ফার্মার শেষ উপপাদ্য: সহজ সমস্যা, কঠিন সমাধান

ব্রিটিশ গণিতবিদ স্যার এন্ড্রু উইলস

কিছু গাণিতিক সমস্যা সেরা গণিতবিদদেরও শতাব্দীর পর শতাব্দী ভাবিয়েছে। কেউ কেউ সারা জীবন ব্যয় করেছেন মাত্র একটার সমস্যা সমাধানের জন্য। কিন্তু তারপরও মেলেনি সমাধান। সেই ১৭ শতকে ফরাসি আইনজীবী পিয়েরে দ্য ফার্মা এ্যারিথমেটিকা বইয়ের মার্জিনে এমন এক সমস্যার কথা লিখে যান, যা প্রমাণ করতে বড় বড় গণিতবিদদের ৩৫০ বছর সময় লেগেছে। ফার্মার দেওয়া সব উপপাদ্য প্রমাণ হয়ে গেলেও মার্জিনে লেখা এই একটি উপপাদ্য কোনোভাবেই প্রমাণ করা যাচ্ছিল না। তাই এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ফার্মার শেষ উপপাদ্য’।

ঘটনার শুরু ১৭ শতকে। এ সময় গণিত ও সংখ্যাতত্ত্বে প্রচুর অগ্রগতি হয়। মজার বিষয় হলো, এসব অগ্রগতির পেছনে পেশাদার গণিতবিদদের থেকে শৌখিন গণিতবিদদের অবদানই ছিল বেশি। এদের মধ্যে আবার কেউ কেউ ছিলেন অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী। তেমনি এক শখের গণিতবিদ ছিলেন পিয়েরে দ্য ফার্মা। পেশায় ছিলেন আইনজীবী। নিজের পেশাগত দায়িত্ব শেষ করার পর বাকি সময়টা গণিত ও সংখ্যাতত্ত্বের বিভিন্ন বই পড়ে কাটাতেন। ১৬৩৭ সালে এমনই এক রাতে তিনি গ্রিক গণিতবিদ ডায়োফান্টাসের এ্যারিথমেটিকা বইটি পড়ছিলেন। ফার্মা যে পৃষ্ঠাটি পড়ছিলেন, সেখানে আলোচনা ছিল ত্রয়ী সংখ্যা নিয়ে।

৩, ৪, ৫ হলো ত্রয়ী সংখ্যার একটি উদাহরণ। এ  সংখ্যাগুলোর মধ্যে বিশেষ একটি সম্পর্ক আছে। যেমন, ৩ + ৪ = ৫। তিনের বর্গ ৯, আর চারের বর্গ ১৬ যোগ করলে পাওয়া যায় ২৫। আর এই ২৫ হলো ৫ এর বর্গ। অর্থাৎ দুটি সংখ্যার বর্গ যোগ করলে যে সংখ্যাটি পাওয়া যাবে, তা আরেকটি সংখ্যার বর্গের সমান। খুঁজলে এমন আরও অনেক ত্রয়ী বর্গ সংখ্যা পাওয়া যাবে।

লিওনার্ড অয়লার ছিলেন ১৮ শতকের বিখ্যাত গণিতবিদ ও বিজ্ঞানী। অয়লার এতটাই মেধাবী ছিলেন যে, কোনো কাগজপত্র ছাড়াই তিনি জটিল সব সমস্যা সমাধান করে ফেলতেন মাথার মধ্যে!

কিন্তু ফার্মায় মাথায় তখন হঠাৎ এক নতুন চিন্তা এল। তিনি ভেবে দেখলেন, এই ত্রয়ী সংখ্যা শুধু বর্গের ক্ষেত্রেই পাওয়া যায়। সংখ্যার পাওয়ার বা ঘাত যদি ২-এর বেশি হয়, তাহলে আর এমন ত্রয়ী সংখ্যার দেখা মেলে না। তিনি সারা রাত অঙ্ক কষে দেখলেন, যদি সংখ্যার ঘাত ৩ বা তার বেশি হয়, তবে কোনো ত্রয়ী সংখ্যা পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু কয়েকটি অঙ্ক কষেই বলা যায় না, ‘এটি কখনো হতে পারে না!’ শুধু সুনির্দিষ্ট গাণিতিক প্রমাণ থাকলেই কোন সিদ্ধান্তকে উপপাদ্য বলে ঘোষণা করা যায়।

ফার্মা করলেন কি, যে এ্যারিথমেটিকা বইটি পড়ছিলেন, সেই বইয়ের মার্জিনে লিখে রাখলেন, ‘এই প্রতিপাদ্যটার সত্যি চমৎকার একটা প্রমাণ আমার কাছে আছে। কিন্তু এই মার্জিনের ক্ষুদ্র পরিসরে তা ধরবে না।’ বুঝতেই পারছেন, উপপাদ্যটি ফার্মা বলে গেলেও তার কোন প্রমাণ তিনি দিয়ে যাননি। ফার্মার উপপাদ্যটি যদি আমরা গাণিতিকভাবে লেখি তাহলে হবে, ‘xn + yn = zn’। সমীকরণটিতে ‘n’ এর মান ২ এর বেশি হলে কোনো সমাধান পাওয়া যাবে না।

