স্ট্যান্ডার্ড মডেলে কাজকারবার করে প্রাকৃতিক তিনটি মৌলিক বল নিয়ে (মহাকর্ষ বাদে)। সেগুলো হল বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল, শক্তিশালী পারমাণবিক বল এবং দুর্বল পারমাণবিক বল। এদের মধ্যে বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলটাই আমরা সরাসরি প্রতিদিন ব্যবহার করছি নানা কাজে। ঘরের লাইট বাল্ব থেকে শুরু করে আপনার হাতের মোবাইল ফোনে এ বলের কারণেই ব্যবহার করতে পারছেন। আবার আলোর কণা—ফোটন দিয়ে আমরা চোখে সবকিছু দেখতে পাই। এই বোসন কণাই আসলে বহন করে বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল। ঘটনাগুলো ঘটছে হয়তো আপনার অজান্তেই।
ওদিকে সবল বা শক্তিশালী পারমাণবিক বল আমরা চোখে না দেখলেও এর প্রভাব না বুঝে উপায় নেই। কারণ, পরমাণুর নিউক্লিয়াসে কোয়ার্ক কণাদের একত্রিত করে পরমাণু গঠন করে এই বল। নিউট্রন ও প্রোটন কণাদেরও একত্রে বেধে রাখে। কাজেই এ বলের অস্তিত্ব না থাকলে পরমাণু গঠিতই হতে পারত না। তাহলে আপনি, আমি, চারপাশের বস্তুজগৎ, পৃথিবী, সূর্য, গ্যালাক্সি কিছুই থাকত না।
কিন্তু এই তিন বলের মধ্যে দুর্বল বলটাই একটু যেনো আলাদা—দৈনন্দিন জীবনে এর কোনো প্রভাব আমাদের চোখে দৃশ্যমান নয়। তাই এই বলের অনিবার্য ভূমিকা বোঝানোও তাই কিছুটা কঠিন। এর কাজকারবার এতই ক্ষুদ্র পরিসরের যে তার প্রভাব সরাসরি বোঝাও যায় না। তবে স্ট্যান্ডার্ড মডেলে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে এই দুর্বল বল বা উইক নিউক্লিয়ার ফোর্স। নামে দুর্বল হলেও প্রকৃতির সবচেয়ে দুর্বল বল আসলে মহাকর্ষ। মহাকর্ষের চেয়ে দুর্বল পারমাণবিক বল প্রায় ১০২৯ গুণ শক্তিশালী। এ বলের এরকম নামের কারণ হল, একটি নির্দিষ্ট পরিসরে শক্তিশালী বল ও বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলের চেয়ে এর ক্ষেত্রের শক্তি কম বা বেশ দুর্বল।
জেড কণার নামকরণ করা হয়েছে ইংরেজি জিরো (Zero) থেকে। অবশ্য ১৯৬১ সালে শেলডন গ্ল্যাসো একটি পেপার এ বিষয়ে তত্ত্ব প্রকাশ করেন, সেখানে জেড-এর কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া ছিল না। পরে অন্য পদার্থবিদরা বলতে থাকেন, জেড এসেছে জিরো শব্দের আদ্যাক্ষর থেকে।
এই বলটি ছাড়া কোয়ার্ক কণা ফ্লেভার বা স্বাদ (খাবারের স্বাদ নয়) পরিবর্তন করতে পারে না। তার মানে হল, দুর্বল বল ছাড়া নিউট্রন কণা প্রোটন কণায় রূপান্তরিত হতে পারত না। তাই সূর্য আলো দিতে পারত না। কারণ, সেজন্য সূর্যের ভেতর চলছে ফিউশন বিক্রিয়া। এতে হাইড্রোজেনের চারটি প্রোটন হিলিয়ামে পরিণত হয়। এ সময় দুটি প্রোটন রূপান্তরিত হয় নিউট্রন কণায়। কাজেই নামে দুর্বল হলেও এই বলটি আমাদের জগতের জন্য অতি জরুরী।
