মাথা ঘামানো জ্যামিতি

মাথা খাটাতে কে না পছন্দ করে! আর গল্পোচ্ছলে মজার বুদ্ধির ব্যায়াম হলে তো কথাই নেই। এরকমই একটি বই অঙ্কের খেলা। এটি রুশ গণিতবিদ ইয়াকভ পেরেলমানের নামকরা বই ফিগারস ফর ফান: স্টোরিজ, পাজলস অ্যান্ড কোনান্ড্রামস-এর বাংলা অনুবাদ। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) প্রগতি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছিল বিমলেন্দু সেনগুপ্তের অনুবাদে। সম্পাদক ছিলেন নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা।

অঙ্কের মজার সব হেঁয়ালি, বুদ্ধির খেলাসহ মাথা খাটানোর মতো দারুণ সব ধাঁধা নিয়ে বইটি। মগজে শান দিতে যা অতুলনীয়। এ বই পড়ে দেশের অনেকে এককালে গণিতে আগ্রহী হয়েছে, সমস্যা সমাধান শিখেছে, মুগ্ধ হয়েছে, প্রেমে পড়েছে গণিতের। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে।

এই পরিচ্ছেদের প্রশ্নগুলোর সমাধান করতে খুব ভাল জ্যামিতি জানার দরকার নেই। গণিতের এই বিভাগটি সম্বন্ধে প্রাথমিক জ্ঞান থাকলেই যে কেউ এগুলো করতে পারবে। এখানে যে এক সারি ধাঁধা দেওয়া হচ্ছে, একজন তা দিয়েই বুঝতে পারবে সত্যিই জ্যামিতি তার কিছু জানা আছে কি না। জ্যামিতিক আকৃতিগুলির বৈশিষ্ট্য জানাই আসল জ্ঞান নয়, জানতে হবে বাস্তব সমস্যায় সেটাকে কি করে কাজে লাগাতে হবে। যে লোক গুলি ছাড়তে জানে না, তার বন্দুক কোন কাজে লাগবে?

পাঠক, তোমরাই দেখ না, এই জ্যামিতিক চাঁদমারীতে কটা গুলিকে তোমরা ঠিক নিশানায় লাগাতে পার।

১. ঠেলাগাড়ি

গাড়ির সামনের চাকা পেছনেরটার চাইতে তাড়াতাড়ি ক্ষয়ে যায় কেন? 

ছবি ১: ঠেলাগাড়ির সামনের চাকা পেছনেরটার চেয়ে তাড়াতাড়ি ক্ষয়ে যায়

২. বিবর্ধক কাঁচের মধ্য দিয়ে

যে কাঁচ দিয়ে জিনিসকে চার গুণ বড় দেখায়, তার ভেতর দিয়ে দেখলে ১.৫ ডিগ্রি কোণকে কত বড় দেখাবে (২ নং ছবি)?

ছবি: ২

৩. ছুতোরের লেভেল

তোমরা বোধহয় ছুতোরদের লেভেল যন্তরটা দেখেছ। এতে থাকে একটা কাঁচের নল আর তার ভেতরে একটা বুদ্বুদ (৩নং ছবি)! ঢালু জায়গায় বসালে এই বুদ্বুদটা কেন্দ্র থেকে দূরে সরে যায়। জায়গাটা যত ঢালু হবে, বুদ্বুদটাও মাঝের দাগ থেকে তত বেশি দূরে সরে যাবে। এটা যে নড়ে বেড়ায় তার কারণ হলো নলের ভেতরকার তরল পদার্থের থেকে হাল্কা হওয়াতে এটা ওপরের দিকে চলে আসে। যদি টিউবটা সোজা হতো, তাহলে বুদ্বুদটা নলের শেষ প্রান্তে চলে আসত। অর্থাৎ সেটাই হতো সবচেয়ে উঁচু জায়গা। এই ধরনের ‘লেভেল’ হলে খুব অসুবিধে হতো, তা তো দেখতেই পাচ্ছ তোমরা। এ জন্যই নলটা বাঁকানো থাকে এবং ৩নং ছবিতে এটাই দেখানো হয়েছে। ‘লেভেল’ যদি সমতল ক্ষেত্রের ওপর থাকে, তাহলে বুদ্বুদটা নলের মাঝে, সবচেয়ে উঁচু অংশে চলে আসে। যদি লেভেলটা ঢালুর ওপর থাকে, তখন এর সবচেয়ে উঁচু অংশ আর কেন্দ্র না হয়ে একটু দূরে সরে যায় আর বুদ্বুদটাও কেন্দ্রের দাগ থেকে নলের অন্যপ্রান্তে চলে যায়।*

ছবি: ৩

প্রশ্নটা হলো, যদি লেভেলটা ০.৫ ডিগ্রি ঢালুর ওপর থাকে, আর বাঁকা নলের ব্যাসার্ধ হয় ১ মিটার, তাহলে বুদ্বুদটা কেন্দ্রের দাগ থেকে কত মিলিমিটার সরে যাবে?

* ‘দাগটা বুদ্বুদ থেকে সরে যায়’ এ কথা বলা আরও সঠিক হবে, কারণ বুদ্বুদটা আসলে নিজের জায়গাতেই থাকে। আর নল ও দাগটাই সরে যায়।

সমাধান

১. প্রথম দেখায় মনেই হবে না যে ধাঁধাটায় কোনো জ্যামিতির ব্যাপার আছে। কিন্তু জ্যামিতি জানা মানুষ সহজেই বুঝতে পারবে যে, এর ভেতরে সবটা বিবরণের আড়ালে একটা জ্যামিতির সূত্র লুকিয়ে আছে। আসলে এটা একটা জ্যামিতির সমস্যা। জ্যামিতিকে বাদ দিয়ে এর কোনো সমাধান সম্ভব নয়।

প্রশ্নটা ছিল, গাড়ির সামনের চাকা কেন পেছনের চাকার চেয়ে তাড়াতাড়ি ক্ষয়ে যায়? সাধারণত দেখতে পাবে গাড়ির সামনের চাকাগুলো পেছনের চাকার চেয়ে ছোট। জ্যামিতি থেকে পাচ্ছি যে একই দূরত্ব যেতে একটা ছোট পরিধির গোলককে একটা বড় পরিধির গোলকের চেয়ে বেশী ঘুরতে হয়। আর এ তো খুবই স্বাভাবিক যে সামনের চাকাটা যত বেশি ঘুরবে, তার চাকাও তত তাড়াতাড়ি ক্ষয়ে যাবে।

ছবি: ৪

২. তোমরা যদি মনে করে থাক যে বিবর্ধক কাঁচের জন্য কোণটা বেড়ে ১.৫ × ৪ = ৬ ডিগ্রি হয়েছে, তাহলে খুব ভুল করছ। বিবর্ধক কাঁচ কোণের পরিমাপ বাড়ায় না। এটা সত্যি যে, কোণ-মাপক চাপের দৈর্ঘ্য বেড়ে যাবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে এর ব্যাসার্ধও সমান অনুপাতে বাড়বে। ফলে কেন্দ্রীয় কোণের পরিমাপের কোন পরিবর্তন হবে না। ৪নং ছবি থেকে এটা ভালো বোঝা যাবে।

ছবি: ৫

৩. ৫নং ছবিতে লেভেলের চাপের প্রাথমিক অবস্থা হলো চ ক ছ। চ' খ ছ' হলো পরিবর্তিত অবস্থা। এদের জ্যা চ' ছ' এবং চ ছ ১/২ ডিগ্রি কোণ তৈরি করেছে। বুদ্বুদটা প্রথমে ছিল ক-তে এবং এখনো ঠিক সেখানেই আছে। কিন্তু চ ছ চাপের মধ্যবিন্দ সরে গেছে খ-তে। আমাদের এখন ক খ চাপের দৈর্ঘ্য বের করতে হবে। এর ব্যাসার্ধ হল ১ মিটার আর কোণের মাপ হল ১/২ ডিগ্রি। (এ রকম হওয়ার কারণ হচ্ছে, লম্ব বাহু, দুটোর অন্তর্বর্তী সুক্ষ্ম কোণের হিসেব করছি আমরা।)

এখন হিসেব করতে আর কোনো সমস্যা নেই। ব্যাসার্ধ ১ মিটার (১০০০ মিলিমিটার) হলে পরিধি হবে ২ × ৩.১৪ ×১০০০ = ৬২৮০ মিলিমিটার। একটি পুরো পরিধিতে আছে ৩৬০০ ডিগ্রি বা ৭২০টি অর্ধ ডিগ্রি, তাহলে এক্ষেত্রে ১/২ ডিগ্রিতে পরিধির দৈর্ঘ্য হবে ৬২৮০: ৭২০ = ৮.৭ মিলিমিটার।

সুতরাং দাগ থেকে বুদ্বুদটি সরে যাবে (আসলে দাগটিই বুদ্বুদ থেকে সরে যাবে) প্রায় ৯ মিলিমিটার। এও বোঝা যাচ্ছে যে নলের বক্রতার ব্যাসার্ধ যত বাড়বে, লেভেলটিও ততই সূক্ষ্ম কাজের উপযুক্ত হবে।