ফার্মার এই উপপাদ্যটি ১৬৩৭ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই এর সমাধান নিয়ে মেতে উঠেন গণিতজ্ঞরা। কিন্তু সমস্যা হলো, সংখ্যার তো শেষ নেই। শেষ নেই ঘাতেরও। তা হলে কী করে বলা যাবে, ঘাত ৩ বা তার চেয়ে বেশি বড় হলেই আর কোনো ত্রয়ী সংখ্যা পাওয়া যাবে না? তবে কি একের পর এক সংখ্যা আর ক্রমশ বড় ঘাত নিয়ে খোঁজাখুঁজি চালাতে হবে? আসলে এভাবে কোন উপপাদ্য প্রমাণ করা যায় না। তাহলে বুঝতেই পারছেন, এই উপপাদ্য প্রমাণ করতে হবে যুক্তি বা গাণিতিক তত্ত্বের সাহায্যে। এভাবে প্রমাণ করলে নিশ্চিত হওয়া যাবে যে, ঘাত যদি ৩ বা তার বেশি হয়, তবে এমন সমীকরণের কোনো সমাধান নেই। কিন্তু দেখতে একদম সাদামাটা এই উপপাদ্যকে গাণিতিক তত্ত্বের সাহায্যে প্রমাণ করতে গিয়ে বিশ্বের বাঘা বাঘা গণিতবিদরাও কোনো সুবিধা করতে পারেননি।

লিওনার্ড অয়লার ছিলেন ১৮ শতকের বিখ্যাত গণিতবিদ ও বিজ্ঞানী। অয়লার এতটাই মেধাবী ছিলেন যে, কোনো কাগজপত্র ছাড়াই তিনি জটিল সব সমস্যা সমাধান করে ফেলতেন মাথার মধ্যে! তবে এমন অসাধারণ প্রতিভাও শুধু n=3 এর জন্য ফার্মার উপপাদ্য প্রমাণ করতে সক্ষম হননি। অয়লার থেকে শুরু করে, সোফি জার্মেইন, গুস্তাভ ডিরিশেট, আন্দ্রেঁ লেগেন্দ্রে, গ্যাব্রিয়েল লামে, তানিয়ামা-শিমুরা, আন্দ্রে ওয়ইল, গেরহার্ড ফ্রে, কেন রিবেটের মতো গণিতবিদরা এই উপপাদ্য প্রমাণের জন্য নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন। এদের কেউ উপপাদ্যটি প্রমাণ করতে না পারলেও, তাঁদের কাজের ফলে চূড়ান্ত প্রমাণের বিষয়ে ধাপে ধাপে অগ্রগতি হয়েছে। কেননা এই উপপাদ্যটি আসলে সরাসরি প্রমাণ করা যাচ্ছিল না। ওপরে যে তানিয়ামা-শিমুরার নাম লেখা হয়েছে, তাঁরা কিন্তু ফার্মার উপপাদ্য নিয়ে সরাসরি কাজ করেননি। তাঁরা গণিতের সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি শাখা—মডুলার ফর্ম ও উপবৃত্তাকার সমীকরণ নিয়ে কাজ করে গেছেন। তাঁরা এই দুটি ভিন্ন শাখার মধ্যে সম্পর্ক দেখিয়ে একটি গাণিতিক অনুমান (Conjecture) করেন। পরে গারহার্ড ফ্রে নামে এক জার্মান গণিতবিদ প্রমাণ করে দেখান ‘তানিয়ামা-শিমুরার অনুমান প্রমাণ করতে পারলে, ফার্মার শেষ উপপাদ্যও প্রমাণ করা যাবে।’

মাত্র দশ বছর বয়সে লাইব্রেরিতে একটি বই খুঁজে পান ব্রিটিশ গণিতবিদ স্যার এন্ড্রু উইলস। আর তাতেই প্রথমবারের মতো ফার্মার শেষ উপপাদ্যের সঙ্গে পরিচিত হন।

এত বড় বড় গণিতজ্ঞদের ব্যর্থতার পর অবশেষে ধরা পড়ে সাফল্য। ব্রিটিশ গণিতবিদ স্যার এন্ড্রু উইলস দিনের পর দিন চেষ্টা করে ১৯৯৩ সালে ফার্মার শেষ উপপাদ্যের সমাধানটি দাঁড় করান। এই উপপাদ্য প্রমাণ করার জন্য গণিতের নোবেলখ্যাত অ্যাবেল পুরস্কার পান ২০১৬ সালে। পুরস্কারের অর্থ হিসেবে তাঁকে দেওয়া হয় ৬০ লাখ নরওয়েজিয়ান ক্রোন।

সেই শৈশবে, মাত্র দশ বছর বয়সে লাইব্রেরিতে একটি বই খুঁজে পান তিনি। আর তাতেই প্রথমবারের মতো ফার্মার শেষ উপপাদ্যের সঙ্গে পরিচিত হন। তখন থেকেই উইলসের স্বপ্ন ছিল উপপাদ্যটি প্রমাণ করা। পরে তিনি গণিতের ওপর ডক্টরেট করে প্রফেসর হন। মূলত উপবৃত্তাকার সমীকরণের স্পেশালিস্ট ছিলেন! আর তানিয়ামা-শিমুরার অনুমানটিও ছিল এই উপবৃত্তাকার সমীকরণ নিয়ে। ফলে তার পক্ষে ফার্মার উপপাদ্য প্রমাণ করার কাজ অনেকটা সহজ হয়ে যায়। তিনি এটা প্রমাণ করার জন্য ঝুঁকি নিয়েছিলেন নিজের ক্যারিয়ার নিয়েও। সবকিছু থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। তাঁর নিরলস চেষ্টার ফলে ‘তানিয়ামা-শিমুরার’ অনুমান প্রমাণ করতে সক্ষম হন। ফলে প্রমাণ হয়ে যায় ফার্মার উপপাদ্যও।

পিয়ার রিভিউ কমিটিতে তাঁর প্রমাণ জমার দেওয়ার পর প্রাথমিক অবস্থায় একটি ত্রুটি ধরা পরলেও তিনি পরে সেটি শুধরে দেন। অবশেষে প্রমাণিত হয় ফার্মার শেষ উপপাদ্য।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক