দ্রুত বংশবিস্তারের রহস্য

মাথা খাটাতে কে না পছন্দ করে! আর গল্পোচ্ছলে মজার বুদ্ধির ব্যায়াম হলে তো কথাই নেই। এরকমই একটি বই ‘অঙ্কের খেলা’। এটি রুশ গণিতবিদ ইয়াকভ পেরেলমানের নামকরা বই ‘ফিগারস ফর ফান: স্টোরিজ, পাজলস অ্যান্ড কোনান্ড্রামস’-এর বাংলা অনুবাদ। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) প্রগতি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছিল বিমলেন্দু সেনগুপ্তের অনুবাদে। সম্পাদক ছিলেন নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা।

অঙ্কের মজার সব হেঁয়ালি, বুদ্ধির খেলাসহ মাথা খাটানোর মতো দারুণ সব ধাঁধা নিয়ে বইটি। মগজে শান দিতে যা অতুলনীয়। এ বই পড়ে দেশের অনেকে এককালে গণিতে আগ্রহী হয়েছে, সমস্যা সমাধান শিখেছে, মুগ্ধ হয়েছে, প্রেমে পড়েছে গণিতের। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে।

একটা পাকা পপিতে থাকে ছোট ছোট বীজ, তাদের সবকটা থেকেই গজাতে পারে নতুন গাছ। যদি সবগুলো বীজ বুনে দেওয়া যায়, আর তা থেকে গাছ গজায়, তাহলে মোট কত গাছ হবে? এটা বের করতে হলে জানতে হবে প্রত্যেকটা পপিতে কতগুলো করে বীজ আছে। কাজটা খুব একঘেয়ে। কিন্তু এর ফলটা এত মজার যে ধৈর্য ধরে হিসেবটা নিখুঁতভাবে করে ফেললে সময়টা নষ্ট হবে না। প্রথমেই দেখতে পাবে যে, প্রত্যেকটা পপি ফলে গড়ে ৩ হাজার বীজ থাকে।

তারপর? তারপরেই দেখতে পাবে এই পপি গাছের চারপাশে যদি যথেষ্ট জমি থাকে, তাহলে প্রতিটি বীজ থেকেই গাছ হবে। আর আগামী গ্রীষ্মকালেই আমরা পেয়ে যাব ৩ হাজারটা পপি গাছ। মাত্র একটা পপি থেকে হবে পুরো পপি গাছের বাগান।

তারপর কি দাঁড়াবে, সেটা দেখা যাক। এই ৩ হাজার পপি গাছের প্রত্যেকটিতেই অন্তত একটা করে পপি ফল পাওয়া যাবে (আরও বেশি হওয়া স্বাভাবিক), আর তাতে থাকবে ৩ হাজারটা করে বীজ। এগুলো গজালে প্রত্যেকটি থেকে হবে ৩ হাজারটা নতুন চারা। তাহলে দ্বিতীয় বছরের শেষে আমরা পাব কমপক্ষে ৩০০০ × ৩০০০ = ৯,০০০,০০০টা গাছ।

এখন হিসেব করা খুব সহজ। তৃতীয় বছরের শেষে আমাদের একটি মাত্র পপির বংশধরের সংখ্যা দাঁড়াবে: ৯,০০০,০০০ × ৩০০০ = ২৭,০০০,০০০,০০০টি।

চার বছরের শেষে হবে ২৭,০০০,০০০,০০০ × ৩০০০ = ৮১,০০০,০০০,০০০,০০০।

ডান্ডেলিয়ন ফুলে বছরে বীজ হয় প্রায় ১০০ টা করে।

পাঁচ বছরের শেষে পুরো পৃথিবীতেও এই পপি গাছের স্থানসংকুলান হবে না। কারণ, তখন মোট সংখ্যা দাঁড়াবে: ৮১,০০০,০০০,০০০,০০০ × ৩০০০ = ২৪৩,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০টি।

আর পুরো মহাদেশ এবং দ্বীপগুলোর আয়তন নিয়ে সমস্ত পৃথিবীর পরিধি হল মাত্র ১৩৫,০০০,০০০ বর্গ কিলোমিটার বা ১৩৫,০০০,০০০,০০০,০০০ বর্গ মিটার।

