হকিংয়ের সেরা অবদান

স্টিফেন হকিং সমকালীন সময়ের সেরা তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী। নিজের তত্ত্বের প্রতি তাঁর আস্থা ছিল অবিচল। তবে নিজের তত্ত্বের পক্ষে যেমন বাজি ধরেছেন, ধরেছেন নিজের বিরুদ্ধেও। তাঁর বাজির সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ ছিলেন আরেক তাত্ত্বিক পদার্থবিদ জন প্রেসকিল। আজ ১৪ মার্চ হকিংয়ের মৃত্যু দিবস। এই দিনে পড়ুন হকিংকে নিয়ে জন প্রেসকিলের লেখা...

স্টিফেন হকিং

স্টিফেন হকিংকে নিয়ে টাইম ম্যাগাজিনে লিখতে খুব ভাল লাগছে। টাইম বা সময় নিয়ে ভেবে আর লিখেই হকিং তাঁর বৈজ্ঞানিক কর্মজীবনের বড় একটা অংশ কাটিয়েছেন।

হকিং সময়কে বিচার করেছেন আইনস্টাইনের মহাকর্ষ বিষয়ক তত্ত্ব সার্বিক আপেক্ষিকতার নিরিখে। তাঁর অন্যতম বড় অবদান হলো সময়ের সূচনা থাকার প্রমাণ। আমাদের জানা পদার্থবিদ্যার সূত্রগুলো প্রারম্ভিক সময়ে গিয়ে অকেজো হয়ে পড়ে। বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের মুহূর্তে সুত্রগুলো অচল। কৃষ্ণগহবর সম্পর্কেও আমরা হকিং থেকে অনেক নতুন বিষয় জেনেছি। কৃষ্ণগহবরের মধ্যে মহাকর্ষ এতই শক্তিশালী যে সময় এখানে থেমে যায়। হকিং দেখান, পদার্থবিদ্যার সূত্র অতীতে ভ্রমণের অনুমতি দেয় না। তাঁর ভাষায়, ‌‘এর ফলে পৃথিবীটা ইতিহাসবিদদের জন্যে নিরাপদ হয়েছে।’ সময়কে হকিংয়ের চেয়ে ভালো কেউ বুঝতেন না।

হকিংয়ের সেরা বৈজ্ঞানিক অবদান ১৯৭৪ সালের। কৃষ্ণগহ্বর বিষয়ক সে অবদান পুরো পৃথিবীকে নাড়িয়ে দেয়। আইনস্টাইনের তত্ত্ব বলছে, কোনো কিছুই, এমনকি আলোও ব্ল্যাকহোল থেকে বের হতে পারে না। আর এ জন্যেই এটি ব্ল্যাক বা কালো। কিন্তু হকিং বুঝলেন, কৃষ্ণগহ্বর পুরোপুরি কালো নয়। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সূক্ষ্ম একটি ফলাফলের কারণে ব্ল্যাক হোল থেকে এক ধরনের বিকিরণ পাওয়া যায়। হকিংয়ের নাম থেকেই এর নাম এখন হকিং বিকিরণ।

২০০৪ সালে ডাবলিনে ৭০০ বিজ্ঞানী ও অন্তত ৭০ জন সাংবাদিকের সামনে হকিং পরাজয় স্বীকার করে নেন। ক্ষতিপূরণ হিসেবে তিনি আমাকে টোটাল বেসবল: দ্য আল্টিমেট বেসবল এনসাইক্লোপেডিয়া বইটি উপহার দেন।

হকিংয়ের এই দারুণ উপলদ্ধি এক বিতর্কেরও সূচনা ঘটায়। ৪৫ বছর পরেও সেই বিতর্ক এখনও চলমান। বিতর্কের বিষয়টি হলো, ব্ল্যাক হোলে পতিত তথ্যের (ইনফরমেশন) ভাগ্যে কী ঘটবে। আমি যদি আমার অত্যন্ত গোপনীয় দিনলিপিটা ব্ল্যাক হোলে ফেলে দেই, এটা কি মহাবিশ্ব থেকে চিরদিনের জন্যে হারিয়ে যাবে? নাকি এটা হকিং বিকিরণ আকারে পুনরায় আবির্ভূত হবে? প্রক্রিয়াটি জটিল হলেও সম্ভব। তবে সঠিক উত্তর এখনও আমাদের জানা নেই। কিন্তু হকিং একটা জায়গায় সফল। বর্তমানে মৌলিক পদার্থবিদ্যার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মহাকর্ষ ও কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে জোড়া দেওয়া। আর হকিংয়ের গবেষণার মাধ্যমেই কাজটির ভিত্তি রচিত হয়েছে।

আরও পড়ুন

শুধু বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক অবদান দিয়েই হকিং তাঁর নাম স্মরণীয় করে রাখতে পারতেন। কিন্তু বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার জন্যেও হকিং অন্যতম সেরা ও সফল অবদান রেখে গেছেন। হকিংয়ের মতে, মহাবিশ্বের একটি পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব, সেটার অনুসন্ধান, অগ্রগতি সম্পর্কে সবারই জানার সুযোগ থাকা উচিত। অন্তত নীতিগতভাবে হলেও। এই চিন্তা থেকেই তিনি লিখেছেন বিখ্যাত বই অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম। অন্য বিজ্ঞানীরাও সাধারণ মানুষের জন্য বই লেখেন। কিন্তু সেকালে নিউইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলার লিস্টে শুধু হকিংই দীর্ঘদিন ঠাঁই পান। এর পেছনে অবশ্য বইয়ের বুদ্ধিদীপ্ত নামও ভূমিকা রেখেছে। বইটি এক কোটির বেশি বিক্রি হয়। অনূদিত হয় কয়েক ডজন ভাষায়। এই অভাবনীয় সাফল্যের পর তিনি আরও বই লেখেন। এর মধ্যে শিশুদের জন্যে একটি ধারাবাহিকও আছে, যার সহলেখক তাঁরই মেয়ে।

পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং

তবে হকিং কেন পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞানী তা আমি এখনও বলিনি। তিনি বিজ্ঞানে মহান অবদান রেখেছেন তাঁর শারীরিক অক্ষমতা সত্ত্বেও। জীবনের প্রতি উচ্ছ্বাস তবু তাঁর ছিল। ছিল তীব্র রসবোধও। যদিও তাঁর অবস্থার কথা ভাবলে এগুলোকে অসম্ভব মনে হয়। মানুষ তাঁকে পছন্দ করত। এত ভক্ত পেয়ে তিনিও আনন্দ পেতেন।

হকিংয়ের সঙ্গে সময় কাটাতে মজা লাগত আমার। তাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের কথা আমার মনে আছে। তাঁকে শ্রদ্ধা দিয়ে কথা না বললে তিনি উপভোগই করতেন। কোনো বৈজ্ঞানিক আলাপের মাঝখানে আমি হয়ত তাঁকে বলতাম, ‘জনাব সবজান্তা সাহেব, আপনি কীভাবে এত নিশ্চিত হলেন?’ একটা নিশ্বাস নিয়ে হকিং জ্বলজ্বলে চোখে বলতেন, ‘বাজি ধরবে?’

আরও পড়ুন
হকিংয়ের মতে, মহাবিশ্বের একটি পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব, সেটার অনুসন্ধান, অগ্রগতি সম্পর্কে সবারই জানার সুযোগ থাকা উচিত। অন্তত নীতিগতভাবে হলেও। এই চিন্তা থেকেই তিনি লিখেছেন বিখ্যাত বই অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম।
বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার জন্যেও হকিং অন্যতম সেরা ও সফল অবদান রেখে গেছেন
অলংকরণ: আরাফাত করিম

আমাদের আরেক বন্ধু কিপ থর্ন। থর্নকে সঙ্গে নিয়ে করা এমন কিছু বাজিকে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করেছি। এগুলোর প্রতি আকর্ষণ আমাদেরকে অবাক করেছে। আমাদের সবচেয়ে বিখ্যাত বাজিতে হকিং হার মেনে নিয়েছেন। এটির বিষয় ছিল ব্ল্যাক হোল তথ্য গায়েব করে ফেলে কি না। ২০০৪ সালে ডাবলিনে ৭০০ বিজ্ঞানী ও অন্তত ৭০ জন সাংবাদিকের সামনে হকিং পরাজয় স্বীকার করে নেন। ক্ষতিপূরণ হিসেবে তিনি আমাকে টোটাল বেসবল: দ্য আল্টিমেট বেসবল এনসাইক্লোপেডিয়া বইটি উপহার দেন। আয়ারল্যান্ডে এটা কেনার ব্যবস্থা নেই। তাই হকিং তাঁর সহাকারিকে বলে রাতারাতি বইটি আনিয়ে নেন। কী করব বুঝতে না পেরে আমি বইটি মাথার ওপর তুলে ধরি। ভাবখানা ছিল এমন, এইমাত্র আমি উইম্বলডনের ফাইনাল জিতলাম। ওদিকে লক্ষ লক্ষ ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলছিল (অন্তত তেমনটাই মনে হচ্ছিল) এমন একটি ছবিই টাইমে আসে।

আমরা অনেক বাজি ধরেছিলাম। এগুলোর বিষয় নিয়ে বহু পদার্থবিদ আন্তরিকভাবে ভাবছেন। হকিংও এগুলোতে রেখে গেছেন সুদূরপ্রসারী অবদান। চিন্তার অসাধারণ গভীরতা ও অদম্য রসবোধ। হকিং সম্পর্কে এটাই আমরা সবচেয়ে বেশি মনে থাকবে।

লেখক: ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির (ক্যালটেক) তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা বিভাগের রিচার্ড ফাইনম্যান অধ্যাপক

অনুবাদক: আব্দুল্যাহ আদিল মাহমুদ, প্রভাষক, পরিসংখ্যান বিভাগ, পাবনা ক্যাডেট কলেজ

*লেখাটি ২০২০ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত

আরও পড়ুন