সাক্ষাৎকার
‘হাইস্কুলে পদার্থবিজ্ঞানে আমার তেমন আগ্রহ ছিল না’—পিটার হিগস
২০১৩ সালে ‘হিগস বোসন’ নিয়ে গবেষণার জন্য পদার্থবিজ্ঞানে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পান যুক্তরাজ্যের পদার্থবিদ পিটার হিগস ও বেলজিয়ামের ফ্রাঙ্কোই অ্যাংলার্ট। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে যুক্তরাজ্যের গবেষক পিটার হিগস ও অন্যান্য আরও কজন বিজ্ঞানী পদার্থের ভর সৃষ্টিকারী অতিক্ষুদ্র নতুন এক কণার সম্ভাবনার কথা বলেন। কণাটি ‘গড পার্টিকেল’ বা ‘ঈশ্বর কণা’ নামেও পরিচিতি। ২০২১ সালে কণাটি শনাক্ত করেন সার্নের বিজ্ঞানীরা।
এ বছরের ৮ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন বিজ্ঞানী পিটার হিগস। ২০১৩ সালের ৬ ডিসেম্বর এই পদার্থবিজ্ঞানী নোবেল প্রাইজ ফাউন্ডেশনে একটি ইন্টারভিউ দেন। এ সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে পিটার হিগসের অজানা কিছু গল্প। সাক্ষাৎকারটির সংক্ষিপ্ত রূপ প্রকাশিত হলো বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য। অনুবাদ করেছেন জাহিদ হোসাইন খান।
প্রশ্ন: যে গবেষণার জন্য আপনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, তরুণদের জন্য সহজ করে বলুন।
পিটার হিগস: একটি তুষার-ঢাকা মাঠের কথা কল্পনা করুন। এই মাঠটি যেন গোটা মহাবিশ্ব। মাঠটি একেকজন একেকভাবে পাড়ি দেন। কেউ স্কির স্ট্রাইপ, কেউ-বা স্নো-শু, কেউ আবার সাধারণ বুট জুতা পরে পার হন। যাঁরা স্কি করেন, তাঁরা কম বাধার মুখে পড়েন। দ্রুত গতিতে ঝামেলাহীনভাবে পেরিয়ে যান মাঠটি। যাঁরা স্নো-শু পরেন, তাঁরা চলাফেরায় কিছুটা বাধা পান। আর যাঁরা বুট জুতা পরেন, তাঁরা খুব ধীরে অতিক্রম করেন মাঠটি। কণাদের সঙ্গে আমরা মাঠ পেরোনোর এই বিষয়টি মেলাতে পারি। কিছু কণা আলোর গতিতে ভরহীন অবস্থায় ভ্রমণ করে। তারা দ্রুত ছুটতে পারে। ভারী কণার ক্ষেত্রে অন্য ঘটনা ঘটে। মাঠের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় এগুলো ছুটতে গিয়ে কিছু বাধা পায়। এই বাধাটাই আসলে ভর। আমার ধারণা, অন্য যেকোনো ব্যাখ্যার চেয়ে এতে পদার্থবিজ্ঞান [এর জটিলতা] কম।
প্রশ্ন: স্ট্যান্ডার্ড বা প্রমিত মডেল নিয়ে একটু বলবেন?
পিটার হিগস: ১৯৬৪ সালে আমাদের এক গবেষণার সূত্র ধরে ইলেকট্রোউইক থিওরি বা তড়িৎ-দুর্বল তত্ত্বের দিকে এগিয়ে যান বিজ্ঞানীরা। মৌলিক কণাদের দুর্বল ও বিদ্যুৎচুম্বকীয় মিথস্ক্রিয়ার একীভূত রূপ এই তত্ত্ব। ১৯৬৭ সালে স্টিফেন ওয়েইনবার্গ এবং আব্দুস সালামের গবেষণার ফলে গড়ে ওঠে তত্ত্বটি। তত্ত্বটার একীভূতকরণ ঠিক ছিল, তবে শেলডন গ্ল্যাশোর কারণে হিসাব-নিকাশ পুরোপুরি ঠিক হয়নি। তবে ৬৪ সালের ওই গবেষণায় প্রতিসাম্যের যে ভেঙে পড়ার বিষয়টি পাওয়া গিয়েছিল, এর সঙ্গে এই মডেলটি খাপ খেয়ে যায়। ওটাই ছিল স্ট্যান্ডার্ড মডেল বা প্রমিত মডেলের সূচনা।
পরে যখন দেখা গেল, তত্ত্বটা গাণিতিকভাবে ঠিক আছে, এটা দিয়ে [কণাদের আচরণ ও বিভিন্ন মিথস্ক্রিয়া] ঠিকভাবে গণনা করা যায়, তখন অনেকে কণাপদার্থবিজ্ঞানের অন্যান্য বলের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করতে শুরু করেন। এভাবে শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বলের একটি তত্ত্ব পাওয়া যায়। এর নাম কোয়ান্টাম ক্রোমোডাইনামিকস (কিউসিডি)। অর্থাৎ ১৯৬৪ সালের কাজটিই ছিল কণাপদার্থবিজ্ঞানে কোয়ান্টাম ফিল্ড তত্ত্বের ফিরে আসার শুরু। আগে ৫০-এর দশকে কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডাইনামিকস সফল হলেও, পরে দেখা গেল, কিছু কণার ক্ষেত্রে ঠিকভাবে কাজ করছিল না। তখন এটাকে কিছুদিন উপেক্ষা করা হয়। এটা যেন কাজ করে, আমরা সে পদক্ষেপের সূচনাটুকু করেছিলাম।
প্রশ্ন: কখন বুঝলেন আপনার কাজটি যুগান্তকারী?
