ইলেকট্রন আসলে কী এবং কেন

ইলেক্ট্রনের মেঘের প্রতীকী ছবিছবি: এআই দিয়ে বানানো
ইলেকট্রন অতি ক্ষুদ্র এক কণা। একটা পরমাণু বা নিউক্লিয়াসেরও বহুগুণে ছোট। একে খালি চোখে দেখাও যায় না। তবে আমরা দেখতে না পেলেও আমাদের চারপাশের সব জায়গায় ছড়িয়ে আছে এই খুদে কণা।

পরমাণুর যে গাঠনিক কণাটি প্রথম শনাক্ত করা হয়েছিল, তার নাম ইলেকট্রন। এই অতিপারমাণবিক কণাটি (আসলে এগুলো উপপারমাণবিক কণা, অর্থাৎ পরমাণু থেকে ছোট কণা) আবিষ্কার করেন ব্রিটিশ পদার্থবিদ জোসেফ জন টমসন। ১৮৯৭ সালে ক্যাথোড রে টিউব নিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে এই খুদে কণা খুঁজে পান তিনি।

উনিশ শতকের শুরুর দিকে বায়ুশূন্য এই টিউব দিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন পদার্থবিদেরা। জার্মান পদার্থবিদ উইলিয়াম রন্টজেনও এক্স-রে আবিষ্কার করেছিলেন এই টিউব ব্যবহার করে। সেই টিউবে চুম্বকীয় ক্ষেত্র ব্যবহার করে টমসন ইলেকট্রন কণা শনাক্ত করেন। সেইসঙ্গে প্রমাণ করেন যে ইলেকট্রন চুম্বকীয় ক্ষেত্রে প্রভাবিত হয়। তাঁর এই আবিষ্কার এখনও টেলিভিশন, ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ এবং কণাত্বরক যন্ত্রে ব্যবহার করা হয়। আগের যুগের কম্পিউটারের ঢাউস আকৃতির সিআরটি (ক্যাথোড রে টিউব) মনিটর বা পেটমোটা টেলিভিশন আসলে এই ধরনের টিউব দিয়ে বানানো হতো।

শুরুতে টমসন কণাটির নাম দেন কর্পাসকল। কিছু দিন পর এর নাম দেওয়া হয় নেগাট্রন। কারণ কণাটির চার্জ নেগেটিভ বা ঋণাত্মক। তবে শেষপর্যন্ত এর নাম দাঁড়ায় ইলেকট্রন। নামটি এসেছে অ্যাম্বারের গ্রিক এক প্রতিশব্দ থেকে। একসময় ইলেকট্রিসিটি বা বিদ্যুৎ নিয়ে যেসব গবেষণা করা হতো, তাতে অ্যাম্বারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সে কারণে এমন নাম।

ইলেকট্রন অতি ক্ষুদ্র এক কণা। একটা পরমাণু বা নিউক্লিয়াসেরও বহুগুণে ছোট। একে খালি চোখে দেখাও যায় না। তবে আমরা দেখতে না পেলেও আমাদের চারপাশের সব জায়গায় ছড়িয়ে আছে এই খুদে কণা। আপনার বাসার ইলেকট্রিক সকেটে, এক্স-রে টিউব থেকে শুরু করে মহাবিশ্বের প্রতিটি পরমাণুতে ইলেকট্রন রয়েছে। বিদ্যুৎ আসলে ইলেকট্রনের স্রোত। আর ঘরে বা বাইরে সুইচ টিপে যে আলো জ্বালান, তাও এই ইলেকট্রনের কারসাজি। মানে ইলেকট্রনের ফোটন কণা নিঃসরণের ফলাফল। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আরও কিছু বলে নিই।

কণা পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেলে মৌলিক কণাগুলো প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়। একভাগ ফার্মিয়ন, আরেক ভাগ বোসন। ফার্মিয়ন হলো বস্তুকণা। যেমন ইলেকট্রন। আর বোসন হলো বস্তুকণাদের মধ্যে বলের বাহক। যেমন ফোটন। ফোটন কণা বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলের বাহক হিসেবে ইলেকট্রন কণাদের সঙ্গে কাজ করে। মানে ইলেকট্রন কণাদের মধ্যে শক্তি বিনিময় করে ফোটন। 

ফার্মিয়নকে আবার দুইভাবে বিভক্ত: কোয়ার্ক ও লেপটন। ইলেকট্রন হলো লেপটন কণা। তিনটি প্রজন্মের লেপটন কণার মধ্যে এটি প্রথম প্রজন্মের। লেপটন পরিবারে ইলেকট্রন ছাড়াও আরও দুই প্রজন্মের সদস্য আছে। সেগুলো হল মিউয়ন ও টাও। এরা হুবহু ইলেকট্রনের মতো, পার্থক্য শুধু তাদের ভরে। ইলেকট্রনের চেয়ে মিউয়ন ও টাউয়ের ভর অনেক গুণ বেশি। (অবশ্য সঠিকভাবে বললে, লেপটন পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছয়। আগের তিনটি কণাসহ আরও আছে তিন ধরনের নিউট্রিনো।)

আরও পড়ুন
আমাদের বাস্তব জগৎ গড়ে ওঠার পেছনে ইলেকট্রনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ইলেকট্রন ছাড়া পরমাণু বা অণু, দেহকোষ তথা মানুষ বলে কিছু থাকত না। কারণ পরমাণুর বাইরের শেল বা খোলস গঠন করে ইলেকট্রন।

ফার্মিয়ন কণারা পাউলির বর্জন নীতি বা এক্সক্লুশন প্রিন্সিপল মেনে চলে। এ নীতি অনুসারে, একইরকম দুটি ফার্মিয়ন একই জায়গা দখল করতে পারবে না। যেমন দুটি ইলেকট্রন পরমাণু একই জায়গায় বা একই শক্তিস্তরে থাকতে পারে না। তাদের অবশ্যই ভিন্ন অবস্থানে থাকতে হবে। এতে কোনো পরমাণুতে যত বেশি ইলেকট্রন থাকবে, তা তত বেশি বড় হবে। কারণ ইলেকট্রনগুলো তখন ক্রমেই বিভিন্ন শক্তিস্তর দখল করতে থাকবে। এই নীতির কারণেই পরমাণুর সিংহভাগ জায়গা ফাঁকা হলেও কঠিন বা দৃঢ় বস্তু গড়ে উঠতে পারে। একই কারণে আপনি কোনো চেয়ারে বসলে সেটা চুপসে যায় না, বরং নিজের দৃঢ়তা ধরে রাখতে পারে। এখানে আরেকটা ব্যাপারও কাজ করে। সেটা হলো বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল ক্ষেত্র। প্রোটন ও ইলেকট্রনের বিপরীতধর্মী চার্জের কারণে এই শক্তিশালী বল ক্ষেত্রটি কাজ করে এবং পরমাণুকে চুপসে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। বলটি এতই শক্তিশালী যে আপনি যদি কোনভাবে পরমাণুর ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন, তাহলে সেটা সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে আটকে দেবে।

আগেই বলেছি, কণাটি ঋণাত্মক বৈদ্যুতিক চার্জ বহন করে। তাদের ভরও খুব কম। এর ভর একটা প্রোটনের প্রায় ১৮৩৬ ভাগের এক ভাগ। সে হিসেবে, একটা ইলেকট্রনের ভর প্রায় ৩×১০-২৬ গ্রাম। ইলেকট্রনের ভর খুব কম হওয়ার কারণে বস্তু বা পদার্থের ওজনে তাদের অবদান কম। যেমন এক কেজি ময়দার মধ্যে যতগুলো ইলেকট্রন আছে, তার সবগুলোর একত্রে ভর হবে প্রায় এক গ্রামের চার ভাগের এক ভাগ মাত্র। তবে ঋণাত্মক চার্জ আর কম ভরের কারণে চুম্বকের সাহায্যে এদের খুব সহজেই সনাক্ত ও প্রভাবিত করা যায়।

পরমাণুর ভেতরে ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন থাকে
ছবি: সংগৃহীত

আমাদের বাস্তব জগৎ গড়ে ওঠার পেছনে ইলেকট্রনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ইলেকট্রন ছাড়া পরমাণু বা অণু, দেহকোষ তথা মানুষ বলে কিছু থাকত না। কারণ পরমাণুর বাইরের শেল বা খোলস গঠন করে ইলেকট্রন। আবার পরমাণুকে স্থিতিশীল বা চার্জনিরপেক্ষ রাখতেও ইলেকট্রনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পরমাণু গঠিত হয় নিউক্লিয়াস এবং ইলেকট্রন দিয়ে। নিউক্লিয়াসে থাকে ধনাত্মক প্রোটন কণা ও চার্জশূন্য নিউট্রন কণা। তাই নিউক্লিয়াসও ধনাত্মক চার্জবাহী। আর তার চারপাশে অনবরত ঘুরছে ঋণাত্মক চার্জের ইলেকট্রন কণা। প্রোটন এবং ইলেকট্রনের চার্জের পরিমাণ একই, কিন্তু ভিন্নধর্মী। যেমন প্রোটনের চার্জ +১.৬×১০-১৯ কুলম্ব এবং ইলেকট্রনের চার্জ -১.৬×১০-১৯ কুলম্ব। চুম্বকের দুই মেরুর মতোই সমধর্মী বৈদ্যুতিক চার্জ পরস্পরকে বিকর্ষণ করে এবং বিপরীতধর্মী চার্জ পরস্পরকে আকর্ষণ করে। পরমাণুর ভেতরও সেটা ঘটছে। কিন্তু পরমাণুর স্থিতি ও গতিশক্তি জটিল এক ভারসাম্যের কারণে ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসে পড়ে যাচ্ছে না। সেটা ঘটলে পরমাণু চোখের নিমিষে ধ্বংস হয়ে যেত।

প্রতিটি পরমাণুর ইলেকট্রন সংখ্যা নির্দিষ্ট এবং তাদের শক্তিস্তরও নির্দিষ্ট, যা অন্য পরমাণু থেকে আলাদা। শক্তিস্তরে ইলেকট্রনের এই বিন্যাসকে যেকোনো পরমাণুর হাতের ছাপ বলা যায়। কারণ, এই বিন্যাস অন্য মৌলের পরমাণুর থেকে আলাদা। পরমাণুতে সাধারণত প্রোটন সংখ্যা ও ইলেকট্রন সংখ্যা সমান থাকে। যেমন হাইড্রোজেন পরমাণুতে প্রোটন সংখ্যা একটি, ইলেকট্রন সংখ্যাও একটি। অন্যদিকে হিলিয়াম পরমাণুতে প্রোটন সংখ্যা দুটি, ইলেকট্রনের সংখ্যাও তাই। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট সবচেয়ে ভারী মৌল ইউরেনিয়াম পরমাণুতে প্রোটনের সংখ্যা ৯২টি, ইলেকট্রন সংখ্যাও ৯২টি।

আরও পড়ুন
ইলেকট্রন শুধু পরমাণুতে আবদ্ধ অবস্থায় নয়, স্বাধীনভাবেও থাকতে পারে। কোনো কারণে পরমাণু থেকে ইলেকট্রন আলাদা হয়ে গেলে শুধু ধনাত্মক নিউক্লিয়াস পড়ে থাকে। একে বলা হয় আয়ন।

এতে গোটা পরমাণুর চার্জে স্থিতিশীলতা বা চার্জের ভারসাম্য বজায় থাকে। কারণ মৌল যত হালকা থেকে ভারী হতে থাকে, ততই তার প্রোটন সংখ্যা বাড়তে থাকে। তাতে বাড়তে থাকে মৌলটির ধনাত্মক চার্জের পরিমাণও। তাই পরমাণুকে ভারসাম্যে আনতে ওই মৌলের পরমাণুতে প্রোটনের সমসংখ্যক ইলেকট্রনের দরকার। এতে পরমাণুটি বৈদ্যুতিকভাবে চার্জ নিরপেক্ষ হয়ে যায়। পরমাণুসহ বস্তর জন্য চার্জ নিরপেক্ষতা গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে বেধে যেত ভয়াবহ বিপত্তি। বিজ্ঞানীদের হিসেবে, আপনার দেহে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জের মধ্যে যদি ০.০০০০১ ভাগও তফাত দেখা দেয়, তাহলে আপনি সঙ্গে সঙ্গে ছিন্নবিছিন্ন হয়ে যাবেন। আর আপনার দেহের টুকরোগুলো বিনা খরচে নিক্ষিপ্ত হবে মহাকাশে। ফ্রি ফ্রি এই মহাকাশ ভ্রমণ মোটেই সুখকর নয়!

যাইহোক, পরমাণুর চার্জে ভারসাম্য আনার পাশাপাশি এই দুই বিপরীতধর্মী চার্জের কণার কারণে নিউক্লিয়াস ও ইলেকট্রনের মাঝখানে শক্তিশালী বিদ্যুৎচুম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি হয়। এটাই পরমাণু তথা বস্তুকে দৃঢ়তা দেয়। এই বলের কারণেই আপনি নিশ্চিন্তে চেযারে বসে বা বিছানায় শুয়ে এই লেখাটি পড়তে পারছেন। কারণে চেয়ারের পরমাণু আপনার পরমাণুকে বাধা দিতে পারছে এই বলের কারণে। তাতে আপনি চেয়ারের মধ্যে বা বিছানার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছেন না।

আগেই বলেছি, বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল খুব শক্তিশালী। কিন্তু কতটা? বিজ্ঞানীদের হিসেবে, মহাকর্ষ বলের চেয়ে এর শক্তি প্রায় ১০৩৬ গুণ বেশি। মানে ১-এর পর ৩৬টি শূন্য বসাতে হবে। নিজ দায়িত্বে গুণে দেখুন। একটা উদাহরণ দিই। পৃথিবীর ভর প্রায় ৬ ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কিলোগ্রাম। তাই মহাকর্ষের রীতি অনুযায়ী পৃথিবী তার ওপরের এবং আশপাশের সবকিছুকে নিজের কেন্দ্রের দিকে টানছে। সে কারণে আমরা পৃথিবীতে স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারি। একই কারণে চাঁদও নিজস্ব কক্ষপথে থেকে পৃথিবীকে অনুসরণ করছে অন্ধের মতো। কিন্তু তারপরও এই আকর্ষণ বলকে সহজেই হারিয়ে দিতে পারে বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল। ভাবছেন কীভাবে? শুকনো মাথায় চিরুনি ঘষলে স্থির বিদ্যুৎ তৈরি হয় সবাই জানি। এই চিরুনি দিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা ছোট ছোট কাগজের টুকরো অনায়াসে টেনে তোলা যায়। অথচ কাগজগুলোকে আকর্ষণ করছে চিরুনির তুলনায় শত শত গুণ ভারী পৃথিবী। আসলে এখানে গোটা পৃথিবীর মহাকর্ষের বিরুদ্ধে কাজ করে জিতে যাচ্ছে ছোট্ট চিরুনির বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল। এটাই বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলে শক্তির প্রমাণ।

ইলেকট্রন শুধু পরমাণুতে আবদ্ধ অবস্থায় নয়, স্বাধীনভাবেও থাকতে পারে। কোনো কারণে পরমাণু থেকে ইলেকট্রন আলাদা হয়ে গেলে শুধু ধনাত্মক নিউক্লিয়াস পড়ে থাকে। একে বলা হয় আয়ন। আর পরমাণু থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া ইলেকট্রনকে বলে মুক্ত ইলেকট্রন। টিউব মনিটর, এক্স-এর টিউবসহ আধুনিক কণাত্বরক যন্ত্রে মুক্ত ইলেকট্রন ত্বারিত করে আলো ও অন্যান্য বিদ্যুৎচুম্বকীয় বিকিরণ তৈরি করা হয়। ইলেকট্রন দিয়ে যে রশ্মি গঠিত, তাকে বলা হয় বিটা রেডিয়েশন। পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রাকৃতিকভাবে বা স্বতঃফূর্তভাবে এই তেজস্ক্রিয়তা ঘটে। ফলে একটা নিউট্রন ক্ষয় হয়ে একটি প্রোটন ও একটি ইলেকট্রনে রূপান্তরিত হয়। আবার উল্টো ঘটনাও ঘটতে পারে। সে প্রসঙ্গ এখানে নয়।

বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের কিছু পরে প্রথমে গঠিত হয়েছিল শুধু হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস। তারপর হিলিয়াম নিউক্লিয়াস। আর ছিল অসংখ্য মুক্ত ইলেকট্রন। তখন মহাবিশ্ব ছিল অতি উত্তপ্ত। তাই ইলেকট্রনগুলো এদিক-ওদিকে ছোটাছুটি করছিল। নিউক্লিয়াসের সঙ্গে তারা জোড় বাধেনি। তাই পুরো পরমাণুও গঠিত হতে পারেনি। এই ইলেকট্রনদের প্রচণ্ড ভীড়ভাট্টার মধ্যে বারবার ধাক্কা খাচ্ছিল ফোটন কণাগুলো। ফলে ইলেকট্রনগুলো অনবরত এক তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ফোটন শোষণ করে আরেক তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ফোটন নিঃসরণ করছিল। তাতে ফোটন বেশি দূর যেতে পারছিল না। সেখানেই আটকা পড়ে ছিল দীর্ঘদিন। তাই মহাবিশ্ব ছিল অস্বচ্ছ। একে বিজ্ঞানীরা বলেন, মহাবিশ্বের অন্ধকার যুগ। 

১৯১৩ সালে পরমাণুর গঠন ব্যাখ্যা করতে প্রথমবার কোয়ান্টাম তত্ত্বের কাছে হাত পাতেন  নীলস বোর। এতে ইলেকট্রন সম্পর্কে অদ্ভুত এক ধারণার জন্ম দেন তিনি। একে বলা হয় ইলেকট্রনের কোয়ান্টাম লাফ।

মহাবিস্ফোরণের প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার বছর পর মহাবিশ্বের তাপমাত্রা যথেষ্ট শীতল হয়ে আসে। তখন নিউক্লিয়াসের চারপাশে জড়ো হতে থাকে ইলেকট্রন। এভাবে গড়ে ওঠে প্রথম পরমাণু। হাইড্রোজেন, হিলিয়ামসহ আর দু-একটি হালকা মৌলের পরমাণু ছিল সেগুলো। তাতে ফোটনগুলোর পথের বাধা সরে গেল। তারা মুক্ত হয়ে আলোর গতিতে ছুটে গেল দিগ্বিদিক। তাতে মহাবিশ্ব সহসা আলোকিত হয়ে ওঠে। একে বলা হয় মহাবিশ্বের প্রথম আলো। বিজ্ঞানের পরিভাষায় কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন বা মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণ। ১৯৬৫ সালে মহাবিশ্বের এই প্রথম আলো প্রথম শনাক্ত করেন মার্কিন বিজ্ঞানী আর্নো পেনজিয়াস এবং রবার্ট উইলসন। সেজন্য নোবেল পুরস্কার জুটেছিল তাঁদের থলিতে।

