অঙ্কের খেলা - পর্ব ১

মাথা খাটাতে কে না পছন্দ করে! আর গল্পোচ্ছলে মজার বুদ্ধির ব্যায়াম হলে তো কথাই নেই। এরকমই একটি বই অঙ্কের খেলা। এটি রুশ গণিতবিদ ইয়াকভ পেরেলমানের নামকরা বই ফিগারস ফর ফান: স্টোরিজ, পাজলস অ্যান্ড কোনান্ড্রামস-এর বাংলা অনুবাদ। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) প্রগতি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছিল বিমলেন্দু সেনগুপ্তের অনুবাদে। সম্পাদক ছিলেন দ্বিজেন শর্মা।

অঙ্কের মজার সব হেঁয়ালি, বুদ্ধির খেলাসহ মাথা খাটানোর মতো দারুণ সব ধাঁধা নিয়ে বইটি। মগজে শান দিতে যা অতুলনীয়। এ বই পড়ে দেশের অনেকে এককালে গণিতে আগ্রহী হয়েছে, সমস্যা সমাধান শিখেছে, মুগ্ধ হয়েছে, প্রেমে পড়েছে গণিতের। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে।

খাবার টেবিলে বুদ্ধির খেলা

অঙ্গসজ্জা: ভ করল্‌কোভ

বৃষ্টি পড়ছে। বিশ্রাম ভবনে দুপুরবেলায় সবে খেতে বসেছি আমরা। এমন সময় আমাদের ভেতর একজন জানতে চাইল, তার ভোরবেলার ঘটনাটা আমরা সবাই শুনতে চাই কি না। আমরা তো সব্বাই রাজি। সে শুরু করল।

১. জংলা জমির কাঠবিড়ালী

‘একটা কাঠবিড়ালীর সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে ভারি মজার ব্যাপার ঘটেছে। জঙ্গলের সেই গোলাকার ফাঁকা জায়গাটা তো চেন তোমরা সবাই—মাঝখানে যার একটামাত্র বার্চ গাছ। এই গাছটাতেই একটা কাঠবিড়ালী লুকিয়ে বেড়াচ্ছিল আমার কাছ থেকে। সবে একটা ঝোপ থেকে বেরিয়েছি, দেখি গাছের গুড়িটার পেছন থেকে ওর নাক আর চকচকে দুটো ছোট চোখ উঁকি মারছে। ক্ষুদে প্রাণীটাকে দেখতে ইচ্ছে হলো। তাই গোল জমিটার কিনারা বরাবর চক্কর দিতে লাগলাম। যাতে ভয় না পেয়ে যায়, তাই খেয়াল করে একটু দূরে দূরেই থাকতে হলো। পুরো চারবার ঘুরে এলাম, কিন্তু ক্ষুদে শয়তানটা সন্দেহমাখা দৃষ্টি নিয়ে দূরে গাছের পেছনদিকে হটে যেতে লাগল। অনেক চেষ্টাচরিত্তির করেও ওর পিঠটা দেখতে পেলাম না।’

‘কিন্তু তুমিই তো বললে এইমাত্র যে গাছটাকে চারবার চক্কর দিয়েছ,’ প্রশ্ন করল শ্রোতাদের একজন।

‘গাছের চারপাশে ঠিকই, কিন্তু কাঠবিড়ালীকে ঘিরে তো নয়!’

‘কিন্তু কাঠবিড়ালীটা তো গাছের ওপরই ছিল, তাই না?’

‘তাতে কী?’

‘তার মানেই হলো তুমি কাঠবিড়ালীটাকেও ঘুরে এসেছ।’

‘বা রে! ওর পিঠটাই দেখতে পেলাম না, আর তুমি বলছ ওর চারপাশে ঘুরে এলাম?’

‘ঘুরে আসার সঙ্গে পিঠের আবার কী সম্পর্ক? গোল জমিটার মাঝখানের গাছটায় ছিল কাঠবিড়ালী। সেই গাছটার চারপাশে ঘুরে এলে তুমি। তার মানেই হলো কাঠবিড়ালীর চারপাশে তুমি ঘুরে এলে।’

'অঙ্কের খেলা' বাংলা অনুবাদের প্রচ্ছদ

‘আরে না, তা নয়। ধরো, তোমার চারপাশে ঘুরছি আর তুমিও এমনভাবে ঘুরছ, যাতে তোমার মুখটাই দেখতে পাচ্ছি কেবল। তার মানে তোমাকে ঘিরে প্রদক্ষিণ করা হলো বলতে চাও?’

‘নিশ্চয়ই, তা ছাড়া আর কী?’

‘তার মানে, তোমার পেছনদিকে কোনো সময়ই পৌঁছতে পারলাম না বা তোমার পিঠটাও দেখতে পেলাম না, তবু তোমাকে ঘুরে আসা হয়ে গেল?’

‘পিঠ-টিঠ ভুলে যাও! আমার চারধারে ঘুরে এলে, এটাই বড় কথা। পিঠের জন্য কী ঠেকে থাকছে?’

‘থামো বাবা, প্রদক্ষিণ করা কাকে বলে, বলো তো? এটাকে আমি যেভাবে বুঝি, তা হলো, কোন জিনিসের চারপাশে এমনভাবে ঘুরে আসা, যাতে সে জিনিসটাকে সব দিক থেকে দেখতে পাওয়া যায়। ঠিক বলিনি, প্রফেসর?’ আমাদের খাবার টেবিলে একজন বৃদ্ধের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল সে।

অধ্যাপক উত্তর দিলেন, ‘তোমাদের সমস্তটা আলোচনা আসলে একটিমাত্র শব্দকে নিয়ে। ‘প্রদক্ষিণ’ শব্দের সংজ্ঞা সম্পর্কে প্রথমে একমত হতে হবে তোমাদের। কোনো কিছুর চারপাশে প্রদক্ষিণ করা বলতে কী বোঝ তোমরা? কথাটা থেকে দুই ধরনের অর্থ বোঝায়। প্রথমটা হলো, একটা বৃত্তের মাঝখানে থাকা কোনো জিনিসকে ঘুরে আসা। দ্বিতীয়টা হলো, জিনিসটার চারপাশে এমনভাবে ঘোরা, যাতে তার সব দিকটাই দেখতে পাওয়া যায়। যদি প্রথম অর্থটাই ধরতে চাও, তাহলে কাঠবিড়ালীকে চারবার ঘোরা হয়েছে তোমার। যদি দ্বিতীয় অর্থটা মেনে নাও, তাহলে কাঠবিড়ালীর চারপাশে মোটেই ঘোরা হয়নি। তোমরা দুজনে যদি একই ভাষায় কথা বলো, আর শব্দগুলোকে একইভাবে মানে করে নাও, তাহলে সত্যি বিতর্কের আর কোনো প্রয়োজন থাকে না।’

‘আচ্ছা, মেনে নিলাম কথাটার দুটো অর্থই হয়। কিন্তু এর ভেতর সঠিক কোনটা?’

‘এভাবে প্রশ্ন করাটা তো ঠিক হয়নি তোমার। যেকোনোটাকেই মেনে নিতে পারো তোমরা। কথাটা হলো, দুটোর ভেতর সাধারণত কোন অর্থটাকে মেনে নিই আমরা? আমার মতে, প্রথমটা। কেন, তা বলছি। তোমরা জানো, সূর্য নিজের চারপাশে পুরো পাক খেয়ে আসে ২৫ দিনের একটু বেশি সময়ে...’

‘সূর্যও ঘোরে নাকি?’

‘নিশ্চয়ই, ঠিক পৃথিবীর মতোই ঘোরে। একটা উদাহরণ দিচ্ছি। মনে করো, এতে সূর্যের ২৫ দিনের বদলে লাগছে ৩৬৫ (৩৬৫.২৫) দিন, অর্থাৎ পুরো এক বছর। ঘটনাটা যদি এমন দাঁড়ায়, তাহলে পৃথিবী থেকে সূর্যের একটা দিক, অর্থাৎ মুখটাই কেবল দেখা যাবে। তবু কেউ কি জোর করে বলতে পারত যে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে না?’

‘ঠিক, এতক্ষণে বুঝলাম আমি কাঠবিড়ালীর চারপাশেই ঘুরে এসেছি তাহলে।’

আমাদের একজন সঙ্গী চেঁচিয়ে উঠল, ‘ভাই, আমার একটা কথা আছে। বৃষ্টি পড়ছে, কেউই বাইরে বের হচ্ছি না। তাহলে, সবাই মিলে ধাঁধার খেলা চালানো যাক। কাঠবিড়ালীর ধাঁধাটা দিয়ে বেশ শুরু করা গেছে। এসো, আমরা সবাই কিছু বুদ্ধি বৃদ্ধির খেলা বের করি। প্রফেসর হবেন আমাদের প্রধান বিচারক।’

‘বীজগণিত বা জ্যামিতির ব্যাপার-ট্যাপার থাকলে আমি কেটে পড়ছি,’ বলল এক তরুণী।

‘আমিও!’ তার সঙ্গে সুর মেলাল আরেকজন।

‘না, সব্বাইকেই খেলতে হবে! অবশ্য কথা দিচ্ছি, খুব সোজা আর সাধারণ নিয়মগুলো ছাড়া বীজগণিত বা জ্যামিতির ভেতর যাব না আমরা।

‘আপত্তি আছে কারও?’

‘না-না,’ সবাই চেঁচিয়ে উঠল একসঙ্গে, ‘তাহলে শুরু করা যাক!’

ইংরেজি অনুবাদ বইয়ের প্রচ্ছদ

২. স্কুলের চক্র

একজন তরুণ পাইওনিয়র শুরু করল, ‘আমাদের স্কুলে পড়াশুনোর বাইরে পাঁচটা চক্র আছে। এগুলো হলো ফিটারের কাজ শেখার, কাঠের কাজ শেখার, ফটোগ্রাফি শেখার, দাবাখেলা শেখার আর সমবেত সঙ্গীত শেখার চক্র। ফিটারের কাজ শেখার চক্রের অধিবেশন হয় একদিন অন্তর, কাঠের কাজ শেখার চক্রের প্রতি তৃতীয় দিনে, ফটোগ্রাফি শেখার চক্রের প্রতি চতুর্থ দিনে, দাবা খেলোয়াড়দের প্রতি পঞ্চম দিনে আর সমবেত সঙ্গীত চক্রের প্রতি ষষ্ঠ দিনে। ১ জানুয়ারিতে প্রতিটি চক্রের প্রথম অধিবেশন হলো। তারপর থেকে নিয়ম মতো প্রত্যেকের বৈঠক হতে থাকল। প্রশ্ন হলো, প্রথম তিন মাসে মোট কতবার সব চক্রই একই দিনে সভা করেছিল (১ জানুয়ারি বাদ দিয়ে)?’

‘বছরটা কি লিপইয়ার (অধিবর্ষ)?’

‘উঁহু।’

‘তাহলে প্রথম তিন মাসে মোট ৯০ দিনই ছিল?’

‘ঠিক ধরেছ।’

অধ্যাপক কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বললেন, ‘আরও একটা প্রশ্ন জুড়ে দিচ্ছি এর সঙ্গে। সেটা হলো: প্রথম তিন মাসে মোট কতদিন কোনো দলেরই বৈঠক হয়নি?’

‘তাহলে নিশ্চয়ই একটা ফাঁকি আছে এর ভেতরে? পাঁচটি চক্রের সবারই বৈঠক হবে—এমন আর কোনো সন্ধ্যেবেলা আসবে না, বা একেবারেই কোনো বৈঠক হবে না—এমন সন্ধ্যেবেলাও পাওয়া যাবে না। এ তো পরিষ্কার!’

‘কেন?’ জিজ্ঞেস করলেন অধ্যাপক।

‘তা জানি না, তবে একটা ফাঁকির গন্ধ পাচ্ছি যেন!’

‘এটা কোনো যুক্তি নয়। সন্ধ্যেবেলা দেখা যাবে আপনার পাওয়া গন্ধটা ঠিক কি না। এবার আপনার পালা!’

এ খেলার কথাটা যে তুলেছিল, সে বলল, ‘জবাব এখন বলা হবে না। বেশ কিছু সময় নিয়ে ভাবব আমরা। রাতে খাবার সময় সব উত্তর জান্য যাবে।’

আপনারাও উত্তরটা ভাবুন। নিজে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করুন। তবে আপনাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না। সমাধান দেখতে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করলেই হবে।

(চলবে...)

টিকা ১: মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার মতে, সূর্য প্রায় ২৭ দিনে একবার নিজ অক্ষের চারপাশে ঘুরে আসে।