পানি কীভাবে আগুন নেভায়

পানি সরাসরি আগুন নেভায় না। আগুন জ্বলার জন্য তিনটি জিনিস প্রয়োজন—জ্বালানি, অক্সিজেন ও প্রয়োজনীয় তাপ।

ছোটবেলাতেই আমরা জেনেছি, পানি দিলে আগুন নিভে যায়। কোথাও আগুন লাগলে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তাই দ্রুত নেভাতে হয় আগুন। আর আগুন নেভানোর সবচেয়ে সহজলভ্য উপায় হলো পানি দেওয়া। এ কারণে আমাদেরকে ছোটবেলাতে বিষয়টা শেখানো হয়। দেখানো হয়, আগুনে পানি দিলে নিভে যায়। কিন্তু কেন বা কীভাবে আগুনটা নেভে, অর্থাৎ এর পেছনের বিজ্ঞানটা হয়তো অনেকের আজও অজানা।

যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানা রাজ্যে অবস্থিত ইউএস ফরেস্ট সার্ভিস। সেখানে মিসুলা ফায়ার সায়েন্স ল্যাবরেটরির অগ্নিনির্বাপণ বিশেষজ্ঞ সারা ম্যাকঅ্যালিস্টারের মতে, ‘পানি খুব ভালো তাপ শোষক। অর্থাৎ আগুনের তাপ বেশ ভালোভাবেই শুষে নিতে পারে পানি। পানিতে যে আগুন নেভে, তার একটা কারণ এটা।’

মজার বিষয় হলো, পানি সরাসরি আগুন নেভায় না। আগুন জ্বলার জন্য তিনটি জিনিস প্রয়োজন—জ্বালানি, অক্সিজেন ও প্রয়োজনীয় তাপ। পানি নিজেই অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন দিয়ে তৈরি। অর্থাৎ আগুন জ্বলার জন্য প্রয়োজনীয় তিনটি উপাদানের দুটিই আছে পানির মধ্য। তাই তীব্র আগুনের মধ্যে পানি দিলে আগুনের তীব্রতা আরও বেড়ে যায়।

আগুন নিয়ন্ত্রণের একটি কার্যকর উপায় হলো, সম্ভাব্য জ্বালানিকে ভিজিয়ে রাখা। এতে আগুন আর ছড়াতে পারে না। আধুনিক ভবনে পানির স্প্রিংকলার সিস্টেম থাকে। সেখানে এই কৌশলটি প্রয়োগ করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার দহনবিক্রিয়া বিশেষজ্ঞ মিখায়েল গলনার বলেন, পানি মূলত যেকোনো জ্বালানির দহন ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। সেটা কাঠ, কাগজ বা কয়লা—যাই হোক না কেন। গলনারের মতে, কাঠ যখন পুড়তে থাকে, তখন আগুনের তাপ মূলত কাঠের উপাদানকে বাষ্পীভূত করে গ্যাসে রূপান্তর করে। এই গ্যাস আবার আগুনের জ্বালানি হিসাবে কাজ করে। কিন্তু পানির তাপ শোষণ ক্ষমতা অনেক বেশি। তাই পানিকে বাষ্পীভূত করতে প্রচুর শক্তি, মানে তাপ লাগে। আগুনে যদি যথেষ্ট পরিমাণ শক্তি না থাকে, তাহলে পানি আগুনের প্রায় সবটা তাপ শুষে নেয়। জ্বালানিকে শীতল ও নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। ফলে, জ্বলার মতো যথেষ্ট তাপশক্তি আর থাকে না। তখন আগুন নিভে যায়।

আগুন নিয়ন্ত্রণের একটি কার্যকর উপায় হলো, সম্ভাব্য জ্বালানিকে ভিজিয়ে রাখা। এতে আগুন আর ছড়াতে পারে না। আধুনিক ভবনে পানির স্প্রিংকলার সিস্টেম থাকে। সেখানে এই কৌশলটি প্রয়োগ করা হয়। মানে আগুনের সংকেত পেলে ছাদে বসানো পানির পাইপ থেকে ঝিরঝির করে পানি পড়ে সম্ভাব্য জ্বালানিকে ভিজিয়ে ফেলে। ফলে, দমকল বাহিনী আসার আগপর্যন্ত কিছুটা সময় আগুনের তেজ কম থাকে।

বিশেষ পরিস্থিতিতে আগুন নেভানোর জন্য পানির বদলে জলীয় বাষ্প বা কুয়াশা বেশ কাজে দেয়। যেমন একটি প্রতিষ্ঠানের সার্ভার রুমের কথা চিন্তা করুন। সেখানে আগুন লাগলে, তা নেভানোর জন্য পানি ব্যবহার করলে সমস্যা হবে। কারণ আগুনের মতো পানিও বৈদ্যুতিক যন্ত্রের ক্ষতি করে। এসব ক্ষেত্রে সরাসরি পানির বদলে জলীয় বাষ্প ব্যবহার করা বেশি কার্যকর। জলীয় বাষ্প বা কুয়াশার কণাগুলো এত ছোট যে এগুলো অক্সিজেনকে স্থানচ্যুত করতে পারে। পাশাপাশি ঠান্ডা করতে পারে আগুনকে। তবে বর্তমানে বৈদ্যুতিক যন্ত্রের আগুন নেভাতে অগ্নিনির্বাপক পাউডার ব্যবহার করা হয়। এটি আরও বেশি নিরাপদ।

আরও পড়ুন

আগুন স্বাভাবিক হলে তা নেভানোর জন্য পানিই যথেষ্ট, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সব ধরনের আগুনের নেভানোর জন্য পানি উপযুক্ত নয়। যেমন দাবানল। এক্ষেত্রে আগুনের উত্তাপ এত বেশি থাকে যে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। অল্প পরিমাণ পানি নিমিষে বাষ্পীভূত হয়ে যায়। এমনকি উত্তাপের কারণে পানির হাইড্রোজেন-অক্সিজেন অণুগুলো আলাদা হয়ে আগুনের জ্বালানি হিসাবে কাজ করে। তখন হিতে বিপরীত হয়।

বেশিরভাগ সময় দাবানলকে কিছুটা ঠান্ডা করে নিয়ন্ত্রণের জন্য পানি ব্যবহার করা হয়। তবে নেভানোর জন্য নয়। পানি ঢাললে অগ্নিনির্বাপন কাজের জন্য কিছুটা বাড়তি সময় পাওয়া যায়। এর মধ্যেই নিচ থেকে জ্বালানি সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করেন দমকল কর্মীরা। কিন্তু আগুনের শিখার উচ্চতা ৫০ ফিটের বেশি হলে সেখানে আর কিছু করার থাকে না। পানি বা অন্য কোনো রাসায়নিকই আর কাজে আসে না। এজন্য ভয়াবহ দাবানলে আমরা বিস্তৃত এলাকা পুড়তে দেখি, এই আধুনিক সময়েও।

এই লেখায় দাবানল বা বৈদ্যুতিক যন্ত্রের কথা বলেছি, তবে বিভিন্ন ধরনের আগুন নেভাতে বিভিন্ন রকম রাসায়নিক ও পদ্ধতি আছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন ‘আগুন নেভানোর উপায়’।

লেখা: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: লাইভ সায়েন্স