প্রকৃতি সুন্দর, এ কথা সবাই জানে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রকৃতির অনেক সৌন্দর্যের ভিত দাঁড়িয়ে আছে গণিতের ওপর!
কখনো আনারসের স্পাইরাল (পাতার প্যাটার্ন) বা সূর্যমুখী ফুলের পাপড়ি খেয়াল করেছেন? এক টুকরা কলার ক্রস অংশগুলো গোনার চেষ্টা করুন অথবা একটি গোলাপ হাতে নিয়ে এর পাপড়িগুলো ভালো করে লক্ষ করুন। আপনার কাছে এগুলো এলোমেলো মনে হতে পারে, কিন্তু এর সংখ্যাগুলোর একটি নির্দিষ্ট ধারা আছে। এগুলো সাজানো থাকে ফিবোনাচ্চি ধারা অনুসারে।
ফিবোনাচ্চি ধারা
ফিবোনাচ্চি ধারায় প্রতিটি নতুন সংখ্যা (প্রথম দুটি ছাড়া) আগের দুটি সংখ্যার যোগফলের সমান। সুতরাং ১ ও ১-এর পরে
পরবর্তী সংখ্যা ২ (১+১)
তার পরেরটি ৩ (২+১)
এর পরেরটি ৫ (৩+২)
পরের সংখ্যাগুলো যথাক্রমে : ৮, ১৩, ২১, ৩৪, ৫৫, ৮৯, ১৪৪, ২৩৩, ৩৭৭,…
এই ধারার নাম রাখা হয়েছে ইতালিয়ান গণিতবিদ লিওনার্দো দ্য পিসার নামে। ১২০২ সালে লিওনার্দো এই ধারা প্রকাশ করেছিলেন তাঁর লাইবার আবাসি (Liber Abaci) বইয়ে। ফিবোনাচ্চি ছিল লিওনার্দোর ডাকনাম।
খরগোশের বাচ্চা উৎপাদনের হার গণনা করতে গিয়ে ফিবোনাচ্চি এই ধারা আবিষ্কার করেন। ফিবোনাচ্চি পরে দেখতে পান, ধারাটি সোনালি অনুপাত (গোল্ডেন রেশিও) মেনে চলে, যা গণিতে ফাই (φ) নামে পরিচিত। এর মান ১.৬১৮। ফিবোনাচ্চি ধারার যে কোনো সংখ্যাকে তার আগের ফিবোনাচ্চি সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে সব সময় ফাই-এর কাছাকাছি মান পাওয়া যায়। যেমন, ৮ ও ১৩ দুটি ক্রমিক ফিবোনাচ্চি সংখ্যা। সুতরাং ২১/১৩ = ১.৬১৫
দক্ষতাই সাফল্যের চাবিকাঠি
প্রকৃতিতে ফিবোনাচ্চি ধারার অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন, ঘৃতকুমারী গাছের পাতার বিন্যাস এবং সূর্যমুখী ফুলের বীজ লক্ষ করুন। এখানে ফিবোনাচ্চি ধারা দেখতে পাচ্ছেন? অবশ্যই ফিবোনাচ্চি ধারার সংখ্যাগুলো ওখানে আছে। আপনি একটা কলা দিয়েও এই পরীক্ষা করতে পারেন। আগেই এ ব্যাপারে বলা হয়েছে। এবার আপনি অন্যান্য ফল ও সবজির মধ্যে এই ধারা খুঁজে দেখতে পারেন।
প্রকৃতির এই ধারা ব্যবহার করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। অল্প জায়গায় সর্বাধিক সংখ্যক একই আকারের জিনিস ধরাতে চাইলে এই ধারা অনুসারে বসাতে হবে। সুতরাং সর্পিলাকার কাঠামো সবচেয়ে কার্যকর এবং দেখতেও সুন্দর।
একটি সর্বজনীন আইন
১৮৫৪ সালে জার্মান মনোবিজ্ঞানী অ্যাডলফ জেইসিং কঙ্কাল, স্নায়ু, স্ফটিক এবং শিল্পের অন্যান্য উদাহরণ লক্ষ করেন। তিনি ভাবতেন, ফিবোনাচ্চি ধারার কারণেই এই জিনিসগুলোর কাঠামো এত সুন্দর। তাঁর মতে, এসব জিনিসের মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু শিল্প, সাহিত্য—এমনকি সংগীতেও ফিবোনাচ্চি ধারা পাওয়া যায়। এই ধারা কি জেনেবুঝে ব্যবহার করা হয়েছে? এই ধারার কারণেই কি প্রকৃতি এত সুন্দর? কারণ যা–ই হোক, মনে রাখতে হবে, গণিতই বিজ্ঞানের প্যাটার্ন। আমরা তিনটি কারণে গণিত শিখি: গণনা, প্রয়োগ এবং অনুপ্রেরণা। এগিয়ে যান...মজা করুন এবং অনুপ্রাণিত হন।
ফিবোনাচ্চি সত্যি নাকি কল্পকাহিনি?
ফিবোনাচ্চি ধারা নিয়ে কিছু মিথ প্রচলিত আছে। বিভিন্ন খোলসযুক্ত সামুদ্রিক প্রাণী সর্পিলাকার হলেও, সেগুলো ফিবোনাচ্চি ধারা নয়। এমনকি সেগুলো সোনালি অনুপাত মেনেও হয় না।
ফিবোনাচ্চি সংখ্যাগুলো ব্যবহার করে বর্গক্ষেত্র তৈরি করা যায়। বর্গক্ষেত্রগুলো দিয়ে আবার তৈরি করা যায় আয়তক্ষেত্র। এর ভেতর যখন একটি সর্পিল নকশা আঁকা হয়, তখন দেখতে আরও সুন্দর লাগে। আপনি নিজেও এটি করে দেখতে পারেন।
যা যা লাগবে
ছক কাগজ, স্কেল, পেনসিল ও কম্পাস
১. ছক কাগজে ১ × ১ মাপের একটি বর্গ আঁকতে হবে।
২. এটির নিচে আবার একই মাপের আরেকটি বর্গ আঁকতে হবে।
৩. এর ডান দিকে ২ × ২ মাপের একটি বর্গ আঁকতে হবে।
৪. এর ওপরে ৩ × ৩ মাপের একটি বর্গ আঁকতে হবে।
৫. এরপর ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ৫ × ৫ মাপের একটি বর্গ আঁকতে হবে। কাগজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এভাবে বর্গ আঁকতে হবে।
৬. সর্বশেষ, সর্পিলাকার তৈরি করতে একটি কম্পাস ব্যবহার করতে হবে। কম্পাস ব্যবহার করে প্রতিটি বর্গের এক-চতুর্থাংশ বৃত্ত নিয়ে ছবির মতো আঁকতে হবে।
এখানে যে ছবিটি আঁকা হয়েছে, সেটাই ফিবোনাচ্চি ধারা। একটি বর্গের কেন্দ্র থেকে আরেকটি বর্গের কেন্দ্রের দূরত্ব ১.৬২ গুণ। কেন এ রকম হয়? ফিবোনাচ্চি ধারায় এর উত্তর পাওয়া যায়।
৫/৩= ১.৬৭
৮/৫= ১.৬০
১৩/৮= ১.৬৩
২১/১৩= ১.৬২
...........
শেষ পর্যন্ত সংখ্যাটি ১.৬২ থেকে কম হয়ে যায়। যাকে সোনালি অনুপাত বলে।
*লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তা ২০২২ সালের মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত