আমি বিজ্ঞানকে খুব ভালোবাসি। কারণ, বিজ্ঞান আমার খুব মজা লাগে। কেন মজা লাগে? সেটাই বলছি।
আমি ধানের লবণসহিষ্ণুতা নিয়ে কাজ করি। আমরা যে উচ্চফলনশীল চাল খাই, উপকূলীয় এলাকায় তা হয় না। কারণ, ওই উপকূলীয় এলাকার মাটিতে লবণের প্রভাব; বিশেষ করে বোরো মৌসুমে। আবার ওই অঞ্চলে কিছু উপজাতীয় ধান রয়েছে। সেগুলো অল্প পরিসরে ধান দেয়। কিন্তু এই জাতের উৎপাদন আমাদের জনবহুল দেশের খাদ্যচাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। তাহলে উপায় কী? আমি এমন একটা ধানের জাত উদ্ভাবন করতে চেয়েছি, যেটা একই সঙ্গে উচ্চফলনশীল ও লবণসহিষ্ণু। কিন্তু এটাই আমার সমস্যা। কিছুটা সফলতা এসেছে। আমার কিছু ধান এখন ট্রায়ালে রয়েছে। আমার কিছু জেনেটিক মডিফিকেশনের ধানও রয়েছে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি ট্রায়াল দেবে।
যা–ই হোক, শুধু লবণ নিয়ে কাজ করাই তো বিজ্ঞান নয়, আরও অনেক কিছু আছে। কী ধরনের সমস্যা নিয়ে আমরা কাজ করতে পারি? বিজ্ঞানীরা কোনো একটা সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করেন গবেষণার মাধ্যমে। যে সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে অনেকের উপকার হবে। অনেকের উপকার করতে তো ভালো লাগে। সেই মজাটাও রয়েছে বিজ্ঞানে। প্রশ্নের মাধ্যমে উত্তর খুঁজে পেলেও কিন্তু ভালো লাগে। যেমন সমস্যা কী কী হতে পারে? ধরা যাক, ঢাকার দূষিত বাতাসের সমস্যা সমাধান করতে হবে। এটাকে কীভাবে সমাধান করা যায়? নদী–নালার দূষিত পানি, ঢাকা শহরের ভূগর্ভস্থ পানির স্বল্পতা, এমনকি বলধা গার্ডেনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করাও কিন্তু একটা সমস্যা। চিন্তা করি, কিছু গবেষণা দিয়ে এগুলোর উত্তর বের করি। এভাবে সমস্যার সমাধানও হচ্ছে, আবার অনেকের উপকারও হচ্ছে। সমস্যার সমাধান করতে আবার মজাও লাগে।
আরেকটা গবেষণার কথা মনে পড়ছে। সম্প্রতি সেটা পত্রিকায় এসেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক ডেঙ্গু মশা মারার প্রাকৃতিক উপাদান খুঁজে পেয়েছেন। এটা গুরুত্বপূর্ণ কেন? কারণ, মশা মারার যে ওষুধগুলো আমরা ব্যবহার করি, সেগুলোয় মশা মরেও না, আবার এগুলো খুব বিষাক্ত। পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর।
এ রকম আরও কিছু উদাহরণ দেওয়া যায়। মাকসুদুল আলম সায়েন্স ল্যাবরেটরি আর আহমদ শামসুল ইসলাম স্কুল অব লাইফ। ওনারা সুযোগ করে দিয়েছেন পঞ্চম থেকে একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু গবেষণা করার। প্রজেক্ট করারও সুযোগ দিয়েছেন। এই প্রজেক্টগুলোর আওতায় শিক্ষার্থীরা অনেকগুলো প্রজেক্ট করেছে। যেমন বিষাক্ত ফরমালিন বাদ দিয়ে লবণ আর আলট্রাভায়োলেট লাইট দিয়ে ফল আর সবজি সংরক্ষণ করা যায় কি না। ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণির একটি মেয়ে আমার ল্যাবরেটরিতে এসে কাজটি করেছে।
আবার ২০১৬ সালে একটি মেয়ে গুগল সায়েন্স প্রাইজ পেয়েছিল। সে সাউথ আফ্রিকান স্কুলের ছাত্রী। ওদের ওখানকার খরার সমস্যা প্রবল। বেশ কয়েক বছর খরা হলে মাটিতে পানি থাকে না। আর পানি যদি দেওয়াও হয়, সেটা সঙ্গে সঙ্গে বাষ্প হয়ে উবে যায়। সে খুঁজছিল এমন একটা পদার্থ, যেটা পানিকে ধরে রাখতে পারে। সে গবেষণা করে ফেলে দেওয়া মাল্টার খোসা, অ্যাভোকাডোর খোসা ও পেকটিন দিয়ে এমন একটি যৌগ তৈরি করে, যেটা নিজের ওজনের প্রায় এক হাজার গুণ বেশি পানি ধরে রাখতে পারে। এই অণু বায়োডিগ্রেডেবল। পরিবেশ ও জলবায়ুর কোনো ক্ষতি করবে না। এই গবেষণার জন্য সে ৫০ হাজার ডলারের প্রাইজ পেল। এ ধরনের বায়োম্যাটেরিয়াল নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেল এই গুগল প্রাইজের মাধ্যমে।
এখনকার শিক্ষার্থীরা সবাই মেধাবী। যে কেউ একটু চিন্তা বা ফোকাস করলেই অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারবে। বাংলাদেশে সমস্যার অভাব নেই। আমি আশা করি, এই শিক্ষার্থীরা জীবনে বিজ্ঞানের সাহায্যে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করবে।
তামিলনাডুর স্কুলের ছাত্র আকাশের কথা মনে আছে? হঠাৎ তার দাদু বা নানা মারা যান। তাঁর ডায়াবেটিস ছিল, ব্লাডপ্রেশার ছিল। এ ছাড়া আর কোনো রোগ ছিল না। তবু হার্ট অ্যাটাক হয়, আর হাসপাতালে নিতে নিতে তিনি মারা যান। আকাশ তার দাদুকে খুব ভালোবাসত। তাই তার মনে প্রশ্ন জাগে, হার্ট অ্যাটাক হলে কেন আগে থেকে কোনো লক্ষণ দেখা যায় না? একে ‘সাইলেন্ট হার্ট অ্যাটাক’ বলে। আকাশ লাইব্রেরিতে গিয়ে গবেষণা করে, সাইলেন্ট হার্ট অ্যাটাক হলে শরীরে কী পরিবর্তন হয়। সে জানতে পারে, হার্ট অ্যাটাকের ৬-৭ ঘণ্টা বা ১০-১২ ঘণ্টা আগে হার্ট একটা প্রোটিন তৈরি করে। সেটা পজিটিভলি চার্জড প্রোটিন। এটাকে বলে FABP3। আকাশ এমন একটা যন্ত্র বানায়, যেটা নেগেটিভ চার্জ তৈরি করে। শরীরে পজিটিভ প্রোটিনের চার্জ বেড়ে গেলে যন্ত্রের সিগন্যাল বেড়ে যায়, আর পজিটিভ-নেগেটিভ চার্জ একসঙ্গে হলে একটা অ্যালার্ম বাজে। অ্যালার্ম বাজলে রোগীকে হাসপাতালে নিতে হয়। হার্ট অ্যাটাকের ৬ ঘণ্টা আগেও এই যন্ত্র কাজ করতে পারে। আর আগেই হাসপাতালে গেলে রোগীকে বাঁচানো সম্ভব। সে যখন এটা তৈরি করে, তখন সে ক্লাস সিক্স বা সেভেনে পড়ত।
এ রকম আরও অনেক সমস্যা আছে, যেগুলো সমাধান করা দরকার। এখনকার শিক্ষার্থীরা সবাই মেধাবী। যে কেউ একটু চিন্তা বা ফোকাস করলেই অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারবে। বাংলাদেশে সমস্যার অভাব নেই। আমি আশা করি, এই শিক্ষার্থীরা জীবনে বিজ্ঞানের সাহায্যে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করবে। বিজ্ঞান অনেকটা খেলার মতো, যেখানে সমস্যা সমাধানের জন্য গবেষণা করতে হয়। আমি বিজ্ঞানচর্চা করে যেমন আনন্দ পাই, শিক্ষার্থীরাও তেমন আনন্দ পাবে। সবাইকে ধন্যবাদ।