তপ্ত দুপুরে গ্রামের একপ্রান্তে বটের ছায়া। যত ক্লান্তই থাকেন না কেন, এখানে এসে বসা মাত্রই শরীরটা জুড়িয়ে যাবে। কোথা থেকে যেন মৃদু শীতল বাতাস স্পর্শ করে ক্লান্তি উড়িয়ে নিয়ে যায়। এ প্রশান্তির কোনো তুলনা হয় না।
আবার গ্রীষ্মের দিনে হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই বাতাস কোত্থেকে যেন উড়িয়ে নিয়ে আসে ভীষণ কালো মেঘ। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসে। কোথা থেকে যেন হাজির হয় উন্মত্ত দানবের মতো শক্তিশালী বাতাস। শুরু হয় কালবৈশাখী। বাতাসের তোড়ে গাছের কাঁচা-পাকা আম পড়ে যায় মাটিতে, ডাল ভাঙে, উড়িয়ে নেয় ঘরের চাল। মানুষের দুর্দশার শেষ থাকে না। উপকূলীয় অঞ্চলের ঘুর্ণিঝড়গুলো আরও এক কাঠি সরেস। ভয়ংকর শক্তিশালী বাতাস শুধু জনপদের স্থাপনা ধ্বংস করেই ক্ষান্ত হয় না, সমুদ্রের বড় ঢেউ তুলে আনে সঙ্গে করে। ভাসিয়ে নেয় জানমাল।
কখনো ভেবে দেখেছেন, এই বাতাসের এত রূপ কীভাবে তৈরি হয়? বাতাসটা আসেই-বা কোত্থেকে? প্রশ্নগুলোর উত্তর একটু পরে দিচ্ছি। তার আগে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি। বলুন তো, বাতাস জিনিসটা আসলে কী?
আমাদের চারপাশে যা কিছু দেখি, সবই আসলে অণু-পরমাণুর ভিন্ন ভিন্ন রূপ। পদার্থের অণু যখন খুব কাছাকাছি থাকে, তখন কঠিন অবস্থা তৈরি হয়। একটু দূরে দূরে থাকলে তরল, আর বেশ দূরে দূরে থাকলে তৈরি হয় পদার্থের গ্যাসীয় অবস্থা। বাতাস মূলত বিভিন্ন পরমাণুমিশ্রিত একটি গ্যাসীয় অবস্থা। এই গ্যাসীয় অবস্থার প্রবাহকে আমরা বলি বাতাসের বয়ে যাওয়া।
পদার্থ কোন অবস্থায় থাকবে, তা নির্ভর করে মূলত দুটি বিষয়—তাপ ও চাপের ওপর। একই তাপ ও চাপে আবার সব পদার্থের ভৌত অবস্থা (কঠিন, তরল ও বায়বীয়) একরকম হয় না।
পদার্থের অবস্থা যা-ই হোক না কেন, সেটা মহাকর্ষ দ্বারা প্রভাবিত হয়। পৃথিবীতে সব পদার্থই ওপর থেকে নিচের দিকে পড়ে। অর্থাৎ অভিকর্ষের দিকে। অভিকর্ষের দিক কোনটা? সাধারণভাবে বলা যায়, নিচের দিক। তবে একটু গভীরভাবে ভাবলে বোঝা যাবে, অভিকর্ষ বলটা কাজ করে কম অভিকর্ষ থেকে বেশি অভিকর্ষের দিকে। তরল পদার্থের বেলায় অভিকর্ষের দিকে এই প্রবাহ খুব ভালো করে দেখতে পাই আমরা। নদীনালা সৃষ্টির প্রধান কারণ এই অভিকর্ষ। সমুদ্র যে পানিতে ভর্তি, তার কারণও অভিকর্ষ। তরল পদার্থ যেমন উঁচু স্থান থেকে নিচু স্থানে প্রবাহিত হয়, বায়বীয় পদার্থ তেমন উচ্চ চাপের জায়গা থেকে নিম্ন চাপের দিকে প্রবাহিত হয়। এখানে বলা প্রয়োজন, তরল পদার্থের প্রবাহের ক্ষেত্রে চাপের ভূমিকা থাকে, আর বায়বীয় পদার্থ প্রবাহের বেলায় থাকে অভিকর্ষের ভূমিকা। তবে, তা বেশ কম।
গ্যাস বা বায়বীয় পদার্থের তাপমাত্রার সঙ্গে চাপের একটি নিবিড় সম্পর্ক আছে। সম্পর্কটা সমানুপাতিক। তাপ বাড়লে চাপ বাড়ে, আবার তাপ কমলে চাপ কমে যায়। এটা আসের গ্যাসের সূত্র থেকে। তবে আমরা সূত্রে যাব না। আপাতত এটুকু বুঝতে পারলে বাকিটুকু বুঝতে আর সমস্যা হবে না।
পৃথিবীতে তাপ আসে মূলত সূর্য থেকে। অর্থাৎ সূর্যের তাপে বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হয়। আমরা জানি, পৃথিবী নিজ অক্ষ ও সূর্যের চারপাশে সর্বদা ঘূর্ণায়মান। এ কারণে পৃথিবীর সব জায়গায় সমানভাবে সূর্যের আলো পড়ে না। ফলে, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল সবজায়গায় সমানভাবে উত্তপ্ত হয় না। তাই বায়ু চাপও সব জায়গায় সমান হয় না। চাপের এই অসম বন্টনে সমতা আনতেই তৈরি হয় বায়ুপ্রবাহ। অসম তাপমাত্রা যেহেতু সব সময়ই থাকে পৃথিবীজুড়ে, তাই বায়ুপ্রবাহ কখনো থামে না। তাপমাত্রার তারতম্যে কম-বেশি হলে বাতাসের শক্তিও কম-বেশি হয়।
কোনো অঞ্চলের তাপমাত্রা হঠাৎ করে অনেক বেড়ে গেলে সেখানকার বায়ু বেশ হালকা হয়ে যায়। হালকা বায়ু দ্রুত ওপরে উঠে গেলে ওই অঞ্চলে তৈরি হয় একধরনের শূন্য স্থান। এই শূন্যতা পূরণ করতে চারপাশ থেকে অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা বাতাস ছুটে আসে। তৈরি হয় প্রচণ্ড ঘূর্ণিপাক। এই ঘূর্ণিপাককেই বলে ঘুর্ণিঝড় বা টর্নেডো।
বুঝতেই পারছেন, পৃথিবীতে আমরা যে বাতাস অনুভব করি, সেটা মূলত অণু-পরমাণুর গ্যাসীয় অবস্থায় একধরনের প্রবাহ। এই গ্যাসীয় অবস্থা পৃথিবীতে সব সময়ই ছিল। বাতাসের মাঝে সবসময়ই ডুবে আছি আমরা। তবে টের পাই শুধু যখন এই বাতাসের প্রবাহ হয়। অর্থাৎ এক স্থানের বাতাস অন্য স্থানে যায়। পানি চক্র, উদ্ভিদের প্রস্বেদন-আস্বাদন, প্রাণীর শ্বাস-প্রশ্বাস ও ধূলিকণার কারণে বায়ুমণ্ডলে নতুন কণা যুক্ত হয় বা হ্রাস পায়। কিন্তু প্রবাহের জন্য প্রয়োজন তাপশক্তি। সূর্যের কারণেই এই প্রবাহ তৈরি হয় পৃথিবীতে। অর্থাৎ বাতাস বয়। মোটা দাগে বায়ুশক্তিকে তাই আমরা সৌরশক্তির একটি রূপ বলে দাবি করতেই পারি।
লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা
সূত্র: দ্য কনভারশেসন