পিটার হিগস: তেমন কোনো সুনির্দিষ্ট মুহূর্ত ছিল না ওটা। আমি কণাপদার্থবিদ্যার একটি উপপাদ্য এড়াতে চেষ্টা করার সময় ব্যাপারটা প্রথম উপলব্ধি করি। কণাপদার্থবিদ্যার একধরনের প্রতিসাম্য ভাঙন ইঙ্গিত করে যে কোনো একধরনের স্পিনহীন ও ভরহীন কণার অস্তিত্ব আছে। উপপাদ্যটি ছিল এই বিষয়ক। উপপাদ্যটি এ তত্ত্বকে অগ্রহণযোগ্য করে তোলে। কারণ তখন পর্যন্ত এ ধরনের কণার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। যে তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে এসব ধারণা তৈরি হয়, এর চার বছর আগে ইয়োচিরো নাম্বু তা প্রণয়ন করেন। জেফ্রি গোল্ডস্টোনের সঙ্গে যুগ্মভাবে কাজটি করেছিলেন তিনি। ইয়োচিরো নাম্বু ২০০৮ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। আমি বুঝতে পারলাম, এ উপপাদ্যে ত্রুটি আছে। যেমন কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডাইনামিকসে ম্যাক্সওয়েলের ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড বা বিদ্যুৎচুম্বকীয় তত্ত্বের জন্য প্রয়োজনীয় গাণিতিক সত্যতা নিশ্চিত হয় না।
কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডাইনামিকস তত্ত্বটি প্রতিসাম্য ভাঙনের এ ঘটনার ব্যাখ্যা করে না। কিন্তু স্পষ্ট দেখা যায়, এ ধরনের ক্ষেত্র রয়েছে, যেগুলো এসব উপপাদ্য বা সংশ্লিষ্ট স্বতঃসিদ্ধ মেনে চলে না। তখন এ ধরনের ক্ষেত্র প্রবর্তনের পথ তৈরি হয়। নাম্বুর বলা প্রতিসাম্য ভাঙার বিষয়টির সঙ্গে এটা খাপ খেয়ে যায়।
সপ্তাহান্তের এক ছুটির দিনে আমি ধীরে ধীরে বুঝতে পারি, আমি দুটি জিনিস জানি। এদের এক করতে হবে। কিছুদিন আগেই আমি জুলিয়ান শোয়িঙ্গারের একটি গবেষণাপত্র পড়েছিলাম। ভদ্রলোক কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রোডাইনামিকসের জন্য নোবেল পুরস্কার জয়ীদের একজন। যতটুকু মনে পড়ে, তিনি ১৯৬৫ সালে এ পুরস্কার পান। তাঁর তত্ত্বের ধরনটা ছিল একটু আলাদা। এতে এমন কিছু সমীকরণ তৈরি হয়, যেগুলো আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের নিয়ম লঙ্ঘন করে। তবে এতে পদার্থবিজ্ঞানের [মূল বিষয়গুলো] প্রভাবিত হয় না। প্রচলিত ধারার গণিতের উদ্ভট একধরনের রূপ ছিল ওদের এ কাজ। জুলিয়ানের এই গবেষণাপত্র পড়েই আমি বুঝতে পারি, কী করা উচিত। তবে এটা হুট করে হয়ে যায়নি। তখন সপ্তাহান্তের ছুটি। আমাকে তাই সোমবার অফিসে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হলো যে আমি আসলে ভুল কিছু করিনি।
প্রশ্ন: আপনার আদর্শ (রোল মডেল) কে?
