গণনা থেকেই জ্ঞানের শুরু

শিল্পীর কল্পনায় প্রাচীন গণিতবিদছবি: সংগৃহীত

জ্ঞানপিপাসা থেকে কোনো জাতি যত দূরে সরে গেছে, পৃথিবীতে তার অবস্থান হয়েছে তত দুর্বল। ইউভাল নোয়াহ হারারি তাঁর বহুল আলোচিত স্যাপিয়েন্স বইতে জ্ঞানপিপাসার আদিসূত্রের খোঁজ দিয়েছেন।

আজ থেকে প্রায় ৫ হাজার ৫০০ বছরেরও আগের কথা। ক্ষমতা বিস্তার ও সাম্রাজ্য পরিচালনার স্বার্থে সুমেরীয়রা দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ায় প্রথম লিখিত লিপি উদ্ভাবন করে। মেসোপটেমিয়া জায়গাটা টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মাঝে অবস্থিত। আজকের হিসাবে পূর্ব সিরিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্ক ও ইরাকের এখানটায়। মাটির ফলকে খোদাই করে তৈরি তাদের এই লিপি কেবল গণনার কাজে ব্যবহৃত হতো।

মানব মস্তিষ্ক এক বিস্ময়। তবু বিশাল মাত্রার তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ এবং তা দ্রুত পুনরুদ্ধার আমাদের জন্য সহজ নয়। কিছু মানুষের স্মৃতিশক্তি প্রবাদতুল্য, এ কথা সত্যি। হাজার বছর আগেও এরকম মানুষ ছিলেন। সেকালে তাঁদের ‘মেমোরি প্রফেশনালস’ বলা হতো। বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘স্মৃতিজীবী’। তবে এমন গুটিকয় মানুষের ওপর ভরসা করে সাম্রাজ্য চালানো হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রায় অসম্ভব।

সুমেরীয়দের গণনাপদ্ধতি ছিল ষাটভিত্তিক
ছবি: সংগৃহীত

সে জন্যই সুমেরীয়রা এ গণনাপদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। সুমেরীয়দের গণনাপদ্ধতি ছিল ষাটভিত্তিক। অর্থাৎ ১, ১০, ৬০, ৩৬০, ৬০০, ৩৬০০, ৩৬০০০—এরকম। যদিও পরে অ্যারাবিক নিউমেরাল বা আরবি সংখ্যা বহুল প্রচলিত হয়ে ওঠে। এর দশভিত্তিক (০-৯ পর্যন্ত অঙ্কনির্ভর) সংখ্যাপদ্ধতি আমরা আজও ব্যবহার করছি।

সুমেরীয়দের গণনাপদ্ধতি কাজে লাগিয়ে ২৪ ঘণ্টায় দিনের হিসাব এবং জ্যামিতির ৩৬০ ডিগ্রিভিত্তিক গণনা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। উড়ুকের গিলগামেশের সময়ে প্রবর্তিত সুমেরীয় লিপি গণনা ও কর আদায়ের জন্য যথেষ্ট ছিল। তবে গিলগামেশ নামের বিখ্যাত লিখনকাব্য রচনা কিংবা গল্প বর্ণনায় এ লিপি ছিল অপারগ। সংখ্যা গণনায় শোষণ চলতে পারে, কিন্তু শিল্প বা কলার বিকাশ তো গণনার ঊর্ধ্বে। আত্মার খোঁজ সেখানে জরুরি হয়ে দাঁড়ায়।

সেই সুমেরীয়রাই ৩০০০-২৫০০ খ্রিস্টপূর্ব সময়ে অঙ্কভিত্তিক লিপিতে আরও কিছু প্রতীক ও চিহ্ন যোগ করে। এতে সংখ্যার দলিলে কিছু শাব্দিক ব্যাখ্যাও লিপিবদ্ধ করে রাখা যেত। সুমেরীয়দের এই লিপিটি কিউনিফর্ম (Cuneiform) নামে পরিচিত।

ইতিহাসের এমনি কাছাকাছি সময়ে মিশরে হায়ারোগ্লিফিক, আর চীনে তাদের লিখিত লিপি প্রবর্তিত হয়। সেই শুরু। হিসাব রক্ষার শিলালিপি হয়ে দাঁড়ায় মহাকাব্য লেখার তাবুলা রাসা (Tabula Rasa)—সাদা পাতা বা স্লেট বলা যেতে পারে—ধর্মবাণী সংরক্ষণ ও প্রচারের সুসংগঠিত উপায়, এমনকি সাধারণের ভালোবাসা প্রকাশের উৎকৃষ্টতম পন্থা। দর্শনের চোখে অবশ্য তাবুলা রাসা মানে শুধু সাদা খাতা নয়, সদ্য জন্ম নেওয়া শিশু—জীবনের পথে পথে ভরে উঠবে যার খাতা।

সুমেরীয়দের কিউনিফর্ম লিপি আবিষ্কারের কিছু পরে আন্দেজ (আজকের দক্ষিণ আমেরিকা) অঞ্চলে, লিখিত নয়, এমন একটি ভৌত গণনাপদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়। এর নাম ছিল কিপু

যাহোক, আজ থেকে ৫ হাজার বছর আগেই মানব সভ্যতার যাত্রা আরম্ভ হয়েছিল জ্ঞানের পথে। জ্ঞান হয়ে দাঁড়িয়েছিল সাম্রাজ্য বিস্তারের হাতিয়ার, ধর্ম প্রচারের সহায়িকা, সাহিত্য রচনার উপঢৌকন।  

গণনা লিপির ইতিহাস নিয়ে বলতে গেলে আরও দুটো উদাহরণ জরুরি বলে মনে করেন হারারি। এক, সুমেরীয়দের কিউনিফর্ম লিপি আবিষ্কারের কিছু পরে আন্দেজ (আজকের দক্ষিণ আমেরিকা) অঞ্চলে, লিখিত নয়, এমন একটি ভৌত গণনাপদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়। এর নাম ছিল কিপু (Quipu)—নানা রঙের দড়িতে গেরো দিয়ে তৈরি একটি গণনাপদ্ধতি। একেক রঙের দড়ি, তাতে দেয়া গেরো ও গেরোর সংখ্যার একেক মূল্য। এভাবে এই ভৌত গণনাপদ্ধতি কাজে লাগিয়ে ইনকা সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটে আজ থেকে প্রায় ৪ হাজার বছর আগে। স্প্যানিয়ার্ডরা যখন দক্ষিণ আমেরিকা দখল করে নিল, তারাও কিপু ব্যবহার করতে শুরু করে। তবে ইউরোপে কেউ কিপু তৈরি বা পড়ার ব্যাপারে প্রশিক্ষিত ছিল না। তাই শোষিতদের হাতে জিম্মি হতে শুরু করে স্প্যানিশ কনকুইস্তাদোর বা শোষক সৈন্যরা। ফলে বিলুপ্ত হয় কিপুর প্রচলন।

অন্য গণনাপদ্ধতিটি আমাদের সবার জানা। অ্যারাবিক নিউমেরাল বা ডেসিমেল পদ্ধতি, মানে দশভিত্তিক সংখ্যাপদ্ধতি। এটি আজ সর্বত্র প্রচলিত। মজার বিষয় হলো, এই দশমিক গণনাপদ্ধতি কিন্তু আরবদের আবিষ্কার ছিল না। আরবরা ভারতে এই গণনাপদ্ধতির খোঁজ পায় নবম খিষ্টাব্দে। এরপর এর আত্মীকরণ করে এবং মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে তার প্রচলন ঘটায়। আজ এই গণনাপদ্ধতি ছাড়া পুরো মানব সভ্যতা অচল।

পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা করে নেওয়ার মন্ত্র হাজার বছর ধরেই ছিল জ্ঞানপিপাসা। আজ একে পাশ কাটিয়ে উন্নয়নের কোনো পথ খোলা আছে বলে মনে হয় না।

জ্ঞানের প্রতি পশ্চিমের আগ্রহ বেড়ে চলেছে ক্রমশ। জ্ঞান, বিশেষ করে বিজ্ঞানে এদের অগ্রগতি আজ অপ্রতিরোধ্য। ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পৃথিবীর অর্থনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্র ছিল প্রাচ্য। কেবল ১০০ বছরে, ১৮৫০ সালের ভেতর, পাশ্চাত্য অঞ্চল ক্ষমতার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। এ অসম্ভবকে তারা সম্ভব করে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা কাজে লাগিয়ে। আজ প্রাচ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ যেন হারিয়ে যেতে ধরেছে। বাংলাদেশে বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির চেয়ে ব্যবসায় প্রশাসনের প্রতি ঝোঁক যেন বেশি অনেকের। গণিত বা প্রাণিবিদ্যার চেয়ে মিডিয়ায় আকর্ষণ তীব্র। বই কেনার বদলে আজ আমরা কফি শপে অর্থব্যয়কে বেশি যুক্তিযুক্ত মনে করি। এ নিয়ে আমাদের আরও ভাবা প্রয়োজন।

পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা করে নেওয়ার মন্ত্র হাজার বছর ধরেই ছিল জ্ঞানপিপাসা। আজ একে পাশ কাটিয়ে উন্নয়নের কোনো পথ খোলা আছে বলে মনে হয় না। লেখনির জোরেই বিশ্বজয় করতে হবে। কেননা লেখনিই আজ নিয়ন্ত্রণ করছে মানবচিন্তা ও অগ্রগতি। হারারি বলছেন: ‘লেখালেখির সূচনা হয়েছিল মানুষের চেতনার সহযোগিতার লক্ষ্যে। কিন্তু এখন এটা হয়ে উঠছে সেই চেতনার নিয়ন্ত্রক।’

লেখক: অধ্যাপক, পরিবেশ প্রকৌশল অনুষদ, ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, অস্টিন, যুক্তরাষ্ট্র

সূত্র: ১. Harari, Y. N. Sapiens: A Brief History of Humankind. 2015. HarperCollins, New York, NY.

২. Ascher, M. and Ascher, R. Mathematics of the Incas: Code of the Quipu. 1981. Dover Publications, Mineola, NY.

৩. Cajori, F. A history of Mathematical Notations. 2011. (First printed in 1928). Dover Publications, Mineola, NY.