বিস্ফোরণ-মেঘে মৌলের খোঁজে মৃত্যু

পরমাণু বোমা বিস্ফোরিত হলো। আকাশে ধোঁয়ার মেঘ। সেই মেঘে ঢুকে পড়লেন দুঃসাহসী জিমি রবিনসন...

কিছুক্ষণের মধ্যেই এক বৈমানিক এফ-৮৪ বিমান নিয়ে প্রবেশ করবেন ভয়ংকর মাশরুম ক্লাউডের মধ্যে!

১ নভেম্বর, ১৯৫২। প্রশান্ত মহাসাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশির ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে একটি এফ-৮৪ থান্ডারজেট বিমান। ককপিটে বসে আছেন ইউএস এয়ারফোর্সের তুখোড় পাইলট ক্যাপ্টেন জিমি রবিনসন। উত্তেজনায় জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন তিনি। বাইরে যতখানি দেখা যায়, চোখে পড়ে প্রশান্ত মহাসাগরের বিস্তৃত নীল জলরাশি। সে এক অপার্থিব দৃশ্য। কিন্তু সেদিকে তাকানোর বিন্দুমাত্র ফুরসত নেই রবিনসনের। আসন্ন মিশনের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করছেন নিজেকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘটতে যাচ্ছে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে শ্বাসরুদ্ধকর অভিজ্ঞতা। ২৮ বছর বয়সী রবিনসনের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লিবারেটর বোমারু বিমানে ‘বোম্বার্ডলাইনার’ হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু এ মিশনের ঝুঁকির মাত্রার সঙ্গে যুদ্ধকালীন সেই সময়েরও তুলনা চলে না। কারণ, কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি এফ-৮৪ বিমান নিয়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন ভয়ংকর মাশরুম ক্লাউডের মধ্যে!

২.

পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণস্থলে গম্বুজ—বলা ভালো, মাশরুম আকৃতির যে ধোঁয়ার কুণ্ডলী সৃষ্টি হয়, সেটাই মাশরুম ক্লাউড নামে পরিচিত। মার্কিন বিমানবাহিনী অনেকটা আকস্মিকভাবেই আবিষ্কার করে, এই ভয়ংকরদর্শন ধোঁয়ার কুণ্ডলীর ভেতর দিয়েও বিমান চালিয়ে আসা সম্ভব। ঘটনার সূত্রপাত ১৯৪৮ সালের মে মাসে। বিমানবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল পল ফকনার একটি বি-২৯ বিমান নিয়ে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণস্থল পর্যবেক্ষণ করছিলেন। এমন সময়ে দুর্ঘটনাক্রমে তিনি মাশরুম ক্লাউডের খুব কাছে চলে যান। চ্যালেঞ্জিং কিছু ঘটনার মুখোমুখি হলেও মোটামুটি অক্ষত অবস্থায়ই দ্রুত সেখান থেকে সরে আসতে সক্ষম হন ফকনার। বিমান নিয়ে নিরাপদে ফেরেন মূল বেসে। ফিরেই গর্ব করে রিপোর্ট করেন—আমাদের কেউ মারা যায়নি, এমনকি অসুস্থও হয়নি।

সামান্য সময়ের জন্য মাশরুম ক্লাউডে প্রবেশের অভিজ্ঞতাটুকু ভীষণ উপভোগ করেছিলেন দুঃসাহসী পল ফকনার। তাই পরে আবারও এমনটা করার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে একটি বিশেষ স্কোয়াড্রন গঠনের সুপারিশ করেন তিনি। তবে এবার তিনি সেখানে যেতে চান হরেক রকম বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতিসহ যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে, যেন সঙ্গে করে নিয়ে আসা যায় ভয়ংকরদর্শন সেই মেঘের নমুনা।

মাশরুম ক্লাউড

মাশরুম ক্লাউডের মধ্য দিয়ে বৈজ্ঞানিক মিশন পরিচালনায় পারদর্শী পাইলট খুঁজে পাওয়া ছিল ভীষণ কঠিন এক কাজ। এমনিতে স্বাভাবিক অবস্থায়ও জেট বিমান সামলানো যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং। কোনোভাবে সামান্য মনোযোগ বিচ্যুতি হলেই কপালে লেখা হয়ে যায় নিশ্চিত মৃত্যু। অথচ ক্লাউডের ভেতর বৈজ্ঞানিক মিশন পরিচালনা করতে হলে পাইলটকে বিমান চালানোর পাশাপাশি মনোযোগ দিতে হবে একগাদা বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও রেকর্ডিং ডিভাইসের দিকে। একই সঙ্গে নজর রাখতে হবে কয়েকটি রেডিয়েশন পরিমাপক যন্ত্রের প্যানেলে। এগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য লিখে রাখার পাশাপাশি নিয়মিত বিরতিতে তাকে রিপোর্ট করতে হবে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থানরত বিজ্ঞানীদের কাছে। পরিষ্কার আকাশে উড়ে বেড়ানোর সময়েই এতগুলো ভিন্ন ভিন্ন ধরনের কাজ একসঙ্গে করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার! আর পারমাণবিক বিস্ফোরণের কেন্দ্রস্থলের কাছে বিক্ষুব্ধ আকাশের সীমানায় এত সব সামলে মিশনের মূল লক্ষ্য অর্জন করা যেকোনো কম অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাসম্পন্ন পাইলটের পক্ষে একরকম অসম্ভব। তবে তুখোড় পাইলট ক্যাপ্টেন জিমি রবিনসনের ঝুলিতে ছিল সফলভাবে এ রকম মিশন সমাপ্ত করে আসার মতো সাহস ও দক্ষতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একবার বুলগেরিয়ায় শত্রুপক্ষের ছোড়া গুলির আঘাতে তাঁর বিমান পৌঁছে গিয়েছিল ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। সেই বিমান ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। প্যারাস্যুট দিয়ে মাটিতে নামার সময়টুকুতে রবিনসন ছিলেন শান্ত ও ধীরস্থির। শূন্যে ভেসে থাকা অবস্থায়ই তিনি ম্যাপে নিজের অবস্থান দেখে নিয়েছিলেন। তারপর সিগারেট জ্বালিয়ে নিরুত্তাপভাবে অপেক্ষা করছিলেন মাটি স্পর্শ করার। রবিনসনের প্রবল মানসিক শক্তি সম্পর্কে খানিকটা আঁচ পাওয়া যায় এ ঘটনা থেকে। ১৯৫২ সালের এপ্রিলে একটা প্র্যাকটিস স্যাম্পলিং মিশন সফলভাবে শেষ করে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেকে মাশরুম ক্লাউডে ডাইভ দেওয়ার যোগ্য প্রমাণ করেন তিনি। কেউ হয়তো তখনো কল্পনা করতে পারেনি, কী নির্মম পরিণতি অপেক্ষা করছে এই সাহসী পাইলটের ভাগ্যে।

আরও পড়ুন
ট্রিনিটি টেস্টের সময় গ্যাজেটের বিস্ফোরণটি ছিল প্রায় পঁচিশ কিলোটনের সমতুল্য। অন্যদিকে আইভি মাইকের বিস্ফোরণের মাত্রা ছাড়িয়ে যায় দশ মেগাটনকেও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত পারমাণবিক বোমা লিটল বয়ের চেয়ে প্রায় ৭০০ গুণ বেশি শক্তিশালী ছিল এই হাইড্রোজেন বোমা

৩.

১ নভেম্বর সকাল। স্থানীয় সময় ৭টা ১৫ মিনিট। আইভি মাইক নামে বিশ্বের প্রথম থার্মোনিউক্লিয়ার বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে মার্কিন মুলুক। এর মাধ্যমে অবমুক্ত শক্তি যেন হার মানিয়েছিল সূর্যের তীব্র শিখাকেও। এটি ছিল ট্রিনিটি-পরবর্তী প্রজন্মের পারমাণবিক অস্ত্র। ম্যানহাটন প্রজেক্টেরই উচ্চাভিলাষী দুই বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড টেলার ও স্ট্যানিসলো উলামের উদ্ভাবনী চিন্তার ফসল এই ‘মাইক’। বোমাটি বানাতে ব্যবহৃত হয় হাইড্রোজেনের দুটি ভারী আইসোটোপ—ডিউটেরিয়াম ও ট্রিটিয়াম। সে জন্য এটি সারা পৃথিবীতে ‘হাইড্রোজেন বোমা’ হিসেবেই বেশি পরিচিত। ট্রিনিটি টেস্টের সময় গ্যাজেটের বিস্ফোরণটি ছিল প্রায় পঁচিশ কিলোটনের সমতুল্য। অন্যদিকে আইভি মাইকের বিস্ফোরণের মাত্রা ছাড়িয়ে যায় দশ মেগাটনকেও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত পারমাণবিক বোমা লিটল বয়ের চেয়ে প্রায় ৭০০ গুণ বেশি শক্তিশালী ছিল এই হাইড্রোজেন বোমা।

সেদিন সকাল থেকেই মিশনের জন্য প্রস্তুত হয়ে অন্য পাইলটদের সঙ্গে মূল বেসে অপেক্ষা করছিলেন ক্যাপ্টেন রবিনসন। পূর্বনির্ধারিত সময়ে বিস্ফোরণ হতেই আকাশে আবির্ভূত হয় একটি উজ্জ্বল কমলা রঙের নিখুঁত উপবৃত্তাকার আলোকচ্ছটা। জগতের সব আলোকে নিষ্প্রভ করে দিয়ে, এক দীর্ঘ দৃশ্যমান আর্তনাদ সৃষ্টি করে ক্রমে সেটি পরিণত হয়েছিল ধুলাবালি আর কোরালমিশ্রিত পরিপূর্ণ এক মাশরুম মেঘে। বিস্ফোরণের সেই ক্লাউডের নমুনা সংগ্রহ করে আনার দুঃসাহসিক মিশনে অংশ নেয় তিনটি দল। এর প্রথমটি, রেড ফ্লাইট, বিস্ফোরণের ঠিক উনিশ মিনিট পর উড়াল দেয় আকাশে। দুটি এফ-৮৪ থান্ডারজেটের সমন্বয়ে গঠিত এ দলের নেতৃত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ভিরগিল মিরোনি। তাঁদের গন্তব্য ছিল মেঘের চূড়া, অর্থাৎ ২৯ হাজার মিটার উচ্চতায়। কিন্তু ১৭ হাজার মিটার ওপরে উঠতেই বিমানগুলো পৌঁছে গিয়েছিল নিজেদের সামর্থ্যের শেষ বিন্দুতে। আসলে এফ-৮৪ জেটগুলোকে সর্বোচ্চ ১২ হাজার মিটার উচ্চতা পর্যন্ত নিরাপদে ওড়ার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। তখন ভিরগিল মিরোনির সামনে কেবল একটি রাস্তাই খোলা। সেটি হলো মাশরুম ক্লাউডের স্টেম অংশের বিক্ষিপ্ত ধুলাবালি আর ভয়ংকর এলোমেলো টার্বুলেন্ট বায়ুপ্রবাহের মধ্য দিয়েই বিমান নিয়ে উড়ে যাওয়া!

ক্যাপ্টেন রবিনসন
মাশরুম ক্লাউডের সীমানা স্পর্শ করতেই বিক্ষুব্ধ পরিবেশের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে নামতে হলো তাঁদের। প্রবল ঝড়ের আঘাতে রবিনসনের ফাইটার জেট তখন ভয়ংকরভাবে দুলছে

সেখানে প্রবেশের মাত্র পাঁচ মিনিটের মাথায় প্রচণ্ড বৈরী আবহাওয়ার কারণে প্রথম দলের দুটি বিমানেরই অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে। তীব্র আর্তনাদ করে যেন আত্মসমর্পণই করে বসে এগুলোর ইঞ্জিন। ফলে দ্রুত ক্লাউড থেকে বেরিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে বাধ্য হন প্রথম দলের পাইলটরা।

এবার জিমি রবিনসনদের পালা। ততক্ষণে সেই প্রলয়ংকরী মাশরুম মেঘটি আইভি মাইক বোমার বিস্ফোরণস্থল—মার্শাল আইল্যান্ডের অংশ—ছোট্ট ইলুগেলাব আইল্যান্ডটিকে ভয়াবহ অন্ধকারে নিমজ্জিত করে ফেলে। পার্শ্ববর্তী আরেকটি এফ-৮৪ থান্ডারজেটে চালকের আসনে থাকা পাইলট বব হ্যাগানকে সঙ্গী করে জিমি উড়াল দিলেন সেদিকে। ক্রমে চোখের সামনে থেকে হারিয়ে যেতে শুরু করল স্বচ্ছ পরিষ্কার আকাশ। স্বেচ্ছায় জেনেশুনে তাঁরা যেন ছুটে চলছিলেন মানবসৃষ্ট নরকের দরজায়।

ইতিমধ্যেই লেফটেন্যান্ট মিরোনি রেডিও বার্তায় রবিনসনদের জানিয়ে দিয়েছিলেন ক্লাউডের ভেতরের ভয়ংকর পরিবেশের কথা। সেখানে দেখা প্রজ্বলিত শিখার মতো একধরনের লালচে আভা এবং বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতিগুলোর অস্বাভাবিক আচরণ সম্পর্কেও আগাম সতর্ক করেছিলেন তিনি। তবে এসব সাবধানবাণীতে খুব একটা কাজ হয়নি। মাশরুম ক্লাউডের সীমানা স্পর্শ করতেই বিক্ষুব্ধ পরিবেশের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে নামতে হলো তাঁদের। প্রবল ঝড়ের আঘাতে রবিনসনের ফাইটার জেট তখন ভয়ংকরভাবে দুলছে। প্রাণান্ত চেষ্টার পর অবশেষে তিনি বিমানের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেলেন। সেই সঙ্গে সক্ষম হলেন অটো পাইলট মোড চালু করতে।

জিমি রবিনসনের এফ-৮৪ বিমানের ডানার সঙ্গে লাগানো ছিল একগাদা ফিল্টার। বিস্ফোরণ থেকে উদ্ভূত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাগুলো আটকে ফেলাই এদের মূল লক্ষ্য। পারমাণবিক বিস্ফোরণের কেন্দ্রস্থলে নিউট্রন ফ্লাক্সের মান ছিল প্রায় ১০২৪ নিউট্রন/সেমি২। বিস্ময়কর গতিতে সেখানে নিউট্রন ক্যাপচার বিক্রিয়া সংঘটিত হচ্ছিল। পৃথিবীতে এমনটা আগে কখনো দেখা যায়নি। ক্ষুধার্ত নিউক্লিয়াসগুলো যেন গোগ্রাসে নিউট্রন গিলে নিচ্ছিল, আর তৈরি করছিল ইউরেনিয়াম-২৫৫-এর মতো হরেক রকম অদ্ভুত আইসোটোপ। এরপর সেগুলো বিটা ক্ষয় প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত হচ্ছিল এমন সব মৌলিক পদার্থে, যাদের সাধারণত দেখা মেলে একীভূত হতে থাকা নিউট্রন তারকাদের গহিনে। অবশ্য এসব নিয়ে ভাবার ফুরসত ছিল না রবিনসনের। বিমানের সেন্সরগুলো প্রতি মুহূর্তে তাঁকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল সামনে ওত পেতে থাকা বিপদের কথা। ধুলাবালি, পাথর ও উত্তপ্ত গ্যাসের বিক্ষুব্ধ আচরণে পুরো এলাকাটাই যেন ছিল ‘নোফ্লাই জোন’। অবস্থা বেগতিক দেখে খানিক পরেই অটো পাইলট মোড অফ করে বিমানের গতিপথ বদলানোর চেষ্টা করতে বাধ্য হয়েছিলেন রবিনসন। তখনই দেহের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রায় অচেতন হয়ে পড়েন তিনি। ক্রমেই তাঁর নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছিল। চেতনা ধরে রাখতে নিষ্ঠুর অভিকর্ষ বলের সঙ্গে আক্ষরিক অর্থেই যুদ্ধে নেমেছিলেন তিনি। এরই মধ্যে উচ্চতা হারিয়ে ক্রমশ মাটির দিকে পড়ে যেতে শুরু করে তাঁর এফ-৮৪ থান্ডারজেট…

বিধাতা জিমি রবিনসনকে শেষ আরেকটি সুযোগ দিয়েছিলেন। মাটি থেকে মাত্র ছয় হাজার মিটার দূরে থাকতে তিনি বিমানটিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন। এরপর কর্নেল মিরোনির নির্দেশে ত্বরিত গতিতে বেরিয়ে আসেন নরকতুল্য মাশরুম ক্লাউড থেকে। বব হ্যাগানকে সঙ্গে নিয়ে উড়ে চলেন শান্ত, রঙিন অসীম নীলিমার প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে।

আরও পড়ুন

একটি এফ-৮৪ থান্ডারজেট প্রতি ঘণ্টায় ৫৪০ কেজি জ্বালানি ব্যবহার করে। রবিনসন ও হ্যাগান যখন মাশরুম ক্লাউড থেকে বেরিয়ে এলেন, তখন তাঁদের দুজনের বিমানেই মাত্র সাড়ে ৪৫০ কেজির কাছাকাছি জ্বালানি অবশিষ্ট ছিল। অর্থাৎ নিরাপদে বাড়ি ফিরতে হাতে সময় ছিল এক ঘণ্টার কম। বিশেষ ধরনের স্যাম্পলিং ফিল্টারগুলোকে জায়গা করে দেওয়ার জন্য এই বিমানগুলো থেকে আগেই খুলে রাখা হয়েছিল অতিরিক্ত জ্বালানি মজুত রাখার রিজার্ভ ট্যাংকার। পরিকল্পনা ছিল, মাশরুম মেঘের সীমানা পেরিয়ে আসার পর আশপাশে আগে থেকে অপেক্ষায় থাকা ট্যাংকার এয়ারক্রাফট থেকে মধ্য আকাশেই প্রয়োজনীয় তেল সংগ্রহের কাজটি সেরে নেওয়া হবে। আর কোনো কারণে উড়ন্ত ফিলিং স্টেশনটিকে খুঁজে না পেলে, কালবিলম্ব না করে সোজা চলে যেতে হবে দক্ষিণের সবচেয়ে কাছের দ্বীপ এনেউইতাকে। ক্লাউড থেকে বের হতেই পাইলটদ্বয় আবিষ্কার করলেন, ইলেকট্রোম্যাগনেটিক শকের কারণে তাঁদের বিমানের অনেক যন্ত্রপাতি ইতিমধ্যেই নষ্ট হয়ে গেছে। বাকিগুলোর অবস্থাও প্রায় সঙিন। এদের ব্যবহার করে পথের দিশা পাওয়া প্রায় অসম্ভব এক কাজ। তাঁরা যেন হারিয়ে গেছেন প্রশান্ত মহাসাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশির মধ্যে। সৌভাগ্যক্রমে কিছুক্ষণ পর বব হ্যাগান রেডিও সিগন্যাল ফিরে পেতে সমর্থ হন। ততক্ষণে বিমানগুলোর জ্বালানি নেমে আসে মাত্র ২৭০ কেজির ঘরে। গন্তব্যস্থল থেকে তখনো তাঁদের অবস্থান ১৫৪ কিলোমিটারের বেশি দূরে!

এমন সময় সমুদ্রের বুকে শুরু হয় প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি। ফলে ভাগ্যবিড়ম্বিত পাইলট দুজনের দৃষ্টিসীমা আশঙ্কাজনকভাবে কমে আসে। যতক্ষণে তাঁরা সমুদ্র পেরিয়ে একটি মাঠের দেখা পেয়েছিলেন, ততক্ষণে তাঁদের থান্ডারজেটগুলোতে আর এক ফোঁটা জ্বালানিও অবশিষ্ট ছিল না। উপায়ান্তর না দেখে বব হ্যাগান বাঁচার শেষ চেষ্টা হিসেবে ডেডস্টিক ল্যান্ডিংয়ের (জরুরি অবতরণ) পথ বেছে নিলেন। তীব্রভাবে মাটিতে আঘাত করায় তাঁর বিমানের চাকা ফেটে গিয়েছিল। তবে অতিমানবীয় দক্ষতায় ও ভাগ্যের জোরে তিনি বিমান কোনোমতে নিয়ন্ত্রণে এনে প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হন। অন্যদিকে বিধাতা যেন একদম তীরে এসে ক্যাপ্টেন জিমি রবিনসন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৫ হাজার ৮০০ মিটার ওপরে থাকতেই তাঁর বিমানের জ্বালানি সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যায়, ৪ হাজার মিটার বাকি থাকতেই বিকল হয়ে যায় ইঞ্জিনগুলো। দেড় হাজার মিটার উচ্চতায় থাকতেই তিনি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন যে বব হ্যাগানের মতো করে মাঠের সীমানায় জরুরি অবতরণ করা অসম্ভব। তখন তাঁর সামনে শুধু দুটি রাস্তা খোলা ছিল। হয় প্যারাস্যুট নিয়ে বিমান থেকে ‘বেইল আউট’ করা, অথবা সমুদ্রের পানিতে অবতরণের দুঃসাহস দেখানো। দুটো বিকল্পই সমান ঝুঁকিপূর্ণ।

মাশরুম ক্লাউডের অ্যানাটমি
সূত্র: এমআইটি

রেডিয়েশনের সুরক্ষাকবচ হিসেবে রবিনসনের শরীরে পরা ছিল সিসার সেফটি ভেস্ট। এটি প্রথম সমাধানটিকে অনেকটাই কঠিন করে তুলেছিল। অন্যদিকে এফ-৮৪ থান্ডারজেট বিমানগুলো পানিতে জরুরি অবতরণের জন্য একেবারেই উপযুক্ত ছিল না। রবিনসন প্রথমে বেইল আউট করার সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন। ‘উদ্ধারকারী হেলিকপ্টার দেখতে পাচ্ছি। এখনই বেইল আউট করতে যাচ্ছি।’—এটাই ছিল তাঁর শেষ কথা। তবে শেষ মুহূর্তে কেন যেন মত বদলে ফেলেন তিনি। চেষ্টা করেন যেকোনোভাবেই হোক পানিতেই অবতরণ করার। সফলতা মেলেনি। এনেউইতাক দ্বীপের রানওয়ের উত্তরে, মাত্র সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দূরে বিমান নিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের পানিতে তলিয়ে গিয়েছিলেন রবিনসন। উদ্ধারকারী দলের একদম চোখের সামনে।

নতুন মৌল খুঁজতে গিয়ে জীবন বিসর্জন দেওয়া ইতিহাসের প্রথম মানুষ ক্যাপ্টেন জিমি রবিনসন। দুঃখজনকভাবে তাঁর মরদেহ কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। এনেউইতাক দ্বীপের আশপাশের পানির গভীরতা অনেক বেশি, তাই তাঁর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ছিল না বললেই চলে। এক বছর পরে আনুষ্ঠানিকভাবে রবিনসনকে ‘কিল্ড ইন অ্যাকশন’ ঘোষণা করা হয়। সম্মানিত করা হয় মরণোত্তর ‘ডিস্টিংগুইশড ফ্লাইং ক্রস’ পুরস্কারে।

১৯৬২ সাল পর্যন্ত মার্কিন প্রশাসন মাশরুম ক্লাউডের গহিনে অভিযান পরিচালনা অব্যাহত রাখে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফিরে রবিনসন মেমফিস লায়নস ক্লাবে একদিন বলেছিলেন, ‘তোমরা নায়কদের ব্যাপারে অনেক কথাই শোনো। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না যে নায়ক বলে সত্যি কিছু আছে।’

রবিনসনের এ কথার সঙ্গে বিনয়ের সঙ্গেই দ্বিমত পোষণ করা যায়। নায়কেরা অবশ্যই আছেন। বিজ্ঞানের ইতিহাসে জিমি রবিনসন তেমনি একজন।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, আইভি মাইকের নমুনা হাতে পাওয়া থেকে শুরু করে নিশ্চিতভাবে অজানা মৌল শনাক্ত করার মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান ছিল মাত্র নয় দিন! সিবর্গরা ক্যালিফোর্নিয়াম (৯৮) আবিষ্কার করেছিলেন মৌলটির পাঁচ হাজার পরমাণুকে সঙ্গী করে। আর এবার সফলতা ধরা দেয় আরও অনেক কম, মাত্র ২০০ পরমাণু দিয়েই

৪.

না, রবিনসনের মৃত্যু বিফলে যায়নি। তিনি বাদে বাকি ফ্লাইটগুলোর সব পাইলট নিরাপদেই মাশরুম ক্লাউডের সেই নরক থেকে বেঁচে ফিরতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিমানের ডানায় লাগানো ফিল্টারগুলোয় তাঁরা জমা করে নিয়ে এসেছিলেন অজস্র তেজস্ক্রিয় কণার নমুনা। পারমাণবিক বিস্ফোরণ থেকে উদ্ভূত সব মাশরুম ক্লাউডের নিচের অংশেই ভারী তেজস্ক্রিয় কণার দেখা মেলে, অন্যদিকে হালকাগুলো পাওয়া যায় ওপরের দিকে। রেড ফ্লাইটের পাইলটদের অবশ্য এই তথ্য জানা ছিল না। জানা থাকলে তাঁরা নিশ্চিতভাবেই চূড়ার দিক দিয়ে আইভি মাইকের মেঘে প্রবেশের চেষ্টা চালাতেন না।

যা-ই হোক। এফ-৮৪ বিমানগুলোর ফিল্টারে এমন সব বস্তুর নমুনার খোঁজ মেলে, যা পৃথিবীতে এর আগে কখনো দেখা যায়নি। সেগুলো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে খুব অল্প সময়ের মধ্যে অভিজ্ঞ মৌল শিকারি, গ্লেন সিবর্গ ও আলবার্ট ঘিয়োরসোর জালে ধরা পড়ে এক নতুন অজানা মৌল। প্রথমে তাঁরা এমন কিছু খুঁজে পেয়েছিলেন, যা অনেকটা নির্দেশ করে পর্যায় সারণির ১০০ নম্বর মৌলকে। অচিরেই তাঁরা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন, প্রকৃতপক্ষে সেটি ছিল ৯৯তম মৌলিক পদার্থ—আইনস্টাইনিয়াম। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, আইভি মাইকের নমুনা হাতে পাওয়া থেকে শুরু করে নিশ্চিতভাবে অজানা মৌল শনাক্ত করার মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান ছিল মাত্র নয় দিন! সিবর্গরা ক্যালিফোর্নিয়াম (৯৮) আবিষ্কার করেছিলেন মৌলটির পাঁচ হাজার পরমাণুকে সঙ্গী করে। আর এবার সফলতা ধরা দেয় আরও অনেক কম, মাত্র ২০০ পরমাণু দিয়েই। বার্কলির এলিমেন্ট হান্টারদের প্রতিযোগিতা যেন ছিল নিজেদের সঙ্গে। সেখানে তাঁরা প্রতিনিয়ত নিজেদেরই ছাড়িয়ে যাচ্ছিলেন।

লেখকদ্বয়: সহকারী ব্যবস্থাপক, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড

সূত্র: সুপারহেভি: মেকিং অ্যান্ড ব্রেকিং দ্য পিরিওডিক টেবল, কিট চ্যাপম্যান