গত বছর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেলেন কারা, কেন

সময়ের অতিক্ষুদ্র ভগ্নাংশে অতিপারমাণবিক জগতের আলো ধরেছেন তাঁরা, উন্মোচন করেছেন সেই ক্ষুদ্র জগৎ। এই ভগ্নাংশের নাম অ্যাটোসেকেন্ড। পদার্থবিদ্যায় নতুন এ ধারার সূচনা ও গুরুত্ব...

পূরবী কাব্যগ্রন্থের ‘শেষ বসন্ত’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘সময় রয়েছে বাকি; সময়রে দিতে ফাঁকি, ভাবনা রেখো না মনে কোনো।’ কিন্তু কবি যতই নিশ্চিন্ত আশ্বাসের বাণী দিন, ভাবনা রয়ে যায়। বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞানে সবচেয়ে বড় ভাবনার বিষয় হলো সময়। এখানে ক্ষুদ্রতম সময়কে ফাঁকি দেওয়াও দিন দিন অসম্ভব হয়ে উঠছে। আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম বইয়ে বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং দেখিয়েছেন, মহাবিশ্বের বৈজ্ঞানিক বিবর্তন আর সময়ের ইতিহাস সমতুল। সময় ও স্থানের পারস্পরিক জটিল সম্পর্কের ভেতর থেকে আইনস্টাইন বের করে এনেছেন আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। এই তত্ত্ব বদলে দিয়েছে মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি। সময় সম্পর্কে আমরা যত জানছি, তত জটিল হয়ে যাচ্ছে সময়ের সংজ্ঞা, সময়ের সমীকরণ।

সময়ের ধারণা কীভাবে ধরা দেয় আমাদের মনে? আমরা নিজেদের পারিপার্শ্বিক ঘটনার পরিবর্তনের সঙ্গে তুলনা করে সময় বোঝার চেষ্টা করি। যেমন হৃৎপিণ্ডের একটি স্পন্দনের সময় মোটামুটি এক সেকেন্ড ধরা যায়। দ্রুত ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনায় আমরা অনেক সময় বলি, একনিমেষেই ঘটে গেল সব। বাংলায় এই নিমেষ হলো চোখের পলক ফেলতে যতটুকু সময় লাগে। চোখের পলক ফেলতে ১০০ থেকে ১৫০ মিলিসেকেন্ড সময় লাগে। অর্থাৎ ধরা যায়, ১ সেকেন্ডের ১০ ভাগের ১ ভাগ সময় লাগে। নিমেষের হিসাবে ধরলেও এক সেকেন্ড অনেক লম্বা সময়।

কোনো ঘটনা ঘটতে কত সময় লাগে, তা স্বাভাবিক নিয়মে হিসাব করতে হলে আমাদের ঘটনাটা ঘটতে দেখা চাই। আবার যেকোনো কিছু সরাসরি দেখার জন্য আলো দরকার। কিন্তু আলো থাকলে, চোখের সামনে ঘটনা ঘটলেই কি আমরা দেখতে পাই সব? না, পাই না। কারণ, আমাদের চোখের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। আমাদের চোখের স্বাভাবিক রেজুল্যুশন বা সূক্ষ্ম দর্শনের ক্ষমতা মাত্র ১০০ মাইক্রোমিটার। অর্থাৎ কোনো বস্তু যদি ১ মিলিমিটারের ১০ ভাগের ১ ভাগের চেয়ে ছোট হয়, স্বাভাবিক চোখে আমরা তা দেখতে পাব না।

আবার দেখার জন্য যে আলো লাগে, সেই আলোর তরঙ্গের খুব সামান্য অংশই—৪০০ ন্যানোমিটার থেকে ৭০০ ন্যানোমিটার পর্যন্ত তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো—আমাদের চোখের রেটিনার কোষের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করতে পারে। তাই ৪০০ ন্যানোমিটারের কম বা ৭০০ ন্যানোমিটারের বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো আমরা দেখতে পাই না। বাতাস যেমন ভরযুক্ত অক্সিজেন, নাইট্রোজেনসহ আরও কয়েকটি গ্যাসের মিশ্রণ। কিন্তু আমরা বাতাস দেখতে পাই না। রাসায়নিক কিংবা ভৌত বিক্রিয়া অনবরত ঘটছে, আমরা জানি। কিন্তু সরাসরি তা দেখতে পাই না। বলা যায়, বস্তুজগতের বেশির ভাগ সূক্ষ্ম ঘটনা, দ্রুততম সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রত্যক্ষ করার ক্ষমতা আমাদের নেই।

কিন্তু সরাসরি দেখতে না পারলে কী হবে, পরোক্ষভাবে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ঘটনাগুলো দেখার অনেক পদ্ধতি বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করে ফেলেছেন। ২০২৩ সালের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে এমনই আশ্চর্যজনক ক্ষুদ্রতম সময়ে ঘটা ঘটনাগুলো দেখার পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য। এর নাম দেওয়া হয়েছে অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিকস। এই অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিকস দ্রুততম সময়ে ঘটা ইলেকট্রনের কাজকর্ম দেখারও সুযোগ করে দিচ্ছে। এটা এমনই এক আশ্চর্যজনক পদার্থবিদ্যা, যা বুঝতে হলে আমাদের ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে অনেক কিছু।

শুরুতেই দেখা যাক, অ্যাটোসেকেন্ড বলতে কতটুকু সময় বোঝায়। ১ অ্যাটোসেকেন্ড হলো ১০-১৮ সেকেন্ড; অর্থাৎ ১ সেকেন্ডকে ১০০ কোটি ভাগ করে তার ১ ভাগকে আবার ১০০ কোটি ভাগ করলে ১ ভাগে যেটুকু সময় হবে, সেটা। আলো এক সেকেন্ডে প্রায় তিন লাখ কিলোমিটার যেতে পারে। অ্যাটোসেকেন্ডের হিসাব করলে এক মিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে আলোর সময় লাগবে প্রায় ৩৩০ কোটি অ্যাটোসেকেন্ড। অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিকস হলো অ্যাটোসেকেন্ড স্কেলে পরিমাপের মতো সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য আলোর স্পন্দন তৈরি করার পদার্থবিজ্ঞান, যে স্পন্দনের মাধ্যমে সেই সূক্ষ্মতম স্কেলে পরিমাপযোগ্য সময়ের ভেতর ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি দেখা সম্ভব।

দ্রুততম সময়ে ঘটা ঘটনাগুলো আমরা কীভাবে দেখতে পারি? যেমন ক্রিকেট খেলার কথা ধরা যাক। একজন ফাস্ট বোলার যখন বল করেন, তখন ক্যামেরাম্যানরা সেই বল ব্যাটারের ব্যাটে লাগার মুহূর্তের ছবি তোলার জন্য লম্বা লম্বা লেন্স তাক করে বসে থাকেন। তখন তাঁদের ক্যামেরার শাটার স্পিড এমনভাবে সেট করা থাকে, যেন দ্রুততম সময়ে ঘটনাটির ছবি তোলা যায়। ঘটনাটি যে বেগে ঘটবে, শাটারের বেগ হতে হবে তার চেয়ে বেশি। নাহলে ছবি ঝাপসা হয়ে যাবে। শাটারের বেগ বেশি হওয়ার অর্থ হলো, ক্যামেরার ডায়াফ্রাম খোলা হবে খুব কম সময়ের জন্য। প্রচণ্ড গতিশীল বস্তুর ওপর তখন খুব কম সময়ের জন্য আলো পড়ে সেই সময়কে স্থির করে ধরে নেবে ক্যামেরায়।

কিন্তু ক্রিকেট বলের গতির চেয়ে কোটি কোটি গুণ দ্রুততর পরমাণুর ইলেকট্রনের কাজকর্ম। ইলেকট্রনের কক্ষপথ কিংবা শক্তিস্তরের পরিবর্তন ঘটতে সময় লাগে মাত্র কয়েক শ অ্যাটোসেকেন্ড। অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিকসের প্রয়োগে ইলেকট্রনের দ্রুততম গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার সম্ভাবনার দরজা খোলার চেষ্টা করে চলেছেন যে কজন বিজ্ঞানী প্রায় ৪০ বছর ধরে, তাঁদেরই তিনজন অগ্রনায়ককে গত বছর পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। এই তিন নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী হলেন অ্যান লুলিয়ে, ফেরেন্স ক্রাউজ ও পিয়ের আগোস্তিনি।

নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীদের মধ্যে নারী বিজ্ঞানীর সংখ্যা এখনো পুরুষদের তুলনায় অনেক কম। ১৯০১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন মাত্র ১৩ জন নারী, রসায়নে মাত্র ৮ জন এবং পদার্থবিজ্ঞানে সবচেয়ে কম—মাত্র ৫ জন। ১৯০৩ সালে মেরি কুরির পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরের ৬০ বছর আর কোনো নারী পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পাননি। ১৯৬৩ সালে মারিয়া গোয়েপার্ট মেয়ার পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারজয়ী দ্বিতীয় বিজ্ঞানী। এরপর আবার ৫৫ বছরের দীর্ঘ বিরতি। অবশেষে ২০১৮ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আরও তিন নারী পদার্থবিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিকসের অগ্রনায়ক অধ্যাপক অ্যান লুলিয়ে নোবেলজয়ী পঞ্চম নারী পদার্থবিজ্ঞানী। গত বছরের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার সে হিসেবেও অনন্য মাত্রা পেয়েছে।

অ্যান লুলিয়ের (Anne L’Huillier) জন্ম ১৯৫৮ সালের ১৬ আগস্ট, ফ্রান্সের প্যারিসে। প্যারিসের ইকোল নরমাল সুপেরিয়র থেকে পদার্থবিজ্ঞানে বিএ পাস করার পর পিয়ের অ্যান্ড মেরি কুরি ইউনিভার্সিটি থেকে গণিত ও তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে ডাবল মাস্টার্স অর্জন করেন। এরপর তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানে, ১৯৮৬ সালে। তাঁর থিসিসের শিরোনাম ছিল ‘মাল্টিফোটন অ্যান্ড মাল্টি–ইলেকট্রন আয়নাইজেশন’। উচ্চ তীব্রতার লেজার রশ্মি প্রয়োগে একাধিক ফোটন ও ইলেকট্রনের আয়নায়ন–সংক্রান্ত গবেষণা করেন তিনি পিএইচডির সময়, যা পরবর্তী সময়ে আরও গভীরে গিয়ে তাঁর নোবেল পুরস্কারের পথ তৈরি করে।

পিএইচডির পর তিনি সুইডেনের গুথেনবার্গের কালমার্স ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে পোস্টডক ফেলো হিসেবে যোগ দেন। কিছুদিন পর যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে যান। তবে বেশি দিন ছিলেন না সেখানে। ইতিমধ্যে তিনি ফ্রান্সের অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের অধীনে যে নয়টি গবেষণাকেন্দ্র আছে, তাদের অন্যতম কেন্দ্র স্যাকলে সেন্টারে গবেষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৯২ সালে তিনি সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটিতে টাইটেনিয়াম-স্যাফায়ার সলিড স্টেট লেজার সিস্টেমে কাজ করেন। ওটা ছিল ইউরোপের প্রথম ফেমটোসেকেন্ড পালস উৎপাদনক্ষম লেজার। ফেমটোসেকেন্ড হলো ১০-১৫ সেকেন্ড। অর্থাৎ ১ সেকেন্ডের ১০০ কোটি ভাগের ১ ভাগ সময়কে আরও ১০ লাখ ভাগ করলে প্রতি ভাগ সময়ের সমান। ফেমটোসেকেন্ড পালস হলো ফেমটোসেকেন্ড স্থায়ী আলোর স্পন্দন। লেজারের সাহায্যে এ রকম স্পন্দন তৈরি শুরু হয়েছিল ১৯৯০-এর দশকে। ১৯৯৪ সালে অ্যান পাকাপাকিভাবে প্যারিস থেকে সুইডেনে চলে যান লুন্ড ইউনিভার্সিটির লেকচারার হিসেবে। ১৯৯৭ সালেই তিনি লুন্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর পদে উন্নীত হন। ২০০৪ সালে তিনি সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেসের সদস্যপদ লাভ করেন। ২০০৭ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ছিলেন নোবেল কমিটি ফর ফিজিকসের সদস্য। সেই আট বছর তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার প্রক্রিয়ায় সরাসরি যুক্ত ছিলেন।

অ্যানের গবেষণা তাঁকে নোবেল পুরস্কার ছাড়াও আরও অনেক পুরস্কার এনে দিয়েছে। ২০০৩ সালে তিনি পেয়েছেন জুলিয়াস স্প্রিঙ্গার প্রাইজ, ২০১১ সালে পেয়েছেন ইউনেসকোর লরিয়াল ওম্যান ইন সায়েন্স অ্যাওয়ার্ড, ২০১৩ সালে পেয়েছেন কার্ল-জেইস রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড, ২০১৮ সালে মনোনীত হয়েছেন আমেরিকান ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সের ফরেন অ্যাসোসিয়েট, ২০১৯ সালে পেয়েছেন ইউরোপিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটির প্রাইজ ফর ফান্ডামেন্টাল অ্যাস্পেক্টস অব কোয়ান্টাম ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড অপটিকস। ২০২১ সালে তিনি অপটিক্যাল সোসাইটি অব আমেরিকার ম্যাক্স বর্ন অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। ২০২২ সালে পেয়েছেন ইসরায়েলের উলফ ফাউন্ডেশনের উলফ প্রাইজ ফর ফিজিকস। বেশ কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, যাঁরা উলফ প্রাইজ পান, তাঁদের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় অনেক গুণ। তাই ২০২২ সালে উলফ প্রাইজ পাওয়ার পর অনেকেই সঠিকভাবে ধারণা করেছিলেন যে অ্যান লুলিয়ে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পাবেন।

২০২২ সালের উলফ ফিজিকস প্রাইজ পেয়েছেন তিনজন, যাঁদের দুজন এবার নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। দ্বিতীয়জন হলেন হাঙ্গেরির অধ্যাপক ফেরেন্স ক্রাউজ (Ferenc Krausz)। ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট অব কোয়ান্টাম অপটিকসের পাঁচ পরিচালকের একজন এই ক্রাউজ। একই সঙ্গে তিনি মিউনিখ লুডবিগ ম্যাক্সিমিলান ইউনিভার্সিটিরও অধ্যাপক।

ফেরেন্স ক্রাউজের জন্ম ১৯৬২ সালের ১৭ মে হাঙ্গেরিতে। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত তিনি হাঙ্গেরির ইউটভোস লোরান্ড ইউনিভার্সিটিতে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে বিএসসি এবং টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব বুদাপেস্ট থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ভিয়েনায় চলে যান পিএইচডি করতে। ১৯৯১ সালে ভিয়েনা ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি থেকে কোয়ান্টাম ইলেকট্রনিকসে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। এরপর মাত্র দুই বছরের মধ্যে তিনি ভিয়েনা ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে ‘হ্যাবিলিটেশন’ সম্পন্ন করেন। এই হ্যাবিলিটেশন পদ্ধতি ইউরোপের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে গেলে অবশ্যই লাগে। শুধু পিএইচডি সম্পন্ন করলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া যায় না, বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত থেকে দীর্ঘদিন ক্লাসরুমে পড়ানো ও গবেষণার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো নিয়মিত বেতন-ভাতাও পাওয়া যায় না। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটির কাছে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়। গবেষণার জন্য গবেষণা-বক্তৃতা দিতে হয় এবং উত্তর দিতে হয় প্রতিপক্ষের প্রশ্নের। অনেক সময় ৫ থেকে ১০ বছর সময় লেগে যায় এসব সম্পন্ন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে। অবশ্য এটা হয়ে গেলে তখন পূর্ণ অধ্যাপকের মর্যাদা পাওয়া যায়। ফেরেন্স ক্রাউজ খুব কম সময়ের মধ্যে ভিয়েনা ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির শিক্ষক হয়ে গেলেন। ১৯৯৯ সালে তিনি ফুল প্রফেসর হয়ে যান। ২০০০ সালে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড লাইট সোর্সেসের পরিচালক নিযুক্ত হন। এর তিন বছর পর, ২০০৩ সালে তিনি জার্মানিতে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট অব কোয়ান্টাম অপটিকসের ডিরেক্টর পদে যোগ দেন। ২০০৪ সাল থেকে মিউনিখের লুডভিগ ম্যাক্সিমিলিয়ান ইউনিভার্সিটির এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিকসেরও চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করে চলেছেন।

২০২৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী তিন বিজ্ঞানী—পিয়ের আগোস্তিনি (যুক্তরাষ্ট্র), ফেরেন্স ক্রাউজ (হাঙ্গেরি) ও অ্যান লুলিয়ে (ফ্রান্স)

অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিকসের একজন পথিকৃৎ বলে ধরা হয় অধ্যাপক ক্রাউজকে। গত বছরের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে তিনি দুই দশক ধরে অনেকগুলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণা পুরস্কার পেয়েছেন। ২০০৫ সালে পেয়েছেন জার্মান রিসার্চ ফাউন্ডেশনের লিবনিজ প্রাইজ, ২০০৬ সালে পেয়েছেন ইলেকট্রো–অপটিক সোসাইটির কোয়ান্টাম ইলেকট্রনিকস অ্যাওয়ার্ড ও ব্রিটিশ রয়্যাল ফটোগ্রাফিক সোসাইটির প্রগ্রেস মেডেল। ২০১১ সালে পেয়েছেন ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানির গবেষণা পুরস্কার, ২০১৩ সালে পেয়েছেন কিং ফয়সাল ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড, একই বছর পেয়েছেন অটো হান পুরস্কার, ২০১৯ সালে পেয়েছেন ভ্লাডিলেন লেটোকভ মেডেল এবং ২০২২ সালে পেয়েছেন উলফ প্রাইজ ইন ফিজিকস।

গত বছরের তিন নোবেলজয়ীর মধ্যে সবার সিনিয়র অথচ সবচেয়ে নিভৃতচারী বিজ্ঞানী হলেন যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক পিয়ের আগোস্তিনি (Pierre Agostini)। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে এই মানুষটির কোনো উইকিপিডিয়া পেজও ছিল না। ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটেও যেনতেনভাবে একটি পুরোনো ছবির সঙ্গে মাত্র দু-তিন লাইনের পরিচিতি ছিল অধ্যাপক আগোস্তিনির। পুরস্কার ঘোষণার আগে নোবেল কমিটি ফোনে যোগাযোগও করতে পারেনি তাঁর সঙ্গে। [ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পোস্টডক করার সময় পিয়ের আগোস্তিনিকে ও তাঁর কাজকর্মের কিছুটা কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। তখন তিনি ৬৪ বছর বয়সে ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটিতে সবে যোগ দিয়েছেন প্রফেসর হিসেবে। তাঁর কাজকর্মে কেমন যেন একটা সন্ন্যাসীসুলভ আচরণ ছিল, কিছুতেই যেন কিছু যায় আসে না—এ রকম একটা ভাব। এত বছর পর বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ পুরস্কার নোবেলস্বীকৃতি পাওয়ার পরও প্রফেসর আগোস্তিনির ভেতর সে রকম কোনো উচ্ছ্বাস দেখা যায়নি। তাঁর মেয়ে ফোন করে তাঁকে জানিয়েছেন, তিনি গুগলে দেখেছেন যে বাবা নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।]

যেভাবে লেজার লাইট পরমাণুর ভেতরের ইলেকট্রনের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে

১৯৪১ সালের ২৩ জুলাই ফ্রেন্স তিউনিসিয়ার তিউনিসে জন্ম পিয়ের আগোস্তিনির। ১৯৫৯ সালে ফ্রান্সের প্রাইতানি ন্যাশনাল মিলিটারি স্কুল থেকে পাস করে দক্ষিণ ফ্রান্সের এইক্স-মারসিলি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলেন। ১৯৬১ সালে ফিজিকসে বিএড ও ১৯৬২ সালে এমএস ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন অপটিকসে। আলট্রাভায়োলেট রশ্মির মাল্টিলেয়ার ডাই–ইলেকট্রিক ফিল্টার নিয়ে পিএইচডি গবেষণা করেন আগোস্তিনি। পিএইচডি করার পরের বছরই যোগ দেন ফ্রান্স অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের স্যাকলে সেন্টারে। সেখানেই তিনি গবেষণা করেছেন পরের ৩৪ বছর। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত অ্যান লুলিয়ের এই গবেষণাকেন্দ্রে পিয়ের আগোস্তিনির সহকর্মী ছিলেন। কিন্তু সেই সময় তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য যৌথ গবেষণা সে রকম হয়নি। সেদিন কেউই ভাবতে পারেননি, তাঁরা একদিন নোবেল পুরস্কার পাবেন যুগ্মভাবে।

২০০২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত পিয়ের আগোস্তিনি নিউইয়র্কের ব্রুকহ্যাভেন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে ভিজিটিং সায়েন্টিস্ট হিসেবে কাজ করার পর ২০০৫ সালে ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির ফিজিকস ডিপার্টমেন্টে যোগ দেন প্রফেসর হিসেবে। ২০১৮ সালে ৭৭ বছর বয়সে তিনি অবসর গ্রহণ করার পর ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। গত বছর তিনি নোবেল পুরস্কার পাবেন, এটা অপ্রত্যাশিত ছিল। অবশ্য এর আগে তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার পেয়েছিলেন—১৯৯৫ সালে ফ্রেন্স একাডেমি অব সায়েন্সের গুস্তাভ রিবাউড প্রাইজ, ২০০৩ সালে গে-লুসাক-হামবোল্ট প্রাইজ, ২০০৭ সালে অপটিক্যাল সোসাইটি অব আমেরিকার মেগার্স অ্যাওয়ার্ড ইন স্পেকট্রোস্কোপি।

লেজার উৎপাদনের মূলনীতি হলো পদার্থবিজ্ঞানের কোয়ান্টাম মেকানিকসের নীতি। পরমাণুর ভেতর ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াসের চারপাশে নিজস্ব কক্ষপথে ঘুরতে থাকে।

এবার দেখা যাক অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিকসের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ কীভাবে ঘটেছে। গত শতকের শেষের দুই দশকে লেজার বিজ্ঞানের বেশ উন্নতি হয়েছে। ফেমটোস্কেলের আলোর স্পন্দন উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে লেজারের সাহায্যে। রাসায়নিক বিক্রিয়ার সময় আণবিক স্কেলের পরিবর্তনগুলো দেখা সম্ভব হয়েছে ফেমটোসেকেন্ড স্পন্দনের মাধ্যমে, উদ্ভব হয় ফেমটোকেমিস্ট্রির। বিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষে ১৯৯৯ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল ফেমটোকেমিস্ট্রির জন্য। ফেমটোমিটার হলো ১০-১৫ মিটার। ক্যালটেকের প্রফেসর আহমেদ জিওয়াইল নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন রাসায়নিক বিক্রিয়ার সময় অণুর মধ্যে পরমাণুগুলো কীভাবে চলাচল করে, তা দেখার একটি পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য। তিনি সেটা করেছিলেন লেজার টেকনিক ব্যবহার করে। তখন ফেমটোকেমিস্ট্রির আবিষ্কার নিয়ে উদ্দীপ্ত হয়েছিল বিজ্ঞানী সমাজ। এর কয়েক বছরের মধ্যেই জন্ম অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিকসের।

ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সময়ের জন্য আলোর স্পন্দন তৈরি করা সম্ভব লেজার রশ্মির মাধ্যমে। এটা বুঝতে হলে আমাদের জানতে হবে লেজার কীভাবে তৈরি হয়। লেজার শব্দটি এসেছে লাইট অ্যামপ্লিফিকেশন বাই স্টিমুলেটেড এমিশন অব রেডিয়েশন (Light Amplification by Stimulated Emission of Radiation) থেকে। বিশেষ উদ্দীপনায় আলোর বিকিরণ ঘটিয়ে সাধারণ আলোর ক্ষমতা ও শক্তি বহুগুণ বাড়িয়ে তুলে লেজার তৈরি করা হয়। লেজার তৈরির প্রথম ধারণা দিয়েছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন—১৯১৭ সালে। তিনি তাঁর ‘অন দ্য কোয়ান্টাম থিওরি অব রেডিয়েশন’ গবেষণাপত্রে ফোটনের ধর্মের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন [On the Quantum Theroy of Radiation, Physikalische Zeitschrift, vol 18 (1917) pp 121-128]। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন, কোনো ফোটন যদি কোনো পরমাণুর ইলেকট্রনকে ধাক্কা দেয়, তবে ইলেকট্রনটি ফোটনের শক্তি শোষণ করে উত্তেজিত হবে। উত্তেজিত হয়ে ইলেকট্রনটি তার মূল শক্তিস্তর থেকে চলে যাবে উচ্চতর শক্তিস্তরে। কিন্তু ফোটন কোনো উচ্চ শক্তিস্তরের ইলেকট্রনকে ধাক্কা দিলে উচ্চ শক্তিস্তরের ইলেকট্রন তার অতিরিক্ত শক্তি ত্যাগ করে নিজের মূল শক্তিস্তরে ফিরে আসবে। এই শক্তিস্তর পরিবর্তনের সময় যে শক্তি ত্যাগ করবে, সেই শক্তি যে ফোটনটি ধাক্কা দিয়েছিল, সেই ফোটনের শক্তির সমান। এ ক্ষেত্রে একই শক্তির দুটি ফোটন একই দিকে একইভাবে ছুটে যাবে। এই দুটি ফোটন যদি আবার দুটি উত্তেজিত ইলেকট্রনকে ধাক্কা দেয়, আরও দুটি সমান শক্তির ফোটন পাওয়া যাবে। মোট ফোটন হবে চারটি। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে ৪ থেকে ৮, ৮ থেকে ১৬, ১৬ থেকে ৩২—এভাবে কোটি কোটি একই শক্তির ফোটনের স্রোত তৈরি হবে। এই ফোটনগুলোর প্রতিটির তরঙ্গদৈর্ঘ্য সমান। ফলে এদের সম্মিলিত প্রাবল্য হবে সাধারণ আলোর চেয়ে অনেক বেশি।

লেজার উৎপাদনের মূলনীতি হলো পদার্থবিজ্ঞানের কোয়ান্টাম মেকানিকসের নীতি। পরমাণুর ভেতর ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াসের চারপাশে নিজস্ব কক্ষপথে ঘুরতে থাকে। কোয়ান্টাম মেকানিকসের নিয়মে এগুলো কক্ষপথে বিন্যস্ত থাকে—প্রথম কক্ষপথে ২টি, দ্বিতীয় কক্ষপথে ৮টি, তৃতীয় কক্ষপথে ১৮টি ইত্যাদি। ইলেকট্রনের কক্ষপথগুলো হলো তাদের শক্তিস্তর। একটি কক্ষপথে যতগুলো ইলেকট্রন থাকে, সব কটি ইলেকট্রনের শক্তি সমান। নিউক্লিয়াসের সবচেয়ে কাছের যে কক্ষপথ (প্রথম কক্ষপথ), সেই কক্ষপথে যেসব ইলেকট্রন থাকে, তাদের শক্তি সবচেয়ে কম। এই শক্তিস্তরকে গ্রাউন্ড স্টেট বলা হয়। ইলেকট্রনগুলো যদি কোনোভাবে শক্তি শোষণ করে, তখন তারা উত্তেজিত হয়ে নিজেদের শক্তিস্তর থেকে উচ্চতর শক্তিস্তরে চলে যায়। কিন্তু একটু পরই সেই অতিরিক্ত শক্তি ত্যাগ করে নিজের শক্তিস্তরে ফিরে আসে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে শক্তি নির্গমনের এই প্রক্রিয়াকে স্পনটেনিয়াস এমিশন বা স্বতঃস্ফূর্ত নিঃসরণ বলা হয়। যদি নির্দিষ্ট শক্তির ফোটনের সঙ্গে পরমাণুর ইলেকট্রনগুলোর মিথস্ক্রিয়া ঘটানো যায়, তাহলে ফোটনের শক্তি শোষণ করে ইলেকট্রনগুলো উত্তেজিত হয়ে উচ্চতর শক্তিস্তরে চলে যায়। তারপর যখন নিজের শক্তিস্তরে ফিরে আসে, তখন যে শক্তি শোষণ করেছিল, তা ফোটনের মাধ্যমে বের করে দেয়। এই নির্গত ফোটনের শক্তি শোষিত ফোটনের শক্তির সমান। ফোটনের প্রবাহ যদি অনবরত চলতে থাকে, তাহলে একটি ফোটন থেকে একই শক্তির ২টি ফোটন, ২টি থেকে ৪টি, ৪টি থেকে ৮টি ফোটন—এভাবে সেকেন্ডের মধ্যে কোটি কোটি ফোটনের প্রবাহ পাওয়া যায়। প্রতিটি ফোটনের শক্তি সমান এবং প্রতিটিই একই সঙ্গে একই দিকে যায়। তীব্র প্রাবল্যের এই ফোটনপ্রবাহই লেজার। সাধারণ দৃশ্যমান আলোতে ৪০০ থেকে ৭০০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের যেকোনো তরঙ্গ থাকতে পারে। তাই আলোকরশ্মি সমশক্তির হয় না। বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মিশ্রণের কারণে সব কটি ফোটন একদিকে না গিয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু লেজারে সব কটি ফোটনের শক্তি সমান, ফলে তরঙ্গদৈর্ঘ্যও সমান। ফলে তারা সব এক বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত থাকে। লেজার রশ্মি তাই একটুও না ছড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারে। পৃথিবী থেকে চাঁদের পৃষ্ঠে লেজার রশ্মি পাঠানো হয়, সেই রশ্মি একটুও ছড়িয়ে না পড়ে চাঁদের পিঠে রাখা আয়নাতে প্রতিফলিত হয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে।

সব ধরনের লেজারেরই মূল প্রস্তুত প্রণালি কমবেশি একই রকম। প্রথমে দরকার একটি উপযুক্ত পদার্থের অ্যামপ্লিফাইং মিডিয়াম বা গেইন মিডিয়াম বা অ্যাকটিভ মিডিয়াম। এই মিডিয়ামের ইলেকট্রনকে উত্তেজিত করে ফোটন বের করা হয়। এই মিডিয়াম কঠিন, গ্যাস, সেমিকন্ডাক্টর ইত্যাদি হতে পারে। এই পদার্থের ওপর বিশেষ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো প্রয়োগ করলে পদার্থের ইলেকট্রন উত্তেজিত হয় ও ফোটন নির্গত হয়। অ্যাকটিভ মিডিয়ামের আলোর ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য মিডিয়ামের চারপাশে বিদ্যুৎপ্রবাহ চালনা করা হয়, অথবা অন্য তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকরশ্মি প্রয়োগ করা হয়। এই পদ্ধতিকে বলা হয় পাম্পিং। ফ্ল্যাশ লাইট বা অন্য লেজার দিয়েও এই পাম্পিং করা যায়। পাম্পিংসহ অ্যাকটিভ মিডিয়ামকে একটি সিলিন্ডার আকৃতির নলের মধ্যে স্থাপন করা হয়। এই নলকে বলা হয় লেজার ক্যাভিটি। এই নলের দুই প্রান্তে দুটি আয়না বসানো থাকে। নলের ভেতর যে আলো উৎপন্ন হয়, সেই আলো এই আয়না দুটিতে অনবরত প্রতিফলিত হতে থাকে। একটি আয়না নলের ভেতরের সব আলোর প্রতিফলন ঘটায়। অন্যদিকের আয়নাটি পুরোপুরি প্রতিফলক নয়। সেই আয়না কিছুটা স্বচ্ছ, যার ভেতর দিয়ে লেজাররশ্মি বের হয়ে আসে। সাধারণত অ্যাকটিভ মিডিয়ামের নাম অনুসারে লেজারের নাম হয়। যেমন অ্যাকটিভ মিডিয়াম রুবি হলে রুবি লেজার, গেইন মিডিয়াম আর্গন গ্যাস হলে আর্গন লেজার ইত্যাদি। বিভিন্ন মিডিয়াম থেকে উৎপন্ন লেজারের শক্তি এবং তরঙ্গদৈর্ঘ্যও ভিন্ন ভিন্ন হয়।

লেজারের ক্ষমতা ফেমটোসেকেন্ড স্পন্দনে আটকে ছিল অনেক বছর। ফেমটোসেকেন্ড পেরিয়ে অ্যাটোসেকেন্ডে আসার জন্য আরও ছোট সময়ের পালস তৈরি করতে হয়েছে বিজ্ঞানীদের। কীভাবে সম্ভব হয়েছে এত ক্ষুদ্র সময়ের আলোর স্পন্দন তৈরি করা?

একটি পদ্ধতি হলো হাই হারমোনিক জেনারেশন (HHG) পদ্ধতি, যেখানে পরমাণুর একটি ইলেকট্রন অনেকগুলো কম শক্তির ফোটন শোষণ করতে থাকে একের পর এক। এরপর একটি উচ্চ শক্তির ফোটন বের করে দেয়। কিন্তু কয়েক দশক আগে এ ধরনের প্রক্রিয়ায় দেখা গেছে, ফোটনের শক্তি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ফোটন নির্গমনের হার কমে যাচ্ছে। ফলে উচ্চ শক্তির আলোর স্পন্দন তৈরি করা সম্ভব হচ্ছিল না।

আর্গন গ্যাসের মধ্যে লেজার রশ্মি চালনার ফলে ইলেকট্রন তিনটি কাজ করছে একসঙ্গে। প্রথমত, কোয়ান্টাম টানেলিংয়ের মাধ্যমে ইলেকট্রন পরমাণু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।

১৯৮৭ সালে অ্যান লুলিয়ে ও তাঁর গবেষক দল আর্গন গ্যাসে ইনফ্রারেড লেজার (অবলোহিত লেজার) প্রয়োগ করে দেখলেন, শক্তি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নির্গত ফোটনের সংখ্যা সেভাবে কমে না গিয়ে বরং একটা স্থিতাবস্থায় আসছে। ব্যাপারটি খুব আশাপ্রদ মনে হয় তাঁর দলের কাছে। এর কয়েক বছরের মধ্যেই লুলিয়ে এবং অন্য বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, এইচএইচজিতে আসলে কী হচ্ছে।

আর্গন গ্যাসের মধ্যে লেজার রশ্মি চালনার ফলে ইলেকট্রন তিনটি কাজ করছে একসঙ্গে। প্রথমত, কোয়ান্টাম টানেলিংয়ের মাধ্যমে ইলেকট্রন পরমাণু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। তারপর ত্বরণ লাভ করে দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছে। এরপর আবার আলোর তরঙ্গের দিক পরিবর্তনের সময় ইলেকট্রন তার নিজের জায়গায় ফিরে আসছে শক্তি ক্ষয় করে। এই শক্তিক্ষয় হচ্ছে উচ্চ শক্তির ফোটন নির্গমনের মাধ্যমে। আর্গনে লেজার প্রয়োগ করার পর ব্যাপারটি একাধিকবার ঘটছে। ফলে আলট্রাফাস্ট অ্যাটোসেকেন্ড স্কেলের আলোর স্পন্দন তৈরি হচ্ছে গ্যাসের মধ্যে।

অ্যান লুলিয়ের কাজ থেকে একটি কর্মক্ষম অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দনের উৎস তৈরি করতে আরও দুটি ধাপ পার হতে হয়েছে। দুটি নতুন দরকারি পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হয়েছে। প্রথমত, স্পন্দনের সময় মাপতে হয়েছে; দ্বিতীয়ত, আলাদা আলাদা স্পন্দন তৈরি করতে হয়েছে। পদ্ধতি দুটির কোনোটিই সহজ নয়। এত ক্ষুদ্র সময়ের স্পন্দন মাপার একটি পদ্ধতির নাম FROG বা ব্যাঙপদ্ধতি (Frequency Resolved Optical Gating–FROG)। কিন্তু অ্যাটোসেকেন্ড মাপা সম্ভব নয় এই পদ্ধতিতে। কারণ, ফ্রগ পদ্ধতি খুবই কম শক্তিসম্পন্ন। এটি ফেমটোসেকেন্ডে সীমাবদ্ধ।

২০০১ সালে পিয়ের আগোস্তিনি নতুন পদ্ধতি বানালেন—র৵াবিট (বা খরগোশ) পদ্ধতি (RABBIT–Reconstruction of Attosecond Beating by Interference of Two-Photon Transitions)। যেখানে একটি অপটিক্যাল লেজারের তড়িৎক্ষেত্র অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দনের সঙ্গে যোগ করে দেওয়া হয়। এই পদ্ধতিতে পিয়ের আগোস্তিনি ও তাঁর দল ২৫০ অ্যাটোসেকেন্ডের ধারাবাহিক আলোর স্পন্দন তৈরি করতে সমর্থ হন।

এদিকে অধ্যাপক ফেরেন্স ক্রাউজের দল জার্মানিতে স্বতন্ত্রভাবে একই ধরনের আরেকটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করে, যেখানে তিনি অ্যাটোসেকেন্ড স্ট্রিকিং পদ্ধতিতে ৬৫০ অ্যাটোসেকেন্ডের স্পন্দনকে স্বতন্ত্রভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম হন। এভাবে অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দন পদ্ধতি আয়ত্তে আসার পর অতিক্ষুদ্র আলোর স্পন্দন তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে এখন।

মানুষের রোগনির্ণয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে অ্যাটোসেকেন্ড পালস, যা হয়ে উঠবে মলিকিউলার ফিঙ্গারপ্রিন্ট অব বায়োলজিক্যাল স্যাম্পলস।

অধ্যাপক লুলিয়ে ও ক্রাউজ তাঁদের অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিকসের গবেষণা ক্রমাগত চালিয়ে গেলেও প্রফেসর পিয়ের আগোস্তিনি আশাও করেননি যে ২০ বছর আগে তিনি যা উদ্ভাবন করেছিলেন, তা এত দিন পর এত গুরুত্ব পাবে।

অ্যাটোসেকেন্ড পালস বা স্পন্দনের অনেক বাস্তব ব্যবহারিক সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। রাসায়নিক কার্যকলাপ দেখার জন্য ফেমটোসেকেন্ড কেমিস্ট্রি বা ফেমটোকেমিস্ট্রি যথেষ্ট। কিন্তু আরও সুনির্দিষ্টভাবে ইলেকট্রনের কার্যক্রম দেখতে হলে অ্যাটোসেকেন্ড পালস দরকার। অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দন এত বেশি সুনির্দিষ্ট ও সূক্ষ্ম যে পরমাণুর ইলেকট্রনের কাজকর্ম দেখতে পারবে সেটা। তার মানে, ইলেকট্রনের কাজকর্ম সরাসরি দেখা যাবে। অ্যাটোসেকেন্ড পালস সলিডের ধর্মাবলি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, অপরিবাহীকে পরিবাহীতে রূপান্তরিত করতে পারবে। খুব কম সময়ের মধ্যেই ইলেকট্রনিকসের ডায়নামিকস পরিবর্তন করা যাবে। আলট্রাফাস্ট সুইচিং সম্ভব হবে, যেখানে সিলিকন ডাই–অক্সাইড অপরিবাহী থেকে দ্রুত পরিবাহীতে পরিণত হতে পারে। ফলে ইলেকট্রনিকসের জগতে এর বিরাট ব্যবহারিক ক্ষেত্র উন্মুক্ত হবে। উদ্ভাবিত হবে খুব দ্রুততর ইলেকট্রনিকস, জন্ম নেবে অনেক নতুন প্রযুক্তি।

মানুষের রোগনির্ণয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে অ্যাটোসেকেন্ড পালস, যা হয়ে উঠবে মলিকিউলার ফিঙ্গারপ্রিন্ট অব বায়োলজিক্যাল স্যাম্পলস। যেমন রক্তের নমুনায় অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দনের মাধ্যমে রক্তের উপাদানের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরিবর্তনও লক্ষ করা সম্ভব হবে। ফুসফুসের ক্যানসারের কথাই ধরা যাক, যেখানে রক্তের পরিবর্তন ধরতে পারা জরুরি। রক্তের উপাদানের রসায়নে কোনো পরিবর্তন হলে তা দ্রুত মনিটর করা যাবে। দ্রুত সময়ে শনাক্ত করতে পারলে উপযুক্ত চিকিৎসা সম্ভব হবে। ক্ষুদ্রতম সময়ের আলোর স্পন্দন যতবার দরকার শরীরে প্রবেশ করানো যাবে, তাতে কোনো ক্ষতি হবে না। কারণ, এই আলো স্বাভাবিক কপাঙ্কের আলো, যার তেজস্ক্রিয় বিকিরণ নেই।

মৌলিক গবেষণা এবং নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতেও বিরাট ভূমিকা রাখবে অ্যাটোসেকেন্ড পালস। যেমন আইনস্টাইনের ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট আরও ভালোভাবে বোঝা যাবে। আলোর ফোটন বস্তুর ওপর পড়ার পর ধাতু থেকে ইলেকট্রন নির্গত হয়। ধারণা করা হয়, এই পদ্ধতিতে আলো পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইলেকট্রন নির্গত হয়। কিন্তু অ্যাটোসেকেন্ড পালস দেখাচ্ছে যে এই পদ্ধতি সঙ্গে সঙ্গে ঘটছে না। আলো শোষণ এবং ইলেকট্রন নির্গমনের মধ্যে বেশ কয়েক অ্যাটোসেকেন্ড ফাঁক রয়ে যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে, পদার্থবিজ্ঞানের আরও অনেক নতুন নতুন বিষয় জানা যাবে, কিংবা পুরোনো বিষয় জানা যাবে আরও ভালোভাবে। অদূর ভবিষ্যতে কোয়ান্টাম বায়োলজি অনেক বেশি গুরুত্ব পাবে। খুলে যাবে ফেমটোকেমিস্ট্রি থেকে অ্যাটোকেমিস্ট্রির জগৎ।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, আরএমআইটি, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া

সূত্র: ১। সায়েন্টিফিক আমেরিকান, ৩ অক্টোবর ২০২৩।

২। www.nobelprize.org October 3, 2023.

৩। ফেরেন্স ক্রাউজ ও মিশা ইভানভ, অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিকস, ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল, কানাডা, ২০০৯।

৪। প্রদীপ দেব, রোগনির্ণয় ও চিকিৎসায় পদার্থবিজ্ঞান, প্রথমা, ২০২২।

৫। phys.org, October 3, 2023.

*লেখাটি ২০২৩ সালে বিজ্ঞানচিন্তার অক্টোবর সংখ্যায় প্রকাশিত