LHC-তে মূলত চারটি জায়গায় প্রোটন প্রোটন সংঘর্ষ ঘটানো হয়। সেখানকার চারটা বিশাল যন্ত্রের মাধ্যমে সংঘর্ষে উত্পন্ন নতুন কণা শনাক্ত করা হয়। ভিন্ন ভিন্ন ধরনের কণা শনাক্ত করার জন্য ভিন্ন ভিন্ন যন্ত্র ব্যবহার করতে হয়। সে জন্য সংঘর্ষস্থলের চারপাশে অনেক যন্ত্রের সমাহার থাকে, যেমন ঠিক ফটোগ্রাফাররা সেলিব্রেটিদের চারপাশে ঘিরে থাকেন। প্রতিটি যন্ত্র-সমাহারই এক-একটি পরীক্ষণ বলে আমরা অভিহিত করে থাকি। LHC-তে এ রকম বড় চারটি পরীক্ষণ রয়েছে (ছবি ১)। তার মধ্যে ALICE নামের পরীক্ষণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। এ রকম পরীক্ষণগুলোতে হাজারেরও বেশি বিজ্ঞানী নিযুক্ত থাকেন—তাঁরা নানা বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণাগারের প্রতিনিধিত্ব করেন। ALICE পূর্ণরূপ হচ্ছে A Large Ion Collider Experiment।
সার্নের ATLAS (A Toroidal LHC Apparatus) আর CMS (Compact Muon Solenoid) দুটি পরীক্ষণ হিগস কণা শনাক্তের জন্য বিশেষ পরিচিতি পেয়েছে। এই দুটি পরীক্ষার উদ্দেশ্য, গ্ল্যাশাও-ভাইনবার্গ-সালাম প্রণীত তড়িত্চুম্বক ও দুর্বল নিউক্লিয় মিথস্ক্রিয়ার সম্মিলিত বিবরণ, যেটাকে আমরা বর্তমানে স্ট্যান্ডার্ড মডেল বলে থাকি—তার বিবরণের স্ট্যান্ডার্ড মডেলের বাইরের নতুন মৌলিক কণা শনাক্ত করা। ALICE পরীক্ষণের উদ্দেশ্যটা কিন্তু ভিন্ন। তাঁরা মূলত নিউক্লিয় বলের প্রকৃতি ও নিউক্লিয়াসের ভেতরের বস্তু প্রচণ্ড তাপ ও চাপে কী অবস্থা নেয়, তা জানার চেষ্টা করছেন। যাঁরা জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান (astrophysics) কিংবা মহাবিশ্ব সৃষ্টির একেবারে আদি অবস্থা নিয়ে কাজ করছেন, তাঁদের কাছে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এ ব্যাপারটা কেন কৌতূহলোদ্দীপক, তা জানলে ALICE পরীক্ষার উদ্দেশ্যটা বোঝা যাবে। গত সংখ্যায় যে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের কথা উল্লেখ করেছিলাম, তার ব্যাখ্যানুসারে সব মৌলিক কণার ভর হিগস (বল) ক্ষেত্র নামের বিশেষ ক্ষেত্রের (Field) সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার কারণে ঘটে। এই ক্ষেত্রটি ঠিক আমাদের পরিচিত তড়িত্চুম্বক ক্ষেত্রের মতোই নতুন একটি ক্ষেত্র। এই ক্ষেত্রের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলে অন্যান্য কণার বেগ কমে যায়। তা না হলে জগতের সবকিছুই ভরহীন হতো, সবাই আলোর বেগে ছোটাছুটি করত—আমরা কোনো পরমাণু বা অণু কিছুই পেতাম না। তবে এ ব্যাখ্যাই ভরের সম্পূর্ণ হিসাব দেয় না। এর মধ্যেও শুভংকরের ফাঁকি আছে। ছোট একটা হিসাব দেওয়া যাক। তার আগে একটা ব্যাপার মনে করিয়ে দিই| E = mc2-এর আশীর্বাদে আমরা ভরকে তার সমতুল্য শক্তির মাত্রায় মাপতে পারি, যার একক হিসেবে পদার্থবিজ্ঞানের এই শাখায় গবঠ ব্যবহার করা হয়। এই এককে প্রোটনের ভর প্রায় ৯৩৮ MeV। আমরা এখন জানি, প্রোটন, নিউট্রন ইত্যাদি কণা যারা সবল নিউক্লিয় মিথস্ক্রিয়ায় (Strong Nuclear Interaction) অংশ নেয়, তারা মূলত কোয়ার্ক (quark) বা তার প্রতিকণা (anti-quark) নামের মৌলিক কণার সমন্বয়ে তৈরি। আমরা বর্তমানে ছয় জাতের কোয়ার্কের অস্তিত্ব জানি। এদের ইংরেজি আদ্যক্ষর u, d, s, c, t, b দিয়ে প্রকাশ করা হয়। যেমন প্রোটন দুটি আপ কোয়ার্ক আর একটি ডাউন কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি। অর্থাত্ uud (u = আপ কোয়ার্ক, d = ডাউন কোয়ার্ক)। ১৯৩৫ সালের দিকে জাপানি বিজ্ঞানী হিডেকি ইউকায়া যে মেসন কণার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন (আমরা এটাকে এখন পায়ন বলে অভিহিত করি), তা কোয়ার্ক নকশায় একটি কোয়ার্ক ও একটি প্রতি-কোয়ার্কের সমন্বয়ে তৈরি। আর এই মেসনের ভর প্রায় ১৩৫ গবঠ। পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, কণা ও তার প্রতিকণার ভর সমান। তাহলে শুধু একটি কোয়ার্ক বেশি হওয়ার কারণে প্রোটনের ভর পায়নের তুলনায় ৯৩৮-১৩৫= ৭০৩ MeV বেশি! তাহলে তো পায়নের ভর ২ x ৭০৩= ১৪০৬ MeV-এর কাছাকাছি হওয়ার কথা!
লেকট্রনের মতো কোয়ার্ক বা গ্লুয়োন কণাকে আমরা বিমুক্ত অবস্থায় শনাক্ত করতে পারি না। এটার কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা দেওয়া হয় যে এই দুই কণারই কালার (color) নামের বিশেষ ধর্ম আছে।
এর কারণ হচ্ছে, পায়ন বা প্রোটন এগুলোর ভরের সিংহভাগ কোয়ার্কের ভর থেকে আসে না; বরং কোয়ার্কগুলোর মাঝের মিথস্ক্রিয়ার কারণে আসে। যেমন হাইড্রোজেন পরমাণুতে প্রোটন ও চারপাশে ঘূর্ণায়মান ইলেকট্রনের মাঝের আকর্ষণ বল উদ্ভূত হয় তাদের মাঝে ফোটন আদান-প্রদানের কারণে। একইভাবে কোয়ার্ক (এরপর থেকে প্রতি-কোয়ার্ককে আমরা আলাদাভাবে উল্লেখ করব না)-এর মাঝে গ্লুয়ন (Gluon) নামের আপাত ভরহীন কণার বিনিময়ের কারণে আকর্ষণ তৈরি হয়। তবে ফোটনের সঙ্গে গ্লুয়নের একটা উল্লেখযোগ্য পার্থক্য আছে। সেটি হলো একটা ফোটন সরাসরি ভেঙে দুটি ফোটন তৈরি করতে পারে না। কিন্তু গ্লুয়নের ক্ষেত্রে এ ঘটনাটিই ঘটে। এর ফলে একটি কোয়ার্ক সব সময়ই অসংখ্য গ্লুয়ন দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে থাকে। যে প্রশ্নটা আমাদের সামনে ঝুলে আছে, সেটা হলো প্রোটন বা নিউট্রনের ভেতর কী পরিমাণ এই গ্লুয়ন আছে? পরিপূর্ণভাবে হিসাব করলে দেখা যায়, কোয়ার্কের হিগসের কারণে প্রাপ্ত ভরের মান প্রায় ৩ MeV। আর d কোয়ার্কের জন্য এই ভরের মান প্রায় ৫ MeV-এর মতো। তাহলে শুধু হিগস মিথস্ক্রিয়ার কারণে প্রোটনের ভর থাকার কথা ৩+৩+৫= ১১ MeV। তাই আমাদের ভরের প্রায় পুরোটাই এই গ্লুয়নের সমাহার থেকে আসে, যদিও কাগজের হিসাবে প্রতিটি গ্লুয়ন কণাই ভরহীন। কেমন করে প্রোটনের ভরের মান এত বেশি হয়, সে প্রশ্নের কোনো সরাসরি উত্তর আমরা এখনো জানি না।
আরও ধাঁধার ব্যাপার হচ্ছে, ইলেকট্রনের মতো কোয়ার্ক বা গ্লুয়োন কণাকে আমরা বিমুক্ত অবস্থায় শনাক্ত করতে পারি না। এটার কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা দেওয়া হয় যে এই দুই কণারই কালার (color) নামের বিশেষ ধর্ম আছে। এটি আমরা পরীক্ষাগারে দেখতে পাব না—শুধু কণাগুলো কালারবিহীন সমন্বয়কেই আমরা শনাক্ত করতে পারব। বলে রাখা ভালো, নামে কালার হলেও এগুলো কিন্তু আমাদের প্রতিদিনের পরিচিত রং নয়। শুধু এই ধর্মটির মান ঠিক প্রাথমিক রঙের সংখ্যার মতো তিনটি হওয়ায় বিজ্ঞানীরা কণাগুলোর বৈশিষ্ট্যটির এ রকম মজার নামকরণ করেছেন। সরাসরি দেখা না গেলেও কালার ধর্মের কারণে যে রকম সমাহার আমরা প্রকৃতিতে দেখব, তার প্রতিটিই গত তিন দশকের চেয়েও বেশি সময় ধরে চলা সব পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বিজ্ঞানীরা দেখেছেন। যে তত্ত্ব কোয়ার্ক ও গ্লুয়নের মিথস্ক্রিয়া বর্ণনা করে, তার নাম কোয়ান্টাম ক্রোমোডাইনামিকস (Quantum Chromodynamics)।
