সম্প্রতি প্রথমবারের মতো আলোকে সুপারসলিডে রূপান্তর করেছেন বিজ্ঞানীরা। গত ৫ মার্চ এ সংক্রান্ত গবেষণাপত্রটি বিশ্বখ্যাত মার্কিন জার্নাল নেচার-এ প্রকাশিত হয়েছে। ইতালির ইনস্টিটিউট অব ন্যানোটেকনোলজির সিএনআর ন্যানোটেকের পরমাণুবিদ দিমিত্রিস ট্রাইপোজর্জোসের নেতৃত্বে ইতালি ও যুক্তরাষ্ট্রের একদল বিজ্ঞানী গবেষণাটি করেন।
সুপারসলিড পদার্থের এক অদ্ভুত অবস্থা। পদার্থের পরমাণুগুলো এ সময় একসঙ্গে ঘনীভূত হয়ে স্ফটিকাকার কঠিন পদার্থ তৈরি করে। অথচ এই কঠিন পদার্থের ভেতরেই পরমাণুগুলো সান্দ্রতাহীন তরলের মতো নড়াচড়া করতে পারে। অর্থাৎ সুপারসলিডে একসঙ্গে কঠিন ও তরলের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। আরেকটু খুলে বলা যাক।
সুপারসলিড পদার্থে পরমাণু বা কণাগুলো নির্দিষ্ট প্যাটার্নে সজ্জিত থাকে। এই প্যাটার্নকে বলা হয় ল্যাটিস। কঠিন পদার্থে পরমাণুগুলো এভাবে সজ্জিত থেকে ক্রিস্টাল বা স্ফটিক গঠন করে। মজার বিষয় হলো, কঠিন পদার্থে পরমাণুগুলো যার যার অবস্থানে শক্তভাবে অবস্থান করলেও সুপারসলিড অবস্থায় এরা তরল পদার্থের মতো আচরণ করে। অর্থাৎ, প্যাটার্ন ঠিক রেখেই চলাচল করতে পারে। তরল পদার্থের মতো এতে সান্দ্রতা (তরলের অণুগুলোর মধ্যে ঘর্ষণ বল) থাকে না। কণাগুলো কীভাবে নিজেদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া করছে, তার ওপর নির্ভর করে এর দিক ও ঘনত্ব পরিবর্তিত হয়—এভাবে স্ফটিকের কাঠামো ঠিক থাকে।
বিজ্ঞানীরা আগেও পরমাণু দিয়ে এরকম সুপারসলিড তৈরি করেছেন গবেষণাগারে। তবে এবার প্রথমবারের মতো গবেষকেরা আলো ও পদার্থকে একীভূত করে সুপারসলিড তৈরি করেছেন। গবেষকদের দাবি, কনডেন্স ফিজিকস বা ঘনীভূত বস্তুর পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণায় নতুন দুয়ার খুলে দিতে পারে এই গবেষণা।
সাধারণত পরম শূন্যের (মাইনাস ২৭৩.১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) কাছাকাছি তাপমাত্রা প্রয়োজন হয় সুপারসলিড অবস্থা তৈরি ও স্থিতিশীল রাখার জন্য। এই স্বল্প তাপমাত্রার কারণে বেশির ভাগ কণা নিজ শক্তির সর্বনিম্ন পর্যায়ে অবস্থান করে। তাপমাত্রা বেশি হলে এসব কণা শক্তি শোষণ ও বিকিরণ করে নির্দিষ্ট অবস্থানে থেকে ওপরে-নিচে লাফালাফি করে। বাতাস ভর্তি বেলুন দিয়ে তৈরি পুকুরে কেউ দাপাদাপি করলে বেলুনগুলো যেমন ক্রমাগত তাদের স্থান পরিবর্তন করে, অনেকটা সেরকম।
অন্যদিকে তাপমাত্রা যথেষ্ট কমিয়ে ফেলা হলে কণাগুলোর অবস্থান প্রায় স্থির হয়ে যায়। তখন প্রতিটি কণার কোয়ান্টাম আচরণ পর্যবেক্ষণ করা সহজ হয়। এভাবে সুপারসলিডিটির মাধ্যমে কণার বৈশিষ্ট্য আরও নিখুঁতভাবে জানা যায়।
এর আগে, বিজ্ঞানীরা পারমাণবিক গ্যাস থেকে সুপারসলিড তৈরি করেছেন। সুপারসলিড তৈরি করা তাই নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক এ গবেষণায় বিজ্ঞানীরা শুধু সুপারসলিড তৈরি করেননি। তাঁরা পারমাণবিক গ্যাসের বদলে পোলারাইটন ব্যবহার করেছেন। পোলারাইটন হলো আলোর কণা ফোটন এবং কোয়াসিকণা এক্সাইটনের মধ্যে শক্তিশালী বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি একধরনের কোয়াসিকণা। এটা তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের কারণে পারমাণবিক গ্যাসের মতোই উপযুক্ত পরিবেশে শক্তির সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করতে পারে।
নতুন এ গবেষণা সুপারসলিড ও সুপারসলিড দশায় পরমাণু বা কণার আচরণ বোঝার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। আমাদের চারপাশের বাস্তবতা, অর্থাৎ প্রকৃতির গোড়ার কথা বুঝতে হলে পরমাণু ও পদার্থের বিভিন্ন কণার মধ্যকার কোয়ান্টাম মিথস্ক্রিয়া বোঝা জরুরি। সুপারসলিড নিয়ে গবেষণা এ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, সুপারকন্ডাক্টর বা ঘর্ষণহীন লুব্রিকেন্ট (বিভিন্ন যন্ত্রাংশের মধ্যে ঘর্ষণ বল কমাতে এটা ব্যবহৃত হয়; যেমন মবিল, গ্রিজ ইত্যাদি) তৈরিতে সুপারসলিড কাজে লাগানো যেতে পারে ভবিষ্যতে।