পদার্থবিজ্ঞান
ফ্যারাডের খাঁচা
বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গের ওপর আমরা ভীষণ নির্ভরশীল। ওয়াই-ফাই, ব্লুটুথ, মুঠোফোনের ফোরজি প্রযুক্তি, সবই বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ। এমনিতে এ তরঙ্গ আটকানো যায় না। তবে বিদ্যুৎ পরিবাহী ধাতব খাঁচা বা বাক্সের সাহায্যে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া যায় যেকোনো বস্তু বা যন্ত্রের চারপাশে। এরই নাম ফ্যারাডে কেজ। ফ্যারাডের খাঁচা। এই খাঁচার আদ্যোপান্ত...
তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য কি গোপন থাকছে? আমরা স্বেচ্ছায় স্মার্টফোন বা কম্পিউটারে নিজের নানা তথ্য দিই। এসব তথ্য সংগ্রহ করছে বিভিন্ন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান। না, আমাদের অজান্তে নয়। আমরা চুক্তি মেনে নিয়েই এসব তথ্য দিচ্ছি। বর্তমানে একটি কথা খুবই শোনা যায়, আপনি নিজেকে যতটা জানেন, গুগল তার চেয়ে বেশি জানে। কথাটা সত্যি। আমরা স্বেচ্ছায় যত তথ্য ডিভাইসে ইনপুট করি, তার চেয়ে বেশি তথ্য পেয়ে যায় প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের অজান্তে। আর এসব তথ্য আমার–আপনার কাছ থেকে তাদের হাতে যায় তরঙ্গের মাধ্যমে। বর্তমান পৃথিবীটা যেন দাঁড়িয়েই আছে বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় তরঙ্গের ওপর। মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট সংযোগ, রেডিও, টেলিভিশন সবখানেই তথ্য আদান–প্রদানের মাধ্যম এই অদৃশ্য তরঙ্গ। বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় তরঙ্গ ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। একে ধ্বংস করারও সুযোগ নেই। তবে একে চাইলে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া যায়।
প্রায় দুই শতাব্দী আগে ইংরেজ পদার্থবিদ মাইকেল ফ্যারাডে আবিষ্কার করেছিলেন সে কৌশল। বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় বিজ্ঞানের এই অগ্রদূত ১৮৩৮ সালে বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় তরঙ্গ নিষ্ক্রিয় করার উপযোগী একটি বাক্স তৈরি করেন। দেখা গেল, সেই বাক্সের বাইরে থেকে কোনো বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় তরঙ্গই আর ঢুকছে না ভেতরে। আমরা এখন জানি, এই বাক্সের নাম ফ্যারাডে কেজ বা ফ্যারাডের খাঁচা। ২০০ বছর আগে যেমন জিনিসটা দারুণ কাজ করেছিল, এখনো তা–ই করে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে এর ব্যবহার তেমন একটা না থাকলেও বাণিজ্যিকভাবে কিন্তু ফ্যারাডে কেজের মূলনীতি নানা ক্ষেত্রে কাজে লাগানো হয়।
বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় তরঙ্গ
প্রাকৃতিকভাবেই কোনো বিদ্যুৎ চার্জ তার চারপাশে একটি বিদ্যুৎক্ষেত্র তৈরি করে। এই ক্ষেত্রের দিক হয় ধনাত্মক চার্জ থেকে বাইরের দিকে। চার্জ থেকে যত দূরে যাওয়া যায়, ততই কমে এর শক্তি। (ছবি ১)
বিদ্যুৎক্ষেত্র তৈরির আরেকটা উপায় আছে। চৌম্বকক্ষেত্রের সাহায্যেও বিদ্যুৎক্ষেত্র তৈরি করা যায়। চুম্বকের চারপাশে মূলত চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি হয়। একটি চুম্বককে ঘোরাতে থাকলে তার চৌম্বকক্ষেত্রের পরিবর্তন ঘটে। এর ফলেই তৈরি হয় বিদ্যুৎক্ষেত্র।
