বিজ্ঞানী
মরিয়ম মির্জাখানি: ফিল্ডস পদকজয়ী প্রথম নারী
প্রথম নারী হিসাবে গণিতে ফিল্ডস পদক পেয়েছিলেন ইরানের গণিতবিদ মরিয়ম মির্জাখানি। আজ ১৪ জুলাই, তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী। এই দিনে জেনে নিন তাঁর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে...
১৯৮৮ সাল। দুই কিশোরীর হাতে আসে একটি জাতীয় গণিত অলিম্পিয়াডের প্রশ্ন। সেখানে মোট ছয়টি প্রশ্নের সমাধান করতে হয়। এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ছাত্রদের গণিতের দক্ষতা যাচাই করা হয়। ছাত্ররা বলছি, কারণ তখন অলিম্পিয়াডে শুধু ছাত্ররাই অংশগ্রহণ করতে পারত। ফলে অলিম্পিয়াড নিয়ে মেয়েদের মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু এই দুই কিশোরীর ইচ্ছা, তারা একটি হলেও প্রশ্নের সমাধান করবেন। দুজনে সবে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছে। তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্বও বেশ। বাসাও পাশাপাশি। দুজনে মিলে সেই প্রশ্নের সমাধান করার চেষ্টা করছেন। টানা দুই দিন খাটনি করে ওই সময়ের মধ্যে তিনটি প্রশ্নের সমাধান করে ফেলেন। খুশিতে দুই বন্ধু আত্মহারা। পরদিন দুজনে স্কুলের অধ্যক্ষ মিসেস হেরিজাদেহের দেখান সমাধানটা। আবদার করে তাদের যেন ছেলেদের মতো অলিম্পিয়াড প্রশিক্ষণ ক্লাসের সুযোগ দেওয়া হয়। তাঁদের কথা শুনে অধ্যক্ষ অত্যন্ত খুশি হন। সুযোগ করে দেন অলিম্পিয়াড প্রশিক্ষণ ক্লাসে।
জুলাই ১৯৯৪। হংকংয়ে অনুষ্ঠিত হয় ৩৫তম জাতীয় অলিম্পিয়াড। সে বছর ইরানের জাতীয় অলিম্পিয়াড দলে জায়গা পান দুই বান্ধবী। অলিম্পিয়াডের মোট পয়েন্ট ৪২। একজন পান ৪২-এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৪১। পান স্বর্ণপদক। ইরানের হয়ে প্রথম কোনো নারী আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে স্বর্ণপদক পান। সেই নারীর নামই মরিয়ম মির্জাখানি। আর তাঁর বান্ধবী রয়া বেহেস্তি? তিনিও পেয়েছিলেন রৌপ্যপদক। নম্বর পেয়েছিলেন ৩৫। পরের বছর মির্জাখানি আবার আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করেন কানাডায়। এবার ৪২ নম্বরে ৪২ পেয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন। মরিয়মের মৃত্যুর আগপর্যন্ত বেহেস্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল। বেহেস্তি বর্তমানে আমেরিকার ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের সহকারী অধ্যাপক।
মরিয়ম মির্জাখানি ১৯৭৭ সালের ১২ মে ইরানের তেহরানে জন্মগ্রহণ করেন। মরিয়মের বাবা আহমেদ মির্জাখানি একজন তড়িৎ প্রকৌশলী। তাঁর মায়ের নাম জাহরা হাঘিঘি। তাঁরা তিন ভাইবোন। আহমেদ মির্জাখানি সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করতেন, তাদের গণিত শিক্ষা দিতেন। ফলে শৈশবেই শুরু হয়েছিল মরিয়মের গণিত পাঠ। গল্পের বই পড়তেও ভালোবাসতেন কিশোরী মরিয়ম। আট বছর বয়সে একটি গল্পও লিখেছিলেন। গল্পের কাহিনি একটি মেয়েকে নিয়ে। মেয়েটি এমন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করে, যার সাহায্যে বিশ্ব ঘুরে দেখা যাবে। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হলে মরিয়ম তেহরানের ফারজানেগান বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। একবার গণিতে কম নম্বর পেয়েছিলেন। ফলে গণিতের শিক্ষক তাঁকে ডেকে বললেন, গণিতে তোমার ভালো করার সম্ভাবনা কম। তুমি অন্য বিষয়ে আগ্রহী হলে আরও ভালো করতে পারবে। ফলে গণিতের প্রতি মরিয়মের আগ্রহ কমতে শুরু করে। কিন্তু বছর শেষ হতেই বদল গণিতের শিক্ষক। নতুন শিক্ষক মরিয়মকে গণিতের প্রতি আগ্রহটাকে জাগিয়ে তোলেন। নতুন করে শুরু হয় মরিয়মের গণিতযাত্রা।
মরিয়ম প্রায়ই পুরোনো বইয়ের দোকানে ঢুঁ মারতেন। কম টাকায় কিনতেন পুরোনো বই। বিচিত্র সব বই পড়তেন। পড়তে পড়তে একদিন বিশ্বাস জন্মায় মরিয়মের, তিনি লেখক হবেন এবং তাঁর বই সারা বিশ্বের মানুষ পড়বে। বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন টেলিভিশন প্রোগ্রাম দেখতেন মরিয়ম। বিশেষ করে বিভিন্ন বিজ্ঞানী ও গণিতবিদের জীবনী। মরিয়ম মেরি কুরি ও হেলেন কেলারের জীবনী দেখে অনুপ্রাণিত হন।
১৯৯৫ সালে মির্জাখানি বৃত্তি পান। সেই টাকায় শরিফ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি থেকে গণিত নিয়ে পড়তে শুরু করেন। একই বছর ই এস মাহামুদিয়ানের সঙ্গে যৌথভাবে গণিতের ওপর একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। ১৯৯৬ ও ১৯৯৮ সালে ব্যক্তিগতভাবে আরও দুটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন মরিয়ম।
ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮। ইরানের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষার্থীরা একটি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। মরিয়ম তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৯৯ সালে শরিফ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি থেকে বিএস পাস করেন মরিয়ম।
এরপর মির্জাখানি যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। ভর্তি হন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে শিক্ষক হিসেবে পান গণিতবিদ কার্টিস ম্যাকমুলেনকে। ম্যাকমুলেনও ১৯৯৮ সালে ফিল্ডস পদক পেয়েছিলেন। ম্যাকমুলেন তখন অধিবৃত্তিক জ্যামিতি পড়াতেন। মরিয়ম এর কিছুই বুঝতেন না। কিন্তু তারপরও ক্লাসে যেতেন নিয়মিত। কারণ, অধিবৃত্তিক জ্যামিতির বিষয়বস্তু ভালো লেগেছিল তাঁর। ২০০৩ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় মরিয়মকে মেরিট ফেলোশিপ প্রদান করে। ২০০৪ সালে হার্ভার্ডেই পিএইচডি করেন। পিএইচডির জন্য ১৩০ পৃষ্ঠার একটি থিসিস জমা দিয়েছিলেন। থিসিসের বিষয়বস্তু ছিল অধিবৃত্তিক জ্যামিতি ও জিওডেসিক।
জিওডেসিক একধরনের জ্যামিতি। সাধারণ জ্যামিতি আঁকা হয় সমতলে বা দ্বিমাত্রিক তলে। কিন্তু জিওডেসিক হলো বক্রতল, অর্থাৎ ত্রিমাত্রিক কাঠামোতে আঁকা জ্যামিতি। এই জ্যামিতিতে সরলরেখাকে দেখতে বক্ররেখার মতো মনে হয়। আসলে সেগুলো সরলরেখা। দুটি বিন্দুর মধ্যে সবচেয়ে কম দূরত্বই সরলরেখা। সে ক্ষেত্রে আমরা সব সময় বিন্দু দুটিকে সমতলেই দেখি। মানে খাতায় আঁকি বা বোর্ডে, এগুলো তো আসলে সমতল। তাই সমতলের সরলরেখাকে সোজা দেখায়। কিন্তু আমরা যদি বক্রতলে দুটি বিন্দুর সর্বনিম্ন দূরত্ব যোগ করি, তাহলে কি সরলরেখা হবে না? সেটা সরলরেখা হবে। শুধু দেখতে বাঁকানো মনে হবে। এই ব্যাপারটিই হলো জিওসেডিক। এর একটা সহজ উদাহরণ দেওয়া যায়। যেমন পৃথিবীকে কেন্দ্র করে যে কাল্পনিক রেখাগুলো আঁকা হয়, সেগুলো কিন্তু সরলরেখা। দেখতে শুধু বাঁকানো মনে হয়।
মরিয়ম এই জিওডেসিক জ্যামিতি নিয়েই গবেষণা করেন। এই জ্যামিতিতে বিশেষ অবদানের জন্য ২০০৪ সালে তাঁকে হার্ভার্ড জুনিয়র ফেলোশিপের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু আরও ভালো পদের আশায় মরিয়ম তা গ্রহণ করেননি। একই বছর তিনি ক্লে রিসার্চ ফেলোশিপ লাভ করেন এবং প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে তিনি জ্যামিতিবিষয়ক আরও পাঁচটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। মির্জাখানির ক্লে রিসার্চ ফেলোশিপ শেষ হয় ২০০৮ সালে। মরিয়ম তখন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।
এ সময় মরিয়মের দেখা হয় এক কম্পিউটারবিজ্ঞানীর সঙ্গে। নাম জন ভনড্রেক। জন ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্টডক্টরাল পদে ছিলেন। দুজনের মন দেওয়া-নেওয়া হয়। তাঁরা বিয়ে করেন।
২০১৪ সালে মির্জাখানি প্রথম নারী হিসেবে ফিল্ডস পদক লাভ করেন। সে বছরই দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক গণিত ইউনিয়নের সভায় মরিয়মের হাতে তুলে দেওয়া হয় গণিতের নোবেলখ্যাত এই পুরস্কার। বক্রপৃষ্ঠের প্রতিসাম্যতার গবেষণার জন্য এই পদক পান তিনি।
২০১৩ সালে মরিয়মের স্তন ক্যানসার ধরা পড়ে। পরে এই ক্যানসার তাঁর লিভার ও হাড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৭ সালের ১৪ জুলাই ক্যালিফোর্নিয়ার একটি হাসপাতালে মৃত্যু হয় মরিয়ম মির্জাখানির।
মাত্র ৪০ বছর বেঁচে ছিলেন তিনি। এই সময়ে পৃথিবীকে দিয়েছেন অনেক কিছু। উজ্জ্বল করেছেন গণিতকে। হাজার হাজার নারীকে করেছেন উৎসাহিত। মরিয়ম মির্জাখানি ছিলেন গণিতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। এই মে মাসেই জন্মেছিলেন মরিয়ম মির্জাখানি। তাই বিজ্ঞানচিন্তার পক্ষ থেকে এই মহীয়সী গণিতবিদের জন্য রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।