সেলসিয়াস ও ফারেনহাইট স্কেলের মান কখন সমান হয়?

গত কিছুদিন ধরে তীব্র গরম। জীবন নাজেহাল। তাপমাত্রা যেন ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামতেই চায় না। তারপর স্বস্তির বৃষ্টি। গত দুদিন ধরে তাপমাত্রা খানিকটা কমেছে। আমাদের আলোচনার বিষয় অবশ্য পরিবেশ নয়। তবু এ প্রসঙ্গের অবতারণা করার কারণ আছে। খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই, তাপমাত্রা বলতে আমরা এখানে ব্যবহার করেছি সেলসিয়াস স্কেল। এটি প্রায় সবার পরিচিত। তবে সবসময় কিন্তু এ স্কেল ব্যবহৃত হয় না। আরেকটি বহুল প্রচলিত স্কেল আছে, সেটা ব্যবহৃত হয়। নাম, ফারেনহাইট স্কেল। খানিকটা অপরিচিত, তবে বিজ্ঞানীরা বেশ ব্যবহার করেন, এমন আরেকটি স্কেল আছে। কেলভিন স্কেল। তবে এটা আমাদের এ লেখার আলোচ্য বিষয় নয়। যাহোক, প্রসঙ্গে ফিরি।

ধরুন, আপনার জ্বর। গিয়েছেন ডাক্তারের কাছে। জ্বর মেপে ডাক্তার জানালেন ১০২। এই ১০২ মানে কী? তাপমাত্রা ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট। সেলসিয়াস নয়। ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় যেকোনো কিছু সেদ্ধ হয়ে যায়, ফুটতে শুরু করে পানি। কাজেই, সেলসিয়াস যে হতে পারে না, তা বলা বাহুল্য।

বুঝতেই পারছেন সেলসিয়াস স্কেলের সঙ্গে ফারেনহাইট স্কেলের তাপমাত্রার পার্থক্য আছে। পার্থক্য ৩২ ডিগ্রি। অর্থাৎ, ০ ডিগ্রি সেলসিয়াস যে কথা, ৩২ ডিগ্রি ফারেনহাইটও সেই একই কথা। 

আরও পড়ুন
প্রতি ডিগ্রি ফারেনহাইটের তুলনায় সেলসিয়াস ১ দশমিক ৮ গুণ বড়।

দুটি স্কেলের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও একটি জায়গায় গিয়ে এরা মিলে যায়। মাইনাস ৪০ ডিগ্রি। কারণ ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মান ১ ডিগ্রি ফারেনহাইটের চেয়ে বেশি। আরেকটু সহজ করে বলি। ধরুন, দৌড় প্রতিযোগিতা চলছে। বৃত্তের চারপাশে দৌড়াচ্ছেন দৌড়বিদেরা। একজন সবার সামনে। তাঁর পেছনে আছেন আরও অনেকে। দ্বিতীয় স্থানে যিনি দৌড়াচ্ছেন, তিনি যদি দৌড়ানোর গতি বাড়িয়ে দেন, তাহলে নিশ্চয়ই একসময় প্রথমজনকে ধরে ফেলবেন। বিপরীতভাবেও ভাবা যায়। প্রথম স্থানে থাকা প্রতিযোগীর দৌড়ের গতি ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। কিন্তু দ্বিতীয় প্রতিযোগির গতি একই আছে। তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়াবে? একসময় প্রথম ও দ্বিতীয় প্রতিযোগী একসমানে চলে আসবেন, দৌড়াবেন ওভাবেই। সেলসিয়াস ও ফারেনহাইট স্কেলের ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটে। কিন্তু কেন ঘটে? কীভাবে ঘটে? চলুন সেটাই জানা যাক।

আঠারো শতকের শুরুর দিকে ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের হাত ধরে ফারেনহাইট ও সেলসিয়াস স্কেলের উদ্ভব। ডাচ পদার্থবিদ ড্যানিয়েল ফারেনহাইট উদ্ভাবন করেন ফারেনহাইট স্কেল। আর সুইডিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী অ্যান্ডার্স সেলসিয়াস উদ্ভাবন করেন সেলসিয়াস স্কেল। দুটি স্কেলকে নানাভাবে আলাদা করা যায়। যেমন মানুষের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফারেনহাইট স্কেলে সেটা ৯৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট। আবার পানি ০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে বরফ হলেও ফারেনহাইট স্কেলে সেটা ৩২ ডিগ্রি। পানির স্ফুটানঙ্ক ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু ফারেনহাইট স্কেলে সেটা ২১২ ডিগ্রি ফারেনহাইট।

