ইউক্লিডের ‘এলিমেন্টস’: মানবজাতির অন্তহীন প্রেরণা

দুই হাজার বছর ধরে একটা বই টিকে আছে জ্যামিতি শেখার আকর গ্রন্থ হিসেবে। দুই সহস্রাব্দে আমূলে বদলে গেছে সভ্যতা-পৃথিবী, বদলে গেছে বিজ্ঞানচর্চার ধরন-ধারণ, বদলায়নি শুধু ইউক্লিডের জ্যামিতি। এলিমেন্টস ছাড়া জ্যামিতি শেখার সহজ কোনো পদ্ধতি আজও নেই। কী এমন রহস্য লুকিয়ে আছে এর মধ্যে?

২২ শতাব্দী আগে রচিত ইউক্লিডের সংকলন গ্রন্থ এলিমেন্টস। দুই হাজার বছর ধরে পঠিত হয়ে আসছে। পঠিত হবে অনন্তকাল। ইউক্লিড জ্যামিতিকে এক বিশাল অবরোহী পদ্ধতিতে পরিণত করেছিলেন। মানুষের সূত্রবদ্ধ চিন্তার সেই শুরু। এই গ্রন্থ অবিরত উত্সাহ জুগিয়েছে প্রতিভাদের, উত্সাহ জোগাবে অনাদিকাল।

কেউ যদি জিজ্ঞেস করে হোমার ব্যক্তিটি কে? তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আর একজন উত্তর দেবে, কেন ইলিয়াড, ওডেসির লেখক! আবার যদি জিজ্ঞেস করা হয় ইলিয়াড, ওডেসি কী, তখন উত্তর হবে কেন হোমারের মহাকাব্য। তেমনি কেউ যদি প্রশ্ন করে, ইউক্লিড কে, তাহলে উত্তর আসবে, এলিমেন্টস–এর লেখক। আর এলিমেন্টস কী—ইউক্লিডের জ্যামিতি গ্রন্থ। আসলে ইউক্লিড আর এলিমেন্টস একে অপরের সমার্থক শব্দ, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ইউক্লিড প্লেটোর ছাত্রদের চেয়ে বয়সে ছোট, কিন্তু আর্কিমিডিসের চেয়ে বড় ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তার ফলে ধরে নেওয়া যায়, খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ বছরের সময় তাঁর কাজগুলোর মাধ্যমে তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ধারণা করা হয়, ইউক্লিড সম্ভবত এথেন্সে প্লেটোর ছাত্রদের কাছে গণিতের প্রথম পাঠ নেন। এ রকম ধারণা করার কারণ হলো, তিনি যেসব গণিতজ্ঞ বা জ্যামিতিশাস্ত্রবিদের ওপর নির্ভর করতেন, তাঁরা সবাই ছিলেন প্লেটোর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের।

তেমনি কেউ যদি প্রশ্ন করে, ইউক্লিড কে, তাহলে উত্তর আসবে, এলিমেন্টস–এর লেখক। আর এলিমেন্টস কী—ইউক্লিডের জ্যামিতি গ্রন্থ। আসলে ইউক্লিড আর এলিমেন্টস একে অপরের সমার্থক শব্দ, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না

পঞ্চম শতকের নব্য প্লেটোনিক ধারার দার্শনিক প্রোক্লাস দাবি করেছিলেন যে ইউক্লিড প্লেটোর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছিলেন এবং দর্শনের অনুসারী ছিলেন। প্লেটোর খেয়ালি কল্পনা সুষম বহুতলীয় তত্ত্বকে উচ্চপর্যায়ের তাত্পর্যে উন্নীত করেছিল। এই কারণে প্লেটোনিক অবয়বগুলো (platonic bodies) সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখাটা অনেকের মতে ছিল জ্যামিতি–সম্পর্কিত জ্ঞানের চূড়ান্ত রূপ। সে জন্য ইউক্লিডের এলিমেন্টস–এর শেষ পর্যায় ত্রয়োদশতম গ্রন্থে সমঘন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এটাই ছিল প্রোক্লাসের মতামতের ভিত্তি। কিন্তু মূলকথা হচ্ছে, ইউক্লিড প্লেটোবাদী হতে পারতেন, আবার এড়িয়ে যেতে পারতেন। কেননা, সুষম বহুতলীয় তত্ত্ব ত্রিমাত্রিক জ্যামিতির স্বাভাবিক পরিণতি। এমন অবস্থায় এলিমেন্টস–এর শেষ পর্যায়ে সমঘন নিয়ে আলোচনা না থেকে পারেনি। এই সমঘন জ্যামিতির ওপর পরবর্তী সময়ে আরও দুটি খণ্ডকে এলিমেন্টস–এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল।

জ্যামিতি শেখার কোনো রাজকীয় পথ নেই

প্লেটোর মতো তিনিও স্কেল ও কম্পাসকে জ্যামিতিচর্চার একমাত্র বৈধ যন্ত্রপাতি বলেছেন। তিনি প্রথম টলেমির সময়ে আলেকজান্দ্রিয়ায় শিক্ষকতা করতেন এবং একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের দিকে জনৈক পাপ্পাসের লেখা থেকে ইউক্লিডের আলেকজান্দ্রিয়ায় অবস্থানের পক্ষে সমর্থন মেলে। তিনি আরও লিখেছেন যে অ্যাপোলোনিয়াস আলেকজান্দ্রিয়ায় ইউক্লিডের ছাত্রদের সঙ্গে দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন এবং এর ফলেই তাঁর অমন বৈজ্ঞানিক চিন্তাচেতনার বিকাশ ঘটে। প্রোক্লাস দাবি করেন যে রাজা প্রথম টলেমিই ইউক্লিডকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে এলিমেন্টস ছাড়া জ্যামিতি শেখার কোনো সহজ পথ আছে কি না। উত্তরে ইউক্লিড বলেছিলেন, ‘একটি দুরূহ গাণিতিক সমস্যাকে নিয়ে সংগ্রাম করা ছাড়া জ্যামিতি শেখার কোনো রাজকীয় পথ নেই।’ তাঁকে ঘিরে অন্য আরেকটি কাহিনি আছে, যা বর্ণনা করেছেন স্পেরিয়স। তা হলো, ইউক্লিডের কাছে শিক্ষারত জনৈক ছাত্র জ্যামিতির ওপর প্রথম পাঠ নেওয়ার পর জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এইগুলো শিখে আমার কী লাভ হবে?’ এ কথায় ইউক্লিড তাঁর দাসকে ডাকলেন এবং বললেন, ‘একে একটি অবল (মুদ্রা) দান করো, কারণ সে যা শেখে, তার দ্বারা সব সময় লাভ করতে চায়।’ আজকালও এ রকম অসংখ্য মানুষ আছে (ক্রমে বাড়ছে), যারা জ্ঞান অর্জনকে হাতেনাতে লাভজনক হিসেবে দেখতে চায়।

পাপ্পাসের লেখা থেকে এ কথাও জানা যায় যে তাঁর নৈতিক চরিত্র খুবই উন্নত ছিল এবং গণিতের অগ্রগতিতে যাঁরা অবদান রেখেছেন, তা যতই ছোট হোক না কেন, তাঁদের সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত উঁচু ধারণা পোষণ করতেন।

ইউক্লিডের এলিমেন্টস

ইউক্লিডের কর্মকাণ্ড ও গ্রন্থখণ্ডগুলো

ইউক্লিডের সবচেয়ে প্রধান গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে এলিমেন্টস–এর ১৩টি খণ্ড। এই খণ্ডগুলো প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তা ক্লাসিকের মর্যাদা লাভ করে এবং এর গুরুত্ব অনুধাবন করা সম্ভব হয়। আর্কিমিডিসের সময় থেকে এগুলো মূল পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তাঁর পূর্বসূরিদের সবার অবদানই তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। প্রোক্লাসের ভাষায়, ইউডোক্সাসের অনেক উপপাদ্য সংগ্রহ করেছিলেন, থিয়েটাসের অনেক উপপাদ্যের তিনি সম্পূর্ণতা দান করেছেন এবং তাঁর পূর্বসূরিরা যেগুলো ঠিকমতো প্রমাণ করে যেতে পারেননি, সেগুলোকে তিনি দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছেন। ইউক্লিডের অন্যান্য কাজের মধ্যে আছে উপাত্তগুলো (Data), যেগুলো ব্যবহৃত হয় জ্যামিতিক বিশ্লেষণে; আছে on Division (of figure), আলোকবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞানে ব্যবহৃত গোলকের জ্যামিতি এবং সংগীতের ওপর লেখা এলিমেন্টস অব মিউজিক বইটির কোনো সন্ধান পাওয়া যায় না। সম্ভবত এলিমেন্টস অব মিউজিক থেকে গৃহীত প্রবন্ধ ‘Sectio Canonis’–এ সংগীত সম্পর্কে পিথাগোরীয় তত্ত্বের ব্যাখ্যা রয়েছে। একটি ছাড়া জ্যামিতি–সংক্রান্ত হারিয়ে যাওয়া সব কাজ উঁচু পর্যায়ের জ্যামিতির (Higher geometry) অন্তর্ভুক্ত।

‘এলিমেন্টস’ যে শেখেনি, সে যেন এই দরজা দিয়ে না ঢোকে

যেহেতু পরবর্তীকালে গ্রিকরা ইউক্লিডের জীবন সম্পর্কে কিছুই জানত না, ফলে মধ্যযুগীয় পণ্ডিতেরা তথ্যের অভাবে তাঁদের মূল জায়গা থেকে সরে ধারাবাহিকতা হারিয়ে ফেলেছিলেন। তাঁরা ইউক্লিডকে মেগারার ইউক্লিড মনে করেছিলেন। কারণ, তাঁরা সক্রেটিসের শিষ্য দার্শনিক ইউক্লিডিসের কথাই চিন্তা করেছিলেন। যিনি প্লেটোর সমসাময়িক ছিলেন এবং মেগারার বিদ্যায়তনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। আরবরা ইউক্লিডের নামটা দেখেছিলেন ucli(key) এবং dis(measure)-এর মিশ্রণ হিসেবে যা অর্থ প্রকাশ করেছিল key of geometry বলে। তাঁরা দাবি করেছিলেন যে গ্রিক দার্শনিকেরা তাঁদের স্কুলের প্রবেশদ্বারে বিজ্ঞপ্তি টানিয়ে রাখতেন, ‘ইউক্লিডের এলিমেন্টস যে শেখেনি, সে যেন আমাদের স্কুলে প্রবেশ না করে।’ এভাবে প্লেটোর একাডেমি থেকে সব বিদ্যায়তনের দরজায় এই কথাগুলো লেখা হতে লাগল এবং জ্যামিতি বা geometry–এর সমার্থক শব্দ হিসেবে Euclid নামটি দাঁড়িয়ে গেল।

শিল্পীর কল্পনায় ইউক্লিড

যারা স্কুলের পাঠ শেষ করেছে, তারা এই এলিমেন্টস গ্রন্থের কিছু উপপাদ্যের সঙ্গে পরিচিত। এ গ্রন্থের কথা মনে এলে মানবজাতির ইতিহাসে বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কথা চলে আসে। তাঁরা হলেন আইনস্টাইন, নিউটন, কেপলার ও গ্যালিলিও ও কোপার্নিকাস, যাঁদের প্রত্যেকের জীবনে এলিমেন্টস এক বিশেষ জায়গা অধিকার করে আছে। এই গ্রন্থ সম্পর্কে আপেক্ষিক তত্ত্বের জনক আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, যৌবনে যিনি এই বই পড়ে অনুপ্রাণিত হননি, তিনি তত্ত্বচর্চার জন্য জন্মগ্রহণ করেননি। ইউক্লিডের এলিমেন্টস গ্রন্থটি নিউটনকে প্রচণ্ড অনুপ্রাণিত করেছিল। গ্রন্থটি পড়ার দুই বছরের মাথায় ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেন, যা গাণিতিক নিয়মে প্রকৃতি বিষয়ে অনুসন্ধানের নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। আব্রাহাম লিংকন রাষ্ট্র পরিচালনায় দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ৪০ বছর বয়সে জ্যামিতিচর্চা শুরু করেছিলেন। কেপলার ইউক্লিডের জ্যামিতির ভেতরে নিখুঁত প্রতিবিম্ব (image of perfection) এবং মহাজাগতিক সৌন্দর্য দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন পরবর্তী সময়ে: ‘সৃষ্টির আগেই জ্যামিতির অস্তিত্ব ছিল। এটা ঈশ্বরের মনের সঙ্গে সমভাবে অনন্তকাল স্থায়ী। আসলে জ্যামিতি নিজেই হলো ঈশ্বর।’

‘এলিমেন্টস’ হলো হাজার হাজার বছরের জ্ঞানচর্চার ফসল

ইউক্লিড ও তাঁর প্রধান সৃষ্টি এলিমেন্টস–এর ১৩টি খণ্ড সম্পর্কে বিচার করার সময় আমাদের মিসরীয় ও ব্যাবিলনীয় হাজার বছরের জ্ঞানচর্চাকে বিবেচনা করলে বলা যায় যে ইউক্লিডের এলিমেন্টস হাজার বছরের সঞ্চিত ধ্যানধারণার চরম প্রকাশ। ইউক্লিডের আগেও বহু প্রতিজ্ঞা আবিষ্কৃত হয়েছে, অনেক প্রতিজ্ঞার সমাধান হয়েছে। বহু প্রতিজ্ঞা প্রতিষ্ঠাও হয়েছিল। তা ছাড়া তার আগেও কিওসের হিপোক্রেটিস কর্তৃক, লিয়ন কর্তৃক এবং সর্বশেষে ম্যাগনেশিয়ার থিওডিয়াস কর্তৃক এলিমেন্টস সংকলিত হয়েছিল। থিওডিয়াসের গ্রন্থ একাডেমিতে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল। এটি সম্পর্কে ইউক্লিড সম্ভবত ভালো খোঁজখবরই রাখতেন। সেই হিসাবে ইউক্লিডকে জ্যামিতির জনক বলা যায় না বা বলা ঠিকও নয়।

তারপরও হাজার বছরের জয়ী প্রতিভা ইউক্লিডের অসাধারণত্ব বিন্দুমাত্র খাটো হয় না। কারণ, এলিমেন্টস–এ আগের ব্যক্তিদের আবিষ্কারগুলো ছাড়া বাকি প্রতিজ্ঞাগুলো নিজে আবিষ্কার করেন বলে আমরা ধরে নিতে পারি। এগুলোর সংখ্যাও কম নয়। অন্য জ্যামিতিবিদেরা তাঁর আগে যা সমাধান করেছিলেন, সেগুলোকে আরও সুন্দর ও বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। যদিও অ্যারিস্টটল স্বীকার্য বা স্বতঃসিদ্ধের অবশ্যম্ভাবিতা ও এগুলোকে ন্যূনতম পর্যায়ে আনার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন। কিন্তু তারপরও ইউক্লিড স্বতঃসিদ্ধগুলোকে নিজে বাছাই করেছিলেন এবং এগুলো ন্যূনতম পর্যায় নামিয়ে আনেন। প্রতিজ্ঞাগুলোকে তিনি ধারাবাহিকভাবে সাজান, যেখানে যেখানে ফাঁক ছিল, সেগুলো পূরণ করেন, যেখানে প্রমাণ দুর্বল মনে হয়েছিল, সেখানে প্রয়োজনীয় সংশোধন করে দেন। এভাবে তিনি এমন এক স্তম্ভের (বিশেষ করে, প্রথম গ্রন্থের বেলায়) সৃষ্টি করেছিলেন, যার প্রতিসাম্য অন্তর্নিহীত সৌন্দর্য ও স্পষ্টতা স্তম্ভিত হওয়ার মতো। বিন্দু, রেখাসংক্রান্ত মৌলিক ধারণাসহ স্বল্পসংখ্যক সংজ্ঞা ও স্বতঃসিদ্ধের ভিত্তিতে জ্যামিতিকে একটি বিশাল অবরোহী পদ্ধতিতে পরিণত করেন। যে কাজ আয়োনীয় বিজ্ঞানী থেলিসের মাধ্যমে প্রথম শুরু হয়েছিল এবং পিথাগোরাসের হাতে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল। এরই মাধ্যমে সূত্রবদ্ধ চিন্তার শুরু হয়েছিল। লাখ লাখ বছরের জ্ঞানের সংগ্রামের ইতিহাসে ‘জ্যামিতি হলো মানুষের চিন্তার দ্বিতীয় পর্যায়’।

যদিও অ্যারিস্টটল স্বীকার্য বা স্বতঃসিদ্ধের অবশ্যম্ভাবিতা ও এগুলোকে ন্যূনতম পর্যায়ে আনার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন। কিন্তু তারপরও ইউক্লিড স্বতঃসিদ্ধগুলোকে নিজে বাছাই করেছিলেন এবং এগুলো ন্যূনতম পর্যায় নামিয়ে আনেন

ভেনিসবাসী বার্টোলোমিও জাম্বাটিই প্রথম ১৪৯৩ সালে বইটি গ্রিক থেকে লাতিন ভাষায় অনুবাদ করেন এবং তা জোয়ানেস ট্যাকুইনাস কর্তৃক মুদ্রিত হয় (ভেনিস, ১৫০৫)। পরবর্তী সংস্করণটিও হয় লাতিনে এবং তা উত্সর্গ করা হয় ইংরেজ গণিতবিদ ও ব্রহ্মবিদ্যাবিদ কাথবার্ট টানস্টলকে। বইটি জোহান হেরেনবাগেন কর্তৃক মুদ্রিত হয় (ব্যাসেল, ১৫৩৩)। প্রথম ইংরেজিতে অনুবাদ করেন কেমব্রিজের সেন্ট জনস কলেজের স্যার হেনরি বিলিংসলি। তিনি কিছুদিন লন্ডনের লর্ড মেয়রও ছিলেন। বাংলায় এর ৫৩০ বছর পর এলিমেন্টস–এর নানা রকম যৌক্তিক ত্রুটির বিশ্লেষণসহ প্রথম খণ্ডের অনুবাদ নিয়ে একটি রচনা বের হয় বাংলা একাডেমির বিজ্ঞান পত্রিকায় (অক্টোবর ১৯৯৯-মার্চ ২০০০ সংখ্যায়)। আর ২০০৬–এর অক্টোবরে একটি বিশ্লেষণসহ চার খণ্ডের অনুবাদ বের হয় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে।

ইতিহাসে সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী বইগুলোর মধ্যে এলিমেন্টস অন্যতম। সভ্যতার ইতিহাসে এলিমেন্টস–এর প্রত্যক্ষ–অপ্রত্যক্ষ অবদান অসামান্য। জ্ঞানের ইতিহাসে এই গ্রন্থ কোপার্নিকাস, কেপলার, গ্যালিলিও, নিউটন, আইনস্টাইনের মতো অসাধারণ সব প্রতিভাবানকে প্রেরণা জুগিয়েছে নতুন কিছু সৃষ্টির, তার নিজের অবস্থা অক্ষুণ্ন রেখে। ১৩ খণ্ডে সম্পূর্ণ এলিমেন্টস–এর সবচেয়ে আলোচিত ও উল্লেখযোগ্য সমান্তরাল স্বীকার্য মানবজাতিকে শত শত বছর বিভ্রান্তির জালে আটকে রেখেছে, আবার জ্ঞানের ও যৌক্তিক উপলব্ধির নতুন দিগন্তে পৌঁছে দিয়েছে, যার অন্যতম উদাহরণ অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতি। সমতলিক জ্যামিতির ক্ষেত্রে ইউক্লিডের এলিমেন্টস হলো পাঠ্যপুস্তকের একমাত্র দৃষ্টান্ত, যা দুই হাজার বছর আগে পাঠ্যপুস্তক ছিল, এখন পর্যন্ত সামান্য সংশোধনের মাধ্যমে ব্যবহারযোগ্য রয়েছে ও থাকবে। এর দীর্ঘস্থায়িত্ব ও টিকে থাকার শক্তি আমাদের বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়, মানুষের ক্ষমতার প্রতি শ্রদ্ধা বাড়িয়ে দেয় আর ইউক্লিডকে করে তোলে মহান।

লেখক: বিজ্ঞানবক্তা