বৃষ্টি শেষে আকাশজুড়ে রঙের মেলা। বিস্তৃত প্রান্তজুড়ে অর্ধবৃত্তাকারে ছড়িয়ে আছে। এর আরেক নাম, রামধনু। ধনু শব্দের বাংলা অর্থ ধনুক, দেখতে অনেকটা অর্ধবৃত্তের মতো। রংধনুও দেখতে অনেকটা সেরকম। নামকরণটা সেকারণেই। স্বার্থক নামকরণ, বলা বাহুল্য।
পৃথিবীর অনেক উপকথায় বলা হয়, রংধনুর শেষ প্রান্তে লুকানো আছে প্রচুর ধনরত্ন। সেই রত্নের সন্ধানে হয়তো মানুষ সত্যি সত্যিই বেরিয়ে পড়ত, যদি রংধনুর সত্যিই কোনো প্রান্ত থাকত। দেখতে যেমনই হোক না কেন, এখন আমরা জানি রংধনুর কোনো প্রান্ত থাকে না। কারণ, রংধনুর আকার আসলে গোল।
পৃথিবী গোলাকার, তাই আমরা খুব বেশি দূর দেখতে পাই না। দিগন্তের কারণে রংধনুর পুরোটা দেখা যায় না সমতল থেকে। কিন্তু একটু কষ্ট করে পাহাড়চূড়ায় উঠলে অনুকূল পরিবেশে রংধনুর পুরো আকৃতি দেখার সম্ভাবনা আছে। কারণ পাহাড়ের মতো উঁচু জায়গা থেকে একইসঙ্গে ওপরে ও নিচে অনেকটা জায়গা দেখা যায়। দৃষ্টিসীমা বাড়ে। অনুকূল পরিবেশ মানে কুয়াশাচ্ছন্ন বা কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়েছে এবং সূর্য পেছনে রয়েছে, এমন অবস্থার কথা বলছি।
আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ভিন্ন হওয়ার অর্থ আমাদের চোখে সেই আলোর রং বদলে যাওয়া। পানির কণায় পড়ে সূর্যের সাদা আলো ভাগ বা বিশ্লিষ্ট হয়ে যাওয়ার পর কণার বিপরীত দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে আবার ফিরে আসে। অর্থাৎ প্রতিসরণের পর আবার প্রতিফলিত হয় এই আলো। বিশ্লিষ্ট ও প্রতিফলিত এই আলো এসে চোখে পড়লে আমরা রংধনু দেখি।
পাহাড়ে ওঠা ছাড়াও উড়োজাহাজে চড়ে অনেকসময় রংধনুর সম্পূর্ণটা দেখা যায়। এজন্য অবশ্য মেঘের ওপরে উঠে যেতে হবে। অথবা নিজেও রংধনু তৈরি করে নিয়ে গোলাকার রূপ দেখতে পারেন। ভাবছেন, কীভাবে তৈরি করবেন? বলছি। তার আগে রংধনু কীভাবে তৈরি হয়, সেটা বুঝতে হবে।
সূর্যের আলো বায়ুমণ্ডলের পানির কণায় প্রতিফলিত ও বিচ্ছুরিত হয়ে তৈরি করে রংধনু। যতটা সহজে বললাম, পুরো বিষয়টি অবশ্য এত সহজ নয়।
সূর্যের আলো বাতাসের মধ্যে থাকা কোটি কোটি পানির কণার ওপর পড়ে। এরপর সেই আলো পানির কণার মধ্যে তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনুযায়ী নানাভাবে বেঁকে যায়। আলোর বেঁকে যাওয়ার এই ঘটনাকে বলা হয় প্রতিসরণ বা রিফ্র্যাকশন। ভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো পানিতে (আসলে শূন্য বাদে অন্য যেকোনো মাধ্যমে) ভিন্ন গতিতে চলে। সাদা আলোয় সব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের দৃশ্যমান আলো থাকে। এ কারণে সূর্যের আলো পানিতে পড়লে তা তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনুযায়ী বেঁকে আলাদা হয়ে যায়।
আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ভিন্ন হওয়ার অর্থ আমাদের চোখে সেই আলোর রং বদলে যাওয়া। পানির কণায় পড়ে সূর্যের সাদা আলো ভাগ বা বিশ্লিষ্ট হয়ে যাওয়ার পর কণার বিপরীত দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে আবার ফিরে আসে। অর্থাৎ প্রতিসরণের পর আবার প্রতিফলিত হয় এই আলো। বিশ্লিষ্ট ও প্রতিফলিত এই আলো এসে চোখে পড়লে আমরা রংধনু দেখি।
এসব পানির কণা থেকে বিভিন্ন রং আলাদা আলাদা কোণে গুচ্ছাকারে প্রতিফলিত হয়। প্রতিটি রঙের শীর্ষ তরঙ্গমুখ থাকে গোলাকার। কিন্তু দিগন্তের কারণে আমরা এর পুরোটা দেখি না। এ কারণে রংধনু আমাদের চোখে অর্ধবৃত্তাকার হয়ে ধরা দেয়। আবার পানির কণা থেকে প্রতিফলিত এই আলো সবদিকে একইভাবে যেতে পারে না। ফলে খুব কাছে দাঁড়িয়ে থাকলেও দুজনের মানুষের চোখে হুবহু একরকম হয়ে ধরা দেয় না রংধনু। খুব সামান্য হলেও পার্থক্য থাকে। মানে, প্রতিটা মানুষের চোখে রংধনু হয় অনন্য। এখানে অনন্য মানে, প্রত্যেকেই খানিকটা ভিন্ন রঙের রংধনু দেখতে পান।
রংধনু হওয়ার জন্য পানির কণা প্রায় সম্পূর্ণ গোলক হওয়া আবশ্যক। কারণ, গোলাকার কণা বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকে সুষমভাবে বিশ্লিষ্ট ও প্রতিফলিত করতে পারে। তাই পানির কণা হলেই তাতে রংধনু দেখা যায় না। বৃষ্টির পর বায়ুমণ্ডলে প্রচুর ছোট ছোট গোলাকার পানির কণা ভেসে থাকে। এ কারণে তখন রংধনু দেখা যায়। এ ছাড়া রৌদ্রজ্জ্বল দিনে ঝরনা থেকে ছিটকে পড়া পানির কণা কিংবা কুয়াশার কণায়ও রংধনুর দেখা মেলে।
আমরা যেখানে রংধনু দেখি, বাস্তবে কিন্তু রংধনু সেখানে তৈরি হয় না। এ হলো আলোর প্রতিফলনের খেলা। আয়নায় যেমন আমরা যেখানে প্রতিবিম্ব দেখি সেখানে মূল বস্তুটা থাকে না, বিষয়টা সেরকম। এ ঘটনার আরেকটি চমৎকার উদাহরণ হলো মরুভূমির মরিচিকা। বিষয়টা হতাশার হলেও সত্যি যে আমরা আসলে কখনোই রংধনুর অস্তিত্ব খুঁজে পাব না। এটা নিছকই আলোর খেলা ছাড়া আর কিছু নয়।
তবে আপনি চাইলে নিজেই রংধনু তৈরি করতে পারেন। এজন্য আপনাকে সূর্যকে পেছনে রেখে দাঁড়াতে হবে। তারপর মুখ ভর্তি পানি প্রচণ্ড জোরে ফুঁ দিয়ে বাতাসের সঙ্গে মিশিয়ে বের করে দিতে হবে। মুখ থেকে বের হওয়া কুয়াশার মতো পানির কণায় নানা রঙের আলোর ছটা দেখতে পাবেন। এটাই মূলত রংধনু।
এক্ষেত্রে অবশ্য খুব অল্প সময়ের জন্য কিছু রং দেখতে পাবেন। আকাশে রংধনুর পূর্ণ রূপ, অর্থাৎ গোলাকার রংধনু দেখতে চাইলে উড়োজাহাজে চেপে বসতে পারেন। কপাল ভালো থাকলে মেঘের মধ্যে দেখা পাবেন নানারঙের গোল রংধনুর। বৈমানিকদের কাছে এটা অবশ্য অত দুর্লভ দৃশ্য নয়। এ কারণে ওপর থেকে দেখা এই রংধনুর আরেক নাম, পাইলটস গ্লোরি।
শেষ করার আগে অবশ্য রংধনুর সাতরং নিয়ে দুকথা বলতেই হবে। প্রচলিত কথায় বলা হয়, রংধনুতে সাত রঙের আলো থাকে। আসলে তা নয়। সাদা আলো ভেঙে বহু বহু আলো বেরিয়ে আসে। তরঙ্গদৈর্ঘ্য সামান্য আলাদা হলেই বদলে যায় আলোর রং বা বর্ণ। তবে আমরা বোঝার সুবিধার্থে প্রধান ও স্পষ্ট পার্থক্য করা যায়, এমন আলোর কথাই বলি। আর, এরকম আলোর সংখ্যা সাতটি। সেজন্যই রংধনুতে সাতরঙের কথা বলা হয়।
লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা
সূত্র: দ্য কনভার্সেশন।