এবার একটা বিষয় খেয়াল করুন। হিমায়িত পানি ও গরম পানির মধ্যে পার্থক্য ১৮০ ডিগ্রি ফারেনহাইট। কিন্তু সেলসিয়াস স্কেলে পার্থক্যটা ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ, প্রতি ডিগ্রি ফারেনহাইটের তুলনায় সেলসিয়াস ১ দশমিক ৮ গুণ বড়।

সহজে কীভাবে দুটি স্কেলের রূপান্তর করা যায়, এবারে তা দেখব। একটা বিষয় স্পষ্ট—প্রতি ডিগ্রি সেলসিয়াস সমান ১ দশমিক ৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট। যদিও দুটি স্কেলের শুরু ভিন্ন সংখ্যা থেকে—০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও ৩২ ডিগ্রি ফারেনহাইট। দুটি স্কেলের মধ্যে রূপান্তর ঘটাতে এই ৩২ যোগ বা বিয়োগ করতে হয়। অর্থাৎ, সেলসিয়াসকে ফারেনহাইটে রূপান্তর করতে হলে প্রথমে সেলসিয়াসকে ১ দশমিক ৮ দিয়ে গুণ করে, তারপর যোগ করতে হবে ৩২। তাহলে সূত্রটা দাঁড়াবে—

F = (1.8 × C) + 32

সুতরাং, (1.8 × -40C) + 32 = -40F

আবার ফারেনহাইটকে সেলসিয়াসে রূপান্তর করতে হলে ফারেনহাইট থেকে ৩২ বিয়োগ করতে হবে প্রথমে। তারপর ভাগ দিতে হবে ১ দশমিক ৮ দিয়ে। সূত্রটা হবে—

C = (F - 32) ÷ 1.8

সুতরাং, (-40F - 32) ÷ 1.8 = -40C  

অর্থাৎ দুটি স্কেলই মাইনাস ৪০ ডিগ্রিতে গিয়ে সমান হয়ে যায়।

দেখাই যাচ্ছে, দুটি স্কেলই মাইনাস ৪০ ডিগ্রিতে গিয়ে একসমান হয়ে যায়।

যাঁরা আরেকটু বিস্তারিত জানতে চান, তাঁরা নিচের গাণিতিক সমাধানটি দেখতে পারেন। পদার্থবিজ্ঞান বোঝার জন্য আসলে গণিতের বিকল্প নেই। বিষয়টা খুব কঠিনও নয়। তবে এখানে একটুখানি বীজগণিতের সাহায্য নিতে হবে। এক্ষেত্রে দুটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। আগে বলা হয়েছে, তারপরেও স্মরণ করিয়ে দিই।

১. ফারেনহাইট স্কেলের ১ ডিগ্রি ৫/৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সমান। আর সেলসিয়াসে ১ ডিগ্রি ৯/৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটের সমান।

২. দুটি স্কেলের পার্থক্য ৩২ ডিগ্রি। অর্থাৎ, পানি ০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৩২ ডিগ্রি ফারেনহাইটে বরফ হয়।

হিসাবের সুবিধার জন্য এখন একটি অজানা চলক ধরে শুরু করা যাক। ধরুন, সেই চলক ‘ক’।

ক চলককে সেলসিয়াসে রাখতে চাইলে সমীকরণের বাম দিকে রাখতে হবে। আর প্রথমে ক নামের চলকটিকে ৯/৫ দিয়ে গুণ করে, যোগ করতে হবে ৩২।

ক = (৯/৫)ক + ৩২

বা, ক - (৯/৫)ক = ৩২

বা, (১-৯/৫)ক = ৩২ [ক কমন নেওয়া হয়েছে]

বা, (-৪/৫)ক = ৩২

বা, (-৪/৫)ক×(-৫/৪) = ৩২×(-৫/৪) [দুপাশে -৫/৪ দিয়ে গুণ করা হয়েছে]

বা, ক = (-৫/৪)×৩২

বা, ক = -(১৬০/৪)

সুতরাং, ক = -৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইট

আর ক চলককে ফারেনহাইটে রাখতে চাইলে, রাখতে হবে সমীকরণের বাম দিকে । প্রথমে ক থেকে ৩২ বিয়োগ করে তারপর ভাগ দিতে হবে ৫/৯ দিয়ে। অর্থাৎ,

ক = (ক-৩২)×(৫/৯)

বা, (৯/৫)ক = ক - ৩২

বা, (৯/৫)ক – ক = -৩২

বা, (৯/৫ - ১)ক = -৩২

বা, (৪/৫)ক = -৩২

বা, ক = -৩২× (৫/৪)

বা, ক = -(১৬০/৪)

সুতরাং, ক = -৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস

একই জিনিসই, দুভাবে করা যায়। তাই দুভাবেই দেখানো হলো। এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে গিয়ে ফারেনহাইট স্কেল ও সেলসিয়াস স্কেল একসমান হয়ে যায়।

লেখক: সম্পাদনা দলের সদস্য, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: হাউ স্টাফস ওয়ার্কস