শেলডন গ্ল্যাশো ও স্টিভেন ওয়াইনবার্গের বন্ধুত্বের কথা

প্রায় ৭৪ বছরের বন্ধুত্ব। বিজ্ঞানী আবদুস সালামের সঙ্গে মিলে দুজনে নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন পদার্থবিজ্ঞানে। শেলডন গ্ল্যাশো ও স্টিভেন ওয়াইনবার্গের সেই বন্ধুত্বের কথা…

শেলডন গ্ল্যাশো ও স্টিভেন ওয়াইনবার্গ

প্রায় ৭৪ বছরের বন্ধুত্ব তাঁদের। নাম শেলডন গ্ল্যাশো ও স্টিভেন ওয়াইনবার্গ। ২০২১ সালের জুলাই মাসে ওয়াইনবার্গের মৃত্যুতে এ সম্পর্কের সমাপ্তি। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। কৈশোরে ব্রঙ্কস হাইস্কুল অব সায়েন্সে প্রথম দেখা। তত দিনে স্কুলটির বয়স সবে এক দশক পেরিয়েছে। প্রিন্সিপাল ড. মরিস মেইস্টারের কর্মতৎপরতা ও শিক্ষকদের দক্ষতায় নিউইয়র্কের বিদ্যালয়টির ভালো স্কুল হিসেবে তখন বেশ নামডাক। অনেক অভিভাবকের মতো তাঁদের মা–বাবাও সন্তানদের সেখানে ভর্তি করে দেন। অনেক ছাত্রের মধ্যে পাঁচজনের বন্ধুত্ব বেশ গভীর। গ্ল্যাশো ও ওয়াইনবার্গ—এ দুজন ছাড়া অন্য তিনজন হলেন গারলেড ফেইনবার্গ, মরটন স্টার্নহেইম ও মেনাসা টসনার।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন মধ্যগগনে। তত দিনে যুক্তরাষ্ট্রও জড়িয়ে পড়েছে যুদ্ধে। দুনিয়াজুড়ে চূড়ান্ত রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি নেমে এসেছে অর্থনৈতিক মন্দা। এই দুর্বিপাকের কেন্দ্র অবশ্যই ইউরোপ, যেখানে চলছে হিটলারের শাসন। একের পর এক দেশের দখল নিচ্ছে নাৎসি বাহিনী। বেঁচে থাকা যেখানে অনিশ্চিত, সেখানে সাধারণ জনজীবন থেকে শুরু করে পড়াশোনা, গবেষণা—সব কাজই যে ব্যাহত হবে, তাতে আর আশ্চর্য কী? সেই আশঙ্কা মাথায় নিয়ে দলে দলে সাধারণ মানুষ ইউরোপ ছেড়ে প্রাণ হাতে নিয়ে পাড়ি দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। বাদ যাচ্ছেন না বিভিন্ন ক্ষেত্রের উচ্চ মেধাসম্পন্ন মানুষেরা। এমনকি আইনস্টাইনের মতো বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানীও পাকাপাকিভাবে চলে এসেছেন এ দেশে। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, বিংশ শতাব্দীর প্রথম অর্ধশতকের বেশির ভাগ অংশে মানবসভ্যতার ইতিহাস এক চূড়ান্ত অশান্ত সময়ের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। অথচ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের নিরিখে এই কয়েক দশক সবচেয়ে বেশি ফলদায়ী। আপেক্ষিকতাবাদ, কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা, আলোক-তড়িৎক্রিয়া ইত্যাদি পদার্থবিজ্ঞানের নতুন নতুন দিশার উন্মোচন করে চলেছেন পদার্থবিদেরা।

বিজ্ঞানের সেই আঁচ এসে লেগেছিল নিউইয়র্কের ওই হাইস্কুলেও। অতটুকু বয়সে পাঁচ বন্ধুই ঠিক করে ফেললেন, ভবিষ্যতে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী হবেন। কিন্তু বিজ্ঞানী হওয়া কি আর সহজ কথা! বিশেষ করে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী! বিজ্ঞানীদের প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো বিপুল কর্মক্ষমতা, স্বজ্ঞা, কল্পনা ও তুখোড় গাণিতিক জ্ঞান। সে কথা মাথায় রেখে পদার্থবিদ্যা ও গণিতের পাঠ খুব ভালোভাবে নিচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু বিজ্ঞানের জগতে নিজেদের কল্পনা প্রকাশের একটা উপযুক্ত মঞ্চ তো চাই!

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বন্ধুর একজনেরও ভর্তির আবেদন গ্রাহ্য হলো না। আবার কর্নেল, প্রিন্সটন এবং এমআইটির মতো তিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চান্স পেলেন দুজনে।

অতএব উদ্যমী সেই ছাত্রের দল ঠিক করল, স্কুলেই একটি কল্পবিজ্ঞান ম্যাগাজিন প্রকাশ করবে। নিজেরা মিটিং করে গারলেড ফেইনবার্গকে পত্রিকার সম্পাদক নির্বাচিত করা হলো। ঠিক করা হলো, কোনো অবস্থাতেই পত্রিকার গুণগত মানের সঙ্গে সমঝোতা করা হবে না। কিন্তু পত্রিকার নাম কী হবে? একটা জবরদস্ত নাম তো দেওয়া চাই! আগামী দিনের বিজ্ঞানীরা যে পত্রিকা প্রকাশ করবেন, তার কি কোনো সাধারণ ম্যাড়মেড়ে নাম হয়? অবশেষে ‘Etaoin shrdlu’ নামে দুটি অর্থহীন শব্দ বাছা হলো। আসলে টাইপ কাস্টিং মেশিনের কি–বোর্ডে উল্লম্বভাবে অবস্থিত প্রথম দুটো লাইনের হরফ হলো e-t-a-o-i-n s-h-r-d-l-u, এটাই হবে তাঁদের পত্রিকার নাম। এই নাম দেখে সবার মনে সম্ভ্রম আসবে। তা ছাড়া অনেকে বলেন, বিজ্ঞানীদের চেতনার জগৎ সাধারণের অনুভবের বাইরে। ঠিক যেমন মহাকর্ষের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আইনস্টাইনের মাথায় কী করে ওই স্থান-কাল সম্পর্কের ধারণা এল, সেটা বোঝা কঠিন। একইভাবে নিজেদের স্বজ্ঞা ও গাণিতিক প্রয়োগক্ষমতা হাতিয়ার করে হাইজেনবার্গ বা শ্রোয়েডিঙ্গার কোয়ান্টাম বলবিদ্যা নামের কণাপদার্থবিজ্ঞানের এক নতুন শাখার দুয়ার উন্মোচন করেছিলেন। এসব ভাবনা হয়তো ঘুরছিল পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর মাথায়। তাই বেশ কাঠখড় পুড়িয়ে সমসাময়িক কালের প্রতিষ্ঠিত কল্পবিজ্ঞান লেখক আলফ্রেড বেসটারের কাছ থেকেও ম্যাগাজিনে প্রকাশের জন্য লেখা আদায় করেছিলেন তাঁরা। তবে স্টিভ (স্টিভেন) ও শেলডন এতেই থেমে থাকলেন না, সিনিয়র ক্লাসের দাদাদের কাছে নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করতে বিখ্যাত অভিনেতা ও নির্দেশক অরসন ওয়েলসের কাছে একটি রেকর্ডিং জমা দিয়ে এলেন। দ্য ওয়ার অব দ্য ওয়ার্লডস শিরোনামে রেডিওতে প্রচারিত সেই অনুষ্ঠানে বক্তা (ন্যারেটর) স্টিভ এবং বিজ্ঞানীর চরিত্রে ছিলেন শেলডন। একেবারে পেশাদারি কায়দায় দিমিত্রি জস্টাকোভিচের সেভেন্থ সিম্ফনি থেকে আবহ (ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক) তৈরি করেছিলেন তাঁরা।

সাফল্যের সঙ্গে এই কোর্স শেষ করার পর এবার উচ্চশিক্ষা নেওয়ার পালা। কিন্তু হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বন্ধুর একজনেরও ভর্তির আবেদন গ্রাহ্য হলো না। আবার কর্নেল, প্রিন্সটন এবং এমআইটির মতো তিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চান্স পেলেন দুজনে। এবার স্টিভের বাবা তাঁদের দুজনকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরিয়ে দেখালেন। সব দেখেশুনে দুজনে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। প্রচণ্ড পড়াশোনার চাপ সেখানে। বিখ্যাত জ্যোতিঃপদার্থবিদ কেনেথ গ্রেইসেন যে কোর্সটি পড়ান, তা বেশ শক্ত। এই শিক্ষা নিতে গিয়ে আবার পদার্থবিদ্যা ও গণিতের বেশ কিছু অ্যাডভান্স কোর্স করতে হলো। অবশ্য এ নিয়ে তাঁদের কোনো আপত্তি ছিল না। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা মানে গণিত ও বিজ্ঞানের উচ্চতর শিক্ষা। শেলডন গ্ল্যাশো থাকতেন ক্যাম্পাসের বাইরে কলেজ টাউনে, অন্যদিকে স্টিভের আস্তানাটি ছিল অনেকটা কাছে ‘টেলুরাইড হাউস’ নামের এক হোস্টেলে।

শেলডন গ্ল্যাশো
পঞ্চাশের দশকেও গবেষণাক্ষেত্র হিসেবে কোপেনহেগেনের ইনস্টিটিউট অব থিওরিটিক্যাল ফিজিকসের খুব নামডাক। বিশেষত তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার জগতে। স্বয়ং নীলস বোর আছেন সেখানে।

যথাসময়ে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ হলো, এবার গবেষণা করতে হবে। এখানেও দুজনের আগ্রহের ক্ষেত্র একই—‘ইউনিফিকেশন অব ফোর্সেস’। অর্থাৎ বিভিন্ন রকম প্রাকৃতিক বলের পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে বের করে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসা, যে স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বয়ং আইনস্টাইন। এই মহাবিজ্ঞানী জীবনের শেষ কয়েক দশক এই গবেষণাতেই নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। তবে এবার দুজনে আলাদা প্রতিষ্ঠানে—গবেষণা করতে শেলডন এলেন হার্ভার্ডে আর স্টিভ গেলেন প্রিন্সটনে। অধ্যাপক জুলিয়ান শুইঙ্গারের অধীনে গবেষণার কাজ শুরু করলেন শেলডন। অধ্যাপকের ধারণা অনুযায়ী তড়িৎচৌম্বকত্ব এবং দুর্বল বলের নেপথ্যে আছে ইয়াং-মিলস গাউস বোসনের একটি ত্রয়ী (ট্রিপলেট)। ছাত্রকে উৎসাহ দিতে প্রায়ই তিনি বলতেন—‘Go forth, young man, and unify!’ শুইঙ্গারের চ্যালেঞ্জের সমাধানে পুরোপুরি সফল হতে না পারলেও নিজের থিসিস লিখে ফেললেন শেলডন গ্ল্যাশো। আর ১৯৫৮ সাল নাগাদ পেলেন পিএইচডি। অন্যদিকে স্টিভেন ওয়াইনবার্গও তত দিনে পিএইচডি লাভ করেছেন। অধ্যাপক স্যাম ট্রিম্যানের তত্ত্বাবধানে তীব্র এবং দুর্বল বলের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় রিনরমালাইজেশন তত্ত্বের প্রয়োগ নিয়ে গবেষণা করেছেন তিনি।

স্টিভেন ওয়াইনবার্গ

পঞ্চাশের দশকেও গবেষণাক্ষেত্র হিসেবে কোপেনহেগেনের ইনস্টিটিউট অব থিওরিটিক্যাল ফিজিকসের খুব নামডাক। বিশেষত তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার জগতে। স্বয়ং নীলস বোর আছেন সেখানে। তাঁর আকর্ষণেই দেশ-বিদেশের তরুণ পদার্থবিদেরা গবেষণার জন্য পাড়ি জমান ডেনমার্কে। কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করার পর এক বছর গবেষণার কাজে কোপেনহেগেনে কাটিয়ে এসেছেন ওয়াইনবার্গ। এবার পিএইচডি করে একই প্রতিষ্ঠানে দুই বছরের জন্য পোস্টডক্টরাল ফেলোশিপ নিয়ে গেলেন গ্ল্যাশো। ১৯৬০ সাল নাগাদ সেখানেই গবেষণায় বড় সাফল্য পেলেন তিনি। নিউট্রাল কারেন্ট বা প্রশম তড়িতের অস্তিত্বের অনুমান করে তিনি দুর্বল তড়িৎ সংশ্লেষণের (Electroweak synthesis) জন্য প্রয়োজনীয় বীজগাণিতিক গঠনকাঠামোর সন্ধান দিলেন। পিএইচডি সুপারভাইজার শুইঙ্গারের চ্যালেঞ্জ যেন এবার অনেকটা মেটাতে পারলেন গ্ল্যাশো। তবে শুইঙ্গারের ধারণা অনুযায়ী তিনটির পরিবর্তে এখানে চারটি মধ্যস্থতাকারী প্রয়োজন। মডেলটি কিন্তু এখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ হলো না, বরং তিনটি বড় প্রশ্ন রয়ে গেল। প্রশ্নগুলো হলো—দুর্বল মিথস্ক্রিয়ায় মধ্যস্থতাকারীরা কীভাবে তাদের ভর অর্জন করে? লেপটনের মতো পারমাণবিক কণাগুলোকেও কি মডেলটির সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায়? তা ছাড়া তত্ত্বটি কি রিনরমালাইজেবল? (রিনরমালাইজেশন হলো কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্ব, পরিসংখ্যান বলবিদ্যা ইত্যাদি বিজ্ঞানের কিছু ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বিশেষ গাণিতিক পদ্ধতি।) আর তাই গাণিতিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ? তবে তখন পর্যন্ত কোন পদার্থবিদ (এমনকি গ্ল্যাশো নিজেও) মডেলটি সিরিয়াসলি নেননি।

ষাটের দশকে দুজন একসঙ্গে তিনটি গবেষণা প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ১৯৬৭ সালে ‘মডেল অব লেপটনস’ (শিরোনামে স্টিভেন ওয়াইনবার্গ লিখলেন তাঁর সেই বিখ্যাত গবেষণা প্রবন্ধ।

এদিকে কলাম্বিয়া ও বার্কলিতে পোস্টডক্টরাল গবেষণার কাজ শেষ করে ওয়াইনবার্গ তত দিনে অধ্যাপনায় যোগ দিয়েছেন। আর গ্ল্যাশো গবেষণা করছেন ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে। এখানে তাঁর তৃতীয় পোস্টডক্টরাল গবেষণার কাজ চলছিল। এর ঠিক ছয় বছর পর দেখা গেল, বার্কলিতে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছেন ওয়াইনবার্গ ও গ্ল্যাশো। আবার কর্মস্থল বদল হলো দুই বন্ধুর। স্টিভ চলে গেলেন এমআইটিতে আর গ্ল্যাশো হার্ভার্ডে। ষাটের দশকে দুজন একসঙ্গে তিনটি গবেষণা প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ১৯৬৭ সালে ‘মডেল অব লেপটনস’ (Model of Leptons) শিরোনামে স্টিভেন ওয়াইনবার্গ লিখলেন তাঁর সেই বিখ্যাত গবেষণা প্রবন্ধ। এতে ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত পিটার হিগস এবং অন্য গবেষকদের আবিষ্কৃত গাউস তত্ত্বের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিসাম্য ভাঙনের সুন্দর প্রয়োগ করেন তিনি। ভরহীন গাউস বোসন কী করে ভর লাভ করে, সেই ক্রিয়াকৌশল প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন হিগস, ফ্রাসোঁয়া অয়েংলার এবং অন্য সমসাময়িক গবেষকেরা। এই ক্রিয়াকৌশল গ্ল্যাশোর দুর্বল তড়িৎসংক্রান্ত মডেলে সফলভাবে প্রয়োগ করেন ওয়াইনবার্গ। হিগস বোসন সেখানে তিনটি মধ্যস্থতাকারী কণা এবং আধানযুক্ত লেপটনগুলোতে ভরের জোগান দিচ্ছে। অর্থাৎ গ্ল্যাশোর মডেলের নিরিখে উত্থাপিত প্রথম প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন স্টিভেন ওয়াইনবার্গ। আজ পর্যন্ত ১৮ হাজারের বেশি গবেষক নিজেদের লেখায় প্রবন্ধটির উল্লেখ করেছেন। বিজ্ঞান লেখকেরা মনে করেন, কণাপদার্থবিজ্ঞানীদের সাধের স্ট্যান্ডার্ড মডেলের ধারণার বীজ নিহিত ছিল ফিজিক্যাল রিভিউ লেটার্স জার্নাল-এ প্রকাশিত মাত্র তিন পৃষ্ঠার সেই গবেষণা প্রবন্ধে।

এ গবেষণার নিরিখে উচ্চশক্তি–সম্পর্কিত কণাপদার্থবিজ্ঞান গবেষণা নতুন মোড় নেয়। হ্যাড্রন–জাতীয় কণার (নিউট্রন ও প্রোটনের মতো নিউক্লীয় কণা এবং পায়ন বা কাউঅনের মতো তীব্র বলের জন্য কার্যকর অন্যান্য কণা) উপাদান হিসেবে কোয়ার্কের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয় বিজ্ঞানী সমাজ। ১৯৬৯ সালের অন্তিমলগ্নে জন ইলিওপুলাস, লুসিয়ানো মিয়ানি, শেলডন গ্ল্যাশো—এ তিন গবেষক একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেন। তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী আগে অনুমান করা চতুর্থ তথা চার্ম কোয়ার্কের অস্তিত্ব ইলেকট্রোউইক মডেলের সম্প্রসারণকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম, যেখানে সব পরিচিত প্রাথমিক কণা অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এটি ‘গ্ল্যাশো-ইলিওপুলাস-মিয়ানি মেকানিজম’ নামে পরিচিতি পায়। ফলে গ্ল্যাশোর প্রস্তাবিত মডেলের দ্বিতীয় প্রশ্নটির সমাধানও পাওয়া গেল।

তৃতীয় প্রশ্নটির উত্তর পাওয়া গেল ১৯৭১ সালে জেরার্ড টি হুফ্টের গবেষণায়। তত দিনে ইলেকট্রোউইক মডেল (ওয়াইনবার্গ-সালাম মডেল) বিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রশংসনীয় তত্ত্ব হিসেবে স্বীকৃত। বিভিন্ন পরীক্ষা–নিরীক্ষায় এই তত্ত্বের সত্যতা যাচাই হয়ে গেল। ১৯৭৩ সালে নিউট্রাল কারেন্ট বা প্রশম তড়িতের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়, পরের বছরই চার্ম কোয়ার্ক আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানীরা। ১৯৭৭ সালে ‘ন্যাচারাল কনজারভেশন লজ ফর নিউট্রাল কারেন্টস’ (Natural conservation laws for neutral currents) শিরোনামে একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন দুই বন্ধু।

ওয়াইনবার্গের মৃত্যুর পর অবশ্য স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে গ্ল্যাশো বলেছিলেন, ‘স্টিভ এবং আমি তখন থেকে খুব কমই কথা বলেছি।

তখন বসন্তকাল। ১৯৭৯ সালে দুর্বল বলের ক্রিয়াকৌশল নিয়ে বক্তব্য দিতে স্টকহোম গেছেন গ্ল্যাশো। বক্তব্য শেষে নোবেল কমিটির পদার্থবিদ্যা বিভাগের এক সদস্য মন্তব্য করলেন, ‘ওয়াইনবার্গ-সালাম মডেলের ফলাফল তো আপনার ১৯৬০ সালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। আপনি শুধু বিষয়টিকে অন্য আঙ্গিকে বলেছিলেন।’ এ কথা শুনে সেদিন খুব খুশি হয়েছিলেন গ্ল্যাশো। ওই বছরই আসে চূড়ান্ত স্বীকৃতি। ওয়াইনবার্গ, সালাম ও গ্ল্যাশো তিনজনই পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন। পাঁচ বছর পর আবার এই তিন বিজ্ঞানী সস্ত্রীক নোবেল পুরস্কার প্রদানের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন, তবে এবারের পুরস্কার প্রাপকেরা হলেন কার্লো রুবিয়া এবং সিমন ভ্যান ডার মেয়ার। দুর্বল বলের ক্রিয়ায় W এবং Z কণার অস্তিত্ব আবিষ্কারে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য এই পুরস্কার পেয়েছিলেন তাঁরা। ফলে ইলেকট্রোউইক থিওরির সত্যতা আবার প্রমাণিত হলো।

আব্দুস সালাম

স্কুলের পড়াশোনা থেকে শুরু করে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি পর্যন্ত একই পথের এ যাত্রায় দীর্ঘ সময় ধরে ওয়াইনবার্গ ও গ্ল্যাশো কিন্তু অভিন্নহৃদয় বন্ধু ছিলেন না। আবিষ্কার ও গবেষণার ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি নিয়ে তাঁদের সম্পর্কে চিড় ধরেছিল। গ্ল্যাশোর আক্ষেপ ছিল, বন্ধু ওয়াইনবার্গ বিভিন্ন কনফারেন্সে বক্তব্য দেওয়ার সময় তাঁর অবদানের কথা উল্লেখ করছেন না। এখানে মনে রাখা দরকার, বিজ্ঞানীরাও রক্ত–মাংসের মানুষ, যাঁদের মধ্যে মেধা ও সৃজনশীলতার পাশাপাশি ক্ষোভ ও হতাশার মতো মানবিক গুণ থাকা স্বাভাবিক। ২০২০ সালে আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব ফিজিকসে একটি সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় এ কথা স্বীকার করেছিলেন গ্ল্যাশো। তিনি বলেন, ‘১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে আমি নিজেকে নোবেল পুরস্কারের একজন প্রতিযোগী হিসেবে ভাবতে শুরু করি। অথচ আমার মনে হয়েছিল, পুরোনো বন্ধু ওয়াইনবার্গ নিজের এবং সালামের মধ্যে পুরস্কারটি রাখার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলেছেন। বিশেষ করে টোকিওতে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে দুর্বল মিথস্ক্রিয়া তত্ত্বের ইতিহাস উপস্থাপনের সময় স্টিভ আমার নাম উল্লেখ করা থেকে বিরত ছিল। ওর এই ভুলের জন্য আমি খুব বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম। এ কারণেই আমাদের বন্ধুত্বের অবসান ঘটে।’

ওয়াইনবার্গের মৃত্যুর পর অবশ্য স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে গ্ল্যাশো বলেছিলেন, ‘স্টিভ এবং আমি তখন থেকে খুব কমই কথা বলেছি। এখন ভাবতে খারাপ লাগে যে আমাদের দীর্ঘ বন্ধুত্ব এবং ফলপ্রসূ সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে পারিনি। তবু আমাদের জীবন এতটাই নিবিড়ভাবে জড়িত ছিল যে তাঁর মৃত্যু কেবল বিজ্ঞানের নয়, আমার জন্যও একটি বড় ক্ষতি।’ নিজেদের ফেলে আসা সোনালি দিনগুলোর কথাও সেখানে স্মরণ করেছেন বিজ্ঞানী। আসলে এটাই বাস্তব। যেখানে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ও হতাশার ঊর্ধ্বে শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়ে থাকে বন্ধুত্ব এবং বিজ্ঞানের প্রতি দুই গবেষকের অবদান।

লেখক: শিক্ষক, রসায়ন বিভাগ, শ্রীরামকৃষ্ণ বয়েজ হাইস্কুল, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

*লেখাটি ২০২৩ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত