প্রকৃতির রহস্যময় ধ্রুবক

সূর্য গ্রহগুলোকে কক্ষপথে ঘুরতে বাধ্য করছে মহাকর্ষ বল প্রয়োগ করে
আমাদের অস্তিত্বের জন্য খুব তাত্পর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, এমন অনেক কিছু সম্বন্ধে আমরা প্রায় কিছুই জানি না। একটা মাছ যে পানিতে সারা জীবন ধরে সাঁতরে বেড়ায়, সে পানি সম্বন্ধে কী-ইবা জানে?

পরের কথাগুলো আলবার্ট আইনস্টাইনের। আমাদের অবস্থা অনেকটা ওই মাছের মতোই। যে মহাবিশ্বে আমাদের সারাটি জীবন কাটে, তার প্রায় কিছুই জানি না আমরা। আবার অনেক বিষয় আছে, যেগুলো সম্বন্ধে আমরা অহরহ কথা বলি, কিন্তু ঠিক বুঝে উঠতে পারি না যে এই বিষয়গুলো প্রকৃতপক্ষে কী বোঝায়? এর মধ্যে একটি হচ্ছে প্রাকৃতিক ধ্রুবক। বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীরা অহরহই এসব ধ্রুবক ব্যবহার করে থাকে, জিজ্ঞেস করলে ধ্রুবকগুলোর মান ও একক মুখস্থ বলে দিতে পারে। কিন্তু এই ধ্রুবকগুলোর কাজ কী, কেন এবং কীভাবে এই ধ্রুবকগুলো এসব সূত্রের সঙ্গে সংযুক্ত হলো, এগুলো আদৌ কোনো অর্থ বা তাত্পর্য বহন করে কি না, করলে সেটা কী—এসব সম্বন্ধে খুব কমই কথা হয়। অথচ আমাদের অস্তিত্বের জন্য এই ধ্রুবকগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। দু-একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীরা স্কুল থেকেই নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রের সঙ্গে পরিচিত। এই সূত্রে বলা হয়েছে, মহাবিশ্বের যেকোনো স্থানে অবস্থিত দুটো ভরবিশিষ্ট বস্তু (তা সে মানুষই হোক আর পাথরই হোক) পরস্পরকে একটি বল দিয়ে আকর্ষণ করে, এই বলের নাম মহাকর্ষ বল। এই বল বস্তু দুটোর ভরের গুণফলের সমানুপাতিক এবং এদের মধ্যকার দূরত্বের  বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। গাণিতিক সমীকরণে লিখলে এই সূত্রটির চেহারা দাঁড়ায় এ রকম—

এখানে m1 ও m2 হচ্ছে যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় বস্তুর ভর এবং r হচ্ছে পরস্পরের মধ্যে দূরত্ব। আর G হলো মহাকর্ষীয় ধ্রুবক, যার মান: G = 6.67 x10-11 Nm2kg-2

গাছ থেকে যে আম নিচের দিকেই পড়ে, পাখির মতো উড়ে যায় না বা উঁচু জায়গা থেকে লাফ দিলে মানুষ যে আকাশে না উঠে ভূপতিত হয়, তার কারণ পৃথিবী এবং ওই আমটি বা মানুষটির মধ্যে ক্রিয়াশীল মাধ্যাকর্ষণ বল। এসব কথা সবারই জানা। তবু এ প্রসঙ্গের অবতারণা করা হলো একটি প্রশ্ন উত্থাপন করার জন্য। নিউটনের সূত্রে দুটো ভরবিশিষ্ট বস্তুর কথা বলা হয়েছে, এর মধ্যে একটিকে পৃথিবীই হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। যেকোনো দুটো বস্তু হলেই চলবে। এবার দুজন মানুষের কথা ভাবা যাক। দুজনেরই তো ভর আছে, ধরা যাক একজনের ৭০ কেজি, আরেকজনের ৬০ কেজি, তাহলে নিয়ম অনুযায়ী তারা পরস্পরের মধ্যে আকর্ষণ বলটি অনুভব করে না কেন? বলটি কি এ ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় থাকে? না, থাকে না। নিষ্ক্রিয় থাকার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, নিষ্ক্রিয় থাকলে প্রকৃতির নিয়ম লঙ্ঘিত হয়—প্রকৃতি কিছুতেই তার নিয়ম লঙ্ঘন করতে দেয় না। তাহলে বলটি অনুভূত না হওয়ার কারণ কী? অনুভূত যে হয় না তার প্রমাণ তো আমরা নিজেরাই। দুজন কি দশ জন পাশাপাশি বা মুখোমুখি বসে বা দাঁড়িয়ে থাকলেও তো আমরা মাধ্যাকর্ষণের টানে পরস্পরের দিকে এগিয়ে যাই না! রহস্যটি আসলে কোথায়? একজন আরেকজনের হাত ধরে টান দিলে যেখানে এগিয়ে যেতে বাধ্য হই আমরা (এই টানও একধরনের বল, তবে তা মহাকর্ষ বল নয়), সেখানে এই বলটির অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও আমরা অনুভব করি না কেন? করি না, কারণ, এই বলটি অতিমাত্রায় দুর্বল। এত দুর্বল যে বাস্তব ক্ষেত্রে তাকে প্রায় শূন্য বলেই ধরে নেওয়া হয় (যদিও পৃথিবীর সঙ্গে অন্য কোনো বস্তুর আকর্ষণটি দুর্বল নয়, কারণ পৃথিবীর ভর অত্যন্ত বেশি, আর দুর্বল নয় বলেই বস্তু ভূপতিত হয়, উড়ে চলে যায় না)। আর এই বল দুর্বল হওয়ার জন্য দায়ী একটি ধ্রুবক, G, যার নাম বিশ্বজনীন মহাকর্ষ ধ্রুবক।