১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে যখন হিগস কণা শনাক্ত করার জন্য LHC-এর পরিকল্পনা করা হচ্ছিল, ঠিক একই সময়ে একই যন্ত্র ব্যবহার করে একদল বিজ্ঞানী ভারী আয়নের যন্ত্র ব্যবহার করে কোয়ার্ক বিমুক্তকরণ (Quark Deconfinement) পর্যবেক্ষণ করার প্রস্তাব করেন।
সংক্ষেপে আমরা তাকে QCD বলি। QCD এর হিসাবে এই কালার নামের ধর্মটি আমাদের দৈনন্দিন শক্তিমাত্রায় অপ্রকাশিত থাকলেও উচ্চ তাপ ও চাপে এটার একরকম বহিঃপ্রকাশ পেতে পারে। এটা হলে পানি যেমন উচ্চতাপে ফুটলে তার ভেতর গ্যাসের বুদ্বুদ তৈরি হয়, একইভাবে নিউক্লিয়ার কণার ভেতরে কোয়ার্ক ও গ্লুয়নের বুদ্বুদ তৈরি হবে। কিন্তু এক ফোঁটা পানির ভেতরের যেমন বুদ্বুদ শনাক্ত করা কঠিন, একটি প্রোটন বা নিউট্রনের ভেতরের এ রকম বিমুক্ত কোয়ার্কের চলাচল শনাক্ত করাও অত্যন্ত কঠিন। এ কারণে বিজ্ঞানীরা প্রোটনের জায়গায় ভারী মৌলের নিউক্লিয়াস (তথা ভারী আয়ন—Heavy Ion) ব্যবহার করেন। ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে যখন হিগস কণা শনাক্ত করার জন্য LHC-এর পরিকল্পনা করা হচ্ছিল, ঠিক একই সময়ে একই যন্ত্র ব্যবহার করে একদল বিজ্ঞানী ভারী আয়নের যন্ত্র ব্যবহার করে কোয়ার্ক বিমুক্তকরণ (Quark Deconfinement) পর্যবেক্ষণ করার প্রস্তাব করেন। তাঁদের এই প্রয়াসটিই বর্তমানে ALICE পরীক্ষা হিসেবে চালু আছে। প্রতিবছর নভেম্বর/ডিসেম্বর মাসে LHC-তে প্রোটনের সঙ্গে প্রোটনের সংঘর্ষের (collision) পরিবর্তে প্রোটন ও সিসার আয়নের সংঘর্ষ অথবা সিসা আয়নের সঙ্গে সিসা আয়নের সংঘর্ষ ঘটানো হয়। সিসা (Lead - Pb) ব্যবহারের কারণ হলো এটা সবচেয়ে ভারী নিউক্লিয়াস যা তেজস্ক্রিয় (radioactive) নয়, অর্থাত্ স্থিতিশীল (stable)। কিন্তু এই ভারী নিউক্লিয়াস ব্যবহার করার কারণে বিজ্ঞানীদের ভিন্ন মাত্রার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়।
প্রতিটি সিসার নিউক্লিয়াসের ভেতর দুই শয়ের বেশি নিউক্লিয়ার কণা থাকায় তাদের সংঘর্ষের ফলাফলটি বেশি জটলা পাকানো। যার ফলে এই পরীক্ষণের প্রতিটির ডেটা তুলনামূলকভাবে বড় আকারের। আর যাঁরা বড় ধরনের ডেটা নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী, তাঁদের জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ উপহার দিচ্ছে। ফলাফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের এখানে কাজ করার সুযোগ আছে—প্রকৌশল, কম্পিউটিং এবং সর্বোপরি পদার্থবিজ্ঞান। এ সুযোগ হাতছাড়া না করাই সমীচীন।
*লেখাটি ২০১৬ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত