নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রের কঠিন পরীক্ষা এবং নেপচুন আবিষ্কার

নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রকে একাধিকবার কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছে। এমনি দুটো কঠিন পরীক্ষার কথা ফাইনম্যান তাঁর ‘ক্যারেক্টার অব ফিজিক্যাল ল’—লেকচারে বলেছিলেন। খানিকটা সংক্ষিপ্ত ও পরিমার্জিত রূপে তা তুলে ধরা হলো বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য।

নিউটনের সূত্রকে একাধিকবার কঠিন পরীক্ষায় পড়তে হয়েছে। ১৬ শতকের শেষদিকের কথা। বিজ্ঞান তখন নিউটনের সময় থেকে আরও উন্নত হয়েছে। আরও নিখুঁতভাবে পরিমাপ করা সম্ভব এখন সবকিছু। এ সময় নিউটনের সূত্রকে আরও কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হলো। এই কঠিন পরীক্ষাগুলোর প্রথমটি ছিল বৃহস্পতির চাঁদগুলোকে নিয়ে। এই চাঁদগুলো কীভাবে ঘোরে, চলাফেরা করে, দীর্ঘসময় তা পর্যবেক্ষণ করে পরীক্ষা করে দেখা যায়, সব কিছু নিউটনের সূত্রানুসারে ঘটছে কি না। দেখা গেল, ঘটছে না। কক্ষপথের যে বিন্দুতে থাকার কথা, কখনো কখনো এসব চাঁদকে তারচেয়ে আট মিনিট এগিয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। আবার কখনো দেখা যাচ্ছে, এগুলো আট মিনিট পিছিয়ে আছে। এক্ষেত্রে সময়টা হিসেব করা হয়েছে নিউটনের সূত্রানুসারে। অর্থাৎ এ সূত্র কাজ করছে না। দেখা গেল, বৃহস্পতি পৃথিবীর কাছে থাকলে এসব চাঁদ সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকে। আর গ্রহটি দূরে থাকলে চাঁদগুলো পিছিয়ে পড়ে। অদ্ভুত ব্যাপার!  

ওলাউস রোমার

বিজ্ঞানী ওলাউস রোমারের (১৬৪৪-১৭১০, ড্যানিশ জ্যোতির্বিদ) মহাকর্ষ তত্ত্বের ওপর ভরসা ছিল। তিনি চমৎকার এক সিদ্ধান্তে এলেন। বললেন, বৃহস্পতির চাঁদ থেকে আলো পৃথিবীতে আসতে কিছুটা সময় লাগে। তাই আমরা যখন এসব চাঁদকে দেখি, তখন আসলে তাদের বর্তমান অবস্থান দেখি না। দেখি ওসব চাঁদ থেকে আলোর পৃথিবীতে আসতে যত সময় লাগে, ততক্ষণ আগের অবস্থান। বৃহস্পতি আমাদের কাছাকাছি থাকলে আলোর আসতে কম সময় লাগে, দূরে থাকলে লাগে বেশি সময়। রোমারকে পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে সময়ের এই পার্থক্যটুকু সংশোধন করতে হয়। পাশাপাশি, এর মাধ্যমে তিনি আলোর বেগ নির্ণয় করেন। আলো যে তাৎক্ষণিকভাবে স্থানান্তরিত হতে পারে না, এটা ছিল তার প্রথম প্রমাণ। 

রিচার্ড ফাইনম্যান
উইকিপিডিয়া

আমি (অর্থাৎ রিচার্ড ফাইনম্যান) এই ঘটনাটি বলেছি একটা বিশেষ কারণে। আপনাদের দেখাতে চাচ্ছিলাম যে কোনো সূত্র যখন সঠিক হয়, তখন সেটা ব্যবহার করে নতুন সূত্র খুঁজে বের করা যায়। কোনো সূত্রের ওপর যদি আমাদের ভরসা থাকে, তাহলে ওতে যখন কোনো ঝামেলা পাওয়া যায়, সেটা আমাদের নতুন কিছুর প্রতি ইঙ্গিত করে। মহাকর্ষ সূত্র জানা না থাকলে আলোর বেগ নির্ণয় করতে আমাদের আরও অনেক সময় লাগত। কারণ, তখন আমরা জানতাম না বৃহস্পতির উপগ্রহগুলোর আচরণ কেমন হওয়া উচিত। এই পদ্ধতির হাত ধরে নতুন আবিষ্কারের ঢেউ উঠেছিল, প্রতিটি আবিষ্কার আবার নতুন আরও আবিষ্কারের পথ খুলে দিয়েছে। এটাই আবিষ্কার-বিপ্লবের সূচনা। ৪০০ বছর পরেও, আজও এটি চলমান। আর এর মাধ্যমে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি অত্যন্ত দ্রুত বেগে।

এরপর আরেকটা সমস্যা দেখা গেল। গ্রহগুলোর আসলে নিখুঁত উপবৃত্তাকার পথে ঘোরার কথা নয়। কারণ, নিউটনের সূত্রানুযায়ী, শুধু সূর্যই এদের আকর্ষণ করে না। প্রতিটা গ্রহই একে অন্যকে আকর্ষণ করে। এর পরিমাণ খুব বেশি না, সামান্য; কিন্তু এই সামান্যকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। এই সামান্য আকর্ষণই এদের গতিপথ কিছুটা বদলে দেবে। বৃহস্পতি, শনি এবং ইউরেনাস যে বিশালাকার গ্রহ, সেটা মানুষ জানত। তাই হিসেব করা হলো, কেপলারের নিখুঁত উপবৃত্তাকার পথ থেকে একে অন্যের ওপর প্রযুক্ত টানের জন্য এদের কক্ষপথ কতটা ভিন্ন হওয়ার কথা। এই হিসেব ও পর্যবেক্ষণ শেষে দেখা গেল, বৃহস্পতি এবং শনি যথানিয়ম ও হিসেব মেনেই ঘুরছে। কিন্তু ইউরেনাস খানিকটা অদ্ভুত আচরণ করছে। নিউটনের সূত্রের জন্য আরেকটা বড় পরীক্ষা।

এরকম পরীক্ষা উৎরে যেতে প্রয়োজন সাহস। সেই সাহস দেখালেন জন কাউচ অ্যাডাম (১৮১৯-৯২, গাণিতিক জ্যোতির্বিদ) ও আরবাইন লেভেরিয়েঁ (১৮১১-৭৭, ফ্রেঞ্চ জ্যোতির্বিদ)। দুজনেই এই হিসেবগুলো স্বাধীনভাবে ও প্রায় একই সময়ে করেন। করে তাঁরা প্রস্তাব করেন, ইউরেনাসের গতিপথের এই অদ্ভুত আচরণের পেছনে দায়ী অদেখা একটি গ্রহ। তাঁরা নিজ নিজ পরিচিত মানমন্দিরে চিঠি লিখে বলেন, ‘নিজেদের দুরবিন ঘুরিয়ে ওখানটায় দেখুন, নতুন একটা গ্রহ পাবেন।’ একটি মানমন্দির এ চিঠি পড়ে বলল, ‘হাস্যকর কথাবার্তা! একটা মানুষ কাগজ-পেন্সিল নিয়ে বসে আমাদেরকে বলছে কোথায় তাকালে নতুন গ্রহ পাওয়া যাবে।’ আরেকটি মানমন্দির ছিল কিছুটা… মানে, তাদের কতৃপক্ষ ছিল ভিন্ন মানসিকতার। এটি আসলে জার্মানির বার্লিন মানমন্দির। এ মানমন্দিরের জ্যোতির্বিজ্ঞানী  জোহান গটফ্রিড গালে ও তাঁর সহকারী হেনরিক ডি অ্যারেস্ট যথাস্থানে দুরবিন তাক করেন। তাই তাঁরা নেপচুনের সন্ধান পান।

এভাবে নেপচুন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে বোঝা গেল, মহাকর্ষ সূত্র আসলেই যথাযথভাবে কাজ করছে।

অনুবাদক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

মূল: দ্য ক্যারেক্টার অব ফিজিক্যাল ল, রিচার্ড ফাইনম্যান