নিঊটনের বিখ্যাত মহাকর্ষ সূত্র দিয়ে দুটি বস্তুর আকর্ষণ বলের ব্যাখ্যা দেওয়া যায়

এই ধ্রুবকের মান অত্যন্ত ক্ষুদ্র (১-এর পিঠে ১১টি শূন্য বসালে যে সংখ্যাটি পাওয়া যায়, অর্থাত্ এক লক্ষ কোটি, সেই সংখ্যা দিয়ে ৬.৬৭ সংখ্যাটিকে ভাগ দিলে যে ভাগফল পাওয়া যাবে, এই ধ্রুবকের মান সেটাই। ভেবে দেখুন, এত বড় একটি সংখ্যা দিয়ে ৬.৬৭-কে ভাগ দিলে ভাগফলটি কী সাংঘাতিক ক্ষুদ্র হয়ে যায়!)। প্রশ্ন হলো, এই ধ্রুবকের মান কি নিউটন নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন? না, এই ধ্রুবক প্রকৃতিরই সৃষ্টি, মহাবিশ্বের জন্মলগ্নেই এই ধ্রুবক নির্ধারিত হয়েছিল, নিউটন শুধু সেটা আবিষ্কার করেছিলেন। বিজ্ঞান এখন অনেকখানিই তত্ত্ব, পরীক্ষণ এবং প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে, দার্শনিক দিকটি প্রায় উপেক্ষিত। ফলে এসব আলোচনা এখন আর হয় না বললেই চলে। নইলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠত, এই ধ্রুবকের মান এত ক্ষুদ্র কেন? যদি বলি, এই মহাবিশ্বের নানা ধরনের ভরবিশিষ্ট পদার্থগুলোর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতেই এ কাজটি করা হয়েছিল, তাহলে কি খুব ভুল বলা হবে? আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলি, পৃথিবী নামের অতি সামান্য একটি গ্রহে একদিন প্রাণের উদ্ভব ঘটিয়ে তাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করাই হয়তো এই ধ্রুবকের কাজ। আর এই বল আছে বলেই গ্রহগুলো সূর্যের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যদি না ঘুরত, দিন-রাত হতো কীভাবে বা ঋতু পরিবর্তনই বা হতো কীভাবে? সোজা কথায়, প্রাণের উদ্ভবই অসম্ভব হয়ে পড়ত। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, মাধ্যাকর্ষণ সূত্রটিও প্রকৃতিরই সৃষ্টি (নিউটন শুধু সেটা আবিষ্কার করেছিলেন)। এই আকর্ষণ বল না থাকলে মানুষ পৃথিবীতে থাকতেই পারত না। আমরা যে মাটিতে হেঁটে বেড়াচ্ছি তার কারণ তো ওই আকর্ষণই, নইলে তো মহাশূন্যে অবস্থিত পৃথিবী থেকে আমরাও মহাশূন্যেই ছিটকে পড়তাম! অন্যদিকে সূত্রটি কার্যকর থাকলে বলের পরিমাণ হতে পারে বৃহত্, ফলে ধ্রুবকটি এমন হলো, যেন দু-কূলই রক্ষা হয়। অর্থাত্, এই প্রাণিকুল যেন পৃথিবীতে বাস করতে পারে, কিন্তু পরস্পরের প্রতি কোনো আকর্ষণ বল অনুভব না করে। আরেকটি কথা বলে এই প্রসঙ্গ শেষ করি, ধ্রুবকটির মান যদি অতখানি ক্ষুদ্র না হয়ে আরেকটু বড় হতো, তাহলে দুজন মানুষের মধ্যে আকর্ষণ বল হতো এতই প্রবল যে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা বা বসে থাকা তাদের পক্ষে অসম্ভব হতো, বরং অপ্রতিরোধ্য এক টানে তারা পরস্পরের সঙ্গে লীন হয়ে যেত। কিংবা একজন মানুষ চেয়ারে বসলে সেখান থেকে আর উঠতে পারত না বা চায়ের কাপ ঠোঁটে ছোঁয়ালে সেটাকে আর ঠোঁট থেকে সরাতে পারত না! এসব দুর্ঘটনা যেন না ঘটতে পারে, সে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল সেই সুদূরতম অতীতে—মহাবিশ্বের জন্মলগ্নে, বিশ্বজনীন মহাকর্ষ ধ্রুবকের ওই মানটি নির্ধারণের মাধ্যমে।

মহাকর্ষ সূত্রের মতোই আরেকটি সূত্র হলো কুলম্বের সূত্র। এই সূত্রের দ্বারা দুটো চার্জের মধ্যে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বল নির্ণয় করা যায়। এই বল চার্জ দুটোর গুণফলের সমানুপাতিক এবং এদের মধ্যকার দূরত্বের ব্যস্তানুপাতিক। সূত্রটির গাণিতিক রূপ এ রকম:

যেখানে q1 ও q2 হচ্ছে যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় বস্তুর চার্জ এবং r হচ্ছে পরস্পরের মধ্যে দূরত্ব। আর k  হলো একটি ধ্রুবক, যার মান k = 8.988 x 109 Nm2C-2। অবশ্য স্কুল-কলেজের বইতে এর মান

9 x 109 Nm2C-2  লেখা। কিন্তু এই মানটি আরও সূক্ষ্ম। ধ্রুবক k-কে আবার আরেকটি ধ্রুবকের দ্বারা লেখা যায়, যার নাম অভেদ্যতা ধ্রুবক ε,

যেখানে ε= 8.85 x 10-12 C2Nm-2

এই ধ্রুবকগুলোও খুব তাত্পর্যপূর্ণ অর্থ বহন করে। আমরা সবাই এখন এ কথা জেনে ফেলেছি যে মহাকর্ষ বল খুব দুর্বল হলেও বৈদ্যুতিক বলটি বেশ শক্তিশালী। সেটি ধ্রুবক শ-এর মান দেখেই বোঝা যায়। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে এই বল শুধু চার্জিত বস্তুর মধ্যেই কাজ করে, চার্জনিরপেক্ষ বস্তুর ক্ষেত্রে এই বলের কোনো প্রভাব নেই। আর সে জন্যই এই শক্তিশালী বলটি আমরা অনুভব করি না। কথাটি যেন কেমন শোনাচ্ছে! কারণ, আমাদের সবার মধ্যেই তো চার্জ আছে! শুধু আমরাই নই, সব বস্তুই যেহেতু পরমাণু দিয়ে গঠিত এবং পরমাণুগুলো আবার ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন দিয়ে গঠিত এবং ইলেকট্রন ও প্রোটন যেহেতু চার্জবাহী কণা, অতএব এটা নিঃসন্দেহেই বলা যায়, প্রতিটি বস্তুর মধ্যেই বিপুল পরিমাণ চার্জ আছে। তাহলে বলটি কাজ করে না কেন? কারণ, সৌভাগ্যক্রমে প্রতিটি পরমাণুতে ইলেকট্রন ও প্রোটনের সংখ্যা সমান বলে সব মিলিয়ে বস্তুটি চার্জনিরপেক্ষ হয়ে যায়। আর আগেই বলেছি, চার্জনিরপেক্ষ বস্তুর ক্ষেত্রে এই বল কাজ করে না। মনে কি হচ্ছে না, ওই ধ্রুবকটি অত বড় হওয়ার কারণেই বস্তুগুলো চার্জনিরপেক্ষ হিসেবে গঠিত হয়েছে? কিন্তু সে ক্ষেত্রে আরেকটি প্রশ্নও জাগে, ওই ধ্রুবকটি অত বড় করে তৈরি করার কী দরকার ছিল? এর তাত্পর্যই বা কী? প্রয়োজন নিশ্চয়ই ছিল! প্রয়োজন ছাড়া প্রকৃতি কোনো কিছুই করে না। আর এই প্রয়োজনটি বোঝার জন্য আমাদের বিদ্যুত্প্রবাহ নিয়ে কথা বলতে হবে।

আমরা সবাই ইলেকট্রনের প্রবাহকেই বিদ্যুত্প্রবাহ হিসেবে জানি। আমাদের পাঠ্যবইগুলোতেও তা-ই লেখা থাকে। কিন্তু আমরা সচরাচর কথাটির মানে বুঝতে চাই না। ইলেকট্রনের প্রবাহ মানে কী? বিদ্যুৎ প্রবাহের সময় ইলেকট্রন কি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় প্রবাহিত বা স্থানান্তরিত হয়? আমরা সুইচ টিপে যখন বাতি জ্বালি বা ফ্যান ঘোরাই, তখন কি সুইচ থেকে বাতি বা ফ্যান পর্যন্ত ইলেকট্রন প্রবাহিত হয়? না, তা হয় না। হলে সুইচ টেপার কয়েক ঘণ্টা পর বাতি জ্বলে উঠত বা ফ্যান ঘুরতে শুরু করত! কেন বলছি এ কথা? কারণ, ইলেকট্রনের গতিবেগ অত্যন্ত কম। এক সেকেন্ডে একটি ইলেকট্রন এক মিটারের ১০ হাজার ভাগের এক ভাগ অতিক্রম করে মাত্র। কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে আমরা যদি ঢাকায় বিদ্যুৎ নিয়ে আসতে চাই, আর বিদ্যুত্প্রবাহের অর্থ যদি হয় ইলেকট্রনের প্রবাহ, তাহলে ওই বেগে ইলেকট্রন আসতে সময় লাগবে প্রায় ৫০ বছর! অবাক লাগছে না? আমি কিন্তু কোনো গাঁজাখুরি গল্প করছি না। এই ফলাফল খুবই সহজ একটি অঙ্ক করে দেখানো যায়। আমরা তো বিদ্যুৎ পাই মুহূর্তের মধ্যে, ৫০ বছর দূরে থাক, ৫ সেকেন্ডও সময় লাগে না। রহস্যটি কোথায়? বিদ্যুত্প্রবাহের অর্থ যে ইলেকট্রনের স্থানান্তর নয়, সেটা তো নিশ্চয়ই বোঝা গেছে! আসলে কী ঘটে? যা ঘটে তা বলার জন্য বৈদ্যুতিক প্রাবল্য ও চৌম্বক প্রাবল্য নিয়ে কথা বলার দরকার হবে। আমরা জানি, একটি চার্জ একটি স্থানে যে প্রভাব সৃষ্টি করে, তাকেই সহজ ভাষায় বৈদ্যুতিক প্রাবল্য  বলা হয়। গাণিতিক সমীকরণে এই প্রাবল্য এভাবে দেখানো যায়,  E = k (q/r2)।

এই সমীকরণের সঙ্গে বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীরা অল্প বয়সেই পরিচিত হয়। একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে বুঝে নিতে হবে যে স্থির অথবা গতিশীল দুই ধরনের চার্জই এই প্রাবল্য তৈরি করতে পারে। তবে স্থির চার্জ বৈদ্যুতিক প্রাবল্য তৈরি করতে পারলেও চৌম্বক প্রাবল্য তৈরি করতে পারে না। অন্যদিকে চার্জ গতিশীল হলে বৈদ্যুতিক প্রাবল্যের সঙ্গে সঙ্গে চৌম্বক প্রাবল্যও তৈরি হয়। তো এই চৌম্বক প্রাবল্যকে গাণিতিক সমীকরণে এভাবে প্রকাশ করা যায়— B = k' (qv/r2)। এখানে k/ হচ্ছে আরেকটি ধ্রুবক, যার মান K' = 10-7TmA-1

