলতে হবে। কীভাবে?

বেশিরভাগ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল জ্বালানি ইউরেনিয়াম। প্রকৃতিতে ভূপৃষ্ঠের গহীনে থাকা পাথরের ভেতরে আকরিক হিসেবে পাওয়া যায়। পাওয়া যায় সমুদ্রের পানিতেও। বিশ্বের অনেক দেশই খনি থেকে ইউরেনিয়াম উত্তোলন করে। আগে গতানুগতিক প্রক্রিয়ায় প্রথমে মাটি খুঁড়ে খনি থেকে ইউরেনিয়াম আকরিক তুলে আনা হতো ভূপৃষ্ঠে। পরে সেগুলোকে পিষে ফেলা হতো। সঙ্গে পানি যোগ করে তৈরি করা হতো এক ধরনের অর্ধ-তরল দ্রবণ। সবশেষে সালফিউরিক অ্যাসিড ব্যবহার করে সেই দ্রবণ থেকে আলাদা করা হতো ইউরেনিয়াম।

বর্তমানে অবশ্য এত ঝামেলার দরকার পড়ে না। ইন-সিটু লিচিং নামের বিশেষ এক কৌশল ব্যবহার করে সশরীরে ভূপৃষ্ঠের গহীনে প্রবেশ করা ছাড়াই খনি থেকে আহরিত হচ্ছে ইউরেনিয়াম। এ পদ্ধতিতে প্রথমে আকরিকের ভেতরে অক্সিজেন সমেত পানি প্রবেশ করানো হয়। এর বদলে অবশ্য অ্যাসিড বা ক্ষার ব্যবহার করলেও চলে। এতে সহজেই দ্রবীভূত হয় ইউরেনিয়াম। পরে ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ এই দ্রবণকে পাম্প ব্যবহার করে তুলে আনা হয় ভূপৃষ্ঠে। বর্তমানে বিশ্বের অর্ধেকের বেশি ইউরেনিয়াম খনিতে এই কৌশল ব্যবহার করা হয়।       

প্রমত্ত পদ্মার তীর ঘেঁষে নির্মাণ করা হয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। ভেড়ামারা, কুষ্টিয়া।
হাসান মাহমুদ

খনি থেকে প্রাপ্ত দ্রবণকে নানাভাবে পরিশোধনের মাধ্যমে তৈরি করা হয় বিশেষ একধরনের পাউডার। রাসায়নিকভাবে এই পাউডারের ৭০-৯০ শতাংশই ট্রাই-ইউরেনিয়াম অক্টা-অক্সাইড (U3O8)। তবে উজ্জ্বল হলুদ রঙের জন্য এগুলো ‘ইয়েলো কেক’ নামেই বেশি পরিচিত। এগুলোতে ইউরেনিয়ামের দুটি আইসোটোপ থাকে। ইউরেনিয়াম-২৩৮ ও ইউরেনিয়াম-২৩৫। প্রথমটির পরিমাণ শতকরা ৯৯.৩ শতাংশ এবং অন্যটি থাকে মাত্র ০.৭ শতাংশ। কিন্তু বেশিরভাগ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে ফিশন ঘটানো হয় মূলত ইউরেনিয়াম-২৩৫-এর সঙ্গে। তাই রিঅ্যাক্টরে ব্যবহারের আগে জ্বালানিতে শতকরা হিসাবে এর পরিমাণ বাড়ানো হয়। যে প্রক্রিয়ায় কাজটি করা হয়, তার নাম এনরিচমেন্ট বা সমৃদ্ধকরণ। প্রেশারাইজড ওয়াটার রিঅ্যাক্টরগুলোতে ব্যবহারের আগে (যেমনটা আমাদের দেশে ব্যবহার করা হবে) জ্বালানিতে ইউরেনিয়াম-২৩৫-এর পরিমাণ প্রায় ৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর দরকার পড়ে। রিঅ্যাক্টরের ডিজাইন ভেদে এনরিচমেন্টের মাত্রা কম-বেশি হতে পারে। অন্যদিকে, পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে এনরিচমেন্টের পরিমাণ হতে হয় ৯০ শতাংশেরও বেশি।

যাহোক, এনরিচমেন্টের জন্য প্রথমেই ইউরেনিয়ামকে গ্যাসে রূপান্তর করতে হয়। ইউরেনিয়াম হেক্সা-ফ্লোরাইড (UF6) নামের এই গ্যাস এরপরে পাঠানো হয় সেন্ট্রিফিউজে। সেখানে এগুলো প্রচণ্ড বেগে ঘোরালে ইউরেনিয়ামের দুটি আলাদা স্ট্রিম তৈরি হয়। প্রথমটিতে থাকে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঘনত্বের (এনরিচড) ইউরেনিয়াম-২৩৫ আইসোটোপ। আর অন্য স্ট্রিমে এর ঘনত্ব থাকে তুলনামূলক কম। এগুলোকে বলা হয় ডিপলেটেড ইউরেনিয়াম।

এনরিচমেন্টের পালা শেষ হলে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামটুকু পাঠানো হয় ফুয়েল ফ্যাব্রিকেশন প্ল্যান্টে। সেখানে এগুলোকে রূপান্তর করা হয় ইউরেনিয়াম ডাই-অক্সাইড (UO2) পাউডারে। তারপর স্থান দেওয়া হয় কৌটার মতো ফুয়েল পেলেটের মধ্যে। অনেকগুলো পেলেটের সমন্বয়ে তৈরি হয় একেকটি ফুয়েল রড। এগুলোকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয় বিশেষ ধরনের সংকর পদার্থের তৈরি ক্ল্যাডিং। এই ক্ল্যাডিংয়ের জন্য কোনোভাবেই ভেতরের তেজস্ক্রিয় পদার্থ বাইরে আসতে পারে না। এরকম তিন শতাধিক রডের সমন্বয়ে তৈরি হয় একেকটি ফুয়েল অ্যাসেম্বলি। এগুলোকেই প্রবেশ করানো হয় রিঅ্যাক্টরের ভেতরে।

এভাবে ভূপৃষ্ঠের গহীনে লুকিয়ে থাকা ইউরেনিয়াম নানা ধাপ পেরিয়ে পরিণত হয় পূর্ণাঙ্গ নিউক্লিয়ার জ্বালানিতে, ফলে নির্বিঘ্নে সংঘটিত হতে পারে ভারসাম্যপূর্ণ চেইন বিক্রিয়া। নিচের ছবিতে পুরো প্রক্রিয়াটির ধারণা একসঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে।

নিউক্লিয়ার ফুয়েল তৈরির নানান ধাপ

একটা মজার তথ্য বলি। সদ্য প্রস্তুত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ পেলেটগুলোয় তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা থাকে খুব কম। প্রায় ব্যাকগ্রাউন্ড লেভেলের সমান। চাইলে আমরা এগুলোকে হাত দিয়েও ধরতে পারি। এতে কোনো ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেই। এরকম ফ্রেশ জ্বালানিই বর্তমানে আমাদের দেশে নিয়ে আসা হয়েছে। রিঅ্যাক্টরে এগুলো ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরেই কেবল দেখা মিলবে উচ্চ মাত্রার তেজস্ক্রিয়তার।

৪.

ভারসাম্যপূর্ণ চেইন বিক্রিয়ার জন্য এবারে আমাদের কাজ করতে হবে নিউট্রন নিয়ে। ফিশনের মূল কারিগর এই নিউট্রন। মুক্ত নিউট্রনগুলো বিভিন্ন শক্তির হতে পারে। কোনোটা দ্রুত গতির, কোনোটা আবার ধীর গতির। দ্রুত গতিসম্পন্নগুলোকে বলা হয় ফাস্ট বা দ্রুতগামী নিউট্রন। আর কম গতির নিউট্রনগুলোকে বলা হয় থার্মাল বা তাপীয় নিউট্রন। থার্মাল নিউট্রনের সঙ্গে ইউরেনিয়াম-২৩৫-এর ফিশন ঘটার সম্ভাবনা অনেক বেশি। কিন্তু ঝামেলা হলো, প্রতিবার ফিশনের ফলে উৎপন্ন নিউট্রনগুলোর সব কটিই ফাস্ট নিউট্রন। এগুলো দিয়ে ইউরেনিয়াম-২৩৫-এর ফিশনের সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছি। রিঅ্যাক্টরে ভারসাম্যপূর্ণ চেইন বিক্রিয়া পেতে হলে তাই এগুলোর শক্তি কমিয়ে পরিণত করতে হবে থার্মাল নিউট্রনে। যে প্রক্রিয়ায় এই কাজটি করা হয়, তার নাম নিউট্রন মডারেশন।

মডারেশনের প্রক্রিয়াটি কিন্তু একদম জটিল কিছু নয়। দ্রুত গতির নিউট্রনগুলোকে কাছাকাছি ভরের অণু বা পরমাণু দিয়ে ধাক্কা দিলেই হয়। প্রতিটি সংঘর্ষের মাধ্যমে কিছু পরিমাণ শক্তি হারিয়ে এগুলো একসময় পরিণত হয় থার্মাল নিউট্রনে। যাদের সঙ্গে সংঘর্ষ করানো হয়, তাদের বলা হয় মডারেটর। সবচেয়ে সহজলভ্য মডারেটর হলো পানি। এ ছাড়াও ভারী পানি (D2O), গ্রাফাইট ইত্যাদি মডারেশনের কাজে ব্যবহৃত হয়। প্রেশারাইজড ওয়াটার রিঅ্যাক্টরগুলোতে সাধারণ পানির মাধ্যমেই নিউট্রনদের গতিবেগ কমানো হয়। নিচের ছবিতে নিউট্রন মডারেশনের প্রক্রিয়াটি তুলে ধরা হয়েছে।

নিউট্রন মডারেশনের ধারণা

জ্বালানি হিসেবে পর্যাপ্ত পরিমাণ এনরিচড ইউরেনিয়াম এবং মডারেটর হিসেবে সাধারণ পানির সমন্বয়ে প্রেশারাইজড ওয়াটার রিঅ্যাক্টরগুলোতে অর্জন করা সম্ভব ভারসাম্যপূর্ণ চেইন বিক্রিয়া। এই ঘটনাকে বলা হয় ক্রিটিক্যালিটি।  

কোল্ড ও হট লেগে পানির তাপমাত্রা থাকে যথাক্রমে ২৯৫ ডিগ্রি ও ৩৩০ ডিগ্রির কাছাকাছি। কিন্তু পানির স্ফুটনাংক স্বাভাবিক চাপে মাত্র ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

৫.

এবার আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশের সঙ্গে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সব যন্ত্রপাতি দুটি সার্কিটে বিন্যস্ত থাকে। প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি সার্কিট। ফিশনের মাধ্যমে শক্তি উৎপাদনের মূল কাজটি করা হয় প্রাইমারি সার্কিটে। রিঅ্যাক্টরের কোরে উৎপন্ন তাপশক্তিকে নিয়ে যাওয়া হয় স্টিম বা বাষ্প-জেনারেটরে। সেখানে প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি সার্কিটের উপকরণগুলোর মধ্যে কোনোরকম স্পর্শ ছাড়াই তাপের আদান প্রদান করা হয়, তৈরি করা হয় স্টিম বা বাষ্প। এই বাষ্প ব্যবহার করে ঘোরানো হয় টার্বাইন। পরে এই ঘূর্ণন কাজে লাগিয়ে জেনারেটর বিদ্যুৎ তৈরি করে। খুব সংক্ষেপে বললে, এটাই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কাজের মূলনীতি। 

এবার আসা যাক বিস্তারিত ব্যাখ্যায়। প্রাইমারি সার্কিটের মূল উপকরণগুলো হলো রিঅ্যাক্টর প্রেশার ভেসেল, রিঅ্যাক্টর কুলেন্ট পাম্প, প্রেশারাইজার ও স্টিম জেনারেটর। রিঅ্যাক্টরের কোরে থাকা ফুয়েল অ্যাসেম্বলিতে এনরিচড ইউরেনিয়াম রাখা হয়। যখন ফিশন শুরু হয়, তখন ফুয়েল উত্তপ্ত হতে থাকে। সেই তাপশক্তিকে ক্রমাগত সরিয়ে নিতে হয় স্টিম জেনারেটরে। এই কাজটি যে যন্ত্রাংশ দিয়ে করা হয়, তার নাম কুলেন্ট। প্রেশারাইজড ওয়াটার রিঅ্যাক্টরে সেই পানিই ব্যবহৃত হয় কুলেন্ট হিসেবে। অর্থাৎ, এ ধরনের রিঅ্যাক্টরে পানি একইসঙ্গে মডারেটর ও কুলেন্ট হিসাবে কাজ করে। কুলেন্ট হিসেবে ব্যবহারের জন্য পানিকে যে পথে কোরে প্রবেশ করানো হয়, তার নাম কোল্ড লেগ। পানি যখন এখান দিয়ে প্রবেশ করে, তখন এর তাপমাত্রা থাকে ২৯৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি।

রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেলের ডায়াগ্রাম

তারপর এগুলো ওপরের ছবিতে দেখানো পথ ধরে প্রথমে যায় কোরের নিচের অংশে। সেখান থেকে ফুয়েল রডগুলোর মধ্যকার ফাঁকা স্থান দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তাপ পরিবহন করে নিয়ে আসে হট লেগে। কোর থেকে গরম পানি বের হওয়ার পথের নাম হট লেগ। এ সময় পানির তাপমাত্রা থাকে প্রায় ৩৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো।

রিঅ্যাক্টর প্রেশার ভেসেলের ওপরের অংশে থাকে কন্ট্রোল রডগুলো। এগুলোর মূল কাজ হলো কোরের নিউট্রন শোষণ করা। এগুলোর মূল উপাদান বোরন। কোনো কারণে যদি অনিয়ন্ত্রিতভাবে কোরের মধ্যে ফিশনের সংখ্যা বাড়তে থাকে, তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই রডগুলো কোরের মধ্যে প্রবেশ করে। শোষণ করতে শুরু করে নিউট্রন। এতে পর্যাপ্ত থার্মাল নিউট্রনের অভাবে কমে আসে ফিশনের গতি। অর্থাৎ, বন্ধ হয়ে যায় রিঅ্যাক্টর। রিঅ্যাক্টর প্রোটেকশন সিস্টেম (প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা) নামের একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার মাধ্যমে সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে রাখা হয় ফিশনের গতি। অবস্থা বেগতিক দেখলেই এর কাজ শুরু হয়ে যায়। মেইন বা মূল কন্ট্রোল রুমে থাকা অপারেটররা চাইলেও একে থামাতে পারেন না। অবশ্য থামানোর কোনো দরকারও নেই।

আবার ফেরা যাক প্রাইমারি সার্কিটের পানির কাছে। এ সার্কিটের ভেতরে পানির প্রবাহ চালু রাখার মূল কাজটি করে রিঅ্যাক্টর কুলেন্ট পাম্প। এটি বেশ উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন। প্রতি ঘন্টায় প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ লিটার পানি প্রবাহে সক্ষম। হট লেগ থেকে বেরোনোর পর উত্তপ্ত পানির গন্তব্য হয় স্টিম জেনারেটরে। সেখানে পৌঁছানোর পর এগুলো স্টিম জেনারেটরে থাকা অনেকগুলো টিউবের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে টিউবগুলোর তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ঠিক অন্য পাশেই থাকে সেকেন্ডারি সার্কিটের পানি। এগুলো টিউব থেকে বিপুল পরিমাণ তাপশক্তি শোষণ করে পরিণত হয় বাষ্পে। অন্যদিকে তাপ ছেড়ে দেওয়ার পর প্রাইমারি সার্কিটের কুলেন্ট ফিরে যায় কোল্ড লেগে, অংশ নেয় সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তিতে।

আচ্ছা পাঠক, এবারে একটি প্রশ্ন করা যাক আপনাকে। আমরা মাত্রই জানলাম, কোল্ড ও হট লেগে পানির তাপমাত্রা থাকে যথাক্রমে ২৯৫ ডিগ্রি ও ৩৩০ ডিগ্রির কাছাকাছি। কিন্তু পানির স্ফুটনাংক স্বাভাবিক চাপে মাত্র ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সে হিসেবে প্রাইমারি সার্কিটের ভেতরে তো সব বাস্প হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমরা তো সেখানে তীব্র বেগে পানি প্রবাহিত হতে দেখি। রহস্যটা কী তাহলে?

আসলে সম্পূর্ণ প্রাইমারি সার্কিটকে প্রায় ১৬ মেগাপ্যাসকেল চাপে রাখা হয় (স্বাভাবিক বায়ুমণ্ডলের চাপের মান মাত্র ০.১০১৩২৫ মেগাপ্যাসকেল)।  তাই অনেক উচ্চ তাপমাত্রাতেও পানি ফুটতে শুরু করে না। এ জন্যই এ ধরনের রিঅ্যাক্টরের নাম দেওয়া হয়েছে প্রেশারাইজড ওয়াটার রিঅ্যাক্টর। যে যন্ত্রের সাহায্যে এত উচ্চ চাপ বজায় রাখা হয়, তার নাম প্রেশারাইজার। এটি আসলে একটি বেশ বড় আকারের ট্যাংক। এর বেশিরভাগই পানি দিয়ে ভর্তি। ট্যাংকের ওপরের দিকে থাকে বাস্প। এর একেবারে নিচের দিকে পানির ভেতরে রাখা থাকে একটি হিটার। কোনোভাবে যদি প্রাইমারি সার্কিটের চাপ কমে যায়, তাহলে হিটার চালু করে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানিকে বাস্পে পরিণত করা হয়। এগুলোর সম্মিলিত চাপের প্রভাবে প্রাইমারি সার্কিটের প্রেশার আগের অবস্থায় ফিরে যায়। অন্যদিকে সার্কিটের ভেতরের চাপ বেড়ে গেলে ট্যাংকের ওপরে থাকা বিভিন্ন ভালভ ও স্প্রের মাধ্যমে পানি ছিটানো হয়। ফলে বাস্প পানিতে পরিণত হওয়ার মাধ্যমে পুরো সার্কিটের চাপ কমে যায়।

প্রিয় পাঠক, এতক্ষণ ধরে আপনাকে প্রাইমারি সার্কিটের একটি লুপের কথা বললাম। যেখানে কোল্ড লেগ থেকে কোর, সেখান থেকে হট লেগ, তারপর স্টিম জেনারেটর হয়ে রিঅ্যাক্টর কুলেন্ট পাম্প ব্যবহার করে আবারো কোল্ড লেগে ফিরে আসে পানি। প্রেশারাইজড ওয়াটার রিঅ্যাক্টরে এমন লুপের সংখ্যা থাকে সাধারণত তিন থেকে চারটি। সবগুলো লুপই একই রিঅ্যাক্টর প্রেশার ভেসেলের সঙ্গে যুক্ত থাকে। আর প্রেশারাইজার যুক্ত থাকে চারটি লুপের মধ্যে যেকোনো একটির হট লেগের সঙ্গে। চারটি হট লেগের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে চারটি স্টিম জেনারেটর। প্রতিটি চারটি আলাদা রিঅ্যাক্টর কুলেন্ট পাম্পের সঙ্গে যুক্ত থাকে। রিঅ্যাক্টরে ফিশন প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন বিপুল তাপশক্তিকে পুরোপুরি কাজে লাগাতেই লুপের সংখ্যা বাড়ানো হয়। নাহয় বেশিরভাগ শক্তিরই অপচয় হয়ে যেত।

