৩০ দিনে কোটিপতি হতে চান!

মাথা খাটাতে কে না পছন্দ করে! আর গল্পোচ্ছলে মজার বুদ্ধির ব্যায়াম হলে তো কথাই নেই। এরকমই একটি বই ‘অঙ্কের খেলা’। এটি রুশ গণিতবিদ ইয়াকভ পেরেলমানের নামকরা বই ‘ফিগারস ফর ফান: স্টোরিজ, পাজলস অ্যান্ড কোনান্ড্রামস’-এর বাংলা অনুবাদ। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) প্রগতি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছিল বিমলেন্দু সেনগুপ্তের অনুবাদে। সম্পাদক ছিলেন নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা।

অঙ্কের মজার সব হেঁয়ালি, বুদ্ধির খেলাসহ মাথা খাটানোর মতো দারুণ সব ধাঁধা নিয়ে বইটি। মগজে শান দিতে যা অতুলনীয়। এ বই পড়ে দেশের অনেকে এককালে গণিতে আগ্রহী হয়েছে, সমস্যা সমাধান শিখেছে, মুগ্ধ হয়েছে, প্রেমে পড়েছে গণিতের। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে।

আসুন একটা চুক্তি করা যাক, পুরো এক মাস প্রতিদিন আমি আপনাকে দেব ১ লাখ করে টাকা দেব

ঘটনাটা কবে বা কোথায় ঘটেছিল তা জানা নেই আমাদের। হয়তো কোনদিনই ঘটেনি, সেটাই অবশ্য বেশি সম্ভব। কিন্তু সত্যিই হোক আর কল্পনাই হোক, এই মজার গল্পটা শোনার মতো।

এক কোটিপতি তো খুব খুশি হয়ে ঘরে ফিরল। একটি লোকের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। তার মতে, এই দেখা হওয়াটা ভবিষ্যতে খুবই লাভজনক হয়ে দাঁড়াবে।

বাড়ির লোকদের সে বলল, কপালখানা দেখ তো! লোকে যে বলে সৌভাগ্য শুধু পয়সাওয়ালাদের জন্য, ঠিকই। অন্তত আমার ভাগ্যে তো কিছুটা ফলেছে কথাটা। ব্যাপারটা ঘটল একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে! বাড়িতে আসছি, এমন সময় দেখা হলো একটা অতি সাধারণ লোকের সঙ্গে, হয়তো লক্ষ্যই করতাম না তাকে আমি। কিন্তু আমার পয়সাকড়ি আছে শুনে সে একটা প্রস্তাব করল। আর সেই প্রস্তাবটা শুনে, আমার তো দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়।

লোকটা বলল, ‘আসুন একটা চুক্তি করা যাক, পুরো এক মাস প্রতিদিন আমি আপনাকে দেব ১ লাখ করে টাকা দেব। পরিবর্তে আমারও নিশ্চয়ই কিছু চাই। অবশ্য সেটা প্রায় কিছুই না!’

‘প্রথম দিন আমাকে যা দিতে হবে সে একটা তামাশা মাত্র, শুধু একটা পয়সা। আমি তো আমার কান দুটো বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।’ জিজ্ঞেস করলাম, মাত্র একটা পয়সা?

সে আবার বলল, ‘মাত্র একটা, দ্বিতীয় দিনের ১ লাখ টাকার জন্য অবশ্য দিতে হবে ২ পয়সা।’

আমার আর তর সইছিল না, জিজ্ঞেস করলাম, ‘তারপর, তারপর কত দিতে হবে?’

আজ্ঞে, তৃতীয়বার ১ লাখ টাকার জন্য আপনি আমাকে দেবেন ৪ পয়সা, চতুর্থবারে দেবেন ৮ পয়সা, পঞ্চমবারে ১৬ পয়সা। এইভাবে প্রতিদিন আপনি আমাকে আগের দিনের ডবল পয়সা দেবেন।

‘তারপর?’

ব্যস, ‘শুধু এই। এর বেশি আর কিছু চাইব না আমি। আপনি শুধু এই শর্তটাই মেনে চলবেন। প্রতিদিন আমি আপনাকে ১ লাখ টাকা এনে দেব, প্রতিদিন আপনি আমাদের কথামতো টাকাটা দিয়ে দেবেন। একটা শর্ত আছে শুধু, মাস শেষ না হলে কিন্তু লেনদেন বন্ধ করা চলবে না।’

পয়সার জন্য লোকটা লাখ লাখ টাকা দিয়ে দিচ্ছে। লোকটা হয় জালিয়াত, নয়ত পাগল। তা যাই হোক, ব্যবসাটা কিন্তু লাভের। সুযোগটা তো ছাড়া চলবে না।

আমি বললাম, ‘আচ্ছা বেশ, টাকাটা নিয়ে এসো, যা চাইছ তাই দেব আমি। দেখ বাবা, ঠকিও না কিন্তু জাল নোট দিও না যেন।’

লোকটা বলল, ‘ভাববেন না। কাল সকালেই আসব আমি।’

আমার শুধু এই ভয় যে লোকটা হয়তো আসবে না। সে হয়তো বুঝতে পেরেছে যে একটা বোকার মতো কাজ করে ফেলেছে সে। আচ্ছা দেখা যাক, আগামী কালের তো দেরি নেই আর।

আরও পড়ুন
ধনী লোকটি উঠে, আরও ভাল করে দরজাগুলো এটে দিল; বারবার জানালা খুলে দেখতে লাগল, আর একটু শব্দ হলেই ঘাবড়ে গিয়ে লাফিয়ে উঠতে লাগল, ঘুম এল না অনেকক্ষণ। ভোরে জানালায় একটা টোকা পড়ল। সেই লোকটা এসেছে।

দুই

পরদিন খুব ভোরেই জানালায় টোকা পড়ল। সেই অচেনা লোকটা এসেছে।

সে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার কোপেক ঠিক করে রেখেছেন তো, আমার কথামতো টাকাটা নিয়ে এসেছি আমি।’

সত্যিই তাই, ঘরে ঢুকেই একটা টাকার বান্ডিল বের করল সে। ঠিক ১ লাখ টাকা গুনল, তারপর বলল: ‘এই হলো আমাদের কথামতো টাকাটা। এখন আমার কোপেকটা দিয়ে দিন।’

টেবিলের ওপর একটা তামার মুদ্রা রাখল কোটিপতি। তার হৃদয় এখন গলার কাছে ধুকপুক করছে, হঠাৎ যদি মত বদলায় লোকটা, যদি হঠাৎ ফেরত চেয়ে বসে টাকাটা! লোকটা মুদ্রাটাকে হাতের তালুতে নিয়ে ওজন করে দেখল, তারপর রেখে দিল ব্যাগের ভেতর।

‘কালও এই সময়েই আসছি আমি। পয়সা দুটো তৈরি রাখতে ভুলবেন না।’

পকেটে আরও ১ লাখ টাকা এল। ধনী লোকটির তো আনন্দ আর ধরে না। এবার কিন্তু লোকটিকে আর ডাকাত বলে মনে হলো না।

সেই ধনী লোকটি তো তার সৌভাগ্যকে বিশ্বাসই করতে পারল না। ১ লাখ টাকা কি আকাশের চাঁদ হাতে নিয়ে এল! টাকাটা গুনলে সে, সব ঠিক আছে, কোন জাল নোট-টোট নেই দেখে আশ্বস্ত হল। তারপর খুশি মনে টাকাটা সরিয়ে রেখে আগামী দিনের কথাটা ভাবতে লাগল।

রাতের বেলা আবার দুশ্চিন্তা শুরু হলো। লোকটা যদি কোন ছদ্মবেশী ডাকাত হয়? কোটিপতি তার ধনরত্ন কোথায় রাখে তাই দেখার জন্যই যদি এসে থাকে, হয়তো পরে ডাকাতি করবে।

ধনী লোকটি উঠে, আরও ভাল করে দরজাগুলো এটে দিল; বারবার জানালা খুলে দেখতে লাগল, আর একটু শব্দ হলেই ঘাবড়ে গিয়ে লাফিয়ে উঠতে লাগল, ঘুম এল না অনেকক্ষণ। ভোরে জানালায় একটা টোকা পড়ল। সেই লোকটা এসেছে। আরও ১ লাখ টাকা গুনে দিয়ে কথামতো দুটি পয়সা নিয়ে ব্যাগে পুরে বেরিয়ে গেল সে।

বলে গেল, ‘কাল চার পয়সা তৈরি রাখতে ভুলবেন না।’

পকেটে আরও ১ লাখ টাকা এল। ধনী লোকটির তো আনন্দ আর ধরে না। এবার কিন্তু লোকটিকে আর ডাকাত বলে মনে হলো না। আসলে, কোটিপতি লোকটিকে আর সন্দেহজনক বলেই মনে হলো না। শুধু কয়েকটা পয়সা চায়, পাগল নাকি! আহা পৃথিবীতে যদি আরও কিছু এমন লোক থাকত, চালাক লোকেরা বেশ থাকত, তাহলে...

তৃতীয় দিনেও ঠিকমতো এল লোকটি। কোটিপতিও এবার ৪ পয়সার বদলে পেল ১ লাখ টাকা দিল।

পরদিন আরও ১ লাখ টাকা এল, বদলে দিতে হলো ৮ পয়সা।

পঞ্চম বারে ১ লাখ টাকার জন্য ধনী লোকটি দিল ১৬ পয়সা। আর ষষ্ঠ বারের জন্য দিল ৩২ পয়সা।

প্রথম সাত দিনে কোটিপতি পেল ৭ লাখ টাকা, আর তার জন্য তার খরচা হল অতি সামান্য:

১+২+৪+৮+১৬+৩২+৬৪ = ১ টাকা ২৭ পয়সা।

এটা লোভী লোকটার খুব মনমতো হলো। শর্তটা এক মাস মাত্র চলবে। এই একটামাত্র দুঃখ থাকল তার। মানে হল মাত্র ৩০ লাখ টাকা পাবে সে। সময়টা অন্তত আরও ১৫ দিন বাড়াবার জন্য লোকটার সঙ্গে কথা বলবে নাকি? না, বাবা, না বলাই ভালো। লোকটা হয়তো তাহলে বুঝে ফেলবে যে টাকাটা সে শুধু শুধুই দিয়ে দিচ্ছে...

এখন থেকে সে যা পাচ্ছিল তার থেকে অনেক বেশি দিতে হচ্ছিল তাকে। এখনই তার থামা দরকার।

এর ভেতর সেই অচেনা লোকটা কিন্তু প্রতি সকালেই ১ লাখ টাকা নিয়ে আসতে লাগল। আট দিনের দিন সে পেল ১ টাকা ২৮ পয়সা, নবম দিনে ২ টাকা ৫৬ পয়সা, দশম দিনে দিন দিন ৫ টাকা ১২ পয়সা, ১১ দিনে ১০ টাকা ২৪ পয়সা, ১২ দিনে ২০ টাকা ৪৮ পয়সা, ১৩ দিনের দিন ৪০ টাকা ৯৬ পয়সা, ১৪ দিনের দিন ৮১ টাকা ৯২ পয়সা পেল।

ধনী লোকটি সঙ্গে সঙ্গে মিটিয়ে দিত টাকাটা। কমবেশি ১৫০ টাকার বদলে সে ১৪ লাখ টাকা পেয়েছে।

কিন্তু তার আনন্দ স্থায়ী হলো না। অল্প দিনেই সে দেখতে পেল কারবারটাকে প্রথমে সে যতটা লাভজনক ভেবেছিল, ততটা নয়। ১৫ দিন বাদেই তাকে আর পয়সা নয়, কয়েক শো টাকা দিতে হলো। তারপর থেকেই দেবার অঙ্কটা তাড়াতাড়ি বাড়তে লাগল। আসলে তাকে যা দিতে হল তা এই:

পনেরো বারে ১ লাখের জন্য… ১৬৩.৮৪ টাকা

ষোলো বারে ১ লাখের জন্য… ৩২৭.৬৮ টাকা

সতেরো বারে ১ লাখের জন্য… ৬৫৫.৩৬ টাকা

আঠারো বারে ১ লাখের জন্য...... ১,৩১০.৭২ টাকা

উনিশ বারে ১ লাখের জন্য .........২,৬২১.৪৪ টাকা

এখনও ক্ষতি হচ্ছিল না তার। ৫ হাজার টাকার বেশি দিতে হয়েছে তাকে, কিন্তু তার বদলে সে কি ১৮ লাখ টাকা পায়নি? লাভের অঙ্কটা কিন্তু প্রতিদিনই ধাপে ধাপে নেমে যাচ্ছিল। এরপর ধনী লোকটিকে যা দিতে হল তা হচ্ছে:

বিশ বারে ১ লাখের জন্য ……৫,২৪২.৮৮ টাকা

একুশ বারে ১ লাখের জন্য.......১০,৪৮৫.৭৬ টাকা

বাইশ বারে ১ লাখের জন্য........২০.৯৭১.৫২ টাকা

তেইশ বারে ১ লাখের জন্য …….৪১,৯৪৩.০৪ টাকা

চব্বিশ বারে ১ লাখের জন্য.......৮৩,৮৮৬.০৮ টাকা

পচিশ বারে ১ লাখের জন্য .........১,৬৭,৭৭২.১৬ টাকা

ছাব্বিশ বারে ১ লাখের জন্য.......৩,৩৫,৫৪৪.৩২ টাকা

সাতাশ বারে ১ লাখের জন্য ……..৬,৭১,০৮৮.৬৪ টাকা

টেবিলের ওপর একটা তামার মুদ্রা রাখল কোটিপতি। তার হৃদয় এখন গলার কাছে ধুকপুক করছে, হঠাৎ যদি মত বদলায় লোকটা, যদি হঠাৎ ফেরত চেয়ে বসে টাকাটা! লোকটা মুদ্রাটাকে হাতের তালুতে নিয়ে ওজন করে দেখল, তারপর রেখে দিল ব্যাগের ভেতর।

এখন থেকে সে যা পাচ্ছিল তার থেকে অনেক বেশি দিতে হচ্ছিল তাকে। এখনই তার থামা দরকার। কিন্তু চুক্তি ভাঙতে পারছে না সে। অবস্থা খারাপ থেকে আরও খারাপ হতে লাগল। খুব দেরি করেই সেই ধনী লোকটি বুঝতে পারল যে অপরিচিত লোকটি নির্দয়ভাবে বোকা বানিয়েছে তাকে, সে যা পেয়েছে তার থেকে অনেক অনেক বেশি দিতে হবে তাকে...

২৮ দিনের দিন ধনী লোকটিকে দশ লাখেরও বেশি টাকা দিয়ে দিতে হলো। তারপরের দুবারের টাকা একেবারে পথে বসিয়ে দিল তাকে। সে একেবারে আকাশ ছোঁয়া টাকা।

আঠাশ বারে ১ লাখের জন্য ........১৩,৪২,১৭৭.২৮ টাকা

উনত্রিশ বারে ১ লাখের জন্য.......২৬,৮৪,০৫৪.৫৬ টাকা

তিশ বারে ১ লাখের জন্য ..........৫৩,৬৮,৭০৯.১২ টাকা

আগন্তুক যখন শেষ বারের মতো চলে গেল, কোটিপতিকে তখন ৩০ লাখ টাকার বিনিময়ে দিতে হয়েছে ১ কোটি ০৭ লাখ ৩৭ হাজার ৪১৮ টাকা ২৩ পয়সা।

১ কোটি ১০ লাখ টাকার অল্প কিছু কম। আর এর শুরু হয়েছিল মাত্র এক পয়সা থেকে। অপরিচিত লোকটি যদি দৈনিক ৩ লাখ  টাকা করেও দিত, তাতেও তার এক পয়সাও ক্ষতি হত না।

আরও পড়ুন

তিন

গল্পটা শেষ করার আগে কোটিপতির লোকসান আরও তাড়াতাড়ি কিভাবে হিসেব করে বের করা যায়, অর্থাৎ তার দেওয়া টাকাগুলো তাড়াতাড়ি যোগ করার উপায় দেখাব তোমাদের:

১=১

২=১+১

৪=(১+২)+১

৮=(১+২+৪)+১

৩২=(১+২+৪+৮+১৬)+১ ইত্যাদি

আমরা দেখছি যে প্রতিটি সংখ্যা তার আগের সংখ্যাগুলোর যোগফলের চাইতে ১ বেশি। তাহলে যদি আমাদের সবগুলো সংখ্যা যোগ করতে হয়, যেমন ধরা যাক ১ থেকে ৩২,৭৬৮ পর্যন্ত, তখন শেষ সংখ্যার সঙ্গে  (৩২,৭৬৮) আমরা যোগ করব তার আগের সংখ্যাগুলোর যোগফল। এই আগের সংখ্যাগুলোর যোগফল হলো, সেই সংখ্যা থেকে ১ কম (৩২,৭৬৮ - ১)। উত্তর হল ৬৫,৫৩৫।

কোটিপতি শেষবার কত টাকা দিয়েছিল সেটা জানলে, এভাবে অঙ্ক কষেই সে মোট কত টাকা দিয়েছিল তা আমরা বের করতে পারি। সে শেষ যে টাকাটা দিয়েছিল তা হল ৫৩,৬৮,৭০৯ টাকা ১২ পয়সা।

তাহলে ৫৩,৬৮,৭০৯ - ১২ আর ৫৩,৬৮,৭০৯ - ১১ যোগ করলেই আমাদের উত্তরটা পেয়ে যাব:

১,০৭,৩৭,৮১৮.২৩ টাকা।

আরও পড়ুন