ধ্রুবক k/ কে আবার আরেকটি ধ্রুবকের দ্বারা লেখা যায়, যার নাম অভেদ্যতা ধ্রুবক u0

উল্লেখ্য, T = Tesla = NA-1m-1 হলো চৌম্বক প্রাবল্যের একক।

এর মানে দাঁড়াল এই যে যখন একটি চার্জ গতিশীল হয়, তখন সংশ্লিষ্ট স্থানে একই সঙ্গে বৈদ্যুতিক প্রাবল্য ও চৌম্বক প্রাবল্য সৃষ্টি হয়। এই দুই প্রাবল্য মিলে একটি ঢেউ তৈরি করে, যার নাম বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ। বিদ্যুতের প্রবাহ আসলে এই তরঙ্গের প্রবাহ, যা বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় শক্তি বহন করে নিয়ে যায়। মজার ব্যাপার হলো, এই তরঙ্গের গতিবেগ নির্ণয় করা যায় ওই দুটো ধ্রুবক k ও k’-এর সমন্বয় করে। সমন্বয়টি হবে এ রকম—

এখানে c = 3 x 108 m/s  হলো আলোর গতিবেগ।

[একইভাবে আরেকটি সম্পর্কও দেখানো যায়:

অর্থাৎ বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ আলোর বেগে প্রবাহিত হয়! আমরা তো এখন অহরহ বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ ব্যবহার করে থাকি। রেডিও ও টেলিভিশন সম্প্রচারে, টেলিফোন যোগাযোগে, ইন্টারনেট যোগাযোগে বিদ্যু্ৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গের ব্যবহার করা হয় বলেই এই যোগাযোগগুলো এত দ্রুতগতির। আমরা যে টেলিফোনে কথা বলি, কখনো কি ভেবে দেখেছি, শব্দের বেগ এত কম অথচ টেলিফোনের শব্দ এত দ্রুত পৌঁছায় কীভাবে? ধরা যাক, ঢাকা থেকে একজন লোক চট্টগ্রামের একজন লোকের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে চাইছে। এই দুই শহরের মধ্যে যে দূরত্ব, তাতে ঢাকার লোকটি ‘হ্যালো’ বলার প্রায় ১৬ মিনিট পর চট্টগ্রামের লোকটি সেটি শুনতে পাবে (যেহেতু শব্দের গতি ৩৪০ মি./সে), তারপর সে-ও ‘হ্যালো’ বলবে এবং ঢাকার লোকটি আবার ১৬ মিনিট পর সেটা শুনতে পাবে! অর্থাত্, এক ‘হ্যালো’র উত্তর শুনতেই ৩২ মিনিট! এ রকম করুণ অবস্থা হলে আমরা নিশ্চয়ই টেলিফোন ব্যবহার করতাম না, হ্যালো বলে কে-ই বা ৩২ মিনিট অপেক্ষা করতে চায়! বলা বাহুল্য, এত সময় তো লাগেই না, বরং মুহূর্তের মধ্যে আমরা পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে সংযোগ স্থাপন করতে পারি। তার কারণ, এই শব্দকে বহন করে নি৬েয় যায় ওই বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ। এই তরঙ্গ ব্যবহারের কারণেই যোগাযোগব্যবস্থার এমন অসামান্য উন্নতি ঘটেছে। যদি বলি, এই মহাবিশ্বের পৃথিবী নামের অতি সামান্য একটি গ্রহে একদিন প্রাণের উদ্ভব ঘটিয়ে তাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে যে প্রকৃতি মহাকর্ষীয় ধ্রুবকের মান ওরকমভাবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল, সেই প্রকৃতিই চেয়েছিল যেন মানুষ যোগাযোগের এই পদ্ধতিটি আবিষ্কার করুক—তাহলে কি খুব ভুল বলা হবে? আর যদি তা-ই না হবে, তাহলে ওই ধ্রুবকগুলো এমনভাবে নির্ধারিত হয়েছিল কেন, যেন দুটোর সমন্বয়ে আলোর বেগ তৈরি হয়! আবার সেটি করতে হলে বস্তুগুলোকেও তৈরি করতে হয় চার্জনিরপেক্ষভাবে, যেন তীব্র ও শক্তিশালী বৈদ্যুতিক বলটি বস্তুগুলোর ওপর কাজ না করে!

এমন উদাহরণ আরও অনেক দেওয়া যায় এবং বলা যায় এ কথাই যে আমাদের এই দৃশ্যমান (এবং দৃশ্যাতীত) মহাবিশ্ব প্রকৃতির এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনারই ফসল। আর সেই পরিকল্পনার খানিকটা প্রকাশ ঘটেছে ধ্রুবক নির্বাচনের প্রক্রিয়াতে। আমরা তো অহরহই এই ধ্রুবকগুলো নিয়ে কাজ করি, এখন থেকে না হয় এগুলোর তাত্পর্য নিয়েও একটু চিন্তা করে দেখি!

লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ইনডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা