প্রকৃতিতে সবকিছুরই একটা বিপরীত স্বভাব আছে। মৌলিক কণাই বলুন আর বল বা শক্তি—এই বৈপরীত্য খুঁজে পাবেন সবখানে। যেমন ধরুন, প্রোটন বা মৌলিক কণা ইলেকট্রনের কথা। এদের সাধারণ ধর্ম যথাক্রমে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক। কিন্তু ধনাত্মক চার্জের ইলেকট্রনও প্রকৃতিতে আছে। এদের বলা হয় অ্যান্টিইলেকট্রন বা পজিট্রন। তেমনি ঋণাত্মক চার্জের প্রোটনেরও অস্তিত্ব আছে, যাকে বলে অ্যান্টিপ্রোটন। বিজ্ঞান সম্পর্কে যারা নূন্যতম খোঁজখবর রাখেন, তাদের কাছে সম্ভবত এ বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। এই দুই বিপরীত ধর্মের সুষম সমন্বয়েই টিকে আছে মহাবিশ্ব, গ্রহ-তারা-ছায়াপথ এবং অবশ্যই আমরা—মানুষসহ অন্যান্য জীবজন্তু।
আলোরও বিপরীত স্বভাব আছে। আসলে আলোর অভাবই অন্ধকার। আলো এবং অন্ধকার হলো মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। সাদাকে যদি আলোর প্রতীক ধরা হয়, তাহলে কালো অন্ধকারের। বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বললে, কোনো বস্তুতে দৃশ্যমান আলোর সব রং যখন একসঙ্গে মিশে আমাদের চোখে প্রতিফলিত হয়, তখনই সাদার জন্ম। আরও ভালোভাবে বললে, এ সময়ই আমাদের সাদা রং দেখার অনুভূতি জন্মায়। উল্টো দিকে কোনো বস্তু যখন সব রং শুষে নেয়, তখন সেখান থেকে কোনো রঙের আলো আর প্রতিফলিত হতে পারে না। তাতেই আমাদের কালো দেখার অনুভূতি জন্মে।
পদার্থবিজ্ঞানের চোখে আলোর গতিসীমা নির্দিষ্ট—প্রতি সেকেন্ডে ৩ লাখ কিলোমিটার (১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল)। একে বলা হয় মহাজাগতিক গতিসীমা। কারণ এই গতির ওপরে মহাবিশ্বের কিছু চলতে পারে না। এ পর্যায়ে এসে মনে একটা প্রশ্ন না জেগে পারে না। সেটা হলো: আলোর মতো অন্ধকারেরও কি নির্দিষ্ট গতি আছে? থাকলে সেটা কত?
সত্যি বলতে কী, পদার্থবিজ্ঞানের চোখে আলোর মতো অন্ধকারের আলাদা কোনো ভৌত অস্তিত্ব নেই। তবে অন্ধকারের গতির কথা স্বীকার করা হয়। সে গতি আলাদা কিছু নয়, আলোরই গতি। অর্থাৎ অন্ধকারও ছড়িয়ে পড়ে আলোর গতিতেই। চলার পথে আলো বাধা পেলে তার বিপরীতে অন্ধকারের জন্ম হয়। যেকোনো মুহূর্তে আলোর সামনে বাধা সৃষ্টি করে অন্ধকার সৃষ্টি করা যায়। সেটাও ঘটে চোখের পলকে। ঠিক আলোরই গতিতে। ব্যাপারটা আরেকটু খুলে বলা যাক।
ধরা যাক, আপনি একটা স্পেসশিপে চড়ে বহুদূর মহাকাশ ভ্রমণে বেরিয়েছেন। সেখানে কোনো আলোর উৎস নেই। এমনকি সূর্য বা অন্য কোনো নক্ষত্রের আলোও নেই। আপনার স্পেসশিপের নাক বরাবর একটা লাইট বাল্ব বসানো আছে। সুইচ অন করলে লাইট বাল্ব থেকে এক ঝাঁক আলোকরশ্মি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে—আলোর গতিতে। ধরুন, বাল্বটা একবার অন করে কিছুক্ষণের জন্য তা বন্ধ করে দিলেন। মানে আবারও সব অন্ধকার। তাহলে মহাকাশের সবদিকে ছড়িয়ে পড়া আলোর গোলকের পিছু পিছু একটা অন্ধকার গোলকও যেতে থাকবে। এরপর বাল্বটা আবারও অন করলেন। এবার দেখা যাবে, তিনটি গোলক। প্রথমটি আলোর গোলক, দ্বিতীয়টি অন্ধকারের গোলক এবং শেষটি আবারও আলোর গোলক। এভাবেই এই তিন গোলক ছড়িয়ে পড়তে থাকবে দূর থেকে আরও দূরের মহাকাশে। আলো যেহেতু তার নিজস্ব গতিতে চলতে থাকবে, তাই দুই আলোর মাঝখানের অন্ধকারটাও ছড়াবে একই গতিতে। এ থেকে বোঝা যায়, অন্ধকারের গতিও আলোর মতো।
পদার্থবিজ্ঞানের বহুল আলোচিত একটা প্রশ্ন দিয়ে শেষ করা যাক। সৌরজগৎ থেকে আমাদের সূর্যটা হুট করে উধাও হয়ে গেলে কী হবে? আমরা কতক্ষণ পর তা টের পাব? পৃথিবীতে কতক্ষণ পর নেমে আসবে অন্ধকার?
নিউটনের মতে, আমরা সঙ্গে সঙ্গেই তা টের পাব। কিন্তু আইনস্টাইন বলেন, ঘটনাটা আমরা টের পাব ঠিক ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড পর। কিন্তু কেন?
কারণ সূর্য থেকে আলো পৃথিবীতে পৌঁছাতে সময় লাগে ওইটুকু। একইভাবে সূর্যের অভাবটাও টের পেতে আমাদের সময় লাগবে ঠিক ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড। কারণ অন্ধকারটাও পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসবে সেকেন্ডে ৩ লাখ কিলোমিটার বেগে।