কয়েক বছর আগে এক ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনারা তো কোনোদিন নিজের চোখে পরমাণু দেখেননি। হয়তো কোনোদিন দেখবেনও না। তাহলে পরমাণুর অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন কেন?’ রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল, ট্রেন এসে যাওয়ায় আর আলোচনা এগোয়নি। বিষয়টা এখানে একটু খোলাসা করা যাক।
মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের পরমাণুর ব্যাপারে পড়ানো হয়। তবে সেখানে পরমাণুর অস্তিত্বের প্রমাণ নিয়ে বিশেষ আলোচনা হয় না। স্কুলে রসায়ন বইয়ে পরমাণুর সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় মৌলের প্রতীক, যৌগের সংকেত ও রাসায়ানিক বিক্রিয়ার সমীকরণ লেখার মাধ্যমে। ফলে রসায়নের ইতিহাসের সঙ্গে খুব একটা পরিচয় হয় না অনেকের।
ইংরেজ বিজ্ঞানী জন ডাল্টন ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দশকে একটা হাইপোথিসিস বা বৈজ্ঞানিক প্রস্তাবনার কথা বলেন। তিনি বলেন, একটা মৌলের পরমাণু হলো সেই মৌলের ক্ষুদ্রতম কণা, যার মধ্যে সেই মৌলের সব রাসায়নিক ধর্ম থাকে। অর্থাৎ একটা লোহার পরমাণু হলো লোহার ক্ষুদ্রতম কণা, যার মধ্যে লোহার সব রাসায়নিক ধর্ম আছে। একই কথা সোনা, রূপা, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন ইত্যাদি সব মৌলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। একই মৌলের সব পরমাণু অভিন্ন, তবে বিভিন্ন মৌলের পরমাণু আলাদা। ডাল্টন একটা হাইড্রোজেন পরমাণুর সাপেক্ষে বিভিন্ন মৌলের পরমাণুর ভর কত হবে, তা গণনা করেন। গণনা থেকে সিদ্ধান্তে আসেন, বিভিন্ন মৌলের পরমাণুগুলো পূর্ণ সংখ্যায় যুক্ত হয়ে একটা যৌগের অণু গঠন করে। অণু হচ্ছে একটা যৌগের ক্ষুদ্রতম কণা, যার মধ্যে ওই যৌগের সব রাসায়নিক ধর্ম থাকে। যেমন দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু ও একটা অক্সিজেন পরমাণু যুক্ত হয়ে গঠন করে একটা পানির অণু। এর ভিত্তিতে হিসাব করে বলা যায়, কী পরিমাণে মৌল থেকে কী পরিমাণ যৌগ পাওয়া যাবে। যেমন ২ গ্রাম হাইড্রোজেন ও ১৬ গ্রাম অক্সিজেন যুক্ত হয়ে ১৮ গ্রাম পানি তৈরি হয়। আবার ১২ গ্রাম কার্বন ও ৩২ গ্রাম অক্সিজেন মিলে তৈরি হয় ৪৪ গ্রাম কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস। কিন্তু এতেও পরমাণুর অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না।
পরমাণু বা অণু আয়তনে কত ছোট হতে পারে, তার একটা ধারণা পাওয়া গেল ইতালীয় বিজ্ঞানী অ্যাভোগেড্রোর কাজের ভিত্তিতে। তিনি দেখান, একই তাপমাত্রা ও চাপে সমআয়তনের যেকোনো গ্যাসে সমান সংখ্যক গ্যাসের অণু থাকে। অর্থাৎ এক মোল গ্যাসে (অর্থাৎ ২ গ্রাম হাইড্রোজেন গ্যাসে বা ৩২ গ্রাম অক্সিজেন গ্যাসে বা ২৮ গ্রাম নাইট্রোজেন গ্যাসে) প্রায় ৬×১০২৩, অর্থাৎ ছয়শ কোটি কোটি কোটি সংখ্যক ওই গ্যাসের অণু থাকে। হাইড্রোজেন, অক্সিজেন ও নাইট্রোজেনের অণু দুটি করে পরমাণু দিয়ে গঠিত। কাজেই দ্বিগুণ সংখ্যক পরমাণু থাকবে।
এরপর ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে এল গ্যাসের অণুর গতিবিদ্যা। মনে করা হলো, গ্যাসের মধ্যে তার অণুগুলো এলোমেলোভাবে বিভিন্ন গতিতে ছুটে বেড়াচ্ছে এবং অণুর গড় গতিশক্তি গ্যাসের তাপমাত্রার সমানুপাতিক। গ্যাসকে একটা বদ্ধ পাত্রে রাখলে এর অণুগুলো পাত্রের দেয়ালে আঘাত করে আবার ফিরে যায় এবং এতে পাত্রের দেয়ালে গ্যাসের চাপ সৃষ্টি হয়। এই তত্ত্বের সাহায্যে গ্যাসের ধর্মগুলো বোঝা গেল এবং অনেক সফল ভবিষ্যদ্বাণীও করা সম্ভব হলো। তত্ত্বটা যথেষ্ট কাজের হলেও পরমাণুর অস্তিত্বের নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায় না এ থেকে।
এই তত্ত্বে প্রথমে অণুগুলোকে বিন্দু কণা ধরা হয়েছিল। তারপর অণু বা পরমাণুগুলোকে ভাবা হলো ছোট ব্যাসার্ধের গোলক। তাহলে এলোমেলোভাবে ছুটন্ত গ্যাসের অণু বা পরমাণুগুলোর পরস্পরের সঙ্গে সংঘাত হবে। ধাক্কা না লেগে তারা কতদূর যেতে পারে, অর্থাৎ তাদের গড় মুক্ত পথের দূরত্ব নির্ভর করবে অণু বা পরমাণুর ব্যাসার্ধ ও গ্যাসের ঘনত্বের ওপর। রূপা বাষ্পীভূত করে পরীক্ষা করে একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও চাপে তার পরমাণুগুলোর গড় মুক্ত পথের দূরত্ব মাপা হলো ও গণনার সঙ্গে তুলনা করে জানা গেল, রূপার একটা পরমাণুর ব্যাসার্ধ এক সেন্টিমিটারের ১০ কোটি ভাগের এক ভাগ মাত্র (১০-৮ সেন্টিমিটার)।
অতএব যদি পরমাণুর অস্তিত্ব থাকে, তবে তার ব্যাসার্ধ হবে এক সেন্টিমিটারের ১০ কোটি ভাগের এক ভাগ। তার মানে, খালি চোখে মানুষ কোনোদিন পরমাণু দেখতে পাবে না। কিন্তু কেন? কারণ আমরা আলোর বর্ণালির খুব ছোট একটা অংশ (লাল আলো থেকে বেগুনি আলো পর্যন্ত) শুধু দেখতে পাই। এর মাধ্যমেই আমরা সবকিছু দেখি।
বিশ শতকের শুরুর দিকেও পরমাণু শুধু একটা বৈজ্ঞানিক প্রস্তাবনাই ছিল। এর অস্তিত্বের সরাসরি কোনো প্রমাণ ছিল না।
আলো একধরনের তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ। যে তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো ব্যবহার করে আমরা দেখতে পাই, তা এক সেন্টিমিটারের এক লাখ ভাগের কয়েক ভাগের সমান। অর্থাৎ একটা পরমাণুর ব্যাসার্ধের (এক সেন্টিমিটারের ১০ কোটি ভাগের এক ভাগ) চেয়ে প্রায় ১ হাজার গুণ বড়। অণুবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করেও এত বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো ব্যবহার করে এই ছোট জিনিস দেখা যায় না। ফলে আমাদের চোখে কখনোই পরমাণু দেখা দেবে না।
বিশ শতকের শুরুর দিকেও পরমাণু শুধু একটা বৈজ্ঞানিক প্রস্তাবনাই ছিল। এর অস্তিত্বের সরাসরি কোনো প্রমাণ ছিল না। তবে ১৮২৭ সালে রবার্ট ব্রাউন নামে এক স্কটিশ জীববিজ্ঞানী অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে দেখেন, স্থির পানিতে ভাসমান ফুলের রেণু স্থির হয়ে ভাসে না, বরং এলোমেলোভাবে ছোটাছুটি করে। ফুলের রেণু অনেকটা বড়, প্রায় এক সেন্টিমিটারের হাজার ভাগের এক ভাগের মতো ব্যাসার্ধ। কাজেই দৃশ্যমান আলোয় অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে এই ভাসমান ফুলের রেণু পর্যবেক্ষণে কোনো অসুবিধা নেই। ফুলের রেণুর এই এলোমেলো গতিকে ব্রাউনীয় গতি বলা হয়।
১৯০৫ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন ব্যখ্যা করেন, কেন স্থির পানির ওপর ভাসমান ফুলের রেণু স্থির থাকে না। তিনি দেখান, পানির অণুগুলো (খুব ছোট বলে যাদের দেখা যায় না) যেহেতু সবসময় এলোমেলোভাবে গতিশীল রয়েছে, তাই তারা সব সময় পানিতে ভাসমান স্থির ফুলের রেণুগুলোকে বিভিন্ন দিক থেকে আঘাত করছে। ফলে ফুলের রেণুগুলো স্থির পানির ওপর এলোমেলোভাবে ছুটছে। পানির অণুর আঘাতে ফুলের রেণুর গড় সরণ শূন্য হলেও সময়ের সঙ্গে এর বর্গ-মাধ্যমূল সরণ (Root mean square displacement) শূন্য হয় না। আইনস্টাইন এ বিষয়ে বিস্তারিত গণনা করে দেখান। পরে ফরাসি বিজ্ঞানী জিন পেরিন এই ব্রাউনীয় গতি বিস্তারিতভাবে পর্যবেক্ষণ করে আইনস্টাইনের গণনার সত্যতা প্রমাণ করেন। তিনি আরও দেখান, তাঁর পর্যবেক্ষণ ও গণনার ভিত্তিতে অ্যাভোগাড্রোর সংখ্যা (৬×১০২৩) খুব নির্ভুলভাবে বের করা যায়। ব্রাউনীয় গতি থেকে প্রথম অণু ও পরমাণুর অস্তিত্বের সরাসরি প্রমাণ পাওয়া গেল। এই কাজের সঙ্গে আরও কিছু কাজের জন্য ১৯২৬ সালে জিন পেরিন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান।
স্ক্যানিং টানেলিং ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করে একটা তলের ওপরে থাকা পরমাণুর ছবি খুব উচ্চ রেজ্যুলুশনে নেওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে ইলেকট্রনের স্রোত তলের ওপর ফেলা হয়।
কিন্তু তবু সরাসরি পরমাণুর ছবি তোলা হলো না। এ জন্য ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় আমাদের। দৃশ্যমান আলোয় পরমাণুর ছবি তোলা সম্ভব নয়, কারণ দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনেক বেশি। পরে কোয়ান্টাম মেকানিকস থেকে জানা গেল, বস্তুকণারও তরঙ্গ ধর্ম আছে এবং তাদের ভরবেগ অনেক বেশি বলে তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনেক কম। উচ্চশক্তির ইলেকট্রন কণার তরঙ্গদৈর্ঘ্য পরমাণুর ব্যাসার্ধের চেয়ে কম হয়। তাই এগুলো ব্যবহার করে পরমাণুর ছবি তোলা যেতে পারে। তবে উচ্চশক্তির ইলেকট্রনের স্রোতকে যে নমুনার ওপর ফেলা হয়, তার ক্ষতি হয় এবং অন্যান্য নানা কারণে এভাবে খুব উচ্চ রেজ্যুলুশনের পরমাণুর ছবি পাওয়া যায় না। স্ক্যানিং টানেলিং ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করে একটা তলের ওপরে থাকা পরমাণুর ছবি খুব উচ্চ রেজ্যুলুশনে নেওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে ইলেকট্রনের স্রোত তলের ওপর ফেলা হয়। তলের পরমাণুর সঙ্গে সংঘাতের ফলে অনেক কম শক্তির সেকেন্ডারি ইলেকট্রন বের হয় এবং সেগুলো ধরা হয়। এই সেকেন্ডারি ইলেকট্রনগুলোকে বিশ্লেষণ করে তলের ছবি ও সেখানে থাকা পরমাণুদের ছবি পাওয়া যায়। অবশ্য এটা ঠিক চোখে দেখা ছবি হচ্ছে না। পরমাণু ও ইলেকট্রনের পারস্পরিক ক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট ছবি এটা। তবে এই ছবি কম্পিউটার স্ক্রিনে দেখা যায় ও প্রিন্ট করা যায়।
বর্তমানে টাইকোগ্রাফি (Ptychography) নামে একটি পদ্ধতি ব্যবহার করে খুব উচ্চমানের পরমাণুর ছবি তোলা সম্ভব হয়েছে। এই পদ্ধতিতে তলের ওপর ইলেকট্রনের স্রোত ফেলা হয় এবং বিভিন্ন দিকে বিচ্ছুরিত ইলেকট্রনদের ধরা হয়। তারপর বিশেষ সফটওয়্যারের সাহায্যে বিভিন্ন প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করে তলের ওপর থাকা পরমাণুর ছবি পাওয়া যায়। সম্প্রতি এই পদ্ধতিতে তোলা একটি কেলাসের পরমাণুগুলোর ছবি তোলা হয়েছে। ফলে ২০০ বছরের চেষ্টায় অবশেষে চোখে দেখা না গেলেও পরমাণুর উচ্চমানের ছবি তোলা সম্ভব হয়েছে। ওপরের ছবিটি সায়েন্টিফিক আমেরিকান নিউজ লেটার-এ ২০২১ সালের ২৮ জুন প্রকাশিত হয়।