১৯১৩ সালে পরমাণুর গঠন ব্যাখ্যা করতে প্রথমবার কোয়ান্টাম তত্ত্বের কাছে হাত পাতেন  নীলস বোর। এতে ইলেকট্রন সম্পর্কে অদ্ভুত এক ধারণার জন্ম দেন তিনি। একে বলা হয় ইলেকট্রনের কোয়ান্টাম লাফ। তাঁর মডেল অনুসারে, কোনো পরমাণুতে ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াসের চারপাশে শুধু কিছু নির্দিষ্ট কক্ষপথেই থাকতে পারে। ফোটন শোষণ করে ইলেকট্রন নিম্ন কক্ষপথ থেকে লাফ দিয়ে উচ্চতর শক্তির কক্ষপথে চলে যেতে পারে। আবার ফোটন নিঃসরণ করে বা শক্তি হারিয়ে উচ্চ শক্তিস্তর থেকে লাফ দিয়ে নিম্ন শক্তিস্তরেও চলে যেতে পারে। বর্ণালী বিশ্লেষণে এই নীতিটি প্রয়োগ করা হয়। এর মাধ্যমে গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সির দূরত্ব, গতিবেগসহ আরও নানা বিষয়ে জানতে পারেন বিজ্ঞানীরা। আবার আপনি সুইচ টিপলে যে বালব জ্বলে ওঠে, সেটাও ওই ইলেকট্রনের কারসাজি। সংক্ষেপে বললে, বালবের ফিলামেন্টের ভেতর দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মুক্ত ইলেকট্রন যাওয়ার সময় ফিলামেন্টের পরমাণুগুলোকে উত্তেজিত বা উত্তপ্ত করে তোলে। এতে ওই পরমাণুর ইলেকট্রনগুলো বাড়তি শক্তি অর্জন করে উচ্চ শক্তিস্তরে চলে যায়। ইলেকট্রনগুলো একসময় এই বাড়তি শক্তি নিঃসরণ করে নিম্নশক্তিস্তরে চলে যায়। নিঃসৃত এই শক্তি তাপ ও আলো হিসেবে পাওয়া যায়।

এখানে আরেকটা কথা না বললেই নয়, টমসন ইলেকট্রন আবিষ্কারের পর পরমাণুর একটি মডেল প্রণয়ন করেছিলেন। তিনি ধারণা করেন, পরমাণু হলো পুডিংয়ের মতো, যার ওপর ইলেকট্রনগুলো কিসমিসের মতো ছড়ানো থাকে। তাঁর এ মডেলকে বলা হয় প্লাম-পুডিং মডেল। এরপর কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে মডেলটিকে ভুল প্রমাণ করেন টমসনেরই এককালের ছাত্র, পদার্থবিদ আর্নেস্ট রাদারফোর্ড। সেই বিখ্যাত পরীক্ষাটির নাম স্বর্ণপাত পরীক্ষা বা গোল্ডফয়েল এক্সপেরিমেন্ট। তিনিও পরমাণুর একটি মডেল দেন, যাকে বলা হয় সোলার মডেল। এ মডেলে পরমাণুর নিউক্লিয়াসে থাকে প্রোটন নামের একটি কণা। আর তার চারপাশে ইলেকট্রনগুলো ঘুরছে সূর্যের চারপাশে গ্রহগুলোর মতো। কিন্তু মডেলটি অনুসারে ধনাত্মক নিউক্লিয়াস ক্রমাগত আকর্ষণ করবে ঋণাত্মক ইলেকট্রনকে। চুম্বকের উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর মতো। তাতে চোখের নিমিষে সর্পিল গতিতে ইলেকট্রন শক্তি বিকিরণ করতে করতে নিউক্লিয়াসে পড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কথা। তাহলে তো আমি-আপনিসহ এই বিশ্বজগতের অস্তিত্বই থাকার কথা নয়। তাহলে ঘটনা আসলে কী? 

ইলেকট্রনকে বলা হয় স্থিতিশীল এবং মৌলিক কণা। কারণ প্রোটন বা নিউট্রনের মতো একে আরও ক্ষুদ্র কোনো কণায় ভাঙা যায় না। আবার এখন পর্যন্ত এদের ক্ষয় হওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

পরমাণুর সোলার মডেলের এই ত্রুটি সংশোধন করেন রাদারফোর্ডের ছাত্র নীলস বোর। তার মডেলটাও সৌরজগতের মতো। তবে সমাধান হিসেবে ইলেকট্রনগুলোর কক্ষপথ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘোরার সময় কোনো শক্তি বিকিরণ বা অর্জনও করবে না। এর ফলে পাওয়া গেল একটা স্থিতিশীল পরমাণু মডেল। তবে বোরের মডেলটা অনেককিছুর সমাধান দিতে পারলেও পুরোপুরি ত্রুটিমুক্ত ছিল না।

আরও পরে কোয়ান্টাম মেকানিক্স ব্যবহার করে পরমাণুর গভীরে উঁকি দিলেন বিজ্ঞানীরা। হাইজেবার্গের অনিশ্চয়তার নীতি অনুসারে, কোনোকিছু চরম নির্ভুলভাবে মাপা যাবে না। যেমন ইলেকট্রনের ভরবেগ ও অবস্থান। আপনার যন্ত্রপাতি যতই সূক্ষ্ণ বা উন্নতমানের হোক না কেন, এই দুইয়ের পরিমাপে সবসময় অনিশ্চয়তা থাকবে। ইলেকট্রনটার ভরবেগ নির্ভুলভাবে মাপা গেলে তার অবস্থান নির্ভুল হবে না। আর অবস্থান নির্ভুলভাবে মাপা গেলে ভরেবেগে অনিশ্চয়তা চলে আসবে। 

সহজভাবে বললে, আপনি যদি জানতে পারেন এই মুহূর্তে একটা গাড়িতে আপনি ফার্মগেটে আছেন, তাহলে আপনার গতিবেগ কত তা কখনোই জানতে পারবেন না। আর যদি গতিবেগ জানেন, তাহলে নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না, গাড়িটায় আপনি ফার্মগেটে আছেন, নাকি গুলিস্তানে। সে অদ্ভুত এক অনিশ্চয়তা। অবশ্য আমাদের বড় পরিসরের বাস্তব জগতে এমনটি ঘটে না। কিন্তু পরমাণুর খুদে জগতের জন্য কথাটা ১০০ ভাগ সত্যি। কণার এই অনিশ্চয়তা নীতি থেকে বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে এলেন, নিউক্লিয়াসের চারপাশে ইলেকট্রন আসলে নির্দিষ্ট জায়গায় নয়, বরং ছড়িয়ে আছে মেঘের মতো করে। একে বলা হয় ইলেকট্রন ক্লাউড বা ইলেকট্রন মেঘ। এর মানে, একটি ইলেকট্রন একইসঙ্গে অনেক জায়গায় থাকতে পারে। 

কণার অনিশ্চয়তা নীতি থেকে বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে এলেন, নিউক্লিয়াসের চারপাশে ইলেকট্রন আসলে নির্দিষ্ট জায়গায় নয়, বরং ছড়িয়ে আছে মেঘের মতো করে

ইলেকট্রনকে বলা হয় স্থিতিশীল এবং মৌলিক কণা। কারণ প্রোটন বা নিউট্রনের মতো একে আরও ক্ষুদ্র কোনো কণায় ভাঙা যায় না। আবার এখন পর্যন্ত এদের ক্ষয় হওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এদের আয়ু দীর্ঘ, এমনকি অসীমও হতে পারে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। কারণ পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র অনুসারে, কোনো ভর বা চার্জ এমনি এমনি স্রেফ ভোজবাজির মতো শূন্য মিলিয়ে যেতে পারে না। এ কারণে ইলেকট্রন এত স্থিতিশীল। তবে কোনো ইলেকট্রন যদি তার প্রতিকণার মুখোমুখি হয়, তাহলে তারা পরস্পরকে ধ্বংস করে ফেলে। এবং শক্তি নিঃসরণ করে। ইলেকট্রনের এই প্রতিকণাকে বলা হয় পজিট্রন। পজিট্রনের ভর ইলেকট্রনের মতো, তবে এর চার্জ ধনাত্মক। পজিট্রনের সঙ্গে ইলেকট্রনের সংঘর্ষে শক্তি নিঃসৃত হয় দুটি ফোটন হিসেবে। অর্থাৎ আলোর কণা হিসেবে। বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যানের নীতি অনুযায়ী, এর উল্টোটাও ঘটা সম্ভব।

এককালে ইলেকট্রনকে ভাবা হতো কণা। ১৮৯৭ সালেই সেটাই প্রমাণ করেন জে জে টমসন। কিন্তু ১৯২৪ সালে শোনা গেল একেবারে উল্টো কথা। ফরাসি বিজ্ঞানী লুই ডি ব্রগলি প্রমাণ করলেন, ইলেকট্রনের তরঙ্গ ধর্মও আছে। অর্থাৎ ইলেকট্রন একইসঙ্গে কণা এবং তরঙ্গ। কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে, শুধু ইলেকট্রনই নয়, সব বস্তুর তরঙ্গ ধর্ম বর্তমান। একে বলা হয় কণা-তরঙ্গ দ্বৈততা বা পার্টিকেল-ওয়েভ ডুয়ালিটি। এ গবেষণার কারণে পরে নোবেল পুরস্কার পান ব্রগলি। পরে ডাবল স্লিট বা দ্বিচিড় পরীক্ষায় ইলেকট্রনের তরঙ্গ ধর্মের প্রমাণও পাওয়া গেছে।

ইলেকট্রনের গুরুত্ব আমাদের নিজেদের এবং আমাদের চারপাশের সবকিছুর জন্য অপরিসীম। সূর্যের পৃষ্ঠ থেকে আসা আলোই হোক, আর আপনার ঘরের বাল্বের আলোই হোক, এই আলো পাওয়া যায় ইলেকট্রনের গতির কারণে।

১৯২৫ সালে শোনা গেল আরও উদ্ভট কথা। জার্মান পদার্থবিদ ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ বললেন, কোনো পরমাণুতে ইলেকট্রনের অবস্থান নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়, শুধু কোনো জায়গায় ইলেকট্রন পাওয়ার সম্ভাবনা গণনা করা যাবে। সে কথা আগেই বলেছি। তার কিছুদিন পর অস্ট্রিয়ান পদার্থবিদ শ্রোডিঙ্গারের কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ওয়েভ ইকুয়েশনে পাওয়া গেল সেই কথারই প্রতিধ্বনি।

রসায়নেও ইলেকট্রন গুরুত্বপূর্ণ। ইলেকট্রনের কারণেই পরমাণু রাসায়নিক বিক্রিয়ায় একত্রিত হয়ে অণু গঠন করতে পারে। এর ফলে গড়ে ওঠে আমাদের চেনা-পরিচিত বস্তুজগত। আসলে প্রতিবেশী পরমাণুতে থাকা ইলেকট্রনগুলো রাসায়নিক বিক্রিয়ায় পরস্পর স্থান বদল করে। ফলে পরমাণুগুলো পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। এতে গঠিত হয় বিভিন্ন ধরনের অণু। ইলেকট্রনদের এই স্থান বিনিময়ের মতো বিশেষ গুণের কারণেই রসায়ন, জীববিজ্ঞান এবং সর্বোপরি প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব হয়েছে।

কাজেই, ইলেকট্রনের গুরুত্ব আমাদের নিজেদের এবং আমাদের চারপাশের সবকিছুর জন্য অপরিসীম। সূর্যের পৃষ্ঠ থেকে আসা আলোই হোক, আর আপনার ঘরের বাল্বের আলোই হোক, এই আলো পাওয়া যায় ইলেকট্রনের গতির কারণে। আবার আমরা ওই আলো অনুভব করি ইলেকট্রনের কারণে। আপনার চোখের রেটিনার কোষে আলো এসে পড়লে, সেখানকার অণুর ইলেকট্রন ওই আলো শোষণ করে। সে কারণে আমাদের দেখার অনুভূতি জন্মে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনও এ কণার ওপর নির্ভরশীল। বৈদ্যুতিক মোটর থেকে শুরু করে জেনারেটর, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন কিংবা আপনার বাসার নিত্যপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিগুলো কার্যকর থাকে ওই ইলেকট্রনের কারণেই। ইলেকট্রন আছে বলেই মানুষসহ অন্যান্য জীবজন্তু বা গাছপালার অস্তিত্ব আছে। আবার আমাদের দেহের প্রতিটি সজীব কোষে ইলেকট্রনদের অবিরাম চলাফেরার কারণেই আমরা পাই জীবনী শক্তি। কাজেই বলাই যায়, জয়তু ইলেকট্রন!

সূত্র: পার্টিকেল ফিজিকস/ ফ্রাঙ্ক ক্লোজ

হাউ টু ফাইন্ড আ হিগস বোসন/ ইভো ভেন ভালপেন

প্যারালাল ওয়ার্ল্ডস/ মিচিও কাকু

উইকিপিডিয়া

আরও পড়ুন