শক্তিশালী বল যেমন কোয়ার্ক কণাদের একত্রে বেধে রাখে, দুর্বল তেমন কিছু বেধে রাখে না। এই বল বহন করে ডব্লিউ ও জেড কণা। ডব্লিউ কণার বৈদ্যুতিক চার্জ থাকে। তাই এটি দুই ধরনের হতে পারে ধনাত্মক (W+) বা ঋণাত্মক (W-)। অন্যদিকে জেড কণা বৈদ্যুতিকভাবে চার্জ নিরপেক্ষ (Z0)। একসঙ্গে বললে দুর্বল বলের বাহক তিনটি কণা হলো—ডব্লিউ প্লাস, ডব্লিউ মাইনাস ও জেড জিরো (W+, W- ও Z0)। এরা বোসন কণা। দুটি মৌলিক কণা যখন এই দুর্বল বলের মাধ্যমে মিথস্ক্রিয়া করে তখন সেখানে একটি ডব্লিউ বা একটি জেড কণা বিনিময় হয়। অন্য কণাদের তুলনায় ডব্লিউ ও জেড কণার ভর অনেক বেশি। সে হিসেবে এদের হেভিওয়েট কণা বলা চলে।
দুর্বল বল যে বিভিন্ন কণার বিনিময়ের কারণ, সে ধারণা গড়ে উঠেছিল ১৯৩০-এর দশকে। বিটা ক্ষয় নামে পরিচিত এক ধরনের তেজস্ক্রিয় ক্ষয় ব্যাখ্যা করতে ধারণাটি ব্যবহার করা হয়েছিল। ১৯৩৩ সালে পদার্থবিদ এনরিকো ফার্মি বললেন, এ প্রক্রিয়ায় চারটি ফার্মিয়ন মিথস্ক্রিয়া দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। তবে সেটা পরে ভুল বলে প্রমাণিত হয়।
এর প্রায় তিন দশক পর, ১৯৬৮ সালে পদার্থবিদ শেলডন গ্ল্যাসো, আবদুস সালাম এবং স্টিভেন ওয়াইনবার্গ দুর্বল বল ও বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলকে একীভূত করেন। তাঁদের নতুন তত্ত্বটা ফোটনের অস্তিত্ব অনুমান করতে পারল। শুধু তাই নয়, ডব্লিউ ও জেড কণার অস্তিত্বের ভবিষ্যদ্বাণীও করতে পারল সফলভাবে। এ অবদানের জন্য ১৯৭৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পান এই তিন বিজ্ঞানী।
বিজ্ঞানীদের সেই স্বপ্নের পথে ইলেকট্রোউইক ফোর্সকে বলা যায় একটি মাইল ফলক। এছাড়া শক্তিশালী বলের সঙ্গে ইলেকট্রোউইক ফোর্স একীভূত করার ক্ষেত্রেও কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। এই একীভূত তত্ত্বকে বলা হয় গ্র্যান্ড ইউনিফায়েড থিওরি বা GUT।
১৯৮৪ সালে এই কণা সনাক্ত করা সম্ভব হয়। তবে তা সরাসরি নয়। আসলে সেবার অতি স্বল্প আয়ুর ডব্লিউ ও জেড কণার ক্ষয়প্রাপ্ত উপাদান সনাক্ত সক্ষম হন সার্নের গবেষণা কেন্দ্রে বিজ্ঞানীরা। এদের মধ্যে ডব্লিউ কণার নাম দেওয়া হয়েছে ইংরেজি উইক (Weak) শব্দটি মাথার রেখে। দেখতেই পাচ্ছেন, ডব্লিউ আসলে উইক শব্দের প্রথম বর্ণ। অন্যদিকে জেড কণার নামকরণ করা হয়েছে ইংরেজি জিরো (Zero) থেকে। অবশ্য ১৯৬১ সালে শেলডন গ্ল্যাসো একটি পেপার এ বিষয়ে তত্ত্ব প্রকাশ করেন, সেখানে জেড-এর কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া ছিল না। পরে অন্য পদার্থবিদরা বলতে থাকেন, জেড এসেছে জিরো শব্দের আদ্যাক্ষর থেকে। কারণ জেড কণার কোনো চার্জ নেই বা চার্জশূন্য। তাই এরকম নাম।
কোনো ইলেকট্রন বা বৈদ্যুতিকভাবে চার্জিত কোনো কণা কীভাবে ফোটন নিঃসরণ করবে তা জানায় বিদ্যুৎচুম্বকীয় তত্ত্ব বা কিউইডি (QED)। একইভাবে দুর্বল মিথস্ক্রিয়া থেকে জানা যায়, কোনো ইলেকট্রন বা দুর্বল চার্জের কোনো কণা কীভাবে জেড বা ডব্লিউ কণা নিঃসরণ করে। এই মিথস্ক্রিয়া থেকে আমরা জানতে পারি যে জেড কণার নিঃসরণ অনেকটাই ফোটন নিঃসরণের মতো। কিন্তু যখন ডব্লিউ কণা নিঃসৃত হয়, তখন ঘটনা কিছুটা অন্যরকম ঘটে। কারণ ফোটন ও জেড কণা চার্জ নিরপেক্ষ হলেও ডব্লিউ কণা চার্জিত। কাজেই কোনো ইলেকট্রন ডব্লিউ কণা নিঃসরণ করলে, তা বৈদ্যুতিক চার্জ হারায় এবং নিউট্রিনোতে রূপান্তরিত হয়। একইভাবে মিওয়ন কণাও একটা ডব্লিউ কণা হারিয়ে মিউয়ন নিউট্রিনোতে রূপান্তরিত হয়। আবার টাউ কণাও একইভাবে টাউ নিউট্রিনোতে রূপান্তরিত হয়। এ সবই ঘটে ডব্লিউ বোসন কণা নিঃসরণের কারণে।
একই ঘটনা ঘটতে দেখা যায় কোয়ার্ক কণার ক্ষেত্রেও। ডাউন কোয়ার্ক থেকে একটা ঋণাত্মক ডব্লিউ কণা নিঃসরণে তা আপ কোয়ার্কে পরিণত হয়। নিঃসৃত এই ডব্লিউ মাইনাস কণাটি ক্রমান্বয়ে ক্ষয় হয়ে একটি ইলেকট্রন ও একটি প্রতি ইলেকট্রন নিউট্রিনো কণায় পরিণত হয়। প্রক্রিয়াটি ঘটে খুবই দ্রুত। বলা যায়, চোখের নিমেষে। কণা পদার্থবিজ্ঞানে এটাই একমাত্র মিথস্ক্রিয়া যেখানে কোয়ার্কের ফ্লেভারে পরিবর্তন ঘটে। অর্থাৎ একটি কোয়ার্ক আরেকটি কোয়ার্কে পরিণত হয়। (বিভিন্ন রকম কোয়ার্ককে বলা হয় কোয়ার্কের ফ্লেভার। যেমন আপ, ডাউন, চার্ম, স্ট্রেঞ্জ, টপ এবং বটম।) একইভাবে স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক রূপান্তরিত হয় চার্ম কোয়ার্কে এবং বটম কোয়ার্ক রূপান্তরিত হয় টপ কোয়ার্কে।
ডব্লিউ মাইনাস কণা আর্বিভাব ও আবার হারিয়ে যাওয়ার এই প্রক্রিয়া সংঘটিত হয় এক সেকেন্ডের এক ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ভাগের এক ভাগ সময়ে। সে কারণে একে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা যায় না। এটাই দুর্বল বলের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। আর এর এরকম ক্ষুদ্র পরিসরের কারণ ডব্লিউ ও জেড কণার বেশি ভর।
ডব্লিউ ও জেড কণার ভূমিকা শুধু পারমাণবিক বা নিউক্লিয়ার ফিউশনেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এর ক্ষয় প্রক্রিয়াতেও গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে এরা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে শক্তি তৈরি করে এবং পারমাণবিক বোমায় ধ্বংসাত্মক শক্তি বের করে আনে।
দুর্বল বলের কারণেই মহাবিস্ফোরণের কয়েক মিনিট পর নিউট্রন ক্ষয় হয়ে প্রোটনে পরিণত হয়েছিল। এক্ষেত্রে একটা ডাউন কোয়ার্ক একটা ডব্লিউ কণা নিঃসরণ করে একটা আপ কোয়ার্কে পরিণত হয়েছিল। এরপর ডব্লিউ কণা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে একটি ইলেকট্রন ও একটি ইলেকট্রন অ্যান্টিনিউট্রিনোতে পরিণত হয়েছিল। নিউট্রনের প্রোটনে রূপান্তর হওয়ার এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় বিটা ক্ষয়।
দুর্বল বল শক্তিশালী না হলেও ডব্লিউ ও জেড কণা যে প্রভাব ফেলে তা মানবজীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। একটু আগেই বলেছি, এসব কণার কারণেই সূর্য জ্বলতে পারে ও আমাদের পৃথিবীতে প্রয়োজনীয় শক্তির যোগান দেয়। আসলে সূর্যের গভীরে পারমাণবিক নিউক্লিয়াসগুলো পরস্পর ফিউজ বা জোড়া লাগে ডব্লিউ ও জেড কণার বিনিময়ের কারণে। এই নিউক্লিয়ার ফিউশনে বিপুল শক্তি তৈরি হয়। কিন্তু তার খুব সামান্য অংশই পৃথিবীতে আসে। তাতে ভূপৃষ্ঠে প্রাণের টিকে থাকা সম্ভব হয়েছে। ডব্লিউ ও জেড কণার ভূমিকা শুধু পারমাণবিক বা নিউক্লিয়ার ফিউশনেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এর ক্ষয় প্রক্রিয়াতেও গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে এরা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে শক্তি তৈরি করে এবং পারমাণবিক বোমায় ধ্বংসাত্মক শক্তি বের করে আনে। মোদ্দা কথায়, নিউক্লিয়ার ফিউশন ও ফিশন দুই প্রক্রিয়ায় সঙ্গে জড়িয়ে আছে বলটি।
প্রশ্ন আসতে পারে, ডব্লিউ ও জেড কণা আবিষ্কারের গুরুত্ব বা তাৎপর্য কী? উত্তরটা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, বরং এর সম্পর্ক তার চেয়ে বেশি কিছু। মানুষের আদিম অন্বেষা, তথা মহাবিশ্বকে সঠিকভাবে উপলব্ধির সঙ্গে জড়িত। সে কারণে দুর্বল বলের বাহক কণা আবিষ্কারকে কণা পদার্থবিজ্ঞানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। আসলে এর মাধ্যমে দুর্বল বলের সঙ্গে বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলকে একীভূত করা সম্ভব হয়েছে। একীভূত এ বলকে বলা হয় ইলেকট্রোউইক ফোর্স। উচ্চশক্তিতে দুর্বল ও বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল একইরকম আচরণ করে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, প্রকৃতির চারটি মৌলিক বলই মহাবিস্ফোরণের সময় একীভূত ছিল। কিছুক্ষণ পর সেগুলো বর্তমানের রূপে আলাদা হয়ে যায়। বিগব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের কিছু সময় পর ইলেকট্রোউইক ফোর্স আলাদা হয়ে দুর্বল ও বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলে পরিণত হয়।
দুর্বল বল শক্তিশালী না হলেও ডব্লিউ ও জেড কণা যে প্রভাব ফেলে তা মানবজীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। একটু আগেই বলেছি, এসব কণার কারণেই সূর্য জ্বলতে পারে ও আমাদের পৃথিবীতে প্রয়োজনীয় শক্তির যোগান দেয়।
আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানের অন্যতম লক্ষ্য হলো, এই চারটি মৌলিক বলকে একীভূত করে একটি একক তত্ত্ব প্রণয়ন করা। সে তত্ত্বকে বলা হয় থিওরি অব এভরিথিং। এটাই একটি সার্বজনীন বা সার্বিক তত্ত্ব, যার মধ্যে প্রকৃতির চারটি বল ও মহাবিশ্বের সব কণাকে ব্যাখ্যা করা যাবে।
বিজ্ঞানীদের সেই স্বপ্নের পথে ইলেকট্রোউইক ফোর্সকে বলা যায় একটি মাইল ফলক। এছাড়া শক্তিশালী বলের সঙ্গে ইলেকট্রোউইক ফোর্স একীভূত করার ক্ষেত্রেও কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। এই একীভূত তত্ত্বকে বলা হয় গ্র্যান্ড ইউনিফায়েড থিওরি বা GUT। এখন এর সঙ্গে মহাকর্ষ বলকে একীভূত করতে পারলেই মিলবে কিংবদন্তিতূল্য থিওরি অব এভরিথিং। এটাই পদার্থবিদদের বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত তত্ত্ব। তবে এখনো এটি সোনার হরিণ। কারণ এখনো এতে সফলতা মেলেনি।