আমাদের মাত্রাজ্ঞান

প্রতীকী ছবি

ধাঁধা দিয়ে শুরু করা যাক। কাউকে যদি একটি ত্রিমাত্রিক গোলকের ভেতর ঢুকিয়ে চতুর্মাত্রিক জগতের মধ্য দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং ঠিক তখনই একটি পঞ্চম মাত্রার কাচের জার এসে তার মাথায় ভেঙে পড়ে, তখন কী হবে? চতুর্মাত্রার কিংবা পঞ্চম মাত্রার প্রাণী পৃথিবী দখল করতে চলে এসেছে-এ রকম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি তো অনেক পড়লাম। এবার দেখা যাক বাস্তব জগতের রথী-মহারথীদের মহাবিশ্বের মাত্রা নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত কৌতূহলের কারণ কী।

নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা দিয়ে খুব সহজেই বলা যেতে পারে স্থান ত্রিমাত্রিক। অর্থাৎ যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো কিছুর অবস্থান চিহ্নিত করার জন্য মাত্র তিনটি সংখ্যার প্রয়োজন-দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা। এটা টেবিলের ওপর রাখা ল্যাম্পের অবস্থানও হতে পারে অথবা পৃথিবী ও মঙ্গলের মাঝখানে মহাশূন্যের যেকোনো একটি বিন্দুও হতে পারে।

ফরাসি গণিতবিদ রেনে দেকার্তের তৈরি কার্তেসীয় স্থানাঙ্ক ব্যবস্থার সঙ্গে কমবেশি সবাই পরিচিত। একটি দ্বিমাত্রিক সমতলে দুটি পরস্পর লম্ব, যাদের ছেদবিন্দুর সাপেক্ষে অন্য যেকোনো বিন্দুর অবস্থান নির্ণয়ের জন্য মাত্র দুটি স্থানাঙ্ক দরকার-ভুজ ও কোটি। দেকার্তে লক্ষ করলেন, এই স্থানাঙ্ক ব্যবস্থা দিয়ে শুধু বিন্দুর অবস্থান নয়, যেকোনো জ্যামিতিক আকৃতিকে সমীকরণের মাধ্যমেও প্রকাশ করা সম্ভব। যেমন, মূল বিন্দুতে কেন্দ্রবিশিষ্ট একটি বৃত্তের সমীকরণ: x2+y2=r2

এখন যদি আরও একটি অক্ষ যোগ করে দেওয়া হয়? x,y,z এই তিনটি অক্ষ দিয়ে আগের সমীকরণের মতো খুব সহজেই একটি গোলকের পৃষ্ঠ বর্ণনা করা যাবে। x2+y2+z2=r2

অ্যারিস্টটলের এই ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে লেগেছে প্রায় দেড় হাজার বছর। মধ্যযুগের শেষের দিকে নতুন ধারণার উদ্ভব হয়, মহাবিশ্ব গঠনই হয়েছে ইউক্লিডীয় জ্যামিতি অনুসরণ করে।

এবার আরও একটি অক্ষ যোগ করব। এ তো ভীষণ বিপদ! বৃত্ত থেকে গোলক বানালাম, গোলক থেকে কী বানাব? একটি গোলক যদি চতুর্মাত্রিক স্থানে গিয়ে বসে থাকে তার অবস্থান নির্ণয় করা কি আদৌ সম্ভব? চতুর্মাত্রিক স্থান কেমন তাই তো কল্পনা করতে পারছি না। মজার ব্যাপার হচ্ছে চতুর্মাত্রিক স্থানে গোলকের অবস্থান কল্পনা হয়তো করা যাবে না, সমীকরণ কিন্তু ঠিকই লেখা যায়।

