বৈশ্বিক স্বাস্থ্য গবেষণায় রোল মডেল

সতীর্থ বিজ্ঞানী, বিশেষ করে নারী বিজ্ঞানীদের জন্য তিনি সব সময় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। শিশুদের বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে তাঁর চেষ্টা নিরন্তর। তিনি সেঁজুতি সাহা। চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশের অণুজীববিজ্ঞানী। দেশে টাইফয়েড, মেনিনজাইটিস ও অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স নিয়ে মৌলিক গবেষণা করেছেন। বাবা বিখ্যাত অণুজীববিজ্ঞানী সমীর সাহাকে নিয়ে দেশে প্রথমবারের মতো জিন সিকোয়েন্স করেছেন করোনাভাইরাসের। পেয়েছেন বিল ও মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের স্বীকৃতি।

সম্প্রতি বিশ্বের খ্যাতনামা পিয়ার-রিভিউ জার্নাল দ্য ল্যানসেট গুরুত্বপূর্ণ ১০ বিজ্ঞানীর পরিচয় নিয়ে ফিচার করেছে। সেখানে সেঁজুতি সাহা ও তাঁর পরিচালিত শিশু চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ (সিএইচআরএফ) নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে নিবন্ধ—সেঁজুতি সাহা: অ্যাডভোকেট ফর ইকুইটি ইন গ্লোবাল হেলথ রিসার্চ। স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞানবিষয়ক ব্রিটিশ লেখক উদানী সমারাসেকেরার লেখা সেই নিবন্ধ বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বাংলায় ভাষান্তর করেছেন আব্দুল্লাহ আল মাকসুদ

বিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা, ফাইল ছবিখালেদ সরকার

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (সিএইচআরএফ) পরিচালক অণুজীববিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা। বৈশ্বিক স্বাস্থ্য গবেষণার এক সমার্থক নাম তিনি। ২০১৮ সালে অনুমতি পান সিএইচআরএফের সিকোয়েন্সিং ফ্যাসিলিটি স্থাপনের। প্রথম কোনো বেসরকারি সংস্থা হিসেবে সিকোয়েন্সিং মেশিনের ব্যবস্থা করেন। সে সময় তিনি বলেন, ‘বিশ্বকে আমি দেখাতে চেয়েছিলাম, পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় জিন সিকোয়েন্স করা সম্ভব। বাংলাদেশে আমরা আমাদের ছোট্ট মেশিনটি ব্যবহার করে তা করে দেখিয়েছি।’

বাংলাদেশের শিশুরা সচরাচর যেসব ভাইরাসে আক্রান্ত হয়, সেঁজুতি সাহা ও তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত জিনোমিকস দল সে ধরনের ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করে। এর মধ্যে রয়েছে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া। ২০২০ সালে দেশে প্রথমবারের মতো সার্স-কোভ-২ অর্থাৎ করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স বের করে তাঁর দল। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যে প্রযুক্তির প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি, আমরা সেখানে বিনিয়োগ করেছি।’

ডায়াগনস্টিক ও সিকোয়েন্সিং সক্ষমতা থাকায় সেঁজুতি সাহা ও তাঁর সহকর্মীরা শিশু ও নবজাতকের ওপর সার্স-কোভ-২–এর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন। এ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির ওপর টিকা কেমন প্রভাব ফেলে, তা নিয়ে নতুন করে গবেষণা করেন তাঁরা। বাংলাদেশে তাঁর গবেষণাটি ব্যাপক সাড়া ফেলে। তিনি বলেন, ‘দেশের অভিভাবকেরা তাঁর কাছে চিঠিতে লেখেন, “আমরা চাই আমাদের সন্তানেরা বিজ্ঞানী হোক। আগে কখনো ভাবিনি এটা পেশা হতে পারে। কারণ, আমরা এর আগে বিজ্ঞানী দেখিনি। বিশেষ করে নারী বিজ্ঞানী দেখিনি।”’

বিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা এবং তাঁর দল

ফলে ২০২২ সালে সেঁজুতি সাহা ও তাঁর সহকর্মীরা ‘বিল্ডিং সায়েন্টিস্ট ফর বাংলাদেশ’ নামের একটি প্রোগ্রাম চালু করেন সিএইচআরএফে। এখানে হাইস্কুল–পড়ুয়া শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এবং নতুন গ্র্যাজুয়েট হওয়া শিক্ষার্থীরা বৈজ্ঞানিক গবেষণা করার সুযোগ পাবেন। জিনোমিকস, মাইক্রোবায়োলজি ও ডায়াগনস্টিকের মতো শাখায় হাতে-কলমে বিজ্ঞান গবেষণা করা যাবে এখানে।

সেঁজুতির সহযোগী কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির মহামারি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান মধুকর পাই বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য খাতে নারী বিজ্ঞানীদের এক অসাধারণ রোল মডেল সেঁজুতি। অসাম্য ও অন্যায্যতার বিষয়ে তিনি উচ্চকণ্ঠ। কোভিড-১৯ অতিমারি চলাকালে এর টিকা নিয়ে জাতিবৈষম্য এবং নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর মানুষের জন্য এর ক্ষতিকর প্রভাব এড়াতে প্রচণ্ড পরিশ্রম করেন তিনি।

সেঁজুতি সাহা বাংলাদেশের ঢাকায় বেড়ে ওঠেন। ছোট থেকে বিজ্ঞান, বিশেষ করে মাইক্রোবায়োলজি নিয়ে তাঁর প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। তাঁর মা–বাবা দুজনই ছিলেন মাইক্রোবায়োলজিস্ট। ২০০৭ সালে তাঁর বাবা অধ্যাপক সমির কে সাহা সিএইচআরএফ প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৯ সালে কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ‘মলিকিউলার জেনেটিকস উইথ স্পেসিফিক ফোকাস অন অ্যান্টিমাইক্রোবাল রেজিস্ট্যান্স’ বিষয়ের ওপর পিএইচডি করেন।

পিএইচডির সময় সেঁজুতির থাইরয়েড ক্যানসার ধরা পড়ে। সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। এ অভিজ্ঞতা তাঁকে বিশ্ব স্বাস্থ্যসেবার নানা সমস্যা নিয়ে ভাবিয়ে তোলে।

নিজের সেই সময়ের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে সেঁজুতি সাহা বলেন, ‘আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। আমি সুস্থ, কারণ আমি তখন কানাডায় ছিলাম। যেখানে চমৎকার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা আছে।’

এ উপলব্ধি ও নিজের সমাজের জন্য সমাজের সঙ্গে মিলে কাজ করার ইচ্ছা থেকে পিএইচডির পর তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। ফিরে এসে সিএইচআরএফে বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি সিএইচআরএফে যোগ দিয়ে খুলে দেন আরএনএ মেটাজিনোমিক সিকোয়েন্সিংয়ের দুয়ার।

বাংলাদেশে পেডিয়াট্রিক মেনিনজাইটিসের তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে সেঁজুতি সাহা দেখতে পান, ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে অসুখের জন্য দায়ী রোগজীবাণু সম্পর্কে কিছু জানা যায় না।

সেঁজুতি সাহা ধারণা করেছিলেন, আরএনএ মেটাজিনোমিকস সমস্যাটি সমাধান করতে পারে। তবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এসব ক্ষেত্রে গবেষণার জন্য দেশে প্রযুক্তি ও দক্ষতার অভাব আছে। ২০১৮ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মলিকুলার বায়োলজিস্ট জোসেফ ডেরিসি ও অলাভজনক সংস্থা সিজি বায়োহাবের সঙ্গে একত্রে কাজ করেন। সেখানে তিনি মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত বাংলাদেশি শিশুদের সেরিব্রাল স্পাইনাল ফ্লুইডের নমুনাগুলো সিকোয়েন্স করার জন্য সহযোগিতা করেছিলেন। প্রকল্পটি বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। বিশ্লেষণের পর জানা যায়, এ রোগের সঙ্গে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাবের সম্পর্ক আছে। এ কাজের পর সিএইচআরএফ নিজস্ব সিকোয়েন্স সক্ষমতা তৈরির জন্য গেটস ফাউন্ডেশন থেকে অর্থ সাহায্য পেয়েছিল।

বিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা

বিশ্ব স্বাস্থ্যের একটি প্রধান সমস্যা হচ্ছে, এর কর্মপরিকল্পনা সব সময় ধনী দেশগুলো ঠিক করে। তারা এ অঞ্চলের জনসাধারণের চিন্তা পুরোপুরি বুঝতে পারে না। এভাবে তিনি আরেকটি সমস্যা তুলে ধরেন। সেঁজুতি সাহা বলেন, ‘সমস্যাটি আমাদের। আমি মনে করি, আমরা এখনো বিশ্বাস করি, উত্তর গোলার্ধে যারা বিজ্ঞানচর্চা করছে, তারা আমাদের চেয়ে ভালো কাজ করছে। আগে উপনিবেশ ছিল, এ রকম অনেক দেশে এ সমস্যা আছে। আমরা নিজেদের সক্ষমতা বুঝতে পারছি না...আর এ সমস্যা সমাধান করা অনেক কঠিন।’ সেঁজুতি মনে করেন, শিক্ষা এবং এ রকম নানা সমস্যা নিয়ে আরও আলোচনা করা প্রয়োজন। এ আলোচনা এই পরিস্থিতি পরিবর্তনে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের ইতিহাস নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন। কথা বলা প্রয়োজন আমাদের সঙ্গে যা ঘটে গেছে, সেসব নিয়ে। এই যে সমাজ ও রাষ্ট্রের অংশ হয়ে যাওয়া বর্ণবাদ, আমরা যাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য বলি—এ ক্ষেত্রে এর অস্তিত্ব রয়ে গেছে আজও। এ নিয়ে আমাদের মুখ খোলা প্রয়োজন, কথা বলা প্রয়োজন।’

স্বাস্থ্য গবেষণায় বৈশ্বিক সাম্য অর্জনের জন্য নীতিনির্ধারকদের বসে আলোচনা করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, এই আলোচনায় তাঁদের থাকতে হবে, যাঁরা দক্ষিণ গোলার্ধের সমস্যাগুলো বুঝবেন। আর দক্ষিণ গোলার্ধের বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা মূলত এ সমস্যাগুলো বোঝেন। তাই এসব সমস্যা সমাধানে এ অঞ্চলের আরও বিজ্ঞানী, গবেষক, নীতিনির্ধারক ও রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। তাঁদের আরও সক্রিয়ভাবে সঙ্গে রাখতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগও স্বল্পমেয়াদি প্রকল্প থেকে টেকসই স্থানীয় বিনিয়োগে পরিবর্তন করতে হবে।

সেঁজুতি সাহা বলেন, ‘কেবল প্রকল্পগুলোকে সহযোগিতা করার বদলে আমাদের স্থানীয়ভাবে দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিনিয়োগকে সহযোগিতা করতে হবে। স্থানীয় স্টার্টআপগুলোতে বিনিয়োগ করতে হবে, তাদের সহযোগিতা করতে হবে। স্থানীয় আইডিয়াগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। তাহলে স্থানীয় উদ্যোগ বা স্টার্টআপগুলো আরেকটু স্বাধীনতা পাবে—আমরা আরও স্বাধীনতা পাব। তখন নির্দিষ্ট প্রকল্পের বদলে আমরা আমাদের প্রয়োজনমতো বিভিন্ন প্রকল্পে এসব অর্থ ব্যবহার করে নিজেদের প্রয়োজনীয় সমস্যা সমাধান করতে পারব।’

অনুবাদক: শিক্ষার্থী, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা