অঙ্কের খেলা – পর্ব ৫

মাথা খাটাতে কে না পছন্দ করে! আর গল্পোচ্ছলে মজার বুদ্ধির ব্যায়াম হলে তো কথাই নেই। এরকমই একটি বই ‘অঙ্কের খেলা’। এটি রুশ গণিতবিদ ইয়াকভ পেরেলমানের নামকরা বই ‘ফিগারস ফর ফান: স্টোরিজ, পাজলস অ্যান্ড কোনান্ড্রামস’-এর বাংলা অনুবাদ। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) প্রগতি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছিল বিমলেন্দু সেনগুপ্তের অনুবাদে। সম্পাদক ছিলেন নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা।

অঙ্কের মজার সব হেঁয়ালি, বুদ্ধির খেলাসহ মাথা খাটানোর মতো দারুণ সব ধাঁধা নিয়ে বইটি। মগজে শান দিতে যা অতুলনীয়। এ বই পড়ে দেশের অনেকে এককালে গণিতে আগ্রহী হয়েছে, সমস্যা সমাধান শিখেছে, মুগ্ধ হয়েছে, প্রেমে পড়েছে গণিতের। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে।

খাবার টেবিলে বুদ্ধির খেলা

গত পর্বের পরে

 ১২. হারানো সংখ্যা

তোমার বন্ধুদের কয়েকটা অঙ্কবিশিষ্ট একটা সংখ্যা লিখতে বলো। কিন্তু শেষের অঙ্ক শূন্য হলে চলবে না। ধরো, সংখ্যাটা হলো ৮৪৭। তাকে সংখ্যার তিনটা অঙ্ক পাশাপাশি যোগ করে যোগফল সংখ্যাটা থেকে বিয়োগ দিতে বলো। তাহলে ফলটা দাঁড়াবে: ৮৪৭ - ১৯ = ৮২৮। এই সংখ্যা থেকে যেকোনো একটি বাদ দিয়ে বাকি দুটি তাকে বলতে বলো। এখন যদিও তোমার আসল অঙ্ক বা সংখ্যাটার কিছু জানা নেই, তবু তাকে অঙ্কটা বলে দিতে পারবে। এটা কী করে ব্যাখ্যা করা যায়, বলো তো?

ব্যাপারটা খুব সহজ। তোমাকে যেটা করতে হবে, তা হলো: তোমার জানা দুটি অঙ্কের সঙ্গে এমন একটা অঙ্ক যোগ করতে হবে, যার সবচেয়ে কাছের সংখ্যাটা ৯ দিয়ে ভাগ দিলে মিলে যায়। উদাহরণ দিচ্ছি: যদি ৮২৮-এর ভেতর প্রথম অঙ্ক (৮) বাদ দিয়ে অন্য দুটি অঙ্ক—২ আর ৮ তোমাকে বলে, তাহলে তুমি সে দুটিকে যোগ করে পাবে ১০। ১০-এর পর সবচেয়ে প্রথমে যে সংখ্যাটা ৯ দিয়ে ভাগ করলে মিলে যায়, তা হলো ১৮। তাহলে সেই হারানো সংখ্যাটা হলো ৮।

সেটা আবার কী করে হয়? সংখ্যাটা যাই হোক না কেন, তা থেকে অঙ্কগুলোর যোগফল বিয়োগ করলে ফলটা সবসময়ই ৯ দিয়ে ভাগ করলে মিলে যাবে। আচ্ছা শতকের ঘরের অঙ্কটাকে ধরি। দশকের ঘরে ধরলাম ‘প’। ‘ফ’ আর ‘ব’-কে ধরলাম এককের কোঠায়। তাহলে এগুলো দিয়ে পুরো সংখ্যাটা হলো:

১০০প + ১০ফ + ব

এই সংখ্যা থেকে অঙ্কগুলোর মোট যোগফল প + ফ + ব বিয়োগ দিলে আমরা পাচ্ছি: ১০০প + ১০ফ + ব - (প+ফ+ব) = ৯৯প - ৯ফ = ৯(১১প+ফ)। আর ৯(১১প + ফ)-কে ৯ দিয়ে ভাগ করলে নিশ্চয়ই মিলে যাবে। তাহলে কোনো সংখ্যা থেকে তার অঙ্কগুলোর যোগফল বিয়োগ করলে ফলটা সবসময়ই ৯ দিয়ে বিভাজ্য হবে।

এমন হতে পারে যে দুটি অঙ্ক বলে দেবে, তাদের যোগফলই ৯ দিয়ে ভাগ যায় (যেমন ৪ আর ৫)। তাহলে দেখা যাচ্ছে, যে অঙ্কটা তোমার বন্ধু বাদ দিয়েছে, তা হয় ০ অথবা ৯। সেসব জায়গায় তোমাকে বলতে হবে, লুপ্ত সংখ্যাটা হলো ০ অথবা ৯।

এই খেলাটাই অন্য আরেকভাবে খেলা যায়। আসল সংখ্যা থেকে অঙ্কগুলোর যোগফল বিয়োগ দেওয়ার বদলে তোমার বন্ধুকে ওই অঙ্কগুলোকেই ইচ্ছেমতো অন্যভাবে সাজিয়ে বিয়োগ দিতে বলো। একটা উদাহরণ ধরা যাক। যদি সে সংখ্যাটা লেখে ৮,২৪৭। তাহলে ২,৭৪৮ বিয়োগ করতে পারে (নতুন করে সাজিয়ে সংখ্যাটা যদি প্রথম সংখ্যাটা থেকে বড় হয়ে যায়, তবে প্রথমটাকেই বিয়োগ দাও)। বাকিটা আগের মতোই করতে হবে: ৮,২৪৭ – ২,৭৪৮ = ৫,৪৯৯। এ থেকে বাদ দেওয়া অঙ্কটা যদি হয় ৪, তবে অন্য অঙ্ক তিনটা জেনে নিয়ে যোগ দিলে পাওয়া যাবে ২৩। এর সবচেয়ে কাছাকাছি যে সংখ্যাটা ৯ দিয়ে ভাগ করলে মিলে যায়, তা হলো ২৭। তাহলে লুপ্ত অঙ্কটা হলো ২৭ - ২৩ = ৪।

কার কাছে আছে?

এই বুদ্ধির খেলায় পকেটে রাখা চলে, এমন তিনটে জিনিস দরকার। একটা পেন্সিল, একটা চাবি আর একটা ছুরি, যা দিয়ে কলম কাটা যায়। আর একটা প্লেটে ২৪টা বাদাম টেবিলের ওপর রেখে দাও। দাবা বা পাশার ঘুটি অথবা দেশলাইয়ের কাঠি দিয়েও কাজটি বেশ চলতে পারে।

এই সব যোগাড়যন্তর শেষ করে তোমার তিন বন্ধুর প্রত্যেককে বলো ওই তিনটা জিনিস থেকে একটা করে নিয়ে পকেটে রাখতে। একজন নেবে পেন্সিল, একজন চাবি আর অন্যজন কলম কাটা ছুরি। ওরা এসব করার সময় তুমি কিন্তু সেখানে থাকবে না। তারপর ঘরে ফিরে এসে তুমি ঠিকঠিক বুঝে নাও, কোনটা কার কাছে আছে।

কীভাবে বুঝে ফেলবে, এবার সেই নিয়মটা বলি। তুমি ফিরে আসার পর (অর্থাৎ সবাই যখন জিনিসগুলো লুকিয়ে ফেলেছে) ওদের কাছে কিছু বাদাম রাখতে দাও। প্রথম বন্ধুকে দাও একটা, দ্বিতীয় জনকে দুটি আর তৃতীয় জনকে তিনটা। তারপর ওদের এভাবে আরও কিছু বাদাম নিতে বলে আবার সে ঘর ছেড়ে চলে যাও। যে পেন্সিল নিয়েছে, তাকে নিতে হবে সে যতটা পেরেছিল, ঠিক ততটা। যে চাবি নিয়েছে, সে নেবে তাকে যতটা বাদাম দেওয়া হয়েছিল তার দ্বিগুণ, আর যে কলম-কাটা ছুরি নিয়েছিল, তাকে নিতে হবে সে যতটা পেয়েছিল তার চারগুণ। বাকিগুলো প্লেটেই থাকবে। ওভাবে নেওয়া হয়ে গেলে ওরা ভেতরে ডাকবে তোমাকে। তুমিও ভেতরে ঢুকে প্লেটটার দিকে একবার তাকিয়েই কোন বন্ধুর পকেটে কী রয়েছে, বলে দেবে।

এটা আরও তাজ্জব খেলা। কারণ খেলাটা তুমি দেখাচ্ছ একেবারে একা, এমনকি কোনো সহকারীও নেই, যে চুপি চুপি ইশারা করতে পারে তোমাকে। কিন্তু সত্যি বলতে কী, এ ধাঁধাটায় কোনো কায়দা-টায়দা নেই। সবটাই হলো হিসেবের ব্যাপার। প্লেটটায় কটা বাদাম আছে, এটা দেখলেই বুঝে নিতে হবে তোমাকে, কে কোনটা নিয়েছে। সাধারণত একটা থেকে সাতটা পর্যন্ত বাদাম পড়ে থাকে। এর বেশি থাকে না। আর এই কটা তো একনজরেই গুণে ফেলতে পারবে। তাহলে কার কাছে কী আছে, সেটা কীভাবে জানা যাবে?

ব্যাপারটা খুব সোজা। তিনটে জিনিসকে যত ভিন্নভাবে রাখা যায়, তার প্রত্যেকটাতেই প্লেটের ওপর ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যার বাদাম পড়ে থাকবে। ব্যাপারটা কীভাবে হয়, দেখাচ্ছি।

তোমার তিনজন বন্ধুর নাম ধরো দাউদ, দেবু আর ফেলু। অথবা ছোট্ট করে বলা যায়, ‘দা’, ‘দে’ আর ‘ফে’। তিনটে জিনিসকে নাম দেওয়া হলো এভাবে: পেন্সিলটা ‘পে’, চাবিটা ‘চা’ আর ছুরিটা ‘ছ’। তিনটে জিনিস তিন বন্ধুর ভেতর ছড়িয়ে দেওয়া যায় মোটমাট ছয়ভাবে:

ওপরের ছকে মোট যে কয়টা ভাগ হওয়া সম্ভব, তা দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া আর কোনোভাবে ভাগ হওয়া সম্ভব নয়।

এবার তাহলে দেখা যাক, এক এক ধরনের ভাগ করলে প্রতিবারে কটা করে বাদাম পড়ে থাকে। দেখতে পাচ্ছ, সব বার আলাদা আলাদা সংখ্যক বাদাম পড়ে থাকছে। তাহলে কত বাকি আছে দেখেই তুমি সহজে ঠিক করতে পারবে, কার পকেটে কী আছে। তৃতীয়বারে আবার ঘর থেকে বের হবে, তোমার নোটবুকটা দেখবে:

এর ভেতরে ওপরের ছকটা তুমি আগেই লিখে রেখেছ (সত্যি বলতে কী, কেবল প্রথম আর শেষ সারিটাই তোমার দরকার হবে)। ছকটা মুখস্থ রাখা কঠিন। কিন্তু সত্যি বলতে কী, তার কোনো দরকারই নেই। ছকটাই জানিয়ে দেবে কোথায় কোন জিনিসটা আছে। উদাহরণ দিই। ধরা যাক, যদি প্লেটটায় পাঁচটা বাদাম পড়ে থাকে, তাহলে জিনিসগুলো ছড়িয়ে আছে ‘চা’ ‘ছু’ ‘পে’—এভাবে। তার মানে দাউদের কাছে চাবি, দেবুর আছে ছুরি, আর ফেলু নিয়েছে পেন্সিল। যদি ঠিকঠিক দেখাতে চাও, তাহলে তিন বন্ধুর কাকে কটা বাদাম দিয়েছিলে, তা মনে রাখতেই হবে (এটা করার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, বর্ণমালার অক্ষর অনুসারে যাওয়া। আর এখানে তা-ই করেছি আমরা)।

গত সংখ্যার উত্তর

আরও পড়ুন

১০. ডিসেম্বরের ধাঁধার উত্তর

আমাদের ক্যালেন্ডার এসেছে পুরনো রোমানদের কাছ থেকে। তাঁরা জুলিয়াস সিজারের আগ পর্যন্ত বছর শুরু করতেন মার্চ মাস থেকে। তখন ডিসেম্বর ছিল দশম মাস। নববর্ষ যখন ১ জানুয়ারি থেকে শুরু করা হলো, মাসের নামগুলোকে কিন্তু আর পরিবর্তন করা হয়নি। এ জন্য মাসের সংখ্যা আর তাদের নামের অর্থে অমিল রয়ে গেছে।

১১. অঙ্কের খেলার সমাধান

প্রথম সংখ্যাটা থেকে কী দাঁড়াল দেখা যাক। শুরুতে সংখ্যাটার পাশে ঠিক ওই সংখ্যাটাই লেখা হলো। তার মানে হলো সংখ্যাটাকে ১ হাজার দিয়ে গুণ করে তার সঙ্গে প্রথম সংখ্যাটা যোগ করলে যা হয় তাই। যেমন:

৮,৭২,৮৭২ = ৮,৭২,০০০ + ৮৭২

তাহলে এটা পরিষ্কার হলো যে, আমরা আসলে প্রথম সংখ্যাটাকে ১০০১ দিয়ে গুণ করেছি। তারপর এটাকে পরপর ৭, ১১ আর ১৩ দিয়ে ভাগ করেছি, অথবা ৭ × ১১ × ১৩, অর্থাৎ ১০০১ দিয়ে ভাগ করেছি—তাই না?

তাহলে, আমরা প্রথমে সংখ্যাটাকে ১০০১ দিয়ে গুণ করেছি, পরে সেটাকে ১০০১ দিয়ে ভাগ করেছি। জলবৎ তরলং নয় কি?