টার্বাইনের দুই ধরনের সিলিন্ডারই একটি কমন শ্যাফটের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। বাষ্প ব্যবহার করে হাই ও লো প্রেশার সিলিন্ডার ব্লেড সেই শ্যাফটকে ঘুরায়। এটি আবার যুক্ত থাকে জেনারেটরের সঙ্গে।

৬.

সেকেন্ডারি সার্কিটের আলোচনায় যাওয়ার আগে চলুন কয়েকটি বিষয়ে বিভ্রান্তি দূর করে ফেলা যাক। প্রাইমারি সার্কিটের পানি সম্পূর্ণ তেজস্ক্রিয়। কোরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় এমনটা হয়। এ ছাড়াও নিউট্রন মডারেশন প্রক্রিয়া চলার কারণে অনেক সময় পানিতে থাকা অক্সিজেন নিউট্রন শোষণের মাধ্যমে পরিণত হয় নাইট্রোজেন-১৬ আইসোটোপে। এগুলো ক্ষতিকর গামা রশ্মি বিকিরণ করে। এ নিয়ে অবশ্য খুব বেশি চিন্তার কিছু নেই। কারণ এদের দৌড় প্রাইমারি সার্কিট পর্যন্তই। সেকেন্ডারি সার্কিটকে এ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা রাখা হয়। তাই কোনোভাবেই পরিবেশে তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর সম্ভাবনা নেই। পাশাপাশি প্রাইমারি সার্কিটকে রাখা হয় দুই স্তর বিশিষ্ট কনটেইনমেন্টের ভেতরে। ভেতরের কনটেইনমেন্ট তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর সম্ভাব্যতাকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনে। আর বাইরের কনটেইনমেন্ট রিঅ্যাক্টরকে রক্ষা করে বাহ্যিক প্রভাব থেকে। যেমন ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, বিমান দুর্ঘটনা ইত্যাদি। নিচের ছবিতে প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি সার্কিটের ডায়াগ্রাম দেখানো হয়েছে।

প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি সার্কিটের ডায়াগ্রাম

এবারে চলুন, আপনাদের সেকেন্ডারি সার্কিটের মূল উপকরণগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। টার্বাইন (লো প্রেশার ও হাই প্রেসার সিলিন্ডার), ময়েশ্চার সেপারেটর অ্যান্ড রিহিটার, জেনারেটর, কনডেনসার, মেইন কন্ডেনসেট পাম্প, লো প্রেশার হিটার হাই প্রেশার হিটার, ফিড ওয়াটার পাম্প, ডিয়ারেটর ইত্যাদি। সেকেন্ডারি সার্কিটে থাকা সব উপকরণ থাকে টার্বাইন বিল্ডিংয়ে। বিল্ডিংটির অবস্থান কনটেইনমেন্টের বাইরে। সেকেন্ডারি সার্কিট তেজস্ক্রিয়তা মুক্ত হওয়ায় এটিকে কনটেইনমেন্টের ভেতরে রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই। রিঅ্যাক্টর বিল্ডিংয়ে থাকা স্টিম জেনারেটর থেকে উৎপন্ন বাষ্প পাইপ লাইনের মাধ্যমে এসে প্রবেশ করে টার্বাইন বিল্ডিংয়ে। তারপর সোজা চলে যায় টার্বাইনে।

টার্বাইনে দুটি প্রধান অংশ থাকে। হাই প্রেশার সিলিন্ডার (HPC) ও লো প্রেশার সিলিন্ডার (LPC)। হাই প্রেশার সিলিন্ডার থাকে একটি। আর লো প্রেশার সিলিন্ডারের সংখ্যা ডিজাইন অনুযায়ী ভিন্ন হয়। তবে সাধারণত এদের সংখ্যা হয় চার।

প্রথমে স্টিম জেনারেটর থেকে আসা ফ্রেশ স্টিম বা বাষ্প টার্বাইনের হাই প্রেশার সিলিন্ডারে প্রবেশ করে। সেখানে এগুলোকে ব্যবহার করে রোটর ঘোরানো হয়। একবার ব্যবহারের পরই কিন্তু স্টিমের কার্যকারীতা শেষ হয়ে যায় না। একে আবারও ব্যবহার করা যায়। তবে প্রথমবার ব্যবহারের পর আদ্রতা বৃদ্ধির জন্য এগুলোর গুণগত মান হ্রাস পায়। দ্বিতীয় ধাপে ব্যবহারের আগে এগুলকে প্রথমে ময়েশ্চার সেপারেটর অ্যান্ড রিহিটার দিয়ে শুষ্ক করে নিয়ে তাপ দেওয়া হয়। এটি বাষ্পের গুণগত মান উন্নয়নে সাহায্য করে। তারপর এগুলোকে পাঠানো হয় লো প্রেশার সিলিন্ডারে। সেখানে দ্বিতীয় দফা ব্যবহার শেষে স্টিম আর ব্যবহারের উপযোগী থাকে না। এরপর শুরু হয় এদেরকে পানিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া।

রূপান্তর প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে শুরুতেই স্টিমগুলোকে পাঠানো হয় কনডেনসারে। প্রতিটি লো প্রেশার সিলিন্ডারের সঙ্গেই একটি করে কনডেনসার যুক্ত থাকে। কুলিং টাওয়ার থেকে টিউবের মাধ্যমে ঠান্ডা পানি আসতে থাকে সেখানে। বাষ্প এই পানিতে তাপ ছেড়ে দিয়ে আবারো তরলে পরিণত হয়।

একটা কথা মনে রাখবেন। কনডেনসারে কিন্তু বাষ্প ও কুলিং টাওয়ার থেকে আসা পানির মিশ্রণ সরাসরি ঘটে না। টিউবের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় ঠান্ডা পানি। এর  (টিউব) সংস্পর্শে এসে বাষ্পও ঠান্ডা হয়ে এক সময়ে স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানিতে পরিণত হয়। তখন এদের বলা হয় কনডেনসেট। এরপর এদেরকে আবারো কাজে লাগানো হয়ে প্রাইমারি সার্কিটের পানি থেকে ফিশনের মাধ্যমে উৎপন্ন তাপ বয়ে নিয়ে আসার কাজে।   

কনডেনসেটকে আবার বাষ্প-জেনারেটরে পাঠানোর আগে একে নির্দিষ্ট মাত্রায় উত্তপ্ত করা হয়। স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানির চেয়ে উত্তপ্ত পানির কর্মদক্ষতা বেশি। সে জন্যই এমনটা করা হয়। উত্তপ করার কাজটি করে লো প্রেশার ও হাই প্রেশার হিটার। লো প্রেশার হিটার উত্তপ্ত করার কাজে ব্যবহার করে লো প্রেশার সিলিন্ডার থেকে আসা বাষ্প। এক্সট্রাকশন লাইনের মাধ্যমে নিয়ে আসা হয় এই বাষ্প। একইভাবে হাই প্রেশার হিটার ব্যবহার করে হাই প্রেশার সিলিন্ডার থেকে আসা বাষ্প উত্তপ্ত করা হয়। প্রথমে কনডেনসেটকে কয়েকটি ধাপে লো প্রেশার হিটার ব্যবহার করে উত্তপ্ত করা হয়। তারপর এতে থাকা ময়েশ্চার দূর করে ফিড ওয়াটার পাম্প ব্যবহার করে পাঠানো হয় হাই প্রেশার হিটারে। সেখানেই কনডেনসেটকে চূড়ান্তভাবে উত্তপ্ত করে কাঙ্ক্ষিত তাপমাত্রায় নিয়ে যাওয়া হয়, পাঠানো হয় বাষ্প-জেনারেটরে। এরপর সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটে আবারো।

টার্বাইনের দুই ধরনের সিলিন্ডারই একটি কমন শ্যাফটের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। বাষ্প ব্যবহার করে হাই ও লো প্রেশার সিলিন্ডার ব্লেড সেই শ্যাফটকে ঘুরায়। এটি আবার যুক্ত থাকে জেনারেটরের সঙ্গে। শ্যাফটের যান্ত্রিক শক্তি কাজে লাগিয়ে জেনারেটরটি বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে।

৬.

সবার শেষে কুলিং টাওয়ার নিয়ে একটু ধারণা দেওয়া যাক। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট নিয়ে যাঁদের ধারণা কম, তাঁরা সাধারণত কুলিং টাওয়ারগুলোকেই মনে করেন রিঅ্যাক্টর। এখান থেকে বের হওয়া সাদা ধোঁয়া দেখে বিভ্রান্ত হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক নয়। বাস্তবে কুলিং টাওয়ার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি অংশ মাত্র। এগুলোকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের অবিচ্ছেদ্য অংশও বলা যাবে না। কারণ অনেক দেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কুলিং টাওয়ার থাকে না। সেগুলোতে ভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে কুলিং বা শীতলীকরণের কাজটি করা হয়।       

কুলিং টাওয়ারের মাধ্যমে তাপ শক্তি অপসারণের ধারণা

কনডেনসার থেকে বাষ্পের ছেড়ে দেওয়া তাপশক্তি যে পানি বয়ে আনে, সেই পানিকে ঠান্ডা করার পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে কুলিং টাওয়ারগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। মেকানিক্যাল ড্রাফট কুলিং টাওয়ার ও ন্যাচারাল ড্রাফট কুলিং টাওয়ার। প্রথমটিতে ঠান্ডা করার কাজে ব্যবহার করা হয় ফ্যান। আর পরেরটিতে কাজে লাগানো হয় প্রাকৃতিক বাতাস। ন্যাচারাল ড্রাফট কুলিং টাওয়ারের নিচের অংশ থেকে ওপরের দিকে বাতাসের প্রবাহের ব্যবস্থা করা হয়। আর গরম পানি নজল বা সরু নলের সাহায্যে ওপর থেকে নিচের দিকে স্প্রে করা হয়। ফলে বাতাস গরম পানি থেকে তাপ শোষণ করে ওপরের খোলা মুখ দিয়ে পরিবেশে চলে যায়। আর পানিগুলো টাওয়ারের নিচে থাকা রিজার্ভারে এসে জমে। সেখান থেকে এগুলোকে আবার পাঠানো হয় কনডেনসারে। এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। 

প্রিয় পাঠক, আশা করি একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কার্যপ্রণালী সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা দিতে পেরেছি আপনাদের। ঠিক এভাবেই ইউরেনিয়াম থেকে শক্তি আহরণ করে তৈরি করা হয় বিদ্যুৎ। অদূর ভবিষ্যতে দেশে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে এর অনেক কিছুই হয়তো নিজের চোখের সামনে ঘটতে দেখতে পারবেন। আপাতত সেই অপেক্ষায় থাকুন।   

সুত্র: ১. হাউ ইজ ইউরেনিয়াম মেড ইনটু নিউক্লিয়ার ফুয়েল, ওয়ার্ল্ড-নিউক্লিয়ার ডট অর্গ

২. হাউ টু ড্রাইভ এ নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর, কোলিন টাকার 

লেখক: সহকারি ব্যবস্থাপক, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড