নতুন যা জানলাম

প্রতিদিন বিজ্ঞানের জগতে ঘটছে নানা ঘটনা। প্রতিমুহূর্তে এগোচ্ছে পৃথিবী, বদলে যাচ্ছে অনেক কিছু। প্রকাশিত হচ্ছে নতুন গবেষণাপত্র, জানা যাচ্ছে নতুন গবেষণার কথা। কিছু বিষয় এত সুদূর প্রসারী যে এগুলোর প্রভাব বোঝা যাবে আরও অনেক পরে। এরকম নানা বিষয়, নানা ঘটনা দেখে নিন একনজরে, জেনে নিন সংক্ষেপে।

১. মহাকাশে থাকার বিশ্ব রেকর্ড

মহাকাশে সবচেয়ে বেশি সময় কাটানোর রেকর্ড গড়েছেন রুশ মহাকাশচারী ওলেগ কোনোনেনকো। তিনি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে (আইএসএস) বছরেরও বেশি সময় কাটিয়ে পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন। ৬০ বছর বয়সী এই নভোচারী মোট ১ হাজার ১১১ দিন মহাকাশে ছিলেন, যা সবচেয়ে বেশি দিন মহাকাশে থাকার নতুন রেকর্ড।

রুশ নভোচারী ওলেগ কোনোনেনকোর সঙ্গে আরও দুই নভোচারী পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন ২৩ সেপ্টেম্বর। তাঁরা হলেন রাশিয়ার নিকোলাই চুব ও নাসার ট্রেসি ডাইসন। রাশিয়ার সয়ুজ এমএস-২৫ মহাকাশযানে তাঁরা কাজাখস্তানে অবতরণ করেছেন। আইএসএস থেকে তাঁদের পৃথিবীতে আসতে সাড়ে তিন ঘণ্টার মতো সময় লেগেছে। রুশ দুই নভোচারী মহাকাশ স্টেশনে একটানা ৩৭৪ দিন থেকে আগের ৩৭১ দিনের রেকর্ড ভেঙেছেন।

২. পৃথিবীর চারপাশে অদৃশ্য তড়িৎ ক্ষেত্রের সন্ধান

পৃথিবীকে ঘিরে রয়েছে এক অদৃশ্য বলয়। খালি চোখে এ বলয় দেখা যায় না। এই অদৃশ্য বলয়ের নাম তড়িৎ ক্ষেত্র। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি এই তড়িৎ ক্ষেত্রের অস্তিত্বের প্রমাণ পেয়েছেন। আমাদের মাথার ওপরে, অর্থাৎ পৃথিবীর চারপাশে থাকা অ্যাম্বিপোলার নামে এই তড়িৎ ক্ষেত্র বায়ুমণ্ডলের একটি স্তরকে মহাকাশে ধরে রাখে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, এই তড়িৎ ক্ষেত্র আমাদের বায়ুমণ্ডলকে পৃথিবীর কাছে আটকে রাখে।

এই স্তরটি নিয়ে বিজ্ঞানীরা বিস্তর গবেষণা শুরু করেছেন। এর সাহায্যে তাঁরা বুঝতে পারবেন, কীভাবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল পরিবর্তিত হয়েছে। তাঁরা এই গবেষণার ফলাফল ২৮শে আগস্ট নেচার জার্নালে প্রকাশ করেছেন।

গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের প্রায় ১৫০ মাইল ওপরে বিভিন্ন কণা বৈদ্যুতিক চার্জে চার্জিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় ৬০ বছর আগে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছিলেন, পৃথিবীর মেরু অঞ্চলে দেখা ‘মেরু বায়ু’ এই অ্যাম্বিপোলার বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের কারণে হয়। এই ঘটনায় মহাকাশ থেকে চার্জযুক্ত কণাগুলো পৃথিবীর মেরু অঞ্চলে প্রবাহিত হয়।

৩. পৃথিবীর কক্ষপথে নতুন গ্রহাণু

ছবি: স্পেস ডটকম

২৯ সেপ্টেম্বর থেকে আগামী দুই মাস পৃথিবীর আকাশে দেখা যাবে পৃথিবীর দ্বিতীয় চাঁদ। অবশ্য এটি আমাদের পরিচিত একমাত্র উপগ্রহ চাঁদের মতো নয়। একটা ছোট্ট গ্রহাণু। পৃথিবীর কক্ষপথে দুই মাস অতিবাহিত করার পর ২৫ নভেম্বর গ্রহাণুটি আবার নিজস্ব কক্ষপথে চলতে শুরু করবে।

সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি রিসার্চ নোটস অব দ্য আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি (আরএনএএএস) জার্নালে এই ছোট গ্রহাণু নিয়ে একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা গ্রহাণুটির নাম দিয়েছেন ‘২০২৪ পিটি৫’। তবে বিজ্ঞানীরা এটিকে ‘মিনি মুন’ বলেও উল্লেখ করেছেন। গ্রহাণুটির আকার খুব ছোট। মাত্র ৩২ ফুট বা ১০ মিটার। অন্যদিকে আমাদের চাঁদের ব্যাস প্রায় ৩ হাজার ৪৭৪ কিলোমিটার। বোঝাই যাচ্ছে গ্রহাণুটি কত ছোট। ‘২০২৪ পিটি৫’ নামে গ্রহাণুটি অর্জুন গ্রহাণু বেষ্টনী থেকে এসেছে। সেখানে পৃথিবীর অনুরূপ কক্ষপথে আরও অনেক শিলা রয়েছে। মাঝে মাঝে এই গ্রহাণুগুলোর মধ্যে কিছু আমাদের গ্রহের খুব কাছাকাছি চলে আসে।

গ্রহাণুটি প্রথম দেখা যায় ৭ আগস্ট। নাসার বিশেষ টেলিস্কোপ অ্যাস্টেরয়েড টেরিস্ট্রিয়াল-ইমপ্যাক্ট লাস্ট এলার্ট সিস্টেম (এটলাস)  গ্রহাণুটি খুঁজে পেয়েছে। ছোট্ট এই চাঁদটি দেখতে হবে টেলিস্কোপের সাহায্যে।

৪. পাওয়া গেল নতুন রক্তের গ্রুপ

ছবি: পিক্সেলস

১৯৭২ সালে গর্ভবতী এক নারীর রক্ত পরীক্ষা করতে গিয়ে চিকিৎসকরা অদ্ভুত এক ঘটনার সম্মুখীন হন। তাঁরা দেখতে পান, এই নারীর রক্তে অন্য সবার মতো লোহিত রক্তকণিকার পৃষ্ঠে যে প্রোটিন থাকে, সেটি নেই। প্রায় ৫০ বছর পরে বিজ্ঞানীরা এই রহস্যের সমাধান করার চেষ্টা করছেন। অবশেষে এই রহস্যের জট খুলেছে। যুক্তরাজ্য ও ইসরায়েলের বিজ্ঞানীরা এই অদ্ভুত অণুর অনুপস্থিতির কারণ বের করে নতুন রক্তের গ্রুপ আবিষ্কার করেছেন।

আমেরিকান সোসাইটি অফ হেমাটোলজির ব্লাড জার্নালে এ সম্পর্কিত গবেষণাপত্র প্রকাশ করা হয়। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের রক্ত বিশেষজ্ঞ লুইস টিলি ও তাঁর দল ২০ বছর ধরে এই বিরল রক্তের গ্রুপের রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেছেন। এই গবেষণার নেতৃত্ব দেওয়া লুইস টিলি বলেন, ‘এই বিরল জিনগত বৈশিষ্ট্যের পেছনে লুকিয়ে থাকা রহস্য উদ্ঘাটন করা সহজ ছিল না। তবে আমরা সফল হয়েছি’।

আমরা সবাই জানি, রক্তের গ্রুপ মূলত এ, বি, ও এবং এবি—এই চার ধরনের হয়। এ ছাড়াও রেসাস ফ্যাক্টর (প্লাস বা মাইনাস) থাকতে পারে। এই গ্রুপগুলো আসলে আমাদের রক্তের লোহিত রক্তকণিকার ওপর থাকা বিশেষ ধরনের প্রোটিনের ওপর নির্ভর করে। এএনডাব্লিউজে নামে একটি বিশেষ ধরনের প্রোটিন সাধারণত সবার রক্তে থাকে। কিন্তু, ১৯৭২ সালে আবিষ্কৃত ওই নারীর রক্তে এই প্রোটিনটি ছিল না। বিজ্ঞানীরা এই নতুন রক্তের গ্রুপকে ‘এমএএল’ নাম দিয়েছেন।  

৫. প্রশান্ত মহাসাগরের নিচে বিশাল পর্বতের সন্ধান

শ্মিডিট ওশান ইনস্টিটিউট

প্রশান্ত মহাসাগরের নিচে এক বিশাল পর্বতের খোঁজ মিলেছে। সমুদ্রতল থেকে এই পর্বতের উচ্চতা মাপা হয়েছে ৩ হাজার ১০৯ মিটার। বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবন দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা থেকেও প্রায় চার গুণ বেশি লম্বা এটি। চিলির উপকূল থেকে প্রায় ৯০০ মাইল দূরে প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে অবস্থিত এই পর্বত।

পর্বতটি আবিষ্কার করেছেন ক্যালিফোর্নিয়ার শ্মিডিট ওশান ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। তাঁরা সোনার সিস্টেম ব্যবহার করে সমুদ্রতলের মানচিত্র তৈরি করেছেন। কাজটি করতে ২৮ দিন সময় লেগেছে। সেখান থেকেই তাঁরা এই সি মাউন্টেনের সন্ধান পান। 

এই অনুসন্ধানের সময় ক্যালিফোর্নিয়ার সমুদ্রবিজ্ঞানীরা প্রশান্ত মহাসাগরের ওই অঞ্চলে এক বিশাল প্রবালবাগান ও বিরল প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণীর খোঁজ পেয়েছেন। এই প্রবালবাগানটি তিনটি টেনিস কোর্টের সমান। বিরল প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণীর মধ্যে রয়েছে প্রোমাচোটিউথিস স্কুইড, ক্যাসপার অক্টোপাস, গোল্ডেন কোরাল ও ফ্লাইং স্প্যাঘেটি মনস্টার ইত্যাদি। সমুদ্রবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত সমুদ্রের নিচে ২০টি নতুন প্রজাতির প্রাণী আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে।

৬. আটকে থাকা নভোচারীদের জন্য স্পেসএক্স পাঠাল ক্যাপসুল

যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার দুই নভোচারী সুনিতা উইলিয়ামস এবং বুচ উইলমোর গত ৫ জুন আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে ভ্রমণে গিয়েছিলেন। মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী, ৮ দিন মহাকাশ স্টেশনে থেকে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসার কথা ছিল। তবে স্টারলাইনার মহাকাশযানে হঠাৎ করে হিলিয়াম গ্যাস লিক হওয়ার ফলে নভোচারীরা পৃথিবীতে ফিরতে পারেননি। তাঁরা এখনো মহাকাশ স্টেশনে অবস্থান করছেন। তাঁদের ফিরিয়ে আনতে নতুন নভোযান পাঠিয়েছে নাসা।

স্পেসএক্সের ড্রাগন ক্যাপসুলটি গত ২৮ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়। এটি ৩০ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে গিয়ে পৌঁছায়। আগামী ফেব্রুয়ারিতে সুনিতা উইলিয়ামস ও বুচ উইলমোরকে নিয়ে পৃথিবীতে ফিরবে নভোযানটি।

সূত্র: নিউইয়র্ক টাইম, সিএনএন, স্পেস ডটকম, বিবিসি, লাইভ সায়েন্স, সায়েন্স এলার্ট, নাসা, বিজ্ঞানচিন্তা