প্রায় ৩০০ বছর আগে আইজ্যাক নিউটন গতি সম্পর্কিত তিনটি সূত্র প্রণয়ন করেন। ১৬৮৭ সালে তাঁর লেখা প্রিন্সিপিয়া ম্যাথেম্যাটিকা বইয়ে সেই সূত্র তিনটি প্রকাশিত হয়। নিউটন কি তখন ভেবেছিলেন, তার সূত্র প্রকাশের এতদিন পরেও তা নিয়ে বিতর্ক হবে! পৃথিবীর মানুষ টানা তিন শ বছর তাঁর সূত্র ভুলভাবে ব্যাখ্যা করবে! সেই ভুলটা কী? কেন এই ভুল হলো?
আসলে ভুলটা ছিল খুব সামান্যই। শুধু একটা শব্দের অর্থ অনুবাদে ভুল হয়েছিল। আর তাতেই বদলে গেছে সূত্রের অর্থ। সম্প্রতি ভার্জিনিয়া টেক বিশ্ববিদ্যালয়ের দার্শনিক ড্যানিয়েল হোয়েক দাবি করেছেন, আমরা এতদিন এই নিয়মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে এসেছি! তাঁর এই গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে ফিলোসফি অব সায়েন্স জার্নালে।
নিউটনের প্রথম সূত্র বলে, ‘বাহ্যিক বল প্রয়োগ না করলে স্থির বস্তু চিরকাল স্থির থাকবে এবং গতিশীল বস্তু চিরকাল সমবেগে চলতে থাকে।’ মানে, একটা স্থির বস্তুকে কেউ আঘাত না করলে ওটা সেখান থেকে নড়বে না। আবার কোনো বস্তুকে আঘাত করলে সেটা দিক পরিবর্তন না করে চলতেই থাকবে, যতক্ষণ না কেউ বা কোনোকিছু তাকে আবার বাধা দেয়। ভুলটা রয়ে গেছে এই কথার মধ্যেই।
ছোট্ট ভুলের কারণে কি পদার্থবিজ্ঞানের সব নিয়ম বদলে যাবে? আবার নতুন করে পদার্থবিজ্ঞান লিখতে হবে। আসলে তেমন কিছু হবে না। সবকিছু আগের মতোই থাকবে। এই নতুন ব্যাখ্যার ফলে নিউটনের প্রথম সূত্র আরও গভীরভাবে বোঝা যাবে।
ড্যানিয়েল হোয়েকের মতে, নিউটনের লেখা প্রথম গতি সূত্রের ইংরেজি অনুবাদে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভুল হয়েছিল। ১৭২৯ সালে প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা লাতিন থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়। তখন লাতিন শব্দ ‘Quatenus’-এর অর্থ ভুল অনুবাদ হয়। লাতিন এই শব্দের মানে ‘যতক্ষণ পর্যন্ত’, ইংরেজিতে ইনসোফার (Insofar)। কিন্তু অনুবাদ করা হয়েছিল ‘যদি না’, ইংরেজিতে ‘Unless’। মানে সূত্রের মধ্যে যেখানে আমরা ‘যদি না’ পড়ছি, সেখানে হবে ‘যতক্ষণ পর্যন্ত’।
অর্থাৎ, এতদিন ধরে আমরা সূত্রটিকে ব্যাখ্যা করেছি এভাবে,‘কোনো বস্তুর ওপর বাহ্যিক কোনো বল না প্রয়োগ করলে সেটি চিরকাল স্থির থাকবে বা একই গতিতে সরলরেখায় চলতে থাকবে।’ কিন্তু নতুন বিশ্লেষণ বলছে, নিউটনের মূল বক্তব্য ছিল ভিন্ন। তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, কোনো বস্তুর গতি পরিবর্তনের পেছনে সবসময় বাহ্যিক বলই কাজ করে। অর্থাৎ, কোনো বস্তুর গতি হঠাৎ থেমে যাওয়া, বাঁক নেওয়া, বা গতি বাড়া-কমার পেছনে বাহ্যিক শক্তির ভূমিকা রয়েছে। আরও সহজভাবে বললে, পৃথিবীর প্রতিটি জিনিসই বাহ্যিক বলের কারণে গতির পরিবর্তন ঘটায়।
এতদিন ধরে আমরা সূত্রটিকে ব্যাখ্যা করেছি এভাবে,‘কোনো বস্তুর ওপর বাহ্যিক কোনো বল না প্রয়োগ করলে সেটি চিরকাল স্থির থাকবে বা একই গতিতে সরলরেখায় চলতে থাকবে।’ কিন্তু নতুন বিশ্লেষণ বলছে, নিউটনের মূল বক্তব্য ছিল ভিন্ন।
এই ভুল ব্যাখ্যার কারণে অনেকেই ভাবত, নিউটনের প্রথম সূত্র শুধু কাল্পনিক কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রযোজ্য, যেখানে কোনো বাহ্যিক বল নেই। কিন্তু বাস্তবে কোনো কিছুই বাহ্যিক শক্তির প্রভাব মুক্ত থাকতে পারে না। এমনকি বাতাসে ঘূর্ণায়মান একটি লাটিমও ধীরে ধীরে থেমে যায়, কারণ বাতাসের ঘর্ষণ শক্তি সেটিকে ধীরে ধীরে থামিয়ে দেয়।
এখন প্রশ্ন হলো, এই ছোট্ট ভুলের কারণে কি পদার্থবিজ্ঞানের সব নিয়ম বদলে যাবে? আবার নতুন করে পদার্থবিজ্ঞান লিখতে হবে। আসলে তেমন কিছু হবে না। সবকিছু আগের মতোই থাকবে। এই নতুন ব্যাখ্যার ফলে নিউটনের প্রথম সূত্র আরও গভীরভাবে বোঝা যাবে। এটি শুধু স্থির বা সরলরেখায় চলমান বস্তু নিয়েই নয়, বরং মহাবিশ্বের প্রতিটি জিনিস—পরমাণু থেকে শুরু করে ছায়াপথের ঘূর্ণন পর্যন্ত—সবকিছুর গতির পেছনের কারণ ব্যাখ্যা করে।
তিনশো বছর পরও এটি আমাদের নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করছে, মহাবিশ্বের সঙ্গে আমাদের সংযোগের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।
এ ব্যাপারে টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের দার্শনিক এবং নিউটনের লেখার বিশেষজ্ঞ জর্জ স্মিথ বলেছেন, ‘প্রথম সূত্রের সাহায্যে আগের চেয়ে আরও ভালোভাবে শক্তির অস্তিত্ব অনুমান করা যাবে’।
নিউটনের প্রথম গতি সূত্র আমাদের মহাবিশ্বের সবচেয়ে গভীর সত্যগুলোর একটি। তিনশো বছর পরও এটি আমাদের নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করছে, মহাবিশ্বের সঙ্গে আমাদের সংযোগের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।
তবে ড্যানিয়েল হোয়েকের এই বিশ্লষণের সঙ্গে কিন্তু সবাই একমত হতে পারেননি। কেউ কেউ বলেন, ‘এটি এতটাই সঠিক যে এ নিয়ে তর্ক করার কিছু নেই।’
আবার অনেকে বলেছেন, ‘এটা একদম নতুন ও অদ্ভুত ব্যাখ্যা!’ আপনার কাছে কি মনে হয়, নতুন এই ব্যাখ্যা সঠিক নাকি আগের সূত্রই ঠিক আছে, সামান্য এই পরিবর্তনে তেমন কিছু যায় আসে না?