সাইকেলের জুয়াচুরি

মাথা খাটাতে কে না পছন্দ করে! আর গল্পোচ্ছলে মজার বুদ্ধির ব্যায়াম হলে তো কথাই নেই। এরকমই একটি বই অঙ্কের খেলা। এটি রুশ গণিতবিদ ইয়াকভ পেরেলমানের নামকরা বই ফিগারস ফর ফান: স্টোরিজ, পাজলস অ্যান্ড কোনান্ড্রামস-এর বাংলা অনুবাদ। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) প্রগতি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছিল বিমলেন্দু সেনগুপ্তের অনুবাদে। সম্পাদক ছিলেন নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা।

অঙ্কের মজার সব হেঁয়ালি, বুদ্ধির খেলাসহ মাথা খাটানোর মতো দারুণ সব ধাঁধা নিয়ে বইটি। মগজে শান দিতে যা অতুলনীয়। এ বই পড়ে দেশের অনেকে এককালে গণিতে আগ্রহী হয়েছে, সমস্যা সমাধান শিখেছে, মুগ্ধ হয়েছে, প্রেমে পড়েছে গণিতের। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে।

বহু লোক তাদের শেষ কুপনগুলো বেচতে না পারায় ক্ষতিগ্রস্ত হলো

প্রাকবিপ্লব রাশিয়ায় এবং বিদেশে হয়তো বর্তমানেও কতগুলো প্রতিষ্ঠান সাধারণ স্তরের মালপত্র কাটাবার জন্য এক নতুন ধরনের পথ বের করে। জনপ্রিয় সংবাদপত্র বা পত্রিকাগুলোতে নিচের মতো করে একটা বিজ্ঞাপন দিয়ে ব্যাপারটা শুরু হতো:

টোপটা অনেকেই গিলল, তারা লিখে পাঠাল নিয়মাবলীর জন্য। তাদের কাছে এল এক বিস্তৃত তালিকা।

১০ রুবলের বদলে তারা যা পেল, তা কিন্তু সাইকেল নয়। তারা পেল চারটে কুপন, এগুলোকে আবার ১০ রুবল দামে তাদের বন্ধুদের কাছে বেচতে বলা হলো। এভাবে যে ৪০ রুবল আদায় হলো, সে তা পাঠিয়ে দিল সেই প্রতিষ্ঠানকে। তখন প্রতিষ্ঠানটি তাকে পাঠাল সাইকেলটা। সে তাহলে সত্যিসত্যিই ১০ রুবল দিল। বাকি ৪০ রুবল এল তার বন্ধুদের পকেট থেকে। আসলে এই ১০ রুবল দেওয়া ছাড়াও খদ্দেরকে বাকি চারটে কুপন কেনার লোক জোগাড় করতে অনেক ঝামেলা পোয়াতে হলো। অবশ্য তাতে তার পয়সা খরচা কিছু হলো না।

এই কুপনগুলো কী? খদ্দের তার ১০ রুবলের জন্য কী কী সুবিধা পেল? সে একই ধরনের পাঁচটা কুপনের সঙ্গে তার কুপনটা বদলে নেওয়ার অধিকারটাকে কিনে নিয়েছিল। অন্যভাবে বলতে গেলে, সে সাইকেলের দাম ৫০ রুবল আদায় করার সুযোগের দাম দিয়েছিল। এই সাইকেলটা কিনতে তার আসলে লাগল কুপনের টাকাটা, মাত্র ১০ রুবল। নতুন করে যারা কুপনের মালিক হলো, তারা আবার প্রত্যেকে বিলি করার জন্য পেল পাঁচটা কুপন, এভাবে চলল।

একবার দেখলে সব ব্যাপারটার ভেতর কোনো জুয়াচুরি আছে বলে মনে হবে না। বিজ্ঞাপনদাতা তার কথা রাখল। সাইকেলটা কিনতে খদ্দেরকে আসলে ১০ রুবলই দিতে হলো। প্রতিষ্ঠানটিরও কিছু ক্ষতি হচ্ছিল না, মালের পুরো দামটাই তারা পেয়ে যাচ্ছিল।

তবু ব্যাপারটা ছিল পরিষ্কার জুয়াচুরি। কারণ বহু লোক তাদের শেষ কুপনগুলো বেচতে না পারায় ক্ষতিগ্রস্ত হলো। তাই রাশিয়ায় এর নাম হল ‘খুস’। কোম্পানির লাভের টাকাটা এদের কাছ থেকেই জুটছিল। দুদিন আগে বা পরে এমন একটা অবস্থা এল যে কুপনের মালিকদের পক্ষে ওগুলো বিক্রি করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। কুপনের মালিকের সংখ্যা কত তাড়াতাড়ি বেড়ে যাচ্ছিল, কাগজ-পেন্সিল নিয়ে হিসেব কষতে বসলেই তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি দেখা যাবে।

শেষ যে ১০০ জন কুপন কিনল, তাদের আবার বিক্রি করতে হলো ৫০০ জন নতুন শিকারের কাছে। তাদের আবার টানতে হলো আরও ২৫০০ জনকে। শহরটা একেবারে কুপনে ছেয়ে যেতে লাগল, আর সত্যি বলতে কি, কুপন কিনতে চায়, এমন লোক পাওয়া কঠিন হয়ে উঠল।

প্রথম কিস্তিতে যারা সরাসরি প্রতিষ্ঠানটি থেকেই কুপন কিনেছিল, কেনার নতুন লোক জোগাড় করতে কোনো মুশকিলই হলো না তাদের। এই দলের প্রত্যেকে লেনদেনটার ভেতর চারজন করে নতুন লোক নিয়ে এল। এদের আবার কুপনগুলো বিক্রি করতে হলো ২০ জনের (৪×৫) ভেতর, আর তা করতে গিয়ে তাদের এই কুপন কেনার সুবিধা সম্পর্কে বিশ্বাস জন্মাতে হলো। ধরে নেওয়া যাক তারা তা পারল, তখন কুড়ি জন নতুন করে অংশ গ্রহণ করল এতে।

আরও পড়ুন
‘ধ্বস’ এবার বন্ধুবান্ধবদের ছোট পরিধি ভেদ করে ছড়িয়ে পড়েছে সারা শহরে, সেখানে কেনার নতুন লোক খুঁজে পাওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে

বরফের ধ্বসটার গতি আর পরিধি (ভর, বেগ) দুইই বেড়ে উঠল। কুপনের ২০ জন নতুন মালিককে কুপনগুলো ছড়িয়ে দিতে হলো আরও ২০×৫ = ১০০ জনের ভেতর।

এই পর্যন্ত সর্বপ্রথম যারা কুপন পেয়েছিল, তারা প্রত্যেকে খেলার ভেতর টেনে এনেছে ১+৪+২০+১০০=১২৫ জন লোককে। এদের ভেতর ২৫ জন সাইকেল পেয়েছে। বাকি ১০০ জনকে একটি করে সাইকেল পাওয়ার আশা দেওয়া হয়েছে, আর এই আশাতেই তারা প্রত্যেকে দিয়েছে ১০ রুবল করে।

‘ধ্বস’ এবার বন্ধুবান্ধবদের ছোট পরিধি ভেদ করে ছড়িয়ে পড়েছে সারা শহরে, সেখানে কেনার নতুন লোক খুঁজে পাওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। শেষ যে ১০০ জন কুপন কিনল, তাদের আবার বিক্রি করতে হলো ৫০০ জন নতুন শিকারের কাছে। তাদের আবার টানতে হলো আরও ২৫০০ জনকে। শহরটা একেবারে কুপনে ছেয়ে যেতে লাগল, আর সত্যি বলতে কি, কুপন কিনতে চায়, এমন লোক পাওয়া কঠিন হয়ে উঠল।

তোমরা দেখতে পাবে যে এই ‘লাভের ব্যবসায়’ যাদের টানা হলো, তাদের সংখ্যা বাড়তে লাগল গুজব যেভাবে ছড়ায়, ঠিক সেভাবে—মানে, চক্রবৃদ্ধি হারে। যে সংখ্যাগুলো পাওয়া গেল, তা পিরামিডের মতো করে সাজালে দাঁড়ায়:

8

২০

১০০

৫০০

২,৫০০

১২,৫০০

৬২,৫০০

শহরটা যদি বড় হয় আর সাইকেল চড়া লোকের সংখ্যা হয় ৬২,৫০০, তাহলে ৮ কিস্তিতেই ‘বরফ ধ্বসে’ পড়া সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। এই সময়ের ভেতর সব লোকই পরিকল্পনার আওতায় এসে গেছে। কিন্তু এদের মাত্র পাঁচ ভাগের এক ভাগ শুধু সাইকেল পাবে। বাকি লোকদের কাছে থাকবে কুপন। সে কুপনগুলো বিক্রির সম্ভাবনা আর এ জন্মে হবে না।

আরও পড়ুন
জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের এক ভাগ ক্রেতার জন্য বাকি পাঁচ ভাগের চার ভাগকে দাম দিতে বাধ্য করছে। তার মানে: এই দল হয়েছে অন্য দলের সুখের জোগানদার। তা ছাড়াও তারা পাচ্ছে অত্যুৎসাহী একদল মালবিক্রেতা, সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছেতেই কাজে এসেছে তারা।

আরও বেশি লোকসংখ্যা যেসব শহরে, এমনকি যে আধুনিক রাজধানীতে লোক থাকে লক্ষ লক্ষ, সেখানেও আর কয়েকটি কিস্তিতেই খেল খতম হয়ে যাচ্ছে। কারণ সংখ্যার এই পিরামিড বেড়ে উঠছে অবিশ্বাস্য গতিতে। নবম কিস্তির পর থেকে সংখ্যাগুলো এরকম দাঁড়াচ্ছে:

৩,১২,৫০০

১৫,৬২,৫০০

৭৮,১২,৫০০

৩,৯০,৬২,৫০০

তোমরা দেখতেই পাচ্ছ যে ১২ নম্বর কিস্তিতে এই পরিকল্পনাটা একটা দেশের সব অধিবাসীকে গ্রাস করে ফেলবে, আর এই জাল কারবারীদের হাতে ঠকে যাবে তাদের ৪/৫ ভাগ।

তাদের লাভটা কী হলো, দেখা যাক। তারা জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের এক ভাগ ক্রেতার জন্য বাকি পাঁচ ভাগের চার ভাগকে দাম দিতে বাধ্য করছে। তার মানে: এই দল হয়েছে অন্য দলের সুখের জোগানদার। তা ছাড়াও তারা পাচ্ছে অত্যুৎসাহী একদল মালবিক্রেতা, সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছেতেই কাজে এসেছে তারা। সমস্ত ঘটনাটাকে একজন রুশ লেখক ঠিকই নাম দিয়েছিলেন ‘পারস্পরিক জুয়াচুরির হিমানী প্রপাত’। ঘটনাটি সম্বন্ধে আর যা বলা যেতে পারে, তা হলো: কী করে হিসেব কষে জুয়াচুরি থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে চলতে হয়, তা যারা জানত না, তারাই ভুগত।

'অঙ্কের খেলা' বই থেকে আরও পড়ুন