ট্রান্সইউরেনিয়াম দেয়াল ভাঙ্গার গল্প – পর্ব ১

এনরিকো ফার্মির নামে মহাবিশ্বের সব বস্তুকণার নাম রাখা হয়েছে ফার্মিওন। এককালে মুসোলিনির ইতালিতে তিনি বিখ্যাত ছিলেন ‘দ্য পোপ’ বা ‘পোপ অব ফিজিকস’ নামে। তরুণ একদল বিজ্ঞানীকে নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন প্যানিস্পারনা বয়েজ। বাসায় বানানো হোমমেড যন্ত্রে এই বিজ্ঞানী ভেঙে দিলেন পর্যায় সারণির সীমা…

নতুন মৌলিক পদার্থ সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে অনেকে ভাবেন আলকেমি বা অপরসায়ন। আদতে প্রাচীন আলকেমিস্টদের মূল মনোযোগ নতুন মৌলিক পদার্থ সৃষ্টিতে ছিল না। তাঁদের স্বপ্ন ছিল সীসার মতো সাধারণ বস্তুগুলোকে যেকোনো উপায়ে স্বর্ণে রূপান্তর করা। এই লক্ষ্য অর্জনে তাঁদের মূল হাতিয়ার ছিল হরেক রকম আজগুবি তন্ত্র-মন্ত্র এবং অদ্ভুতুড়ে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা। বিগত শত-সহস্র বছরে বহু মানুষ জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত চেষ্টা করে গেছেন নতুন কিং মাইডাস হিসেবে আত্মপ্রকাশের। প্রাচীন গ্রিক কিংবদন্তী অনুসারে, এই রাজার ছোঁয়ায় যেকোনো কিছু পরিণত হতো নিখাদ স্বর্ণে। কিন্তু আলকেমিস্টদের কেউ এ সফলতার মুখ দেখেননি। তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেই মৌলিক পদার্থ নিয়ে তৎকালীন প্রচলিত গ্রিক ধারণাতেই আস্থা রাখতেন। অর্থাৎ তাঁরা বিশ্বাস করতেন—মাটি, পানি, বাতাস ও আগুনের সমন্বয়ে গঠিত পুরো বিশ্বজগত।

এরপর কালের বিবর্তনে দৃশ্যপটে এলেন ফরাসি রসায়নবিদ অ্যান্টনি ল্যাভয়েসিয়ে (সঠিক উচ্চারণ, অঁতোয়ান লাভোয়াজিয়ে)। আলকেমিতে তিনি মোটেও বিশ্বাসী ছিলেন না। আবার মাত্র চারটি বস্তু নিয়ে পুরো মহাবিশ্ব গঠনের ধারণারও ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাঁর এহেন ব্যতিক্রমী চিন্তা-ভাবনার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে স্ত্রী ম্যারি অ্যান অনূদিত বিজ্ঞানের হরেকরকম বইগুলো।

ল্যাভয়েসিয়ে মহাবিশ্বের সম্ভাব্য সব মৌলিক পদার্থের একটি তালিকা প্রস্তুত করার কাজে নেমে পড়লেন। সেই তালিকায় স্থান পেয়েছিল মোট ৩৩টি মৌলিক পদার্থ। এদের মধ্যে ৩৩টিকে আধুনিক বিজ্ঞানের বিচারেও মৌলিক পদার্থ হিসেবে নিঃসন্দেহে আখ্যা দেওয়া যায়। কিছু ভুলভ্রান্তি থাকলেও (তালিকায় স্থান পেয়েছিল আলো ও ক্যালরিক) মোটা দাগে ল্যাভয়েসিয়ের চেষ্টাকে বেশ সফলই বলা চলে। পরের ৮২ বছর ধরে কয়েক প্রজন্মের বিজ্ঞানীরা তাঁর এই তালিকাটিকেই নানাভাবে পরিমার্জন করেছেন। ক্রমে সেখানে যুক্ত হয়েছে নতুন সব নাম।

১৮৬৯ সালে রুশ রসায়নবিদ দিমিত্রি মেন্ডেলিভ পরিমার্জিত তালিকাটি নিয়ে ব্যতিক্রমী এক কাজে হাত দেন। মৌলগুলোকে নানা মৌলিক ধর্ম ও বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে ক্রমানুসারে সাজানো শুরু করেন তিনি। সেই সুসজ্জিত তালিকাটি পরে পরিচিতি পায় পিরিয়ডিক টেবিল বা পর্যায় সারণি নামে। মেন্ডেলিভের সারণিতে মৌলিক পদার্থের সংখ্যা ছিল ৬৩টি।

বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি

প্রিয় পাঠক, কখনো টুকরো টুকরো অংশ জোড়া লাগিয়ে পাজল মেলানোর খেলা খেলেছেন? এই খেলায় প্রথমে আপনাকে একটি পূর্ণাঙ্গ ছবি দেখানো হবে। তারপর সেই ছবির বিভিন্ন অংশের জোড়া খুলে এলোমেলো করে দেওয়া হবে টুকরোগুলো। আপনার মূল লক্ষ্য থাকবে টুকরোগুলো জোড়া লাগিয়ে আবার পূর্ণাঙ্গ ছবি ফিরিয়ে আনা। সমধর্মী মৌলগুলোকে একসঙ্গে রেখে পর্যায় সারণি তৈরির প্রচেষ্টা এরকম পাজল মেলানোর খেলার মতোই ছিল। এখানে পার্থক্য হলো, তিনি জানতেন না পাজলের মোট টুকরার সংখ্যা কয়টি এবং মেলানো শেষে পূর্ণাঙ্গ ছবিটা আসলে কেমন দাঁড়াবে।

মেন্ডেলিভ মৌলিক পদার্থগুলো সাজিয়েছিলেন মূলত এদের ক্রমবর্ধমান ভরের ওপর ভিত্তি করে। সে জন্য তাঁর তালিকায় সবার প্রথমে স্থান পেয়েছিল প্রকৃতির সবচেয়ে হালকা মৌল হাইড্রোজেন (পারমাণবিক সংখ্যা: ১, ভর: ১), আর সবশেষের ঘরটি ছিল তখন পর্যন্ত জানা সবচেয়ে ভারী মৌল ইউরেনিয়ামের (পারমাণবিক সংখ্যা: ৯২, ভর: ২৩৮) জন্য। পর্যায় সারণি তৈরি করতে গিয়ে বেশ কিছু ঝামেলার মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। যেমন মাঝেমধ্যে দেখা যাচ্ছিল, ঊর্ধ্বক্রমানুসারে সাজালে কিছু মৌলকে স্থান দিতে হয় ভিন্ন ধর্ম বিশিষ্ট অন্যান্য মৌলের সঙ্গে। ফলে পর্যায় সারণির মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। এ ঝামেলা এড়াতে মেন্ডেলিভ তার সারণিতে কিছু স্থান ফাঁকা রেখেছিলেন। তাঁর আশা ছিল, এই ফাঁকা জায়গাগুলো হয়তো তখনো অনাবিষ্কৃত মৌল দিয়ে পূরণ হয়ে যাবে অদূর ভবিষ্যতে। এসব ‘সম্ভাব্য’ মৌলের নানা রাসায়নিক ধর্ম ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও আগাম ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তিনি। পরবর্তী প্রজন্মের বিজ্ঞানীরা মেন্ডেলিভকে মোটেও হতাশ করেননি। তাঁর অনুমান সত্য প্রমাণ করে একে একে পূরণ হয়ে যায় পর্যায় সারণির প্রতিটি ফাঁকা স্থান। তবে অনেকদিন পর্যন্ত এর প্রান্তসীমায় কোনো ধরনের পরিবর্তন আসেনি। শেষ স্থানটিতে যেন বাধার দেয়াল গড়ে রেখেছিল ইউরেনিয়াম মৌল। কোনোভাবেই আবিষ্কার করা যাচ্ছিল না এর পরের অবস্থানের—অর্থাৎ এর চেয়ে ভারী—মৌলগুলো। আমাদের আজকের গল্পটা সেই শত বছরের পুরোনো শক্ত দেয়াল ভাঙ্গার।   

১.

বেনিতো মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী ইতালির অন্যতম বিখ্যাত বিজ্ঞানী ছিলেন এনরিকো ফার্মি। হালকা পাতলা গড়ন, তীক্ষ্ম ক্ষুরধার দৃষ্টি সম্পন্ন এই পদার্থবিদের ব্যক্তিত্ব সহজেই সবার ওপর প্রভাব বিস্তার করত। চটজলদি অদ্ভুতুড়ে সব প্রশ্নের যৌক্তিক উত্তর খুঁজে বের করার দুর্লভ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন ফার্মি। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সেই পুরো মাত্রায় পদার্থবিজ্ঞানের প্রফেসর বনে গিয়েছিলেন। ইতালির বিজ্ঞানচর্চাকে বদলে দেওয়ার প্রত্যয় নিয়ে ইউনিভার্সিটি অফ রোমের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে তিনি গড়ে তুলেছিলেন একটি পরীক্ষাগার। দ্রুত এক ঝাঁক তরুণ প্রতিভাবান বিজ্ঞানী সেখানে যোগ দিলেন তাঁর সঙ্গে মহাবিশ্বের রহস্য উদ্‌ঘাটনে। ফার্মিসহ এদের কারোই নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করার তেমন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু সে সবের থোড়াই কেয়ার করে নিজেদের মতো করে গবেষণায় ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। দলটি ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেয় ‘ভিয়া প্যানিস্পারনা বয়েজ’ (Via Panisperna Boys) নামে। এনরিকো ফার্মির নেতৃত্বাধীন এই দলের সদস্যরা হলেন এদোয়ার্দো অ্যামাল্ডি, এত্তোরে মেজোরানা, ব্রুনো পন্টিকোর্ভ, ফ্রাংকো রাসেতি, এমিলিও সের্গি এবং অস্কার ডগোস্টিনো। এর মধ্যে একমাত্র অস্কার ছিলেন রসায়নবিদ, বাদ বাকি সবাই পদার্থবিদ। দলের প্রত্যেক সদস্যের কাছে ফার্মি ছিলেন ‘দ্য পোপ’-এর সমতুল্য। তাই তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন ‘পোপ অব ফিজিকস’ নামে।

অপ্রতুল সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার দরুন প্যানিস্পারনা বয়েজের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল সঙিন। প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রিটিশ, ফরাসি বা মার্কিন বিজ্ঞানীদের মতো ভালো মানের যন্ত্রপাতি কেনার সামর্থ্য তাঁদের একেবারেই ছিল না। সে জন্য বাধ্য হয়েই বিকল্প রাস্তা খুঁজে বের করতে হয়েছিল তাঁদের। ঘরে বসে নানান ফন্দি-ফিকির করে তাঁরা গাইগার-মুলার কাউন্টারের মতো সংবেদনশীল যন্ত্রপাতি মোটামুটি কাজ চালানোর জন্য তৈরি করে নিয়েছিলেন নিজেরাই। গবেষণার কাজে যখন হরেকরকম ভারী বস্তু সরানোর প্রয়োজন পড়ত, তখন আশপাশে থাকা ছেলে-ছোকরাদের ডেকে যৎসামান্য পারিশ্রমিক দিয়ে টানাটানির কাজটুকু সেরে ফেলা হতো। তবে রেডিয়েশন বা বিকিরণ নিয়ে কাজ করার সময় প্রয়োজনীয় সুরক্ষামূলক যন্ত্রপাতির অভাবে খুব ভুগতে হয়েছিল তাঁদের। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রায়ই তাঁদের লুকিয়ে থাকতে দেখা যেত ল্যাবের করিডোরের একদম শেষ প্রান্তে।

এনরিকো ফার্মির (ডানে) সঙ্গে ভিয়া প্যানিস্পারনা বয়েজের একাংশ—অস্কার ডগোস্টিনো, এমিলিও সের্গি, এদোয়ার্দো অ্যামাল্ডি, ফ্রাংকো রাসেতি (বাঁ থেকে)

মাত্র কয়েক দশক আগেই আর্নেস্ট রাদারফোর্ড দুটি আলাদা ধরনের রেডিয়েশন আবিষ্কার করেন—আলফা ও বিটা। আলফা কণা হলো হিলিয়াম নিউক্লিয়াস। খুব সহজ করে বললে, কোনো নিউক্লিয়াস থেকে আলফা কণা নির্গত হওয়ার অর্থ হলো সেখান থেকে দুটি প্রোটন ও দুটি নিউট্রন কমে যাওয়া। এ কারণেই রাদারফোর্ড ও সডির থোরিয়াম (৯০) নমুনাটি রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল রেডিয়ামে (৮৮)। অন্যদিকে, বিটা রেডিয়েশন হলো ইলেকট্রনের প্রবাহ। তবে এগুলো নিউক্লিয়াসকে ঘিরে ঘূর্ণমান গতানুগতিক ইলেকট্রন নয়, বরং এদের উৎস স্বয়ং নিউক্লিয়াস! কী, অবাক হলেন? ভাবছেন, নিউক্লিয়াসের ভেতরে আবার ইলেকট্রন এল কীভাবে? আসলে, অনেক সময় ভারসাম্য অর্জনের জন্য সেখানকার একটি নিউট্রন ক্ষয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রূপান্তরিত হয় একটি প্রোটনে। ঠিক এ সময়েই বিটা রেডিয়েশন হিসেবে নিউক্লিয়াস থেকে নির্গত হয় একটি ইলেকট্রন। এভাবে নিউক্লিয়াসে প্রোটনের মোট সংখ্যা এক বৃদ্ধি পাওয়ায় মূল মৌলিক পদার্থটি পর্যায় সারণির এক ধাপ পরের মৌলে পরিণত হয়। বিটা ইলেকট্রনের উৎস হিসেবে নিশ্চিত হতে পারলেও এদের নিয়ে বেশ বড়সড় ঝামেলাতেই পড়ে গিয়েছিলেন বিংশ শতাব্দীর পদার্থবিদেরা। কারণ এই ক্ষয় প্রক্রিয়ায় নিউট্রন থেকে যদি কেবল প্রোটন ও ইলেকট্রন আবির্ভূত হয়, তাহলে এদের ব্যাখ্যাকারী সমীকরণটি যেন ঠিক খাপ খায় না। সংরক্ষিত থাকে না শক্তি ও কৌণিক ভরবেগ। অচিরেই সমস্যাটি ফার্মির দৃষ্টি আকর্ষণ করে।     

১৯৩০ সালে অস্ট্রিয়ান পদার্থবিদ উলফগ্যাং পাউলি বিটা ক্ষয় প্রক্রিয়ার রহস্য সমাধানে অদ্ভুত এক প্রস্তাব হাজির করেন। তাঁর মতে, নিউক্লিয়াস থেকে যদি ইলেকট্রনের সঙ্গে আরেকটি অজানা কণা তীব্র বেগে নির্গত হয়, তাহলে ঝামেলা ছাড়াই সংরক্ষিত থাকবে শক্তি ও কৌণিক ভরবেগ। তবে এই সম্ভাব্য কণাটিকে বেশ কিছু অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে হবে। যেমন এদের ভরের মান হতে হবে ইলেকট্রনের চেয়ে কম, প্রায় শূন্যের কোঠায়। পাশাপাশি এদের মধ্যে কোনো ধরনের তড়িৎ চার্জের অস্তিত্ব থাকতে পারবে না। আপাতদৃষ্টিতে শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও পাউলির আইডিয়াটি বেশ যৌক্তিক ছিল। এর ওপর ভিত্তি করে কাজ শুরু করেন এনরিকো ফার্মি। তিনি এই অদেখা কণাটির নাম দেন নিউট্রিনো। নিউক্লিয়াস থেকে কীভাবে যুগপৎ ইলেকট্রন ও নিউট্রিনো আবির্ভূত হতে পারে, সেটি এত্তোরে মেজোরানার সঙ্গে যৌথভাবে বিস্তারিত দেখান বিখ্যাত ‘থিওরি বিটা ডিকে’ পেপারে। অতঃপর চটজলদি পেপারটি পাঠিয়ে দেওয়া হয় বিখ্যাত নেচার জার্নালে। দুর্ভাগ্যবশত জার্নাল কর্তৃপক্ষ এর গুরুত্ব বুঝতে পারেনি। বাস্তবতা বিবর্জিত আখ্যা দিয়ে পেপারটি তারা প্রত্যাখ্যান করে।

অনুমিতভাবেই, রেগে আগুন হয়ে যান ফার্মি। কিন্তু কিছু করার ছিল না। অন্য আরও কিছু জার্নালে পেপারটি পাঠিয়ে ফার্মি অবশেষে রণেভঙ্গ দেন। ক্ষণিকের জন্য তাত্ত্বিক কাজ থেকে ছুটি নিয়ে প্র্যাকটিক্যাল রিসার্চে মনোযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ঠিক এমন সময়েই তাঁর নজরে আসে ‘আর্টিফিশিয়াল ইনডিউসড রেডিয়েশন’ নামের নতুন এক আইডিয়া।

ধনাত্মক আলফা কণার পরিবর্তে তিনি নিউট্রন দিয়ে নিউক্লিয়াসকে আঘাত করার ফন্দি আঁটলেন। আধান নিরপেক্ষ হওয়ায় কুলম্ব ব্যারিয়ার ফাঁকি দিয়ে খুব সহজেই এদের পৌঁছে যেতে পারার কথা নিউক্লিয়াসের গহীনে।

২.

কোনো মৌলিক পদার্থকে আলফা কণা দিয়ে আঘাত করলে তার নিউক্লিয়াসে দুটি প্রোটন ও দুটি নিউট্রন যুক্ত হতে পারে। তখন পর্যায় সারণিতে দুই ধাপ এগিয়ে সেটি রূপান্তরিত হয় সম্পূর্ণ নতুন এক মৌলে। ১৯৩৪ সালে ঠিক এভাবেই আইরিন জুলিয়েট-কুরি এবং তাঁর স্বামী ফ্রেডরিক জুলিয়েট-কুরি অ্যালুমিনিয়ামকে (পারমাণবিক সংখ্যা: ১৩) পরিণত করেছিলেন ফসফরাসে (পারমাণবিক সংখ্যা: ১৫)। আইরিন ছিলেন কিংবদন্তীতুল্য পদার্থবিদ যুগল পিয়ের ও মেরি কুরির সন্তান। তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে নিত্যনতুন আবিষ্কারকে তাঁরা যেন একরকম পারিবারিক সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেছিলেন।

যাহোক, আলফা কণার আঘাতে নিউক্লিয়াসকে আমূল বদলে দিতে গেলে বিজ্ঞানীদের মোটামুটি দুটি প্রধান বাধার সম্মুখীন হতে হয়। প্রথম বাধাটি আসে পরমাণুতে ঘূর্ণমান ইলেকট্রনদের তরফ থেকে। এদের আকর্ষণে আলফা কণাদের গতিবেগ বেশ খানিকটা কমে যেতে পারে। ফলে হ্রাস পায় নিউক্লিয়াসের সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষের সম্ভাবনা। অন্যদিকে, দ্বিতীয় বাধাটি আসে স্বয়ং নিউক্লিয়াস থেকে। নিজেরাও ধনাত্মক আধান বিশিষ্ট হওয়ায় এটি সমধর্মী আলফা কণাদের ধারে কাছে ভিড়তে প্রবল বাধা দেয়। কুলম্ব ব্যারিয়ার নামে পরিচিত এই বিকর্ষণ বল ডিঙ্গিয়ে নিউক্লিয়াস পর্যন্ত পৌঁছাতে হলে অবধারিতভাবেই ত্বরিত করতে হয় আলফা কণাদের। এ জন্য প্রয়োজন বিপুল শক্তি। বিজ্ঞানীরা যে যন্ত্রের সাহায্যে ওপরের সমস্যা দুটির সমাধান করেন, তার নাম পার্টিকেল অ্যাক্সিলারেটর বা কণাত্বরক যন্ত্র। এদের তৈরি করা যেমন কষ্টসাধ্য, তেমনি ব্যয়বহুল। যেখানে গবেষণার জন্য দরকারি গতানুগতিক যন্ত্রপাতি ও মৌলিক সুরক্ষা সামগ্রী যোগাড় করতেই ফার্মি হিমশিম খাচ্ছিলেন, সেখানে এহেন দামি যন্ত্রের চিন্তা মাথায় আনাও যেন পাপ। তবে তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে গবেষণার বেলায় এটি মোটেও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। অদ্ভুত সুন্দর এক কৌশলের মাধ্যমে ফার্মি সব হিসাব-নিকাশ বদলে দিয়েছিলেন নিমিষে।

ধনাত্মক আলফা কণার পরিবর্তে তিনি নিউট্রন দিয়ে নিউক্লিয়াসকে আঘাত করার ফন্দি আঁটলেন। আধান নিরপেক্ষ হওয়ায় কুলম্ব ব্যারিয়ার ফাঁকি দিয়ে খুব সহজেই এদের পৌঁছে যেতে পারার কথা নিউক্লিয়াসের গহীনে। ফলে পার্টিকেল অ্যাক্সিলারেটর ব্যবহার করে কোনোটিকে আর আলাদাভাবে ত্বরিত করার প্রয়োজন পড়বে না। আর এই নিউট্রনগুলো একবার নিউক্লিয়াসের ভেতর পৌঁছাতে পারলে সেখানে বিদ্যমান ভারসাম্য পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তখন সম্ভাবনা থাকবে ব্যতিক্রম কিছু ঘটার। 

দেরি না করে দলবল নিয়ে নতুন আইডিয়া বাজিয়ে দেখার কাজে নেমে পড়েন এনরিকো ফার্মি। প্রথমেই তিনি চেষ্টা শুরু করলেন একটি নিউট্রন সোর্স জোগাড় করতে। কাজটি মোটেও সহজ ছিল না। ল্যাবরেটরি বিল্ডিংয়ের বেসমেন্টের সেফ বক্সে অন্য আরেক অধ্যাপকের জিম্মায় তেজস্ক্রিয় রেডিয়ামের নমুনা থাকার পাকা খবর ছিল তাঁর কাছে। সেগুলোর মাত্র এক গ্রামের অর্থমূল্যই প্যানিস্পারনা বয়েজের বার্ষিক বাজেটের প্রায় বিশ গুণের সমান! কথিত আছে, উপায়ন্তর না দেখে ফার্মি প্রথমে সেই রেডিয়ামের নমুনাটুকু চুরি করার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু তাতে বিশেষ সুবিধা করতে না পেরে বিকল্প রাস্তা অনুসন্ধানে বাধ্য হন তিনি। ফার্মি জানতেন, রেডিয়াম পরমাণুগুলো আলফা কণা বিকিরণের মাধ্যমে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ক্ষয় প্রাপ্ত হয়ে পরিণত হয় রেডন গ্যাসে, যারা কিনা নিজেরাও তেজস্ক্রিয়। সেই সেফ বক্স থেকে পাইপের মাধ্যমে পাম্প করে বিশেষ কৌশলে এই তেজস্ক্রিয় গ্যাসগুলোকে ছোট ছোট বোতলে সংগ্রহ করতে সক্ষম হন তিনি। অতঃপর এদের সঙ্গে মিশিয়ে দেন বেরিলিয়াম পাউডার। রেডন থেকে নিঃসৃত আলফা কণার আঘাতে এই বেরিলিয়াম পরমাণু থেকে অবিরাম নির্গত হতে থাকে নিউট্রন। এভাবে ফার্মির হাতের নাগালে চলে আসে পরম আকাঙ্ক্ষিত ‘হোমমেড’ নিউট্রন বিম বা রশ্মি।

নিউট্রন তো যোগাড় হলো। এবারে এদের হরেকরকম লক্ষ্যবস্তুতে ছুড়ে মারার পালা। কিন্তু ঠিক কিসের দিকে ছুড়ে মারা হবে? টার্গেট বা লক্ষ্য হিসেবে বিশেষ কোনো বস্তু বা মৌলিক পদার্থের কথা মাথায় ছিল না ফার্মির। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, সবকিছুকেই ব্যবহার করা হবে টার্গেট হিসেবে। যেই ভাবা সেই কাজ। বেশ লম্বা এক বাজারের ফর্দ তৈরি করে তিনি ধরিয়ে দিলেন সহকর্মী এমিলিও সের্গির হাতে। সেই তালিকায় স্থান পেয়েছিল তখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত মৌলিক পদার্থের সবগুলো। নিজে গিয়ে কেনাকাটা করা ছিলো ফার্মির দুচোখের বিষ। তাই অন্য কাউকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে তিনি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন, বাড়ি গিয়ে খেয়ে দেয়ে দিলেন শান্তির ঘুম। অন্যদিকে, এমিলিও বেরিয়ে পড়েন ‘দ্য পোপ’-এর ফরমায়েশ পূরণে। দ্রুতই এক সাপ্লাইয়ারের খোঁজ বের করে ফেললেন করিৎকর্মা এমিলিও। সেখানেই পাওয়া গেল চাহিদা মতো সবকিছু। এমনকি বেশ কটি মৌলিক পদার্থ বিনামূল্যেই যোগাড় করা সম্ভব হলো। কারণ বিগত পনের বছরে দোকানীর কাছে কেউই এদের কোনোটার খোঁজ করেনি।

আগামীকাল বাজারে আসছে বিজ্ঞানচিন্তার ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সংখ্যা

বিজ্ঞানচিন্তার চলতি সংখ্যায় থাকছে থিওরি অব এভরিথিং। সঙ্গে থাকছে আকর্ষণীয় সব ফিচার, বিজ্ঞান কমিক, রম্য, ছড়া, কার্যকারণ, দুই চালে মাত, কুইজসহ নিয়মিত সব আয়োজন। বিশেষ আয়োজন হিসেবে থাকছে বিজ্ঞানের নতুন বইয়ের খোঁজ। আপনার হকারকে আজই বলে রাখুন, অথবা অনলাইনে অর্ডার করুন এই লিঙ্ক থেকে

আরও পড়ুন

যোগাড়যন্ত্র শেষ হতেই শুরু হলো ম্যারাথন পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ফার্মি মৌলগুলোকে তাদের পারমাণবিক সংখ্যার ঊর্ধ্বক্রম অনুসারে এক-এক করে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ব্যবহার করতে লাগলেন। নিউট্রন দিয়ে আঘাত করার পর প্রথম দিকের কয়েকটি হালকা মৌলের বেলায় তেমন কিছু ঘটতে দেখা গেল না। তবে পরের কতগুলো থেকে নির্গত হতে দেখা গেল আলফা কণা। নিউক্লিয়াস থেকে দুটি করে প্রোটন ও নিউট্রন কমে যাওয়ায় এগুলো পর্যায় সারণির দুই ধাপ পেছনের মৌলে রূপান্তরিত হলো। অন্যদিকে, ভারী মৌলিক পদার্থদের নিউক্লিয়াসগুলোকে টার্গেট হিসেবে ব্যবহার করে সহজে আলফা কণা নির্গত হতে দেখা গেল না। কারণ এদের অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী সবল নিউক্লিয়ার বল আগত নিউট্রনকে ধরে রাখে। তবে পরবর্তীতে বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে এরা পরিণত হলো পর্যায় সারণির এক ধাপ পরের মৌলিক পদার্থে। ফার্মি এই প্রক্রিয়ার নাম দিলেন ‘নিউট্রন ক্যাপচার’। অর্থাৎ, নিউট্রনের আঘাতে মৌলরা পর্যায় সারণির দুই দিকেই রূপান্তরিত হতে পারে। বেশ কয়েক সপ্তাহ গবেষণার পরে অবশেষে ফার্মির দল পৌঁছে যায় সারণির একদম শেষ প্রান্তে। এবারে নিউট্রনের লক্ষ্যবস্তু প্রকৃতির সবচেয়ে ভারী মৌলিক পদার্থ ইউরেনিয়াম, যার পারমাণবিক সংখ্যা ৯২। পরীক্ষা শেষে তাঁরা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখলেন, নিউট্রনের আঘাতে নিশ্চিতভাবেই ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াস রূপান্তরিত হয়েছে অন্য কিছুতে। এখন প্রশ্ন হলো, রূপান্তরটি ঘটেছে কোন দিকে? আলফা ক্ষয়ের মাধ্যমে দুই ধাপ পিছিয়ে পর্যায় সারণির চেনা-জানা অংশের দিকে? নাকি বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে একধাপ সামনে এগিয়ে অজানার পথে?

দলবল নিয়ে ফার্মি নতুন সৃষ্ট বস্তুটির সঙ্গে পর্যায় সারণির ইউরেনিয়ামের আশপাশের অন্যান্য মৌলদের অর্ধায়ু ও হরেকরকম রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য মিলিয়ে দেখার কাজে নেমে পড়লেন। একে একে তারা নিম্নক্রমে লেড বা সীসা (পারমাণবিক সংখ্যা: ৮২) পর্যন্ত মৌলদের সঙ্গে সেরে ফেললেন তুলনার কাজ। কিন্তু সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়া গেল না। যদি নিউট্রনের আঘাতে ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াস থেকে সত্যিই আলফা কণা নির্গত হতো, তাহলে সেখানে একধরনের ‘ডিকে চেইন’ সৃষ্টি হওয়ার কথা। অর্থাৎ, প্রথমে ইউরেনিয়াম রূপান্তরিত হতো থোরিয়ামে (পারমাণবিক সংখ্যা: ৯০), তারপর সেটি রূপান্তরিত হতো রেডিয়ামে (পারমাণবিক সংখ্যা: ৮৮), তারপর পাওয়া যেত রেডন (পারমাণবিক সংখ্যা: ৮৬)। রূপান্তরের এই ধারা অব্যাহত থাকত কাছে-পিঠের সবচেয়ে ভারসাম্যপূর্ণ মৌল লেড পর্যন্ত। অনেক চেষ্টা চালিয়েও এমন কিছু ঘটার সামান্যতম চিহ্নও খুঁজে পেলেন না ফার্মি। এমতাবস্থায় সবচেয়ে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত হলো, নিউট্রনের আঘাতে অস্থিতিশীল ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসে সংঘটিত হয়েছে বিটা ক্ষয় প্রক্রিয়া। ফলে সেটি পর্যায় সারণির এক ধাপ সামনে এগিয়ে পরিণত হয়েছে সম্পূর্ণ নতুন এক মৌলিক পদার্থে, যার অস্তিত্ব আগে কখনো দেখেনি বিশ্ব! চমক এখানেই শেষ নয়। সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্যানিস্পারনা বয়েজের সদস্যরা আরও একটি অজানা মৌলিক পদার্থ শনাক্ত করে বসলেন। আপাতদৃষ্টিতে এটিরও আবির্ভূত হওয়ার একমাত্র ব্যাখ্যা নবসৃষ্ট মৌলটির পুনরায় বিটা ক্ষয়।

তৎকালীন সিংহভাগ বিজ্ঞানী বিশ্বাস করতেন, প্রকৃতিতে ইউরেনিয়ামের চেয়ে ভারী আর কোনো মৌলের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব নয়। এর মাধ্যমেই সমাপ্তি ঘটে পর্যায় সারণির। এমন ধারণার উৎপত্তি ঘটেছিল সারণিটি আবিষ্কারেরও বহু আগে, সেই ১৭৮৯ সালে; যখন কিনা জার্মান রসায়নবিদ মার্টিন হেইনরিখ ক্লাপ্রোথ সর্বপ্রথম খুঁজে পেয়েছিলেন এদের। প্রায় দেড়শ বছরের পুরোনো ধারণাটি গুটিকয়েক ঘরে বানানো যন্ত্রপাতি ও একগাদা ধূলিমাখা লক্ষ্যবস্তু ব্যবহার করে ভেঙ্গে দিতে পেরেছিলেন এনরিকো ফার্মি ও তার দল। অথচ তাদের চেয়ে বহু উন্নত যন্ত্রপাতি থাকার পরেও এর ধারে কাছের কিছু করে দেখাতে পারেনি অনেক নামী-দামী ল্যাবরেটরি।

অচিরেই ফার্মি বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিলেন পর্যায় সারণির সর্বশেষ সংযোজন, মৌলিক পদার্থ ৯৩ ও মৌলিক পদার্থ ৯৪, আবিষ্কারের খবর। তবে গল্পটা এখানেই শেষ নয়। ফার্মির জন্য অপেক্ষা করছিল আরও বড় চমক। সে গল্প ধীরে ধীরে জানা যাবে পরের পর্বগুলোয়।

(চলবে…)

লেখক: সহকারি ব্যবস্থাপক, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড

সূত্র:

১. সুপারহেভি: মেকিং অ্যান্ড ব্রেকিং দ্য পিরিওডিক টেবিল, কিট চ্যাপম্যানচ