মজার বিষয় হলো, বিদ্যুৎক্ষেত্রের পরিবর্তনের কারণেও চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি হয়। অর্থাৎ আমরা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারি, যেখানে বিদ্যুৎক্ষেত্রের পরিবর্তনের কারণে চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি হয়, আবার ওই চৌম্বকক্ষেত্রের পরিবর্তনের কারণে তৈরি হয় বিদ্যুৎক্ষেত্র।
এটাই ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলোর মূল ধারণা। সমীকরণগুলো বিদ্যুৎক্ষেত্র ও চৌম্বকক্ষেত্রের মধ্যকার সম্পর্ক নির্দেশ করে। মোট চারটি সমীকরণ প্রকাশ করেন স্কটিশ পদার্থবিদ জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল।
ফ্যারাডের খাঁচার জন্য দুটি জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ। এক, পরিবাহী পদার্থের পুরুত্ব। আর দুই, পরিবাহীর কাঠিন্য। পুরুত্বের বিষয়টা আগে বলা যাক।
বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য খুব বড়, অর্থাৎ ১০ মিটারের বেশি হলে একে বলা হয় রেডিও ওয়েভ বা বেতার তরঙ্গ। অন্যদিকে তরঙ্গদৈর্ঘ্য ১ মিলিমিটার থেকে ১ মিটারের মধ্যে থাকলে সেটা হবে মাইক্রোওয়েভ। আমার–আপনার চোখ ৪০০ থেকে ৭০০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় তরঙ্গ শনাক্ত করতে পারে। একেই আমরা দৃশ্যমান আলো বলে চিনি। বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় বর্ণালির খুবই ছোট্ট একটা অংশ এটা।
আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ধারণা আছে। একে বলা হয় সুপারপজিশন প্রিন্সিপাল বা উপরিপাতন নীতি। এ নীতি বলে, কোথাও যখন একাধিক ক্ষেত্র তৈরি হয়, তখন সব কটি ক্ষেত্রের ভেক্টর যোগফলের সমান হয় সম্মিলিত ক্ষেত্রটি। যেমন ধরা যাক, আপনার কাছে দুটি বিদ্যুৎ চার্জ আছে। সেগুলো একই জায়গায় রাখা। এখন এদের বিদ্যুৎক্ষেত্রটা ঠিক কেমন হবে? যোগফল হবে, তাতে সন্দেহ নেই। তবে যোগটা সাধারণ বীজগণিতের নিয়মে হবে না। যেহেতু ক্ষেত্রের দিক থাকে, তাই ভেক্টর নিয়মে যোগ হবে। অর্থাৎ যেকোনো বিন্দুতে বিদ্যুৎক্ষেত্রটা হবে আসলে দুই বা ততোধিক চার্জের ভেক্টর যোগফলের সমান। (ছবি-২)
দুটি চার্জ যদি একই দিকে বিদ্যুৎক্ষেত্র তৈরি করে, তাহলে সম্মিলিত ক্ষেত্রটি হবে অনেক বড়। আর দুটি চার্জ বিপরীত দিকে ক্ষেত্র তৈরি করলে মোট বিদ্যুৎক্ষেত্রটি ছোট হবে। বিদ্যুৎক্ষেত্র শূন্যও হতে পারে, যদি পরস্পর বিপরীতমুখী দুটি ক্ষেত্রের মান সমান হয়!
পরিবাহী পদার্থের বিদ্যুৎক্ষেত্র
ঠিক এই কাজই করা হয় ফ্যারাডের খাঁচায়। এতে একই ধরনের বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় তরঙ্গ বিপরীতমুখী করে তৈরি করা হয়। ফলে বাইরে থেকে আসা তরঙ্গটি বাতিল হয়ে যায়। এ জন্য সুপারপজিশনকে ধন্যবাদ দিতে পারেন। দুটি ক্ষেত্র পরস্পরকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে মোট ক্ষেত্রটি শূন্য হওয়ার বিষয়টিকে সুপারপজিশন বলে। আরেকটা সুপারপজিশন আছে কোয়ান্টাম মেকানিকসে। দুটো পুরোপুরি এক জিনিস নয়। বিদ্যুৎক্ষেত্র শূন্য হলে সেখানে কোনো বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় তরঙ্গ থাকার সুযোগ নেই। মনে রাখা দরকার, ফ্যারাডের খাঁচা কিন্তু বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় তরঙ্গকে আটকে দিচ্ছে না, শুধু শূন্য করে বাতিল করে দিচ্ছে।
মুক্ত ইলেকট্রনগুলো যেহেতু গোলকের পৃষ্ঠে অবস্থান করছে, তাই গোলকের ভেতরের যেকোনো বিন্দুতে মোট বিদ্যুৎক্ষেত্র হবে শূন্য। যদি শূন্য না হয়, তাহলে বিদ্যুৎক্ষেত্রটি ইলেকট্রনকে ধাক্কা দিতে থাকবে। মুক্ত ইলেকট্রনগুলো সব সরে যাবে গোলকের পৃষ্ঠের দিকে।
‘খাঁচা’ মানে একটি আবদ্ধ বস্তু। অনেকটা মুঠোফোনের মতো আকারের গোলাকার ছোটখাটো যন্ত্র হিসেবে ধরা যেতে পারে। বিদ্যুৎপরিবাহী ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি করা হয়। ধাতব পদার্থের পরিবাহিতার কারণে এর পুরো কাঠামোর পৃষ্ঠে মুক্ত ইলেকট্রন ও ইলেকট্রন চার্জ ছোটাছুটি করে। তৈরি হয় বিদ্যুৎক্ষেত্র, যা ভেতর থেকে বেরোনো বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় তরঙ্গকে বাতিল করে দেয়। ফলে ভেতর থেকে কোনো বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় তরঙ্গ আর বাইরে যেতে পারে না। এ কারণে ফ্যারাডে খাঁচার মধ্যে ফোন বা যেকোনো বৈদ্যুতিক যন্ত্র রাখলে তা বাইরে থেকে শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
একইভাবে বাইরের তড়িচ্চৌম্বকীয় তরঙ্গও বাতিল হয়ে যায় ফ্যারাডে খাঁচার কারণে। ফলে ভেতরে থাকা মুঠোফোনও বাইরের সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারে না।
আগেই বলেছি, বিদ্যুৎপরিবাহী পদার্থ দিয়ে ফ্যারাডের খাঁচা তৈরি করা হয়। যেমন কপার, অ্যালুমিনিয়াম, ইস্পাত ইত্যাদি। সুপরিবাহী পদার্থের অণুগুলো একটি অন্যটির সঙ্গে ইলেকট্রন শেয়ার করে। এর অর্থ, একটি ইলেকট্রন প্রায় সহজেই এক পরমাণু থেকে অন্য পরমাণুতে যেতে পারে। অপরিবাহী পদার্থ, যেমন কাঠ, প্লাস্টিক বা কাচে কিন্তু এমন ঘটনা ঘটে না। সেখানে ইলেকট্রন তাদের নিজ পরমাণুর সঙ্গে আবদ্ধ থাকে। ছোটাছুটি করতে পারে না।
পরিবাহী পদার্থে চার্জ মুক্তভাবে চলাচলের কারণে দারুণ কিছু ঘটনা ঘটে। যেমন বিদ্যুৎক্ষেত্রের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় জড়ালে পরিবাহীর ওপর চার্জ এমনভাবে চলাচল করতে পারে যে মোট বিদ্যুৎক্ষেত্র শূন্য হয়ে যায়।
বিষয়টা ভালোভাবে বোঝার জন্য আসুন একটি মানস পরীক্ষা করা যাক। ধরুন, আপনার কাছে ধাতব পরিবাহীর তৈরি একটি গোলক আছে, আর আছে কিছু ইলেকট্রন। (অতিরিক্ত এসব ইলেকট্রন যেকোনো জায়গা থেকে আসতে পারে।)
ধরা যাক, এরকম ১০০ ইলেকট্রন আছে আপনার কাছে। এগুলো আপনি গোলকের ওপর ছড়িয়ে দিলেন। নতুন এসব ইলেকট্রন একটা বিদ্যুৎক্ষেত্র তৈরি করবে। বিদ্যুৎক্ষেত্রটা ধাক্কা দেবে আগের ইলেকট্রনগুলোকে। ফলে এরা সবাই সরে যাবে গোলকের পৃষ্ঠের দিকে। পৃষ্ঠ থেকে নিজে নিজে এসব ইলেকট্রন বেরিয়ে যেতে পারবে না। অনেকটা তৃতীয় ছবির মতো গোলকের পৃষ্ঠে গাদাগাদি করে থাকবে। (ছবি ৩)
মুক্ত ইলেকট্রনগুলো যেহেতু গোলকের পৃষ্ঠে অবস্থান করছে, তাই গোলকের ভেতরের যেকোনো বিন্দুতে মোট বিদ্যুৎক্ষেত্র হবে শূন্য। যদি শূন্য না হয়, তাহলে বিদ্যুৎক্ষেত্রটি ইলেকট্রনকে ধাক্কা দিতে থাকবে। মুক্ত ইলেকট্রনগুলো সব সরে যাবে গোলকের পৃষ্ঠের দিকে। একটা সময় অবশ্যই শূন্যে পরিণত হবে। আর বিদ্যুৎক্ষেত্র শূন্য হলে এর ভেতরে কোনো বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় তরঙ্গ থাকবে না। গোলকটি পরিণত হবে একটি ফ্যারাডে খাঁচায়।
বিদ্যুৎক্ষেত্র নাহয় শূন্য হলো, কিন্তু চৌম্বকক্ষেত্রের কী হবে? এটাও বাতিল হয়ে যাবে। তবে বিদ্যুৎক্ষেত্রের মতো করে নয়। আসলে বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় তরঙ্গ চলাচলের জন্য চৌম্বকক্ষেত্রের পাশাপাশি বিদ্যুৎক্ষেত্রও দরকার। কোনো একটি শূন্য হলেই আর তরঙ্গ চলাচল করতে পারে না। ফলে চৌম্বকক্ষেত্র আপনাতেই বাতিল হয়ে যাবে।
সত্যিকারের ফ্যারাডে খাঁচা
ফ্যারাডে খাঁচা গোলাকার হওয়া জরুরি নয়। প্রায় যেকোনো আকৃতিরই হতে পারে। শুধু ভেতরটা ফাঁকা থাকতে হবে। যদিও তাত্ত্বিকভাবে ফাঁকা হওয়াও জরুরি নয়। কারণ, সব চার্জ পৃষ্ঠে জমা হলে ভেতরের বিদ্যুৎক্ষেত্র এমনিতেই শূন্য হবে। ব্যবহারোপযোগী করার জন্য ভেতরটা ফাঁকা রাখতে হয়। বাস্তব জীবনে আপনি অবশ্য যেকোনো পরিবাহী দিয়ে ফোন ঢেকে রেখে সেটাকে ফ্যারাডে খাঁচা হিসেবে ধরতে পারবেন না।
ফ্যারাডের খাঁচার জন্য দুটি জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ। এক, পরিবাহী পদার্থের পুরুত্ব। আর দুই, পরিবাহীর কাঠিন্য। পুরুত্বের বিষয়টা আগে বলা যাক।
ফ্যারাডে খাঁচার একটি মানদণ্ড হলো উপাদানের পুরুত্ব। এর মাধ্যমে ফ্যারাডে খাঁচা তৈরির জন্য ন্যূনতম কতটুকু পুরু হলে তা বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় তরঙ্গকে বাতিল করার মতো যথেষ্ট হবে, তা হিসাব করা হয়।
উপাদানের পুরুত্ব কেমন হবে, তা নির্ভর করে এর প্রতিরোধক্ষমতা (কোনো পদার্থের ইলেকট্রনগুলো চলাচল কতটা কঠিন), বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় তরঙ্গের কম্পাঙ্ক এবং ওই পদার্থের চৌম্বক ধর্মের ওপর। এর অর্থ, বেতার তরঙ্গের মতো লম্বা তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় তরঙ্গের জন্য তুলনামূলক বেশি পুরুত্বের পদার্থ দরকার।
ধরুন, আপনি আপনার ফোনটা এক প্রস্থ অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল দিয়ে মুড়িয়ে ফেললেন। অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল বিদ্যুৎ পরিবহন করে। আর এটি খুবই পাতলা। খুব বেশি ইলেকট্রন এতে মুক্ত থাকে না, বেশি দূরেও যেতে পারে না। ফলে জিনিসটা ফ্যারাডের খাঁচায় পরিণত হবে না। এ ক্ষেত্রে একটি অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল যথেষ্ট নয়।
এসব কথা যে চোখ বন্ধ করে মেনে নিতে হবে, তা নয়। চাইলে বাজার থেকে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল কিনে পরীক্ষাটি হাতে–কলমে করতে পারেন। এ জন্য প্রথমে আপনার ফোনটিকে এক প্রস্থ অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল দিয়ে ভালোভাবে মুড়ে নিন। এরপর আরেকটি ফোন দিয়ে আপনার ফোনে কল করুন। যদি বেজে ওঠে, তাহলে বুঝবেন জিনিসটা ফ্যারাডে খাঁচায় পরিণত হয়নি। তাই আরেক প্রস্থ অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল নিয়ে আবার ফোনটা মুড়ে ফেলুন। আবার কল দিন। এভাবে যতক্ষণ পর্যন্ত কল ঢুকবে, ততক্ষণ একই কাজ করুন। একসময় দেখবেন, অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের স্তর যথেষ্ট পুরু হয়েছে। আর কল ঢুকছে না। অর্থাৎ অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের আবরণটি এখন ফ্যারাডের খাঁচা হিসেবে কাজ করা শুরু করেছে।
বর্তমানে বিভিন্ন গবেষণা ও ব্যবহারিক কাজেও ব্যবহার করা হয় ফ্যারাডের খাঁচা। এর একটা চমৎকার উদাহরণ হলো উড়োজাহাজ। আকাশের মেঘের মধ্য দিয়ে চলা এই যানকে বজ্রপাতের হাত থেকে রক্ষা করে ফ্যারাডের আবিষ্কৃত এ প্রযুক্তি।
পুরোপুরি কঠিন পদার্থ ছাড়া জালের মতো বস্তু দিয়েও ফ্যারাডের খাঁচা তৈরি সম্ভব। হিসাব–নিকাশটা একটু জটিল। সহজভাবে বললে, জালের ছিদ্রগুলো যদি বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চেয়ে ছোট হয়, তাহলে সেটা ঠিকভাবে কাজ করবে।
কল্পনা করুন, আপনার ফোনের এফএম রেডিও ১০০ মেগাহার্জে টিউন করা আছে। এই বেতার তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রায় ৩ মিটার। এ ক্ষেত্রে জালের ছিদ্রগুলো ৩ মিটারের ছোট হলেই বাতিল হয়ে যাবে বেতার তরঙ্গ। তার মানে আপনি চাইলেই এমন ফ্যারাডের খাঁচা তৈরি করতে পারেন, যার মধ্য দিয়ে প্রমাণ আকারের একজন মানুষ অনায়াসে পেরোতে পারে।
বর্তমানে স্মার্টফোন বা ওয়াই–ফাই তরঙ্গে অবশ্য এর চেয়ে অনেক কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তরঙ্গ ব্যবহার করা হয়। ওয়াই–ফাই রাউটার থেকে সাধারণত ২.৪ বা ৫ গিগাহার্জের তরঙ্গ নির্গত হয়। এগুলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যথাক্রমে ১২০ ও ৬০ মিলিমিটার। অন্যদিকে ফোরজি মোবাইল নেটওয়ার্কের তরঙ্গ কম্পাঙ্ক সাধারণত ৭০০ মেগাহার্জ থেকে ৩ গিগাহার্জের মধ্যে থাকে। আর ফাইভজি প্রযুক্তিতে তাত্ত্বিকভাবে তরঙ্গের কম্পাঙ্ক হতে পারে ৬ থেকে ৩০০ গিগাহার্জের মধ্যে। এ ক্ষেত্রে তরঙ্গদৈর্ঘ্য হবে ১ সেন্টিমিটারের মতো। জালের মতো উপাদান দিয়ে তৈরি ১ সেন্টিমিটারের চেয়ে কম ব্যাসের ছিদ্রযুক্ত ফ্যারাডের খাঁচা এ তরঙ্গকে আটকে দিতে পারবে।
বর্তমানে বিভিন্ন গবেষণা ও ব্যবহারিক কাজেও ব্যবহার করা হয় ফ্যারাডের খাঁচা। এর একটা চমৎকার উদাহরণ হলো উড়োজাহাজ। আকাশের মেঘের মধ্য দিয়ে চলা এই যানকে বজ্রপাতের হাত থেকে রক্ষা করে ফ্যারাডের আবিষ্কৃত এ প্রযুক্তি। উড়োজাহাজের দেহটা ধাতব হওয়ায় এটা নিজেই ফ্যারাডের খাঁচা হিসেবে কাজ করে। ফলে বিমানে বজ্রপাত হলেও যাত্রীরা বেঁচে যান ফ্যারাডে খাঁচার কল্যাণে।
মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার বিষয়টি এখানে উদাহরণ হিসেবে আনা হয়েছে। বাস্তবিক অর্থে মুঠোফোনকে ফ্যারাডে খাঁচায় বন্দী রাখা কোনো কাজের কথা নয়। ডিজিটালি নিরাপদ থাকার অনেক উপায় আছে। আর কিছু না হোক, বেশি দুশ্চিন্তায় পড়লে ফোনটাই বন্ধ করে রাখতে পারেন।