যতগুলো পপি গাছ এ সময়ের মধ্যে গজাতে পারবে জায়গাটা তার প্রায় ২০০০ ভাগের এক ভাগ মাত্র। 

দেখতে পাচ্ছ, যদি সব পপি বীজ থেকেই চারা হয়, তাহলে এক বর্গ মিটারে ২০০০ চারা হিসেবে পাঁচ বছরের মধ্যেই একটামাত্র পপির বংশ সারা পৃথিবীর মাটি ছেয়ে ফেলবে। ছোট্ট পপি বীজটায় কেমন একটা দানবীয় সংখ্যা লুকিয়ে আছে, তাই না?

অল্প বীজ হয় এমন গাছ দিয়েও ব্যাপারটা দেখা যেতে পারে। ফল তাতে সমানই হবে। শুধু এক্ষেত্রে সারা পৃথিবীর মাটি ছেয়ে ফেলতে গাছগুলোর পাঁচ বছরের কিছু বেশি সময় লাগবে। যেমন ধরা যাক, ডান্ডেলিয়ন ফুলের কথা। এতে বছরে গড়ে বীজ হয় ১০০টা। সব বীজ থেকেই যদি গাছ গজায় তাহলে আমরা পাচ্ছি:

১ম বছর শেষে                     ১টি চারা

২য় বছর শেষে                    ১০০টি চারা

৩য় বছর শেষে                    ১০,০০০টি চারা

৪র্থ বছর শেষে                    ১,০০০,০০০টি চারা                               

৫ম বছর শেষে                    ১০০,০০০,০০০টি চারা

৬ষ্ঠ বছর শেষে                    ১০,০০০,০০০,০০০টি চারা

৭ম বছর শেষে                     ১,০০০,০০০,০০০,০০০টি চারা

৮ম বছর শেষে                    ১০০,০০০,০০০,০০০,০০০টি চারা

৯ম বছর শেষে                    ১০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০টি চারা

পুরো পৃথিবীতে যত বর্গ মিটার জমি আছে তার ৭০ গুণেরও বেশি জমি দরকার এই চারাগুলোর জন্য।

তাহলে ৯ বছর বাদে প্রতি বর্গ মিটারে ৭০টি হিসেবে সমস্ত মহাদেশগুলো ঢাকা পড়ে যাবে ডান্ডেলিয়ন ফুলে।

কিন্তু এমনটা হয় না কেন? কারণ খুব সোজা। একটা বিরাট সংখ্যার বীজ গাছ গজানোর আগেই নষ্ট হয়ে যায়। হয় তারা পড়ে অনুর্বর জমিতে, না হয় ঢাকা পড়ে যায় অন্য গাছের নীচে, অথবা যদি শেকড় গজায় জন্তু-জানোয়ার নষ্ট করে ফেলে তাদের। বীজ আর চারাগুলো যদি এভাবে গাদায় গাদায় নষ্ট না হতো, তাহলে তারা অতি অল্প দিনের ভেতর ছেয়ে ফেলত আমাদের এই গ্রহকে।

শুধু উদ্ভিদের ক্ষেত্রেই নয়, প্রাণীর ক্ষেত্রেও এমনই ঘটে। এরা যদি মরে না যেত, তাহলে আজ হোক বা কাল হোক, মার একজোড়া প্রাণীর সন্তানসন্ততিতেই গিজগিজ করত পৃথিবী। মৃত্যু যদি প্রাণীর বৃদ্ধিকে রোধ না করত, তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াত তার জলন্ত উদাহরণ হল পঙ্গপালের বিস্তীর্ণ এলাকা ছেয়ে ফেলা। কয়েক বছর বাদেই আমাদের মহাদেশগুলো ছেয়ে যেত জঙ্গল আর তৃণভূমিতে। আর তার ভেতর গিজগিজ করত প্রাণী, তারা একটু জায়গার জন্য মারামারি করত নিজেদের ভেতর। সাগরগুলোতে মাছ এত বেড়ে যেত যে নৌকো চলতে পারত না। আর আমরাও দিনের আলো আর দেখতে পেতাম না। কারণ, অসংখ্য পাখি আর পতঙ্গ ঘুরে বেড়াত আকাশে।

সাধারণ মাছির উদাহরণটাই নেওয়া যাক। সে এক অদ্ভুত বিরাট সংখ্যা। ধরে নেওয়া যাক, প্রতিটি স্ত্রী মাছি ১২০টি করে ডিম পাড়ে; গ্রীষ্মকালের মধ্যে এই ১২০টি ডিম থেকে জন্ম নিতে পারে মাছিদের ৭ পুরুষ। এদের ভেতর অর্ধেক আবার স্ত্রী মাছি। ধরে নেওয়া যাক ১৫ এপ্রিল তারিখে জন্মাল প্রথম ডিমটা, আর তার ২০ দিনের মধ্যেই স্ত্রী মাছিগুলো ডিম পাড়বার মতো বড় হলো। দৃশ্যটা তাহলে দাঁড়াচ্ছে অনেকটা এরকম:

১৫ এপ্রিল একটা স্ত্রী মাছি ডিম পাড়ল। মে মাসের প্রথম দিকে তা থেকে হলো ১২০টা মাছি। তাদের ভেতর ৬০টা স্ত্রী মাছি।

৫ মে প্রত্যেকটি স্ত্রী মাছি ১২০টা ডিম পাড়বে, আর মাসের মাঝামাঝি তা থেকে হবে ৬০×১২০ = ৭২০০টা মাছি, এদের ভেতর ৩৬০০টা স্ত্রী মাছি।

২৫ মে এই ৩৬০০ স্ত্রী মাছির প্রত্যেকে ১২০টা করে ডিম পাড়বে, আর জুন মাসের প্রথম দিকে তা থেকে হবে ৩৬০০ × ১২০ = ৪৩২,০০০টা মাছি। এর মধ্যে ২১৬,০০০টা স্ত্রী মাছি।

১৪ জুন প্রত্যেক স্ত্রী মাছি ১২০টা করে ডিম পাড়বে, মাসের শেষে ১২,৯৬০,০০০টা স্ত্রী মাছি সহ মোট মাছি হবে ২৫,৯২০,০০০টা।

৫ জুলাই ১,২৯,৬০,০০০টা স্ত্রী মাছি ১২০টা করে করে ডিম পাড়বে, তা থেকে হবে ১,৫৫৫,২০০,০০০টা মাছি (৭৭৭,৬০০,০০০টা স্ত্রী মাছি)।

২৫ জুলাই হবে ৯৩,৩১,২০,০০,০০০টা মাছি। তাদের ভেতর ৪৬,৬৫৬,০০০,০০০টা হবে স্ত্রী মাছি।

১৩ আগস্ট সেই সংখ্যাটা দাঁড়াবে ৫,৫৯৮,৭২০,০০০,০০০। এদের ভেতর ২,৭৯৯,৩৬০,০০০,০০০টা মাছি হবে স্ত্রী-জাতের।

১ সেপ্টেম্বর জন্মাবে ৩৫৫,৯২৩,২০০,০০০,০০০টা মাছি।

এক গ্রীষ্মে মাছির যে বংশবৃদ্ধি হয় সেগুলোকে ইউরেনাস গ্রহ থেকে পৃথিবীর যা দূরত্ব সেই দৈর্ঘ্যে রেখায় পাশাপাশি বসানো যায়।

একটা গ্রীষ্ম ঋতুতে যত মাছি জন্মাতে পারে, তারা যদি কেউ না মরে যায় বা তাদের আর কিছু না ঘটে, সেই বিরাট সংখ্যক মাছির একটা পরিষ্কার ছবি দিচ্ছি। দেখা যাক তারা সার বোধে দাঁড়ালে কী হয়। একটা মাছি ৫ মিলিমিটার লম্বা, তাহলে এই লাইনটা হবে ২,৫০০,০০০,০০০ কিলোমিটার। অর্থাৎ পৃথিবী থেকে সূর্যের যা দূরত্ব তারও ১৮ গুণ বেশি (ইউরেনাস গ্রহটার পৃথিবী থেকে যতটা দূরত্ব, প্রায় ততটা)।

সবশেষে উপযুক্ত অবস্থায় প্রাণীর অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে বংশবৃদ্ধির কয়েকটা ঘটনা বললে মন্দ হবে না।

মার্কিন মুলুকে আগে কোনো চড়ুই ছিল না। সেখানে তাদের আমদানি হয় পোকামাকড় ধ্বংস করার জন্য। তোমরা তো জানই যে চড়ুই শুঁয়োপোকা আর ফলের বাগান এবং সবজি ক্ষেত ধ্বংসকারী অন্যান্য পোকাও খেয়ে থাকে। বোধহয় চড়ুইদের ভাল লেগে গিয়েছিল ওই দেশটা। ওদের নষ্ট করার মতো কোনো প্রাণী বা শিকারী পাখি ছিল না সেখানে। ওদের বংশ বাড়তে লাগল দ্রুতগতিতে। পোকামাকড়ের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে গেল। কিন্তু চড়ুইদের সংখ্যা হুহু করে বেড়ে উঠল। এরপর এমন একটা সময় এল যখন তাদের জন্য আর উপযুক্ত সংখ্যায় পিঁপড়াও থাকল না। তারা তখন শস্য নষ্ট করতে শুরু করল। রীতিমতো একটা যুদ্ধ ঘোষণা করা হলো চড়ুইদের বিরুদ্ধে। কিন্তু এতে এত খরচ হল যে শেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইন করে বাইরে থেকে প্রাণী আমদানি বন্ধ করা হলো।

আরও একটা উদাহরণ দিচ্ছি। ইউরোপীয়ানদের অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কারের আগে সেখানে কোনো খরগোশ ছিল না। ১৮ শতাব্দীর শেষদিকে প্রথম খরগোশ আমদানি হল সেখানে। খরগোশদের বংশ সেখানে অদ্ভুত দ্রুতগতিতে বাড়তে লাগল। কারণ, খরগোশদের খেয়ে ফেলার মতো কোনো শিকারী জন্তু ছিল না সেখানে। অল্পদিনের ভেতরই খরগোসের দল অস্ট্রেলিয়া ছেয়ে ফেলে ফসল নষ্ট করতে শুরু করল। উৎপাতটা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল। খরগোশদের বিনষ্ট করতে বিপুল ব্যয় হয়ে গেল। সাধারণ মানুষের দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ব্যবস্থাই শেষে এই ক্ষয়ক্ষতিকে রোধ করল। আরও পরে প্রায় এই ধরনেরই ঘটনা ঘটেছিল ক্যালিফোর্নিয়াতে।

সেক্রেটারি পাখি—সাপের দুশমন

তৃতীয় গল্পটা এসেছে জামাইকা থেকে। সেখানে ছিল বহু বিষধর সাপ। ওদের ধ্বংস করার জন্য সেক্রেটারি পাখি আনা ঠিক হল। সাপের ভয়ানক দুশমন বলে নাম আছে এদের। সাপের সংখ্যাটা কমে গেল ঠিকই, কিন্তু যে মেঠো ইঁদুরগুলোকে সাপ খেয়ে ফেলত, তারা বাড়তে লাগল। ইঁদুরগুলো আখের আবাদের এত ক্ষতি করল যে কৃষকরা এদের বিনাশ করে ফেলা ঠিক করে চার জোড়া ভারতীয় বেজী নিয়ে এল। এরা ইঁদুরের শত্রু বলে পরিচিত। ওদের যথেচ্ছভাবে বাড়তে দেওয়া হলো। আর অল্প সময়ের ভেতরই দ্বীপটা ছেয়ে ফেলল ওরা। বছর দশেকের ভেতরই প্রায় সব ইঁদুর উৎখাত করে ফেলল তারা। কিন্তু তা করতে গিয়ে ওদের আর খাবারের বাছবিচার রইল না। কুকুরের বাচ্চা, মেশশাবক, শুয়োর ছানা আর মুরগীগুলোকে তারা আক্রমণ করতে লাগল, নষ্ট করে ফেলল ডিমগুলোকে। তাদের সংখ্যা আরও বেড়ে গেলে তারা ফলের বাগিচা, গমের ক্ষেত আর আবাদের ভেতর ঢুকে পড়ল স্রোতের মতো। পুরনো এই বন্ধুদের ওপর দ্বীপবাসীরা তখন খাপ্পা হয়ে উঠল, কিন্তু ক্ষতিরোধ করতে শুধু আংশিকভাবেই সফল হলো তারা।