শুধু আরেকটি অক্ষ যোগ করার অপেক্ষা: x2+y2+z2+p2=r2

অর্থাত্ গাণিতিকভাবে গোলকটিকে যেকোনো মাত্রার স্থানে প্রকাশ করতে পারা যায়। মাত্রা একটি নতুন অক্ষ বৈ আর কিছু নয়। মজার ব্যাপার, মহাজ্ঞানী অ্যারিস্টটল মাত্রা দূরে থাক মহাশূন্য কিংবা শূন্যস্থানেই বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর মতে, টেবিলে যদি একটি কাপ রাখা থাকে এবং কাপটিকে বায়ু যদি চারপাশ থেকে ঘিরে রাখে, তাহলে কাপ আর বায়ুর মধ্যকার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সীমানাই হচ্ছে স্থান (Space)। মানে হলো বস্তু আছে বলেই স্থান আছে। স্থান বলতে আলাদা কিছু নেই।

অ্যারিস্টটলের এই ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে লেগেছে প্রায় দেড় হাজার বছর। মধ্যযুগের শেষের দিকে নতুন ধারণার উদ্ভব হয়, মহাবিশ্ব গঠনই হয়েছে ইউক্লিডীয় জ্যামিতি অনুসরণ করে। তাহলে মহাবিশ্বের যেকোনো বস্তুর অবস্থান বা গতিকে প্রকাশ করতে ইউক্লিডীয় জ্যামিতিই যথেষ্ট হওয়া উচিত। গিয়টো, পাওলো ইউকেলেও এবং পিয়েরো ডিলা ফ্রন্টসকার মতো শিল্পীরা এ ধারণার ওপর ভিত্তি করে দ্বিমাত্রিক কাগজে ত্রিমাত্রিক বস্তু আঁকার এক অভিনব কৌশল আবিষ্কার করেন। এই কৌশলের নাম পারসপেকটিভ অথবা জিওমেট্রিক ফিগারিং। এই দলে ছিলেন স্বয়ং গ্যালিলিও। তাঁর ধারণা ছিল স্থান হলো নিষ্ক্রিয়, বৈশিষ্ট্যহীন, একে ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করা যায় না। একে শুধু ইউক্লিডীয় জ্যামিতি দ্বারা বর্ণনা করা সম্ভব। তাঁর পারসপেকটিভ কৌশল অবলম্বন করে আঁকা বিখ্যাত ছবিতে প্রথমবারের মতো চাঁদের গভীরতা চিত্রায়ণ করা সম্ভব হয়। একইভাবে স্পেসের মধ্য দিয়ে একটি প্রাসের গতিবেগ কীভাবে গণিতের সূত্র মেনে চলে, এই বিষয়টিও ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হলেন। 

আরও পড়ুন
দেকার্তে লক্ষ করলেন, এই স্থানাঙ্ক ব্যবস্থা দিয়ে শুধু বিন্দুর অবস্থান নয়, যেকোনো জ্যামিতিক আকৃতিকে সমীকরণের মাধ্যমেও প্রকাশ করা সম্ভব
নিউটনিয়ান পদার্থবিজ্ঞানে মহাকর্ষ বলকে যেখানে আলাদা করে ব্যাখ্যা করা লাগত, সেখানে সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুযায়ী বলা যায়, মহাকর্ষ বল স্পেসটাইমের জ্যামিতিক আকৃতিরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।

একটু লাফ দিয়ে চলে আসি বিংশ শতাব্দীতে। ১৯০৫ সালের দিকে আলবার্ট আইনস্টাইন নামের অখ্যাত এক ব্যক্তি দুম করে বলে বসলেন, মহাবিশ্ব তো চতুর্মাত্রিক, যার চতুর্থ মাত্রা সময়।

এর বছর দশেক পর এল তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতা। স্থানের সঙ্গে সময়কে সমন্বিত করে নতুন পদ এল স্থানকাল অথবা ঝঢ়ধপবঃরসব। মহাকর্ষ বলকে বললেন স্থানকালে বক্রতায় তৈরি ঢেউ, যা আলোর গতিতে এগিয়ে যায়। ধরা যাক, স্থানকাল টানটান করে রাখা একটি রাবারের পর্দা। এর ঠিক মাঝখানে লোহার বল রাখা হলো। লোহার বল যে জায়গায় রাখা হয়েছে, ঠিক সেই জায়গায় পর্দা একটু প্রসারিত হবে; উপরন্তু পর্দা যে যে জায়গায় টান খেয়েছে, ওই ওই জায়গায় কতগুলো রেখা দেখা যাবে। ওই রেখাগুলোকে কল্পনা করা যেতে পারে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ হিসেবে। নিউটনিয়ান পদার্থবিজ্ঞানে মহাকর্ষ বলকে যেখানে আলাদা করে ব্যাখ্যা করা লাগত, সেখানে সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুযায়ী বলা যায়, মহাকর্ষ বল স্পেসটাইমের জ্যামিতিক আকৃতিরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। বেশ কয়েক বছর পর পোলিশ গণিতবিদ থিওডোর কালুজার মাথায় নতুন এক চিন্তা এল। তিনি বললেন, একটি নতুন মাত্রা যোগ করে যদি মহাকর্ষ বল ব্যাখ্যা করা যায়, আরও একটি নতুন মাত্রা যোগ করলে না জানি কী হয়! যেই কথা সেই কাজ। আইনস্টাইনের সমীকরণে পঞ্চম মাত্রা যোগ করে অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, বিদ্যুত্চুম্বক বলকেও স্থানকালের জ্যামিতিক মডেল দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে।

সবই ঠিকঠাক, কিন্তু এই পঞ্চম মাত্রা আছে কোথায়? একে দেখা যায় না, উপলব্ধি করা যায় না, এর অস্তিত্ব শুধু সমীকরণে। সুইডিশ পদার্থবিদ অস্কার ক্লেইন খুব সুন্দরভাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে, মহাবিশ্বে তিনটি মাত্রা যেখানে সম্প্রসারিত হয়েছে, বাকি মাত্রাগুলো এত বেশি কুঁচকে আছে যে তা দেখা সম্ভব হচ্ছে না। এভাবে চিন্তা করা যাক, একটি কংক্রিটের দেয়াল অনেক দূর থেকে দ্বিমাত্রিক সমতল মনে হয়। একটু কাছে গেলে দেখা যাবে এরও বেধ বা পুরুত্বও আছে। আরও একটু কাছে গেলে দেখা যাবে দেয়ালের পৃষ্ঠে ত্রিমাত্রিক ফাটল কিংবা গর্ত আছে।

আবার ধরা যাক, লম্বা একটি দড়ির ওপর দিয়ে একটি পিঁপড়া হেঁটে যাচ্ছে। অনেক দূর থেকে দড়িকে একমাত্রার লম্বা এক লাইন মনে হতে পারে। কাছে গেলে দেখা যাবে আসলে অনেকগুলো একমাত্রার সুতা পাকিয়ে এই তিন মাত্রার দড়ি তৈরি করা হয়েছে। কুঁচকে থাকা অতিরিক্ত মাত্রা বোঝানোর জন্য ওপরের উপমা হয়তো যথেষ্ট নয় কিন্তু এতটুকু নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে, যা দেখা যায়, যা অনুভব করা যায় তার বাইরেও এক বিশাল জগত্ লুকিয়ে থাকতে পারে। ক্লেইন এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মাত্রার ব্যাস হিসাব করেছিলেন ১০-৩০সেমি। খুব সূক্ষ্ম মান, কারণ হাইড্রোজেন পরমাণুর ব্যাস এর চেয়ে অনেক অনেক অনেক বেশি- ১০-৮ সেমি!

আরও পড়ুন
হার্ভার্ডের পদার্থবিদ লিসা রেন্ডাল ও রমন সুন্দারাম বলেন আবার অন্য কথা। তাঁদের ‘মেমব্রেন’ থিওরি অনুযায়ী আমাদের চতুর্মাত্রার মহাবিশ্ব আসলে পঞ্চম মাত্রার কোনো বৃহত্তর স্পেসে সারিবদ্ধভাবে থাকা অসংখ্য মহাবিশ্বের একজন সদস্য মাত্র।

বিজ্ঞানীরা এখানেই ক্ষান্ত হলেন না। এবার পদার্থবিদেরা পাকড়াও করলেন দুর্বল নিউক্লীয় বল আর সবল নিউক্লীয় বলকে। দেখা গেল তাঁদেরও স্থানকালেই জ্যামিতিক মডেল দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। বেশি নয়, অতিরিক্ত পাঁচটি মাত্র মাত্রার দরকার পড়ে। তাহলে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা, সময়-এই ৪টি, তড়িৎ-চুম্বক বলের জন্য ১টি, দুর্বল আর সবল নিউক্লীয় বলের জন্য আর ৫টি-মাত্রা হলো মোট ১০টি। এই ধারণা থেকে উদ্ভব হলো স্ট্রিং তত্ত্বের। যদিও গণিতবিদ এডওয়ার্ড উইটেন তাঁর বিখ্যাত গ-থিওরিতে ১১ মাত্রার কথা বলেছেন, এখন পর্যন্ত বাস্তব জগতে এই অতিরিক্ত মাত্রার কোনোটিরই অস্তিত্ব প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। তাই বলে ১০ মাত্রার স্পেস দেখতে কেমন হবে তা নিয়ে জল্পনাকল্পনা শেষ হয়নি। একটি ঘনকের ছায়া দ্বিমাত্রিক কাগজের ওপর ফেললে যেমন বর্গ দেখতে পাওয়া যায়, তেমনিভাবে ১০ মাত্রার স্পেসের ছায়া দ্বিমাত্রিক তলে ফেললে অনেকটা এই লেখার শুরুর ছবির মতো দেখা যাওয়ার কথা।

হার্ভার্ডের পদার্থবিদ লিসা রেন্ডাল ও রমন সুন্দারাম বলেন আবার অন্য কথা। তাঁদের ‘মেমব্রেন’ থিওরি অনুযায়ী আমাদের চতুর্মাত্রার মহাবিশ্ব আসলে পঞ্চম মাত্রার কোনো বৃহত্তর স্পেসে সারিবদ্ধভাবে থাকা অসংখ্য মহাবিশ্বের একজন সদস্য মাত্র।

ক্যালটেকের জ্যোতিঃপদার্থবিদ সান ক্যারল সম্প্র্রতি বলেছেন, তাপমাত্রা যেমন বস্তুর কণাসমূহের গতিশক্তির ফলাফল, স্থান তেমনি মাইক্রোস্কোপিক লেভেলের কোয়ান্টাম তথ্যের ফলাফল। কোয়ান্টাম প্রেক্ষাপট থেকে, মহাবিশ্ব গাণিতিকভাবে ১০১০^১০০ মাত্রায় উন্নীত হতে পারে। ১০-এর পরে শূন্যের গুগল অথবা ১০ হাজার ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন শূন্য! যার প্রতিটি মাত্রাকে কোয়ান্টাম সমীকরণ দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব!

হয়তো এতক্ষণ যা কিছু বলা হলো তার সবই ভুল, হয়তো একসময় দেখা যাবে মাত্রা বলে কিছু নেই, অথবা একসময় লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারে অতিরিক্ত মাত্রা ধরা পড়বে, ত্রিমাত্রিক প্রাণীরা ১০ মাত্রার জগতে পা রাখবে, পা রাখার জায়গা যদি পাওয়া যায় আরকি। ওই জগত্ আমার-আপনার মতো ত্রিমাত্রিক প্রাণীর চোখে দেখতে কেমন হবে—ওই আলোচনা না হয় আরেক দিনের জন্য তোলা থাক।

লেখক: শিক্ষার্থী, তড়িৎকৌশল ও ইলেকট্রনিক প্রকৗশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: অ্যায়ন ডট সিও

*লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তার ২০১৮ সালের মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত