বিদ্যুৎ ছাড়া আধুনিক জীবন কল্পনা করা কঠিন। ঘরে বাতি, পাখা কিংবা কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন—বিদ্যুতের ব্যবহার সবখানে। কখনো ভেবেছেন, এই বিদ্যুৎ বা ইলেকট্রিসিটি আবিষ্কার করলেন কে? একটু ভেবে দেখলেই বুঝবেন, বৈদ্যুতিক বাতির উদ্ভাবকের নাম আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু বিদ্যুতের আবিষ্কারক কে, এই প্রশ্নটির জবাব চট করে মাথায় আসছে না। স্বাভাবিক। এই প্রশ্নটির উত্তর চট করে বলা মুশকিল। কারণ, বৈদ্যুতিক বাতি বা পাখা কাউকে তৈরি করতে হয়েছে। কিন্তু বিদ্যুৎ জিনিসটা মানুষকে উদ্ভাবন করতে হয়নি। শক্তির এই বিশেষ অবস্থাটি প্রকৃতিতে সব সময়ই ছিল। মানুষ শুধু খুঁজে বের করেছে।
হ্যাঁ, বিদ্যুৎ বা তড়িৎ শক্তির একটি রূপ। আরও অনেক রূপ আছে প্রকৃতির। যেমন তাপ, আলো, শব্দ ইত্যাদি। এগুলো প্রকৃতিতে আগে থেকেই আছে।
প্রকৃতিতে আগে থেকেই আছে, এমন কিছু খুঁজে বের করাকে বলে আবিষ্কার করা। ইংরেজিতে বলে ডিসকভারি। আর প্রকৃতিতে সরাসরি নেই, বানাতে হয়েছে—এরকম কিছু তৈরি করাকে বলা হয় উদ্ভাবন বা ইনভেনশন। উদ্ভাবকের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া অনেক সময় সহজ, কিন্তু আবিষ্কারকের ব্যাপারে অত দ্রুত নিশ্চিত হওয়ার উপায় থাকে না। কারণ পৃথিবীর নানা প্রান্তে বিভিন্ন সময় মানুষ প্রকৃতির রহস্য খুঁজে বের করেন। প্রয়োজনে সেটাকে আরও উন্নত বা ব্যবহারযোগ্য করে তোলেন। আর উদ্ভাবন করা হয় সাধারণত মানুষের প্রয়োজন বা ব্যবহারের কথা মাথায় রেখে।
আধুনিক পৃথিবীতে বিদ্যুৎ আবিষ্কারের জন্য মার্কিন বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও রাজনীতিবিদ বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিনকে বেশিরভাগ কৃতিত্ব দেওয়া হয়। ১৭৫২ সালে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে তিনি ভয়ংকর একটা পরীক্ষা করেন।
আমরা সবাই বোধ হয় জানি, বিদ্যুৎশক্তি উৎপন্ন হয় মূলত ইলেকট্রিক চার্জ বা ইলেকট্রনের শক্তিপ্রবাহের কারণে। ইলেকট্রন স্থানান্তরিত হয় না, এর মধ্য দিয়ে একধরনের শক্তি প্রবাহিত হয় শুধু। এটাই বিদ্যুৎশক্তি। আগেও বলেছি, আজকের আধুনিক জীবনের চালিকাশক্তি এই বিদ্যুৎ। প্রশ্নটা হলো, এই বিদ্যুৎ শক্তি কে আবিষ্কার করেন সবার আগে? অর্থাৎ কে প্রথম বিদ্যুৎ খুঁজে পান?
আধুনিক পৃথিবীতে বিদ্যুৎ আবিষ্কারের জন্য মার্কিন বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও রাজনীতিবিদ বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিনকে বেশিরভাগ কৃতিত্ব দেওয়া হয়। ১৭৫২ সালে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে তিনি ভয়ংকর একটা পরীক্ষা করেন। হাতে-কলমে পরীক্ষণের উদ্দেশ্যে বজ্রঝড়ের সময় ঘুড়িতে তার বেঁধে উড়িয়ে দেন। তাতে দেখতে পান, বজ্রের মাঝে আছে বিদ্যুতের উপস্থিতি।
তবে শুধু এজন্য তাঁকে বিদ্যুৎ আবিষ্কারের পুরো কৃতিত্ব দেওয়া যায় না। আসলে এককভাবে কাউকেই এ কৃতিত্ব দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ হাজার বছর ধরে বিদ্যুতের অস্তিত্ব খুঁজে বের করার পেছনে শ্রম দিয়েছেন আরও অনেকে। কালে কালে তাঁদের সবার গবেষণার ফল আমাদের আজকের আধুনিক ব্যবহারযোগ্য বিদ্যুৎ।
প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক থেলিস প্রথম আবিষ্কার করেন, পশুর লোমের সঙ্গে অ্যাম্বার ঘষলে দুটি বস্তুই পরস্পরকে আকর্ষণ করে। এই অ্যাম্বার জিনিসটা কী? গাছ থেকে একধরনের তরল আঠা বের হয়। কালের আবর্তে এই আঠা শুকিয়ে স্ফটিকের মতো হয়ে যায়, পরিণত হয় জীবাশ্মে। এই জীবাশ্মকেই বলা হয় অ্যাম্বার। যাহোক, অনেকটা না জেনেই বিদ্যুৎচুম্বকীয় প্রভাব ও স্থির বিদ্যুৎ পর্যবেক্ষণ করেন থেলিস। ঐতিহাসিকদের মতে, তিনি প্রাচীন গ্রিসের মিলেটাস শহরের মানুষ ছিলেন। আর এ ঘটনা ঘটেছিল ৬২৪ থেকে ৫৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে। কারণ বিজ্ঞানীদের ধারণা, তিনি এ সময়কালের মানুষ।
সতের শতকের শুরুতে ইংরেজ বিজ্ঞানী উইলিয়াম গিলবার্ট তাঁর দে ম্যাগনেতে বইতে প্রথমবারের মতো ‘Electricus’ (ইলেকট্রিকাস) শব্দটি ব্যবহার করেন। মানে, অ্যাম্বারের মতো। অ্যাম্বারের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতেই এ শব্দের অবতারণা। এখানে ভাষাগত একটা মজার চক্র আছে।
অষ্টদশ শতকের শুরুর দিকে আরেক ইংরেজ বিজ্ঞানী স্টিফেন গ্রে বিদ্যুৎ পরিবাহী বা কন্ডাকটর এবং অন্তরক পদার্থ বা ইনসুলেটর আবিষ্কার করেন। পাশাপাশি বিদ্যুৎ যে তারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, এ বিষয়টিও তাঁর আবিষ্কার।
ইলেকট্রিকাস শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ ইলেকট্রাম (Electrum) থেকে। ইলেকট্রামের মূল শব্দ হলো গ্রিক শব্দ ইলেকট্রন (ἤλεκτρον)। ইলেকট্রাম বা ইলেকট্রন—দুটো শব্দের অর্থই আসলে অ্যাম্বার। এই ‘ইলেকট্রন’ শব্দটি গ্রিক ভাষায় ঠিক কোথা থেকে এসেছে, তা নিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না। ধারণা করা হয় ফিনিশিয়ান ভাষা থেকে এসেছে। সে ভাষাতেও মূল শব্দ ওটাই—ইলেকট্রন (elēkrŏn)। এর অর্থ, উজ্জ্বল আলো। যাহোক, পরে ১৬৪৬ সালে ইংরেজ বিজ্ঞানী টমাস ব্রাউন শব্দটাকে সামান্য পরিবর্তন করে ‘Electricity’ (ইলেকট্রিসিটি) করেন। আজকের দিনে বিদ্যুৎ বোঝাতে ইংরেজিতে এই শব্দটিই ব্যবহার করা হয়। যার বাহককণা হিসেবে আবার ফিরে আসে মূল শব্দটি—ইলেকট্রন। যাই হোক, প্রসঙ্গে ফিরি।
এর কিছুদিন পরেই গিলবার্ট ও ব্রাউনের কাজের ওপর ভিত্তি করে জার্মান বিজ্ঞানী অটো ভন গুয়েরিক জটিল কোনো যন্ত্র ছাড়াই উৎপাদন করেন স্থির বিদ্যুৎ। নিজের হাত দিয়ে ঘূর্ণমান সালফারের বল ঘষে তিনি এ বিদ্যুৎ তৈরি করেন।
অষ্টদশ শতকের শুরুর দিকে আরেক ইংরেজ বিজ্ঞানী স্টিফেন গ্রে বিদ্যুৎ পরিবাহী বা কন্ডাকটর এবং অন্তরক পদার্থ বা ইনসুলেটর আবিষ্কার করেন। পাশাপাশি বিদ্যুৎ যে তারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, এ বিষয়টিও তাঁর আবিষ্কার।
১৭২৫ সালে অ্যাওয়াল্ড জর্জ ভন ক্লিস্ট ও পিটার ভ্যান মুশেনব্রোক ‘লিডেন জার’ উদ্ভাবন করেন। বিদ্যুতকে বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার এটি। লিডেন জারের প্রধান উপদান একটি কাচের বয়াম। এর ভেতরে ও বাইরে থাকে ধাতব পাতের আবরণ। বিদ্যুৎ সংরক্ষণ করা যেত এ যন্ত্রে।
বিজ্ঞানী উইলিয়াম ওয়াটসন, হেনরি ক্যাভেন্ডিস এবং চার্লস কুলম্বসহ আরও অনেক বিজ্ঞানী লিডেন জার ব্যবহার করে বিদ্যুৎ নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। এসবই বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের ঘুড়ি ওড়ানোর আগের ঘটনা।
এতক্ষণ যাঁদের কথা বলা হলো, তাঁরা সবাই কমবেশি পরিচিত ও বিখ্যাত ব্যাক্তি। এ ছাড়াও পৃথিবীর নানা প্রান্তে যুগে যুগে বিদ্যুৎ নিয়ে কাজ করেছেন আরও অনেকে। সময়ের প্রবাহে তাঁদের নাম হারিয়ে গেছে, পৃথিবী ভুলে গেছে তাঁদের অবদানের কথা।
১৭৫২ সালে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন প্রমাণ করেন বজ্রে বিদ্যুৎ থাকে। বিদ্যুৎ পরিবহনের প্রভাব বুঝতে ঘুড়ির সুতোয় ধাতব চাবি বেঁধে দেন তিনি। পরীক্ষণটি সফল হয়। জনশ্রুতি আছে, তিনি ইলেকট্রিক শকও খেয়েছিলেন। বিদ্যুৎ যে শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে, তা এ পরীক্ষণ থেকেই প্রথম জানা যায়।
আরও কিছু কাল পরে ইতালিয়ান বিজ্ঞানী আলেসান্দ্রো ভোল্টা উদ্ভাবন করেন বৈদ্যুতিক ব্যাটারি। ১৮০০ সালে উদ্ভাবিত তাঁর এ ব্যাটারি ‘ভোল্টাইক পাইল’ নামেও পরিচিত। এটা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ প্রবাহ সরবহার করতে পারত। বিদ্যুতের বর্তমান অবস্থানের পেছনে তাঁর আবিষ্কারের ভূমিকা অনেক।
এরপরেই মঞ্চে এলেন মাইকেল ফ্যারাডে। ইংরেজ এই বিজ্ঞানী প্রথমবারে মতো দেখলেন, পরিবর্তনশীল চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। এ বিষয়টিকে বলা হয় ইন্ডাকশন বা তড়িৎচৌম্বকীয় আবেশ। বিদ্যুৎ ও চুম্বকের মধ্যকার এ সম্পর্ক আবিষ্কার করেই তিনি থেমে যাননি, সূত্র হিসাবে প্রকাশ করেন বিষয়গুলোকে। ফ্যারাডের এসব সূত্র ইলেকট্রিক জেনারেটর ও ট্রান্সফরমারের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। মাইকেল ফ্যারাডের মৃত্যু হয় ১৯৬৭ সালে। তারপর এ মশাল চলে যায় এডিসনের হাতে।
টমাস আলভা এডিসনের কথা সবার জানা। মার্কিন এই উদ্ভাবক বিদ্যুতের ব্যবহারিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। প্রথম কার্যকর ইলেকট্রিক বাতি তাঁরই উদ্ভাবন। তবে প্রথম ইলেকট্রিক বাতি কিন্তু তিনি উদ্ভাবন করেননি। এর উদ্ভাবক ইংরেজ রসায়নবিদ হামফ্রে ডেভি। এ ছাড়াও এডিসন প্রথম ইলেকট্রিক পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম স্থাপন করেন।
বিদ্যুতের আজকের অবস্থানের পেছনে নিকোলা টেসলার ভূমিকাও অনস্বীকার্য। সার্বিয়ান বংশোদ্ভূত মার্কিন এই উদ্ভাবক ও প্রকৌশলী বিদ্যুতের উন্নয়নে প্রচুর কাজ করেছেন। আজ আমরা বাড়িতে বা কর্মস্থলে যে অল্টারনেটিং কারেন্ট বা এসি কারেন্ট ব্যবহার করি, তার সঞ্চালন প্রক্রিয়াই মূলত বিদ্যুৎ ব্যবহারের সংজ্ঞা বদলে দেয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ পদ্ধতিতে রীতিমতো বিপ্লব ঘটান তিনি।
এতক্ষণ যাঁদের কথা বলা হলো, তাঁরা সবাই কমবেশি পরিচিত ও বিখ্যাত ব্যাক্তি। এ ছাড়াও পৃথিবীর নানা প্রান্তে যুগে যুগে বিদ্যুৎ নিয়ে কাজ করেছেন আরও অনেকে। সময়ের প্রবাহে তাঁদের নাম হারিয়ে গেছে, পৃথিবী ভুলে গেছে তাঁদের অবদানের কথা। হয়তো সেসব ইতিহাসও সামনে আসবে একদিন।
বুঝতেই পারছেন, কেন বিদ্যুৎ আবিষ্কারের কৃতিত্ব এককভাবে কাউকে দেওয়া সম্ভব নয়। আসলে শুধু বিদ্যুৎ নয়, বড় যেকোনো আবিষ্কারের পেছনেই এরকম অনেকের অবদান থাকে। মানব সভ্যতার বড় সার্থকতা এখানেই। অনেকের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই গড়ে উঠে আজকের এই জ্ঞান-বিজ্ঞান। এভাবেই পৃথিবী এগিয়ে চলে, সঙ্গে মানবজাতিও।
লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা
সূত্র: সায়েন্স ফোকাস