পিটার হিগস: হাইস্কুলে পদার্থবিজ্ঞানে আমার তেমন আগ্রহ ছিল না। গণিত ও রসায়নে ভালো ছিলাম। বিশেষ করে রসায়নের নানা বিষয় নিয়ে বেশ উত্সাহী ছিলাম আমি। পদার্থের আণবিক গঠনে বিভিন্ন স্তরের কথা জেনেছিলাম। ধীরে ধীরে জানতে পারি, পদার্থের আরও গভীর স্তর রয়েছে। জানতে পারলাম, সে সব পদার্থবিজ্ঞানে আলোচনা করা হয়। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে আকর্ষণীয় কিছু জিনিস খুঁজে পেলাম তখন। আমাকে প্রভাবিত করলেন পল ডিরাক। প্রায় এক শতাব্দী উনি আগে আমার স্কুলে পড়তেন। ১৯২০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে কোয়ান্টাম মেকানিকসের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। তাঁর সম্পর্কে আমি কৌতূহলী ছিলাম। প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের কৃতিত্বের কথা উঠে এলেই বারবার তাঁর নাম ঘুরে-ফিরে আসত। এই কৌতূহল থেকেই আমি পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞান (অ্যাটমিক ফিজিকস) ও কোয়ান্টাম তত্ত্ব সম্পর্কে পড়তে শুরু করি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে, জাপানে বোমা ফেলার কিছুকাল পরেই আমার হাইস্কুল অধ্যায় শেষ হয়। তখন ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের দুই অধ্যাপক কিছু পাবলিক লেকচারের আয়োজন করেন। একজন ছিলেন তাত্ত্বিক, আরেকজন ছিলেন পরীক্ষণবিদ বা এক্সপেরিমেন্টালিস্ট। আমি তখন কিছু লেকচার শুনতে গিয়েছিলাম। যুদ্ধের বোমা তৈরির প্রেক্ষাপট কী ছিল, তা জনসাধারণকে জানানোর জন্য এসব বক্তৃতার আয়োজন করা হয়। দারুণ সফল বক্তৃতা সিরিজ ছিল সেটা। পরীক্ষণ-পদার্থবিদের নাম ছিল সিসিল পাওয়েল। তিনি এক্সপেরিমেন্টাল কণাপদার্থবিজ্ঞানে কাজ করতেন। সেই সময়ে এ ধরনের পরীক্ষার জন্য বেলুনের সাহায্যে বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তরে ফটোগ্রাফিক ইমালশনের প্যাকেজ পাঠানো হতো। তিনি তাঁর নিজের কাজ সম্পর্কে বক্তৃতা দেন। আমি তাঁর কাছ থেকে কণাপদার্থবিজ্ঞানের পরীক্ষণ সম্পর্কে অনেক কিছু শিখেছি। তাঁর লেকচার আমাকে বুঝতে সাহায্য করেছিল যে আমি কী করতে চাই।
প্রশ্ন: নোবেল পুরস্কারের খবর পাওয়ার সময় কী করছিলেন?
পিটার হিগস: যখন পুরস্কার ঘোষণা করা হয়, তখন আমি বাড়িতে ছিলাম না। ইচ্ছা করেই বাইরে ছিলাম। নোবেল ফাউন্ডেশন বা একাডেমির কাউকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছিলাম না। তবে গণমাধ্যমের দৃষ্টি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছিলাম। আমার ধারণা ছিল, ওরা আমাকে দ্রুতই অনুসরণের চেষ্টা করবে। পুরস্কারের ঘোষণা হয়তো সকাল সাড়ে এগারোটায় দেওয়ার কথা। আমি সকাল এগারোটায় বেরিয়ে পড়লাম। দুপুরের খাবারের জন্য চলে গেলাম এডিনবার্গের বন্দর এলাকায়। তারপর একটা চিত্রকর্ম প্রদর্শনীতে গেলাম। বাড়িতে ফিরে এলাম প্রায় দুপুর তিনটার দিকে।
খবরটা আমাকে প্রথম জানায় আমার এক প্রতিবেশি। আমি হেঁটে বাড়ি ফিরছিলাম। প্রতিবেশি তার গাড়ি থামিয়ে আমাকে জানায়। সে রাস্তা পেরিয়ে বলল, ‘তোমাকে অভিনন্দন। আমার মেয়ে এই পুরস্কারের কথা বলতে লন্ডন থেকে আমাকে ফোন করেছিল।’ তখন জিজ্ঞেস করলাম, ‘কীসের পুরস্কার?’ সেই প্রতিবেশীর কাছ থেকে প্রত্যাশিত উত্তরই পেলাম। বাড়ি ফিরে ফোন-বার্তায় সেই খবর আবার পাই আমি।