বিজ্ঞানচিন্তা বনাম বিজ্ঞান রম্য

ক্যারিকেচার: মেহেদী হক

সময়টা ১৯৭৫ সাল। সেই সময় সুযোগটা এল। মুহম্মদ ইব্রাহীম স্যারের বিজ্ঞান সাময়িকী ম্যাগাজিনে সায়েন্টিফিক ইলাস্ট্রেশনের কাজ করার। সেই প্রথম দেশের কোনো বিজ্ঞান পত্রিকায় কাজ করার সুযোগ এল। এর কিছুদিন পর স্যার বললেন, বিজ্ঞান সাময়িকীতে কার্টুন আঁকতে। সায়েন্টিফিক কার্টুনও আঁকা শুরু করলাম। তখন যেহেতু আমাদের উন্মাদ-এর বাজারে বেশ রমরমা চলছে... সেই প্রসঙ্গেই হয়তো বিজ্ঞান সাময়িকীতে কার্টুন চালু হয়ে গেল। দীর্ঘদিন এই প্রক্রিয়া চলল। স্যারের বিজ্ঞান সাময়িকীর বয়স ৫০-এর ওপরে। তিনি এটা শুরু করেছিলেন যখন ইন্টারমিডিয়েট (উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে) পড়তেন। (আমরাও ইন্টারমিডিয়েটে থাকতেই উন্মাদ শুরু করেছিলাম।)

পরে ইব্রাহীম স্যার তাঁর এনজিও ‘বিজ্ঞান গণশিক্ষা কেন্দ্র’ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বিজ্ঞান সাময়িকী প্রকাশনা অনিয়মিত হতে হতে এক সময় বন্ধই হয়ে গেল।

তারপর এল বিজ্ঞান বক্তা আসিফের সায়েন্স ওয়ার্ল্ড। সেখানে কার্টুন না, ‘সায়েন্সটুন’ নামে বিজ্ঞান নিয়ে মজার সব ঘটনা লেখা শুরু করলাম। সবাই মনে হয় পছন্দই করল। বিজ্ঞানীদের জীবনে মজার ঘটনার তো আর অভাব নেই। মজার ঘটনা শুনতে কার না ভালো লাগে? আর দু-একটা বানিয়ে বললেই-বা কী যায় আসে? বিজ্ঞানীদের নিয়ে কিংবদন্তি গল্পের তো আর শেষ নেই।

তারপর আর কী, বাংলাদেশে প্রকাশনার ক্ষেত্রে যা ঘটে, ‘কিপ দ্যা বোট ফ্লোটিং’ স্টেজে আসিফের সায়েন্স ওয়ার্ল্ড বন্ধ হয়ে গেল।

তারপর বহুদিন গেছে কোনো বিজ্ঞান পত্রিকা নেই। দু-একটা দৈনিকে বিজ্ঞানের পাতা বেরোতো বটে। কিন্তু ক্রিড়া আর সিনেমা পাতার দৌরাত্নে একদিন দেখা গেল তাও নেই। অবশ্য কিছু কিছু কিশোর-তরুণ নিজেদের উদ্যোগে ছোটখাটো লিটল ম্যাগাজিন টাইপ এলাকা ভিত্তিক সায়েন্স পত্রিকা বের করার চেষ্টা করেছে , সেগুলোও মন্দ ছিল না।

অবশেষে এল কাইয়ুম ভাইয়ের (আব্দুল কাইয়ুম) বিজ্ঞানচিন্তা। তার নির্বাহী সম্পাদক আবুল বাসারের কারণে আমিও আবার লিখতে শুরু করলাম ‘বিজ্ঞান রম্য’, সঙ্গে ফ্রি কার্টুন। লেখা বা কার্টুন (নাকি ইলাস্ট্রেশন?) কেমন হচ্ছে, জানি না। তবে এই ‘বিজ্ঞান রম্য’ লেখালেখির কারণে এক জনপ্রিয় সায়েন্স ফিকশন লেখক আমাকে তাঁর বেশ মোটাসোটা একটা সায়েন্স ফিকশন সংগ্রহ উত্সর্গ করেছেন, তিনি সেটা উল্লেখও করেছেন। এটাই-বা কম পাওয়া কি!

একটা ঘটনা বলি বরং—

আমি মাঝেমধ্যে পত্রিকা স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে খেয়াল করি আমার উন্মাদ আছে কি না। না থাকলে কেন নেই, সেটা জানার চেষ্টা করি। একদিন এরকম দাঁড়িয়ে আছি একটা পত্রিকা স্ট্যান্ডে। দেখি, ভারী চশমা পরা এক তরুণ বিজ্ঞানচিন্তা কিনছে। আমাকে দেখে সম্ভবত বোঝার চেষ্টা করল আমি আদৌ আহসান হাবীব কি না। বলল—

- আচ্ছা, আপনি আহসান হাবীব?

- হ্যাঁ।

- এই বিজ্ঞানচিন্তার ‘বিজ্ঞান রম্য’র লেখক?

- হ্যাঁ।

- কিছু মনে করবেন না, একটা কথা বলতে পারি?

- বলো।

- বিজ্ঞানচিন্তা আমার খুব প্রিয় পত্রিকা। আমি এর প্রথম পাতা থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত পড়ি। তবে ‘বিজ্ঞান রম্য’ পাতাটা পড়ি না।

- তাই? কেন?

- বিজ্ঞান একটা সিরিয়াস বিষয়, এ নিয়ে ফান করা আমার অসহ্য লাগে, তাই পড়ি না।

- আমিও পড়ি না। আমি বলি।

সে অবাক হয়ে বলে—

- আপনি পড়েন না মানে? আপনিই তো লেখেন... লেখক আবার নিজের লেখা না পড়ে কীভাবে?

- ছাপা হওয়ার পর আর পড়ি না। আমি গম্ভীর হয়ে বলি।

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, ‘বিজ্ঞান রম্য’ জাতীয় রম্য লেখালেখি বন্ধ করার সময় মনে হয় উপস্থিত... হা হা হা। তবে বিজ্ঞানচিন্তা এগিয়ে যাবে আরও বহুদূর। দেশের তরুণদের বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তুলতে বিজ্ঞানচিন্তা জরুরী। বিজ্ঞানচিন্তার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী  ঘন ঘন আসুক, এই কামনা থাকল।

 লেখক: রম্য লেখক ও কার্টুনিস্ট; সম্পাদক, উন্মাদ

আরও পড়ুন