১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড লিনিয়ার অ্যাকসিলারেটর সেন্টারে (SLAC) আপ, ডাউন এবং স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক আবিষ্কৃত হয়।
কোয়ার্কের ধারণা দেন বিজ্ঞানী মারে গেল-মান, ১৯৬৪ সালে। তিনি প্রস্তাব করেন, প্রোটন ও নিউট্রন আসলে পরমাণুর মৌলিক কণা নয়। এসব কণা আরও ক্ষুদ্র কোনো মৌলিক কণা দিয়ে গঠিত এক ধরনের যৌগিক কণা। তবে খুদে এই মৌলিক কণার নাম কী হবে, তা নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন গেল-মান। কোনো নামই তাঁর পছন্দ হচ্ছিল না। একদিন ইউলিসিস-খ্যাত লেখক জেমস জয়েসের ফিনেগানস ওয়েক বইটি পড়ছিলেন গেল-মান। বইয়ের একটি ছড়ার লাইনে হঠাৎ তাঁর চোখ আটকে গেল। ছড়াটির একটি লাইন ছিল: ‘থ্রি কোয়ার্কস ফর মাস্টার মার্ক!’ ‘কোয়ার্ক’ শব্দটা বেশ মনে ধরল গেল-মানের। এই লিমেরিক থেকে তিনি ক্ষুদ্র সেই মৌলিক কণার নাম দিলেন কোয়ার্ক।
এরপর কোয়ার্ক কণার সন্ধানে নেমে পড়েন বিজ্ঞানীরা। পাঁচ বছর পর, অর্থাৎ ১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড লিনিয়ার অ্যাকসিলারেটর সেন্টারে (SLAC) আপ, ডাউন এবং স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক আবিষ্কৃত হয়। পরে, ১৯৭৪ সালের নভেম্বরে আবিষ্কৃত হয় চার্ম কোয়ার্ক। একই দিনে দুটি আলাদা দল স্বাধীনভাবে এই কোয়ার্কটি আবিষ্কারের ঘোষণা দেন। এরপর আবিষ্কৃত হয় বটম কোয়ার্ক। সেটি ১৯৭৭ সালে। অন্যদিকে সবচেয়ে ভারী কোয়ার্ক কণা শনাক্ত করা হয় ১৯৯৫ সালে। সর্বশেষ আবিষ্কৃত কণাটি ছিল টপ কোয়ার্ক। সংক্ষেপে এই হলো কোয়ার্ক আবিষ্কারের কাহিনি।
আবিষ্কারের ইতিহাস তো জানা গেল, কিন্তু কোয়ার্ক আসলে কী? এদের আচরণ কেমন? এই কণা খায়, নাকি মাথায় দেয়? প্রোটন, নিউট্রনের গভীরে তার কাজটা কী? চলুন, সেটাই এবার বোঝার চেষ্টা করা যাক।
কোয়ার্কদের নানা ভৌত ধর্মের ওপর ভিত্তি করে এদের নানাভাবে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে রয়েছে বৈদ্যুতিক চার্জ, ভর, কালার চার্জ এবং আইসোস্পিন। কণাপদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেলে একমাত্র কোয়ার্ক কণারাই চারটি মৌলিক বল—বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল, মহাকর্ষ, সবল ও দুর্বল নিউক্লিয়ার বল অনুভব করে।
ভরের ভিত্তিতে কোয়ার্ক তিন রকম: হালকা, মাঝারি ও ভারী। যেমন আপ ও ডাউন কোয়ার্ক হালকা, চার্ম ও স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক মাঝারি ভরের এবং টপ ও বটম ভারী কোয়ার্ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এরমধ্যেই আপনি নিশ্চয় ছয় ধরনের কোয়ার্ক কণার কথা জেনে গেছেন। এদের নাম: আপ, ডাউন, চার্ম, স্ট্রেঞ্জ, টপ ও বটম কোয়ার্ক। এদের বলা হয় ফ্লেভার। ছয়টি কোয়ার্কের মধ্যে পার্থক্য করতে তাদের এভাবে ভাগ করা হয়েছে। বাংলায় চাইলে স্বাদ বা গন্ধ বলতেই পারেন। কিন্তু এর সঙ্গে খাদ্যরসনার কোনো সম্পর্ক নেই। তাই জিভে চেখে দেখার ইচ্ছা এখনই বাদ দিন। কথিত আছে, মারে গেল-মান এবং হ্যারল্ড ফ্রিটজ একটা আইসক্রিম পার্লারে বসে কোয়ার্কদের মধ্যে পার্থক্য করার উপায় খুঁজছিলেন। আইসক্রিমের জন্য ব্যবহৃত ফ্লেভার শব্দটি তাঁদের বেশ মনে ধরে। তাই এমন নাম।
এদের তিনটি ধনাত্মক চার্জবাহী, বাকি তিনটি ঋণাত্মক চার্জবাহী। তবে এদের চার্জ পূর্ণ সংখ্যা নয়, বরং ভগ্নাংশ। আপ, চার্ম ও টপ কোয়ার্কের চার্জ +২/৩ এবং ডাউন, স্ট্রেঞ্জ ও বটম কোয়ার্কের চার্জ -১/৩। এ ব্যাপারে একটু পরে আবার আসছি।
ভরের ভিত্তিতে কোয়ার্ক তিন রকম: হালকা, মাঝারি ও ভারী। যেমন আপ ও ডাউন কোয়ার্ক হালকা, চার্ম ও স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক মাঝারি ভরের এবং টপ ও বটম ভারী কোয়ার্ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এদের মধ্যে টপ কোয়ার্ক সবচেয়ে ভারী। অন্য সব কোয়ার্কের ভর যেখানে ৫ গিগা ইলেকট্রন ভোল্টের নিচে, সেখানে টপ কোয়ার্কের ভর প্রায় ১৭৩ গিগা ইলেকট্রন ভোল্ট। (এমনিতে ইলেকট্রন ভোল্ট শক্তি পরিমাপের একক। তবে ক্ষুদ্র কণাদের জন্য আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ভর-শক্তি বিনিময় নীতি অনুযায়ী ভর বোঝাতেও এই একক ব্যবহৃত হয়।) আগেই বলেছি, পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রথম হালকা কোয়ার্ক আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৯৬৯ সালে। আবার এই কণাদের ভরের ভিত্তিতে তাদেরকে তিনটি আলাদা প্রজন্মেও ভাগ করা হয়। যেমন আপ ও ডাউন হলো প্রথম প্রজন্মের কোয়ার্ক। চার্ম ও স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক দ্বিতীয় প্রজন্মের এবং টপ ও বটম তৃতীয় প্রজন্মের কোয়ার্ক।
কোয়ার্কদের বিভাজন এখানেই শেষ নয়। আইসোস্পিনের ওপর ভিত্তি করেও এদের ভাগ করা হয়। বলে রাখা দরকার, প্রোটন ও নিউট্রনের পার্থক্য করতে আইসোস্পিনের ধারণাটি প্রথম দিয়েছিলেন জার্মান পদার্থবিদ ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ।
বৈদ্যুতিক চার্জ ছাড়াও প্রতিটি কোয়ার্কের আরেক ধরনের চার্জও থাকে। বৈদ্যুতিক চার্জ থেকে আলাদা করতে একে বলা হয় কালার চার্জ। বাংলায় রং বলতে চাইতে পারেন কেউ কেউ। কিন্তু একে আসলে আক্ষরিক অর্থে নয়, নিতে হবে রূপক অর্থে। কালার চার্জ অনুযায়ী, ছয়টি কোয়ার্কের প্রতিটিই তিনটি আলাদা রঙের হতে পারে। সেগুলো হলো: লাল, নীল ও সবুজ। মানে প্রকৃতির মৌলিক তিনটি রঙের। সহজভাবে বললে, আপ কোয়ার্ক তিনটি রঙে পাওয়া যায়। ডাউনসহ অন্যান্য কোয়ার্কও তাই। কাজেই কালার চার্জের হিসেব করলে কোয়ার্ক আসলে ছয় ধরনের নয়, ১৮ ধরনের। কারণ ছয়টি কোয়ার্কের প্রতিটির তিন ধরনের কালার চার্জ রয়েছে। পরমাণুর প্রোটন গঠিত হয় একটা নীল আপ কোয়ার্ক, একটি লাল আপ কোয়ার্ক এবং একটি সবুজ ডাউন কোয়ার্ক মিলে। সে কারণে প্রোটন কোনো বিশেষ রঙের হয় না, একে বলা যায় সাদা। কারণ এই তিনটি মৌলিক রং একত্রিত হয়ে সাদা রং তৈরি করে। গুগলে কোয়ার্কের ছবি সার্চ দিলে কোয়ার্কের কালারের ব্যাপারটি দেখতে পাবেন। এ বিষয়টি আলোচনা করা হয় কোয়ান্টাম ক্রোমোডাইনামিকসে। ক্রোমো অর্থ কালার বা রং। তাই এমন নামকরণ।
কোয়ার্কদের বিভাজন এখানেই শেষ নয়। আইসোস্পিনের ওপর ভিত্তি করেও এদের ভাগ করা হয়। বলে রাখা দরকার, প্রোটন ও নিউট্রনের পার্থক্য করতে আইসোস্পিনের ধারণাটি প্রথম দিয়েছিলেন জার্মান পদার্থবিদ ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ। সেই ১৯৩২ সালে। আইসোট্রপিক স্পিন থেকে শব্দটির উৎপত্তি। এটা অনেকটা কণাদের স্পিনের মতো। তবে দুইয়ের মধ্যে পার্থক্যও বিস্তর। যেমন স্পিন হলো কৌণিক ভরবেগ। অন্যদিকে আইসোস্পিন হলো স্পিনের মতো একধরনের ভৌত ধর্ম, যা কণার কোয়ার্কের গঠনের সঙ্গে সম্পর্কিত। এর মান ধনাত্মক বা ঋণাত্মক হতে পারে। যেমন আপ ও টপ কোয়ার্কের আইসোস্পিন ধনাত্মক, অন্যদিকে ডাউন ও বটম কোয়ার্কের আইসোস্পিন ঋণাত্মক।
কোয়ার্কের মধ্যে এতসব পার্থক্য থাকলেও তাদের মধ্যে একটা সাধারণ মিলও আছে। সেটি হলো, কোনো কোয়ার্কই প্রকৃতিতে আলাদা অবস্থায় পাওয়া যায় না। সবসময় দুটি বা তিনটি কোয়ার্ক একত্রে জোড় বেঁধে থাকে। সে হিসেবে কোয়ার্ককে বেশ সামাজিক আর মিশুক বলা যায়। এদের জোড় বাঁধার কাজটি করে গ্লুয়ন নামের এক বলবাহী কণা। গ্লুয়ন কণা কোয়ার্কদের গ্লু বা আঠার মতো জোড়া লাগিয়ে রাখে বলে অমন নাম। পরমাণুর নিউক্লিয়াসের প্রোটন ও নিউট্রনের প্রতিটিই তিনটি কোয়ার্ক কণা দিয়ে গঠিত। এদের মধ্যে দুটি আপ ও একটি ডাউন কোয়ার্ক মিলে তৈরি হয় প্রোটন। আর দুটি ডাউন ও একটি আপ কোয়ার্ক মিলে তৈরি হয় নিউট্রন। এখানে কোয়ার্কদের একত্রে বেঁধে রাখে গ্লুয়ন।
কোয়ার্কের সংখ্যা ৬টি হলেও আমাদের পরিচিত জগৎ গড়ে উঠেছে মাত্র দুটি কোয়ার্ক দিয়ে। সেগুলো হলো আপ ও ডাউন কোয়ার্ক। তাহলে বাকি কোয়ার্কগুলোর কাজ কী
আসলে গ্লুয়ন কণা সবল বা শক্তিশালী পারমাণবিক বল বা স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্সের বাহক হিসেবে কাজ করে। দুটি কোয়ার্কের মধ্যে দূরত্ব বাড়লে তাদের মধ্যে সবল বল আরও শক্তিশালী হয়। যদি জোরজবরদস্তি করে দুটি কোয়ার্কের মাঝখানের দূরত্ব বাড়ানো হয়, তাহলে শক্তিটা এতই বেশি হয়ে যায় যে সেখানে একটা নতুন কোয়ার্ক সৃষ্টি হয়। ব্যাপারটা বোঝা যাবে, দুটি আঙুলে রাবার ব্যান্ড ধরে আঙুল দুটি দূরে সরিয়ে নিলে। দেখা যাবে, আঙুল যত দূরে, ব্যান্ডটা তত শক্তিতে আঙুল দুটিকে কাছে টানবে। সবল বলের এই ধর্মটা বোঝাতে অনেক বিজ্ঞানী উদাহরণটা ব্যবহার করেন। এ কারণে প্রকৃতিতে একক কোয়ার্কের দেখা মেলে না।
কোয়ার্ক ও গ্লুয়ন একটি প্রোটনের তুলনায় অন্তত ১০ হাজার ভাগ ছোট। কাজেই তাদের নিয়ে গবেষণা করা চাট্টিখানি কথা নয়। আবার প্রোটন ও নিউট্রনের ধর্মের ভিত্তি হলো কোয়ার্ক ও গ্লুয়নের সম্মিলিত মিথস্ক্রিয়া। এই মিথস্ক্রিয়ার পেছনে এতই জটিল বিষয় জড়িত যে তা এই ছোট্ট আলোচনায় পুরোপুরি বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। তাই এ লেখাটা পড়ে কোয়ার্ক সম্পর্কে সবকিছু বুঝে ফেলার আশা করা ঠিক হবে না। এখানে স্রেফ একটা ধারণা পাওয়া যাবে।
আগেই বলেছি, কোয়ার্ক কণারা একত্রিত হয়ে নতুন কণা তৈরি করে। যেমন দুটি আপ এবং একটি ডাউন কোয়ার্ক মিলে তৈরি করে প্রোটন। তবে এখানে একটা মজার ব্যাপার আছে। বিষয়টা বিস্ময়করও বটে। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানে, এই তিনটি কোয়ার্কের মোট ভরের যোগফল হওয়া উচিত প্রোটনের ভর। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, ওই তিনটি কোয়ার্কের চেয়ে প্রোটনের ভর প্রায় ১০০ গুণ বেশি। তাহলে বাড়তি ভুতুড়ে ভরটা এল কোথা থেকে? উত্তরে বিজ্ঞানীরা বলেন, তিনটি কোয়ার্ককে যে বিপুল শক্তি একত্রে ধরে রাখে, তার কারণেই এই বাড়তি ভরটা আসে ভর-শক্তি বিনিময়ের নীতি অনুসারে।
আরও মজার ব্যাপার হলো, কোয়ার্কের সংখ্যা ৬টি হলেও আমাদের পরিচিত জগৎ গড়ে উঠেছে মাত্র দুটি কোয়ার্ক দিয়ে। সেগুলো হলো আপ ও ডাউন কোয়ার্ক। তাহলে বাকি কোয়ার্কগুলোর কাজ কী? এমনি এমনি? সেটাও বিজ্ঞানীদের কাছে বিরাট এক প্রশ্ন হয়ে ঝুলে আছে।
যাই হোক, আপ ও ডাউন কোয়ার্কগুলো যদি সঠিকভাবে একসঙ্গে ঘুঁটে দেওয়া যায়, তাহলে প্রোটন ও নিউট্রন বানানো সম্ভব। এতক্ষণে জেনে গেছেন, প্রোটন বানাতে লাগবে দুটি আপ ও একটা ডাউন কোয়ার্ক। তাহলে এদের চার্জ হবে ২/৩ + ২/৩ -১/৩ = +১। আর নিউট্রন বানাতে লাগবে একটি আপ ও দুটি ডাউন কোয়ার্ক। তাহলে এদের চার্জ হবে ২/৩ -১/৩ -১/৩ = ০। অর্থাৎ চার্জ শূন্য বা চার্জ নিরপেক্ষ।
পরমাণু তথা আমাদের জগতের জন্য এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং সৌভাগ্যেরও বটে। কারণ ইলেকট্রনের চার্জ শুধু -১ হতে পারে। কোয়ার্কের চার্জ যদি এর চেয়ে বেশি বা কম হতো, তাহলে তা ইলেকট্রনের ঋণাত্মক চার্জকে পুরোপুরি বাতিল করতে পারত না। তাতে কখনও গঠিত হতে পারত না স্থিতিশীল ও চার্জনিরপেক্ষ পরমাণু। কাজেই কোয়ার্কের এই সুষম -১/৩ ও +২/৩ চার্জ না থাকলে আজ মহাবিশ্বের এই ছোট্ট কোণে আমাদের কোনো অস্তিত্বই থাকত না। থাকত না কোনো রসায়ন, জীববিদ্যা বা অন্য কিছু; এমনকি প্রাণ বা বুদ্ধিমত্তা বলতে কোনো কিছুর অস্তিত্বও হতো এক কথায় অসম্ভব।