চার্ম কোয়ার্কের কাহিনি

১৯৬০-এর দশকের প্রথম দিকে মারে গেল-মান তাঁর অষ্টাঙ্গিক পন্থা অবলম্বন করে প্রোটন ও নিউট্রনের অভ্যন্তরে কোয়ার্ক নামের ভগ্নাংশ তড়িৎ আধানের মৌলিক কণার ভাবীকথন করেছিলেন। তাঁর পদ্ধতি আপ (u, ওপর), ডাউন (d, নিচ) এবং স্ট্রেঞ্জ (s, অদ্ভুত) কোয়ার্কের অস্তিত্ব নির্দেশ করে। এর আগে আমরা বিজ্ঞানচিন্তায় মারে-গেলমানের এই পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছিলাম। ছবি ১-এ সেই অষ্টাঙ্গিক পন্থা বর্ণিত হয়েছে। মোট তিনটি অক্ষ দিয়ে কিছু কণার বৈশিষ্ট্য দেখানো হয়েছে। এই অক্ষগুলো হলো I3 (আইসোস্পিন), S (স্ট্রেঞ্জনেস, strangeness) এবং Q (তড়িৎ আধান)। যেমন প্রোটন দুটি u এবং একটি d কোয়ার্কের সমষ্টি, সেটির স্ট্রেঞ্জনেস হলো ০, আইসোস্পিন হলো ১/২ এবং তড়িৎ আধান +১। অন্যদিকে Ξ– (যাই বা যি) কণার স্ট্রেঞ্জনেস হলো ২, আইসোস্পিন -১/২ ও তড়িৎ আধান -১।

আইসোস্পিনের ব্যাপারটা অনেকটা ইলেকট্রন স্পিনের মতোই, ইলেকট্রনের যেমন +১/২ ও -১/২ স্পিন থাকতে পারে, বিজ্ঞানীরা ধারণা করলেন প্রোটন ও নিউট্রন একটি কণারই দুটি আইসোস্পিন রূপ। কণার আইসোস্পিন +১/২ হলে প্রোটন ও -১/২ হলে সেটি হবে নিউট্রন। আর স্ট্রেঞ্জনেস হলো স্পিনের মতোই কণাগুলোর একটি অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য। যদি কোনো কণা প্রোটনে রূপান্তরিত হয়, তবে তার স্ট্রেঞ্জনেস হবে -১, অ্যান্টি বা প্রতিপ্রোটনে রূপান্তরিত হলে তার স্ট্রেঞ্জনেস হবে +১। কোনো স্ট্রেঞ্জ কণা অন্য একটি স্ট্রেঞ্জ কণায় রূপান্তরিত হতে বেশি সময় (~১০-১০ সেকেন্ড) নিলে তার স্ট্রেঞ্জনেস হবে বেশি, যেমন -২, আর কম সময় (~১০-২৪ সেকেন্ড) নিলে তার স্ট্রেঞ্জনেস হবে -১। আমরা এখন জানি, সবল মিথস্ক্রিয়ায় কণাগুলোর স্ট্রেঞ্জনেস নম্বর সংরক্ষিত হয়, দুর্বল মিথস্ক্রিয়ায় হয় না।

ছবি ১: মারে গেল-মানের Eight-Fold Way (অষ্টাঙ্গিক পথ)। I3 অক্ষ হলো আইসোস্পিন, S স্ট্রেঞ্জনেস ও Q হলো তড়িৎ আধান।

ছবি ১-এ দুটি কণার, Σ০ (সিগমা) ও Λ-র (লামডা) স্ট্রেঞ্জনেস ১, আইসোস্পিন ০ ও তড়িৎ আধান হলো ০; তারা স্থান পেয়েছে ষড়ভুজের কেন্দ্রে। চিত্রটি নিশ্চয়ই প্রকৃতির মধ্যে কোনো গভীর প্রতিসাম্য নির্দেশ করে, কিন্তু এর অর্থ উদ্ধার করতে গেল-মানের একটু সময় লাগল। কারণ, কোয়ার্কের বাস্তব অস্তিত্বের কথা তখনো জানা ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দীতে নরওয়ের গণিতবিদ সোফাস লি এমন একটি গ্রুপ তত্ত্ব সৃষ্টি করেছিলেন, যেখানে Special Unitary SU(3) নামে একটি গ্রুপ পাওয়া যায়। SU(3) দিয়ে গেল-মান তাঁর অষ্টাঙ্গিক পথের রহস্য উদ্‌ঘাটন করলেন।

১৯৬০-এর দশকের শেষে স্ট্যানফোর্ড লিনিয়ার অ্যাক্সিলারেটর সেন্টার (এসএলএসি) কণা ত্বরক যন্ত্রে পদার্থবিদেরা প্রোটনের ওপর উচ্চশক্তির ইলেকট্রন আঘাতের একটি পরীক্ষা করছিলেন।

SU(3) তত্ত্বে ত্রিভুজ একটি মৌলিক গ্রুপ। গেল-মান ভাবলেন, এ ধরনের ত্রিভুজ পাওয়া যাবে, যদি আমরা কোয়ার্ক নামের একধরনের কণা চিন্তা করি, যেগুলোর তড়িৎ আধান পূর্ণ সংখ্যা নয়। তিনি তিন ধরনের কোয়ার্কের কথা চিন্তা করলেন—আপ (u), ডাউন (d) ও স্ট্রেঞ্জ (s)। এগুলোর তড়িৎ আধান হবে যথাক্রমে +২/৩, -১/৩ ও -১/৩ এবং অন্যদিকে আইসোস্পিন সংখ্যা হবে +১/২, -১/২ ও ০। ২ নম্বর ছবিতে এই ত্রিভুজ গ্রুপ দেখানো হলো। এই মৌলিক গ্রুপটি ব্যবহার করে খুব সহজেই অষ্টাঙ্গিক পথের চিত্র ১-এর ষড়ভুজটি গঠন করা সম্ভব। মারে গেল-মান এই পদ্ধতি ব্যবহার করে W- নামে কোয়ার্ক দিয়ে গঠিত একটি নতুন অনাবিষ্কৃত কণার ভাবীকথন করলেন। কণা ত্বরক যন্ত্রে সেটি আবিষ্কারের পর ১৯৬৯ সালে তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।

১৯৬০-এর দশকের শেষে স্ট্যানফোর্ড লিনিয়ার অ্যাক্সিলারেটর সেন্টার (এসএলএসি) কণা ত্বরক যন্ত্রে পদার্থবিদেরা প্রোটনের ওপর উচ্চশক্তির ইলেকট্রন আঘাতের একটি পরীক্ষা করছিলেন। তাঁরা দেখলেন, বেশ কিছু ক্ষেত্রে ইলেকট্রনগুলো প্রোটনকে আঘাতের পরে সূক্ষ্ম কোণ করে বিচ্ছুরিত হচ্ছে, অর্থাৎ প্রায় উল্টো দিকে ফিরে আসছে। বিজ্ঞানীরা তত দিনে জানতেন, প্রোটনের ব্যাসার্ধ ১০-১৫ মিটারের মতো। যদি প্রোটনের সব ভর সমানভাবে ১০-১৫ মিটারে ছড়ানো থাকত, তাহলে এ ধরনের বিচ্ছুরণ পাওয়ার কথা নয়। কারণ, ইলেকট্রনকে একেবারে উল্টো দিকে ফিরিয়ে দেওয়ার মতো যথেষ্ট ভর আঘাতের বিন্দুগুলো থাকত না। এটা তখনই সম্ভব, যদি প্রোটনের তড়িৎ আধান সমানভাবে ছড়ানো না থেকে কয়েকটি জায়গায় ঘনীভূত থাকে।

ছবি ২: SU(3) গ্রুপের একটি মৌলিক গ্রুপ হলো u, d, এবং s কোয়ার্কের ত্রিভুজ। এখানে I অক্ষ হলো আইসোস্পিন ও S অক্ষ হলো স্ট্রেঞ্জনেস। এই গ্রুপ ব্যবহার করে চিত্র ১-এর ষড়ভুজটি সৃষ্টি করা সম্ভব।

ইলেকট্রন প্রোটনের সঙ্গে বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয়ভাবে বিক্রিয়া করে অলীক বা ভাচ্যুয়াল (Virtual) ফোটনের আদান-প্রদানের মাধ্যমে। তাত্ত্বিক গণনায় পাওয়া গেল, এই ফোটনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ১০-১৬ মিটার, অর্থাৎ প্রোটনের ব্যাসার্ধের এক–দশমাংশ (১/১০)। এর মানে হলো ইলেকট্রন যখন প্রোটনকে আঘাত করছে, তখন সেই আঘাতের অংশটা ১০-১৬ মিটারের মতো, অর্থাৎ প্রোটনের খুব অল্প অংশের সঙ্গে ইলেকট্রন বিক্রিয়া করছে। ওই ছোট অংশে প্রোটনের ভরের একটা বড় অংশ ঘনীভূত আছে। কারণ, সেই ভরের সংঘাতে ইলেকট্রন প্রায় সোজাসুজি ফিরে আসছে, অল্প ভরের সঙ্গে আঘাত করলে সোজাসুজি ফিরে আসার সম্ভাব্যতা কম থাকে। বিজ্ঞানীরা ধীরে ধীরে বুঝতে পারলেন, গেল-মান বর্ণিত কোয়ার্কের সঙ্গেই মনে হয় ইলেকট্রনগুলো আঘাত করছে। অর্থাৎ প্রোটন একক সমসত্ত্ব কোনো কণা নয়, বরং বিচ্ছিন্ন কোয়ার্ক কণা দিয়ে গঠিত। এভাবেই কোয়ার্কের বাস্তব অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হলো। এই পরীক্ষার জন্য এমআইটির জেরোম ফ্রিডম্যান ও হেনরি কেন্ডাল এবং এসএলএসির রিচার্ড টেইলার ১৯৯০ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।

ইলেকট্রন প্রোটনের সঙ্গে বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয়ভাবে বিক্রিয়া করে অলীক বা ভাচ্যুয়াল (Virtual) ফোটনের আদান-প্রদানের মাধ্যমে। তাত্ত্বিক গণনায় পাওয়া গেল, এই ফোটনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ১০-১৬ মিটার, অর্থাৎ প্রোটনের ব্যাসার্ধের এক–দশমাংশ (১/১০)।

কণা ত্বরক যন্ত্রে এরপর আরও উচ্চশক্তির ইলেকট্রন দিয়ে প্রোটনকে আঘাত করা হয়েছে, যেখানে বিক্রিয়া-মধ্যস্থতাকারী ফোটনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য হলো ১০-১৮ মিটার। কিন্তু সেই সূক্ষ্মতায় কোয়ার্ক গঠনের মধ্যে আর কোনো উপগঠন পাওয়া যায়নি, অর্থাৎ ১০-১৮ মিটার পর্যন্ত দেখলে কোয়ার্কই হচ্ছে মৌলিক কণা।

ছবি ৩: W- কণার মাধ্যমে দুর্বল মিথস্ক্রিয়ায় একদিকে যেমন d কোয়ার্ক স্বাদ (ফ্লেভার) বদলিয়ে u হয়, অন্যদিকে ইলেকট্রন নিউট্রিনো কণা ইলেকট্রনে পরিণত হয়।

গেল-মানের অষ্টাঙ্গিক চিত্রে তিনটি কোয়ার্কের কথা বলা হয়েছে—u, d ও s। দেখা গেল u ও d-কে এক গোত্রে রাখা গেলেও s (স্ট্রেঞ্জ) যেন দলছুট। কীভাবে দলছুট? সেই কাহিনির জন্য ১৯৬০-এর দশকের শেষে শেলডন গ্লাশো, স্টিভেন ওয়াইনবার্গ ও আবদুস সালামের গবেষণায় গঠিত বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় ও নিউক্লীয় দুর্বল বলকে একীভূত করার তত্ত্বকে স্মরণ করতে হবে। তাঁদের কাজ বর্তমানের পদার্থবিদ্যার স্ট্যান্ডার্ড বা প্রমিত মডেল নামে গৃহীত (এ জন্য তাঁরা ১৯৭৯ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন)। এই মডেলের জন্মের সময় মনে করা হতো, দুর্বল মিথস্ক্রিয়া দুটি আধানযুক্ত কণা দ্বারা বাহিত হয়—W+ ও W-। যেমন বেটা অবক্ষয় বলে যে প্রক্রিয়া (চিত্র ৩), যেখানে একটি নিউট্রন প্রোটনে রূপান্তরিত হয় একটি ইলেকট্রন এবং পরা-নিউট্রিনো (পরা ইলেকট্রন নিউট্রিনো) বিকিরণের মাধ্যমে। সেটিকে বাস্তবায়িত করতে W- বোসন নামে একটি কণার উপস্থিতি লাগবে। এই W- বোসন কণাটি দুর্বল মিথস্ক্রিয়ার পরিবাহক এবং ১০-২৫ সেকেন্ডের কম সময় স্থায়ী হয়। এই প্রক্রিয়ায় একটি W- কণা (আধান -১) বিকিরণের মাধ্যমে নিউট্রনের একটি d কোয়ার্ক (আধান -১/৩) একটি u কোয়ার্কে (আধান +২/৩) পরিণত হয়। d থেকে u হওয়া মানে কোয়ার্কের স্বাদ বা ফ্লেভার যায় বদলে, নিউট্রন হয়ে যায় প্রোটন। এই W- কণাটি আবার কিছুক্ষণ পরে একটি ইলেকট্রন (আধান -১) ও একটি ইলেকট্রন প্রতি-নিউট্রিনোতে (আধান ০) ক্ষয়িত হয়। আবার প্রোটনও W কণার মাধ্যমে নিউট্রনে রূপান্তরিত হতে পারে একটি u কোয়ার্ককে ডাউন কোয়ার্কে পরিণত করে।

ছবি ৪: W-বোসন কণা বিকিরণের মাধ্যমে একটি d কোয়ার্ক একটি u কোয়ার্কে রূপান্তরিত হতে পারে।

কিন্তু তাহলে গেল-মানের অষ্টাঙ্গিক প্রথায় যে চার্ম কোয়ার্ক (c) পাওয়া গিয়েছিল, সেটির স্থান কোথায়? বিজ্ঞানীরা ধারণা করা শুরু করলেন, u ও d কোয়ার্ক যেমন একটি কোয়ার্ক প্রজন্ম, তেমনি নিশ্চয়ই c-এর আরেকটি সঙ্গী আছে, যা দিয়ে দ্বিতীয় প্রজন্মের কোয়ার্ক পরিবার গঠিত। ইতিমধ্যে বিজ্ঞানীরা দুটি প্রজন্মের লেপটন পরিবার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। লেপটন হলো ১/২ স্পিন মাত্রার মৌলিক কণা, যেগুলো সবল মিথস্ক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে না। এই দুই লেপটন প্রজন্ম হলো ইলেকট্রন ও ইলেকট্রন নিউট্রিনো এবং মিয়ন ও মিয়ন নিউট্রিনো। কোয়ার্কের সঙ্গে ইলেকট্রন নিউট্রনো (νe) বিক্রিয়া কোয়ার্কের স্বাদ (ফ্লেভার) যেমন বদলায়, আবার নিজে ইলেকট্রনে (e) পরিবর্তিত হয়, অন্যদিকে এই প্রক্রিয়ায় মিয়ন নিউট্রনো (νμ) মিওনে (μ) পরিবর্তিত হয়। ছবি ৩-এ এ রকম একটি প্রক্রিয়ার ফাইনম্যান চিত্র দেখানো হলো। চিত্রে t অক্ষ হলো সময় এবং x অক্ষ হলো স্থান।

যখন গ্লাশো, ওয়াইনবার্গ ও সালামের তত্ত্ব থেকে দুর্বল মিথস্ক্রিয়ার দুটি পরিবাহী কণা W+ ও W- ছাড়া আরেকটি কণা পাওয়া গেল। সেটি হলো আধানবিহীন Z0 বোসন কণা—শুধু তখনই বিজ্ঞানীরা আরেকটি প্রজন্মে, s কোয়ার্কের জোড়া হিসেবে c কোয়ার্কের অস্তিত্ব নিশ্চিতভাবে অনুমান করতে পারলেন।

এসব গবেষণার ফলে বিজ্ঞানীরা ৪-এর ছবিতে দেখানো তালিকাটা প্রস্তুত করতে পেরেছিলেন। এটা দেখে হয় তো মনে করা যেতে পারে, তাঁদের প্রথম থেকেই s কোয়ার্কের সঙ্গে আরেকটি কোয়ার্কের কথা অনুমান করা উচিত ছিল, কিন্তু সেটি সরাসরি না করতে পারার বেশ কিছু কারণ ছিল। একটা কারণ হলো ছবি ৩-এর যে প্রক্রিয়া, তাতে দেখা গেল, খুব অল্প কিছু বিক্রিয়ায় (৫%) একটি s কোয়ার্ক (আধান -১/৩) u কোয়ার্কে পরিণত হচ্ছে। অর্থাৎ এক প্রজন্মের কোয়ার্ক স্বাদ বদলে অন্য প্রজন্মের কোয়ার্কে রূপান্তরিত হচ্ছে। এমন যেন d কোয়ার্ক ঠিক d কোয়ার্ক নয়, বরং মূলত d এবং অল্প s দিয়ে তৈরি। এটি একটি বিভ্রান্তির কারণ। যখন গ্লাশো, ওয়াইনবার্গ ও সালামের তত্ত্ব থেকে দুর্বল মিথস্ক্রিয়ার দুটি পরিবাহী কণা W+ ও W- ছাড়া আরেকটি কণা পাওয়া গেল। সেটি হলো আধানবিহীন Z0 বোসন কণা—শুধু তখনই বিজ্ঞানীরা আরেকটি প্রজন্মে, s কোয়ার্কের জোড়া হিসেবে c কোয়ার্কের অস্তিত্ব নিশ্চিতভাবে অনুমান করতে পারলেন। (আমরা আপাতত Z0 কণার ভূমিকা নিয়ে এখানে আলোচনা করছি না।)

ছবি ৫: প্রমিত মডেলে চার্ম কোয়ার্ক আবিষ্কারের আগে কোয়ার্ক ও লেপটন কণাগুলোর শ্রেণি। s কণাকে একটি প্রশ্নচিহ্নের কোয়ার্কের সঙ্গে রাখা হয়েছে, সেই অজ্ঞাত কণাটিই হলো চার্ম (c)।

