স্ট্রিং থিওরি কি পরীক্ষায় প্রমাণ করে দেখা সম্ভব

স্ট্রিং থিওরিকে অনেকে বলেন, সম্ভাব্য থিওরি অব এভরিথিং। গত শতকের ৬০-এর দশকে আকস্মিকভাবে আবিষ্কৃত হয়েছিল তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের এ ধারণা। এরপর অনেক মেধাবী তাত্ত্বিক বিজ্ঞানীদের চেষ্টায় তত্ত্বটি বিবর্তিত হয়ে বর্তমান রূপে এসে দাঁড়িয়েছে। এ তত্ত্বের ধারণা মতে, বস্তু বা পদার্থের ক্ষুদ্রতম একক পরমাণু, ইলেকট্রন বা কোয়ার্কই শেষ কথা নয়, বরং এর চেয়েও আরও ক্ষুদ্র স্ট্রিং হলো পদার্থের গাঠনিক একক। এ তত্ত্ব বলে, কোয়ার্ক বা ইলেকট্রন আরও ক্ষুদ্র এককে ভাঙতে থাকলে একসময় পাওয়া যাবে একমাত্রিক স্ট্রিং বা সুতো বা তারের মতো কিছু একটা। সেটা অনেকটা রাবার ব্যান্ডের অতিক্ষুদ্র ভার্সন।

সেই স্ট্রিং পরমাণু, ইলেকট্রন বা কোয়ার্কের চেয়েও ক্ষুদ্র। স্ট্রিং থিওরি মতে, আমাদের বাস্তবতা গড়ে ওঠেছে এসব অতিক্ষুদ্র তার বা স্ট্রিংয়ের কম্পনের মাধ্যমে। এসব স্ট্রিং কম্পিত হলে, পাক খেলে বা ভাজ হওয়ার কারণে ক্ষুদ্র মাত্রায় বিভিন্ন ধরনের প্রভাব সৃষ্টি হয়, আর এভাবেই গড়ে ওঠে আমাদের দৈনন্দিন বাস্তব জগৎ। আরও সহজভাবে বললে, স্ট্রিংয়ের প্রতিটি কম্পন একেকটি কণার প্রতিনিধিত্ব করে। গিটারের বিভিন্ন তারের ভিন্ন ভিন্ন কম্পন যেমন ভিন্ন ভিন্ন ধ্বনি বা সুর সৃষ্টি করে, এটাও অনেকটা সেরকম। অর্থাৎ ইলেকট্রন, কোয়ার্ক আসলে কম্পনশীল তার বা স্ট্রিংয়ের ওপর ভিন্ন ভিন্ন সুরের নোট ছাড়া আর কিছু নয়।

আরও পড়ুন
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কাজ-কারবার ক্ষুদ্র পরিসরের জগৎ নিয়ে

শুরুতেই বলেছি, স্ট্রিং থিওরিকে বলা হয় সম্ভাব্য ‘থিওরি অব এভরিথিং’ বা সবকিছুর তত্ত্ব। তাই এ তত্ত্ব নিয়ে একদল বিজ্ঞানী বেশ আশাবাদী। কারণ এমন একটা তত্ত্বের পেছনে দীর্ঘদিন হন্যে হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন পদার্থবিজ্ঞানীরা। সর্বকালের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী আইনস্টাইনও তাঁর জীবনের শেষের বছরগুলো এই তত্ত্ব দিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন। তাঁর সমসাময়িক অনেক প্রভাবশালী বিজ্ঞানীও চেষ্টা করেছেন প্রাণান্ত। এর ধারাবাহিকতায় বর্তমানেও তাত্ত্বিক পদার্থবিদরা খুঁজে বেড়াচ্ছেন থিওরি অব এভরিথিং। কিন্তু সব চেষ্টাই শেষপর্যন্ত গুড়েবালি। সে তত্ত্বের ধারেকাছেও পৌঁছানো যায়নি এখনো। কিন্তু কী সেই থিওরি অব এভরিথিং?

স্ট্রিং থিওরি মতে, আমাদের বাস্তবতা গড়ে ওঠেছে এসব অতিক্ষুদ্র তার বা স্ট্রিংয়ের কম্পনের মাধ্যমে। এসব স্ট্রিং কম্পিত হলে, পাক খেলে বা ভাজ হওয়ার কারণে ক্ষুদ্র মাত্রায় বিভিন্ন ধরনের প্রভাব সৃষ্টি হয়, আর এভাবেই গড়ে ওঠে আমাদের দৈনন্দিন বাস্তব জগৎ।

সহজ কথায় বলা যায়, আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের দুটি প্রধান ভিত্তি হলো সাধারণ আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্স। প্রথমটি কাজ করে গ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথ, মহাকর্ষ, কৃষ্ণগহ্বরের মতো বড় পরিসরের জগৎ নিয়ে। আর কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কাজ-কারবার ক্ষুদ্র পরিসরের জগৎ নিয়ে। যেমন পরমাণু থেকে শুরু করে পরমাণুর গাঠনিক উপাদান প্রোটন, নিউট্রন, ইলেকট্রন, কোয়ার্ক ইত্যাদি অতিপারমাণবিক কণা এবং এদের নিয়ন্ত্রণকারী মৌলিক বলগুলো নিয়ে। নিজ নিজ ক্ষেত্রে তত্ত্ব দুটি সফল। বিজ্ঞানীরা অনেক ধরেই স্বপ্ন দেখছেন, তত্ত্ব দুটিকে একীভূত করে একটা মাত্র তত্ত্ব দিয়ে মহাবিশ্বের সব কণা এবং সবগুলো বল—বড় ও ক্ষুদ্র পরিসরের জগৎকে ব্যাখ্যা করবেন। বহু কাঙ্খিত এবং বহু আরাধ্য সেই তত্ত্বটাই পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় থিওরি অব এভরিথিং। অনেকে একে বলেন, আপেক্ষিতা তত্ত্বের সঙ্গে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিবাহবন্ধন। কিন্তু তত্ত্ব দুটোকে কোনোমতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসানো যায়নি।

আরও পড়ুন

ঠিক এখানেই একটা আশার আলো দেখায় স্ট্রিং থিওরি। যেমন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা স্ট্যান্ডার্ড মডেলে প্রাকৃতিক তিনটি মৌলিক বলকে (দূর্বল নিউক্লিয় বল, শক্তিশালী নিউক্লিয় বল, তড়িৎচুম্বক বল) একীভূত করা সম্ভব হলেও চতুর্থ মৌলিক বল মহাকর্ষকে একীভূত করা সম্ভব হয়নি। সেখানে স্ট্রিং থিওরিতে আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মেলবন্ধন সম্ভব হয়েছে। এ তত্ত্বে সহজাতভাবেই অন্য তিনটি মৌলিক বলের সঙ্গে মহাকর্ষ এসে হাজির হয়। স্ট্রিং তত্ত্বে মহাকর্ষ বলকে গ্র্যাভিটন কণার বিনিময় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গ্র্যাভিটন কণাও গড়ে ওঠে স্ট্রিংয়ের এক বিশেষ ধরনের কম্পনের মাধ্যমে। 

পরমাণুর মতো অতিক্ষুদ্র সে পরিসর। বুঝতেই পারছেন, এত ছোট জায়গায় জট পাকিয়ে আছে বলেই সেগুলো আমরা সনাক্ত করতে পারছি না। আবার এই বাড়তি মাত্রাগুলো জট পাকাতে পারে কোটি কোটি উপায়ে।

এভাবেই স্ট্রিং থিওরির মাধ্যমে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সঙ্গে যোগ করা সম্ভব হয়েছে মহাকর্ষ বলকে। প্রকৃতির চারটি বলকে একীভূত করা সেই তত্ত্বকে কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি বা কোয়ান্টাম মহাকর্ষ নামেও ডাকা হয়। এসব বিবেচনায় নিয়ে স্ট্রিং থিওরি ব্যবহার করে কৃষ্ণগহ্বর, মহাবিস্ফোরণ, গুপ্ত শক্তি বা ডার্ক এনার্জির মতো মহাবিশ্বের কিছু মৌলিক বিষয়ের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা। এই সফলতার কারণে স্ট্রিং থিওরিকে বলা হচ্ছে সম্ভাব্য সবকিছুর তত্ত্ব বা থিওরি অব এভরিথিং। কিন্তু ‘সম্ভাব্য’ কেন? কেন চূড়ান্ত নয়?

সমস্যা হলো, আমাদের জগৎ সম্পর্কে স্ট্রিং থিওরি এমন কিছু অনুমান করে, যাকে এককথায় বলা চলে উদ্ভট এবং রহস্যময়। সেগুলো আমাদের জগতের চেনা-পরিচিত বাস্তবতার সঙ্গে মেলে, এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয়ত যেকোনো তত্ত্বকে সঠিক বলে প্রমাণ করতে হলে, কিছু অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। মানে তত্ত্বটির কিছু ভবিষ্যদ্বাণীর পরীক্ষামূলক প্রমাণ করতে হয়। কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলেন আর আপেক্ষিকতা তত্ত্ব বলেন, সব তত্ত্বই সেসব অগ্নিপরীক্ষা পার করে সফল তত্ত্বে পরিণত হয়েছে। কিন্তু স্ট্রিং তত্ত্ব থেকে পাওয়া কোনো ভবিষ্যদ্বাণী এখনও প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। এমনকি সেগুলো প্রমাণের জন্য যেসব উপকরণ দরকার, সেগুলোও আমাদের সক্ষমতার বাইরে। আর ভবিষ্যতেও সেগুলো মানুষের পক্ষে প্রমাণ করা যাবে বলেও ঘোর সন্দেহ করেন বিজ্ঞানীরা। সহজ কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক।

আরও পড়ুন
স্ট্রিং থিওরি মতে, কণা নয়, বস্তুজগতের মৌলিক একক আসলে স্ট্রিং বা তার বা সুতার মতো কিছু একটা

স্ট্রিং থিওরির বেশ কয়েকটি ভার্সন রয়েছে। এসব ভার্সন অনুসারে আমাদের বস্তুজগতের মাত্রা চারটি (স্থানের মাত্রা ৩টি এবং সময়ের ১টি) নয়, বরং ২৬টি, ১১টি অথবা ১০টি। আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুযায়ী আমরা মাত্র চারটি মাত্রার কথাই জানি। তাহলে বাকী মাত্রাগুলো কোথায় গেল? সেগুলো আমরা দেখতে বা অনুভব করতে পারছি না কেন?

এর উত্তরে স্ট্রিং তাত্ত্বিকরা বলেন, বাকী মাত্রাগুলো আমরা দেখতে পাচ্ছি না কারণ, সেগুলো কোনো অতিক্ষুদ্র পরিসরে জট পাকিয়ে আছে। সেটা কত ছোট জায়গা? মাত্র ১০-৩৩ সেন্টিমিটার জায়গায়। পরমাণুর মতো অতিক্ষুদ্র সে পরিসর। বুঝতেই পারছেন, এত ছোট জায়গায় জট পাকিয়ে আছে বলেই সেগুলো আমরা সনাক্ত করতে পারছি না। আবার এই বাড়তি মাত্রাগুলো জট পাকাতে পারে কোটি কোটি উপায়ে। তাই প্রতিটি জট পাকানোর কারণে সৃষ্টি হতে পারে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের স্থানকাল। এভাবে দেখা যায়, এ তত্ত্ব ১০৫০০ রকমের মহাবিশ্বের ভবিষ্যদ্বাণী করে। এসব মহাবিশ্ব বা মাল্টিভার্সের প্রতিটিই গুণে-মানে নিজের মতো করে অনন্য। 

একেই স্ট্রিং থিওরি সবচেয়ে চ্যালিঞ্জিং ব্যাপার বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা কারণ স্ট্রিং থিওরির একেকটি সমাধান হলো একটা গোটা মহাবিশ্ব। তাই তত্ত্বটাকে সরাসরি পরীক্ষা করার জন্য আমাদের দরকার গবেষণাগারে একটা আস্ত শিশু মহাবিশ্ব তৈরি করা! সেটি কি আমাদের পক্ষে সম্ভব?

কোনো যোগসূত্র নেই। সত্যিই আমাদের বর্তমান প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ তত্ত্বের পরীক্ষামূলক প্রমাণ দাখিল করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আবার ভবিষ্যতে এ তত্ত্বের ললাটে কী লেখা আছে, তাও কেউ জানে না।

স্ট্রিং তত্ত্বের সমালোচকরা এ ব্যাপারে কঠোর ভাষায় বলেন, মানুষের পক্ষে এসব মাল্টিভার্সের পরীক্ষামূলক প্রমাণ দাখিল করা কখনোই সম্ভব নয়। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ মিচিও কাকুর মতে, একমাত্র ঈশ্বরই পারেন এ তত্ত্বটা সত্যিকার অর্থে পরীক্ষা করে দেখতে।

আবার স্ট্রিং থিওরি অনুমান করা গ্র্যাভিটন বা অন্য স্ট্রিংগুলোর পরীক্ষামূলক প্রমাণ হাজির করতে হলে দরকার অনেক অনেক বড় পার্টিকেল অ্যাক্সিলারেটর। গত দশকে হিগস-বোসন কণা সনাক্ত করা সার্নের লার্জ হ্যার্ডন কলাইডার বা এলএইচসিও সেজন্য যথেষ্ট নয়। বিজ্ঞানীদের হিসেবে, এই তত্ত্বটা সরাসরি প্রমাণের জন্য যে পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটরের দরকার হবে, তার আকার হবে একটা গ্যালাক্সির সমান। আমাদের বর্তমান প্রযুক্তি জ্ঞান ও দক্ষতায় সেটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

আরও পড়ুন

এসব কারণে সমালোচকরা বলেন, স্ট্রিং থিওরির প্রধানতম সমস্যা এটা পরীক্ষাযোগ্য নয়। তাঁদের দাবি, স্ট্রিং থিওরির সুন্দর গণিত আছে সত্যি, কিন্তু এর সঙ্গে আমাদের ভৌত বাস্তবতার হয়তো কোনো যোগসূত্র নেই। সত্যিই আমাদের বর্তমান প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ তত্ত্বের পরীক্ষামূলক প্রমাণ দাখিল করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আবার ভবিষ্যতে এ তত্ত্বের ললাটে কী লেখা আছে, তাও কেউ জানে না। তাই নিঃসন্দেহে বলা চলে, পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে ‘স্ট্রিং থিওরি’ এবং ‘রহস্যময়’ দুটি সমার্থক শব্দ হিসেবে গণ্য হয়ে রইবে।

সূত্র: দ্য গড ইকুয়েশন/ মিচিও কাকু, নিউ সায়েন্টিস্ট, লাইভ সায়েন্স, সায়েন্টিফিক আমেরিকান, নাসা ডট কম, উইকিপিডিয়া

আরও পড়ুন