চার্ম কোয়ার্কের আবিষ্কার প্রমিত মডেলকে একটা দৃঢ় ভিত্তিতে স্থাপন করে। ১৯৭৪ সালে এসএলএসি কণা ত্বরক যন্ত্রে বিজ্ঞানীরা ইলেকট্রন ও পজিট্রনের সংঘর্ষ ঘটিয়ে একটি খুব উচ্চশক্তির কণা আবিষ্কার করলেন। একই সময়ে আমেরিকার পূর্ব তীরে ব্রুকহেভেনের কণা ত্বরকে বেরেলিয়াম নিউক্লিয়াসের সঙ্গে উচ্চগতির প্রোটনের সংঘর্ষে একই শক্তির কণা পাওয়া গেল। স্যামুয়েল টিংয়ের ব্রুকহেভেনের দল কণাটির নাম দিল J, আর বার্টন রিখটারের এসএলএসির দল নাম দিল Ψ সাই। দেখা গেল, J/Ψ কণা একটি চার্ম কোয়ার্ক (আধান +২/৩) ও একটি প্রতি-চার্ম কোয়ার্কের (আধান -২/৩) সমষ্টি। এগুলো খুব অল্প সময়ের জন্য (১০-২০ সেকেন্ড) জুটি বাঁধে, তারপর একে অপরকে ধ্বংস করে শক্তি সৃষ্টি করে। টিং ও রিখটার ১৯৭৬ সালে নোবেল পুরস্কার পেলেন।

প্রোটনের থেকে তিন গুণ ভারী J/Ψ কণা ওই সময় পর্যন্ত আবিষ্কৃত কোয়ার্কগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভরসম্পন্ন ছিল। ৫ নম্বর চিত্রে J/Ψ কণার চার্ম ও প্রতি-চার্ম কণা পরস্পরকে ধ্বংস করে বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় মিথস্ক্রিয়ায় কী করে ফোটনের মাধ্যমে ইলেকট্রন ও পজিট্রন জোড়া তৈরি করতে পারে, তা–ই দেখানো হয়েছে।

ছবি ৬: একটি চার্ম ও একটি পরা-চার্ম পরস্পরকে ধংস করে বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় মিথস্ক্রিয়ায় একটি ইলেকট্রন ও একটি পজিট্রন তৈরি করতে পারে।

চার্ম কোয়ার্কের আবিষ্কারের মাধ্যমে যাকে এখন আমরা বলি কোয়ান্টাম ক্রোমোডাইনামিকস (কোয়ার্কের রং নির্ধারিত আধান থেকে নামটি এসেছে) ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করতে থাকল। J/Ψ কণা আবিষ্কারের কয়েক বছরের মধ্যেই তৃতীয় প্রজন্মের লেপটন τ (টাউ) এবং তৃতীয় প্রজন্মের কোয়ার্ক b (বটম) আবিষ্কৃত হলো। আর সবচেয়ে ভারী কণা তৃতীয় প্রজন্মের t (টপ) কোয়ার্ক পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হলো ১৯৯৪ পর্যন্ত। কণা ত্বরক যন্ত্রে এই ছয় কোয়ার্কের আবিষ্কার তাদের ভর অনুযায়ী হয়েছে, সময়ের সঙ্গে কণা ত্বরকের যত ক্ষমতা বেড়েছে, তত উচ্চভরের কোয়ার্কের সন্ধান পাওয়া গেছে। আর আমরা এখন যে প্রমিত মডেল ব্যবহার করি, তার পূর্ণ রূপের জন্য ১৯৭০-এর দশকের গবেষণার কাছে আমরা ঋণী। এই লেখা শেষ করার আগে বলি, মহাবিশ্বের সব স্থিত (stable অর্থে) বস্তু u এবং d কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি। অন্য দুটি প্রজন্মের s, c, b এবং t (টপ) কোয়ার্ক অস্থিত এবং সেগুলো উচ্চশক্তির প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়ে খুব দ্রুত ক্ষয় হয়ে যায়। কেন কোয়ার্কগুলো তিনটি প্রজন্মের রূপে আসে, সেটি বিজ্ঞানীদের কাছে এখনো রহস্য হয়ে আছে।

লেখক: অধ্যাপক ও গবেষক, মোরেনো ভ্যালি কলেজ, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র

* লেখাটি ২০২২ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত

আরও পড়ুন