দাবাখেলার গাণিতিক কাহিনি

মাথা খাটাতে কে না পছন্দ করে! আর গল্পোচ্ছলে মজার বুদ্ধির ব্যায়াম হলে তো কথাই নেই। এরকমই একটি বই অঙ্কের খেলা। এটি রুশ গণিতবিদ ইয়াকভ পেরেলমানের নামকরা বই ফিগারস ফর ফান: স্টোরিজ, পাজলস অ্যান্ড কোনান্ড্রামস-এর বাংলা অনুবাদ। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) প্রগতি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছিল বিমলেন্দু সেনগুপ্তের অনুবাদে। সম্পাদক ছিলেন নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা।

অঙ্কের মজার সব হেঁয়ালি, বুদ্ধির খেলাসহ মাথা খাটানোর মতো দারুণ সব ধাঁধা নিয়ে বইটি। মগজে শান দিতে যা অতুলনীয়। এ বই পড়ে দেশের অনেকে এককালে গণিতে আগ্রহী হয়েছে, সমস্যা সমাধান শিখেছে, মুগ্ধ হয়েছে, প্রেমে পড়েছে গণিতের। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে।

খাবার সময় সেসার কথা মনে পড়ল রাজার। সেই ‘বেকুব’ আবিষ্কারক তার নগণ্য পুরস্কার পেয়ে গেছে কি না জিজ্ঞেস করলেন তিনি

দাবাখেলা—পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো খেলার একটা। খেলাটা আবিষ্কার হয়েছে বহু শতাব্দী আগে। সুতরাং এর সম্বন্ধে যে অনেক কাহিনী থাকবে তাতে আর আশ্চর্য কী। আর কাহিনীগুলোর বেলায় যা হয়, সেগুলোর সত্যি-মিথ্যা জানা অসম্ভব হয়ে ওঠে। এগুলোর একটা বলছি তোমাদের। গল্পটা বুঝতে অবশ্য দাবা খেলতে জানা দরকার নেই: একটা ছক-কাটা বোর্ডে ৬৪টা খোপ থাকে, এটুকু জানলেই চলবে।

 

এক

পুরাবৃত্ত বলে, দাবাখেলাটা এসেছে ভারতবর্ষ থেকে। একটা খেলায় যে কতরকম বুদ্ধির চাল দেওয়া যায় তা দেখে রাজা শেরাম খুব উৎসাহিত হয়ে উঠলেন।

এর উদ্ভাবক তাঁরই একজন প্রজা জানতে পেরে, এই অপূর্ব আবিষ্কারের জন্য পুরস্কার দেবেন ঠিক করে রাজা শেরাম তাঁকে তাঁর সামনে হাজির করতে আদেশ করলেন।

খুব সাদাসিধে পোশাক পরা এই লোকটির নাম ছিল সেসা। শিক্ষকতা করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তিনি। সেসা এসে উপস্থিত হলেন রাজার সামনে।

রাজা তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, ‘আপনার অদ্ভুত আবিষ্কারের জন্য পুরস্কার দিতে চাই আপনাকে।’

সেসা মাথা নুইয়ে নমস্কার জানালেন।

রাজা বললেন, ‘আপনার মনের যেকোনো কামনা পূর্ণ করার মতো ধনসম্পদ আমার আছে। কী চাই আপনার তাই শুধু বলুন, তাই দেব আপনাকে।’

সেসা নীরব রইলেন।

রাজা উৎসাহ দিয়ে বললেন, ‘লজ্জার কী আছে? বলুন না কী চাই আপনার। আপনার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করতে কোন ত্রুটিই হবে না।’

পণ্ডিত উত্তর করলেন, ‘মহারাজ, আপনার দয়ার সীমা নেই, কিন্তু একটু ভাবতে সময় দিন আমাকে। ভালোভাবে চিন্তা করে কাল আমার প্রার্থনা জানাব আপনাকে।’

পরদিন অতি তুচ্ছ এক অনুরোধ জানিয়ে রাজাকে আশ্চর্য করে দিলেন সেসা।

তিনি বললেন, ‘প্রভু, দাবার ছকের প্রথম ছকটার জন্য এক দানা গম পেতে চাই আমি।’

‘সাধারণ এক দানা গম?’ রাজা যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।

‘হ্যাঁ প্রভু, দ্বিতীয়টার জন্য দুটো, তৃতীয়টার জন্য চারটে, চতুর্থটার জন্য আটটা, পঞ্চমটার জন্য ১৬টা, যষ্ঠটার জন্য ৩২টা...’

বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলেন রাজা, ‘আচ্ছা, আচ্ছা, দাবার ৬৪টা ছকের জন্যই আপনার ইচ্ছেমতো গমের দানা পাবেন আপনি। প্রতিদিন তার আগের দিনের চাইতে দ্বিগুণ, এই তো। কিন্তু জেনে রাখুন আপনার প্রার্থনাটা ঠিক আমার দেবার ইচ্ছের উপযুক্ত হলো না। এরকম একটা নগণ্য পুরস্কার প্রার্থনা করে আপনি আমাকে অসম্মান করলেন। সত্যি বলতে কি, একজন শিক্ষক হিসেবে রাজার উদারতাকে আরও একটু বেশি সম্মান দেখাতে পারতেন আপনি। আপনি যান! আমার ভৃত্যরা আপনার গমের থলি পৌঁছে দেবে।’

হেসে বেরিয়ে গেলেন সেসা। তারপর তোরণের কাছে তাঁর পুরষ্কারের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।

দুই

খাবার সময় সেসার কথা মনে পড়ল রাজার। সেই ‘বেকুব’ আবিষ্কারক তার নগণ্য পুরস্কার পেয়ে গেছে কি না জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

তাঁকে জানানো হলো, ‘প্রভু! আপনার আদেশ পালন করা হচ্ছে। কতগুলো গমের দানা তিনি পাবেন, তা পণ্ডিতরা হিসেব করছেন।’

রাজা ভুরু কোঁচকালেন। এত ধীরে ধীরে তাঁর আদেশ পালন করা হচ্ছে, এতে অভ্যস্ত ছিলেন না তিনি। রাতে শোবার আগে আবার জিজ্ঞেস করলেন তিনি, সেসাকে তাঁর গমের থলিটা দেওয়া হয়েছে কি না।

উত্তর শুনলেন, ‘প্রভু, আপনার হিসেবনবীশরা হিসাব করে চলেছেন একটানা, তাঁরা আশা করছেন সকালের আগেই হিসেবটা শেষ হবে।’

রেগে উঠে প্রশ্ন করলেন রাজা, ‘এরা এত দেরি করছে কেন? আমার ঘুম ভাঙার আগেই সেসাকে যেন কড়ায় ক্রান্তিতে সব শোধ করে দেওয়া হয়। একটা দানাও যেন বাকি না থাকে। আমি দুইবার আদেশ দিই না!’

সকালে রাজাকে বলা হল, ‘রাজসভার প্রধান হিসেবনবীশ দেখা করতে চেয়েছেন।’

রাজা তাঁকে আসতে আদেশ করলেন।

রাজা শেরাম প্রশ্ন করলেন তাঁকে, ‘আপনার দরকারী কথা শোনবার আগে, সেসাকে তাঁর প্রার্থনা মতো নগণ্য পুরস্কার দেওয়া হয়েছে কি না, সেটা জানতে চাই।’

বুড়ো পণ্ডিত উত্তর দিলেন, ‘সেজন্যই তো এত ভোরে আপনার সামনে আসতে সাহস করেছি। সেসার প্রার্থনা মতো গমের দানার সংখ্যাটা বের করতে একটানা খেটেছি আমরা। সে একটা বিরাট...’

অধৈর্য হয়ে তাঁকে বাধা দিলেন রাজা, ‘হিসেবটা যত বিরাটই হোক না কেন, আমার শস্যের গোলাগুলো থেকে সহজেই তা দেওয়া যাবে। তাঁকে এই পুরস্কার দেব কথা দিয়েছি। আর তা দিতেই হবে...’

‘মহারাজ, সেসার প্রার্থনা পূর্ণ করা আপনার ক্ষমতার বাইরে। সেসা যা চেয়েছেন তত দানা আপনার গোলায় নেই। আপনার সমস্ত রাজ্যেও ততটা দানা নেই। সত্যি বলতে কি, সারা পৃথিবীতেও নেই। যদি আপনার কথা রাখতেই হয় তাহলে সমস্ত সাগর ও মহাসাগরের জল ছেঁচে, উত্তরের মরুভূমিগুলোর তুষার আর বরফ গলিয়ে ফেলে সারা পৃথিবীর সমস্ত জমিতে গমের চাষ করতে আদেশ করুন। যদি এই সমস্তটা জমিতেই গমের আবাদ করা যায় তাহলে হয়তো সেসাকে দেওয়ার মতো গমের দানা পাওয়া যাবে।’

অবাক বিস্ময়ে পণ্ডিতের কথা শুনছিলেন রাজা।

‘কত দানা?’ চিন্তান্বিতভাবে বললেন তিনি। পণ্ডিত উত্তর করলেন, ‘মহারাজ, সংখ্যাটা ১,৮৪,৪৬,৭৪,৪০,৭৩,৭০, ৯৫,৫১,৬১৫।’

দ্বিতীয় ছকটির জন্য দুটি দানা দেওয়ার আদেশ করুন

তিন

গল্পটা হলো এই। সত্যিই এরকম ঘটেছিল কি না তা আমরা জানি না। কিন্তু পুরস্কারটা যে এইরকমই একটা সংখ্যায় দাঁড়াবে তা বোঝা কিছু কঠিন নয়। একটু ধৈর্য ধরে আমরাই হিসেবটা কষে ফেলতে পারি।

১ থেকে শুরু করে ১, ২, ৪, ৮ ইত্যাদি সংখ্যাগুলো যোগ করতে হবে। ২-এর ৬৩তম ঘাত যত সেটাই হল ৬৪তম ছকের জন্য আবিষ্কারকের প্রাপ্যের সমান। ২৬৪ থেকে ১ বিয়োগ করলেই খুব সহজে শস্যদানার সংখ্যাটা পেয়ে যাব আমরা। এর অর্থ হল ২-কে ২ দিয়ে ৬৪ বার গুণ করতে হবে:

২×২×২×২×২×২×… ইত্যাদি ৬৪ বার।

হিসেবের সুবিধার জন্য এই ৬৪টি উৎপাদককে আমরা ৬টা ভাগে ভাগ করব। প্রতিভাগে থাকবে ১০টা করে ২, সবচেয়ে শেষের ভাগে থাকবে ৪টা ২। ২১০-এর ফল হলো ১০২৪ আর ২৪ হলো ১৬। তাহলে যে

উত্তরটা আমরা চাই তা দাঁড়াচ্ছে:

১০২৪×১০২৪×১০২৪×১০২৪×১০২৪×১০২৪×১৬

১০২৪-কে ১০২৪ দিয়ে গুণ করলে আমরা পাই ১০,৪৮,৫৭৬।

এখন আমাদের বের করতে হবে,

১০,৪৮,৫৭৬ × ১০,৪৮,৫৭৬ × ১০,৪৮,৫৭৬ × ১৬

এর থেকে ১ বিয়োগ করলেই শস্যের এই সংখ্যাটা পেয়ে যাব আমরা:

১,৮৪,৪৬,৭৪,৪০,৭৩,৭০,৯৫,৫১,৬১৫

এই বিরাট সংখ্যাটা সম্বন্ধে ঠিকঠিক ধারণা করতে হলে ভেবে দেখ শস্যগুলো রাখতে কত বড় গোলার দরকার হবে? আমরা জানি যে এক ঘন মিটার গমের ভেতর থাকে ১,৫০,০০,০০০ দানা। তাহলে দাবাখেলা যিনি আবিষ্কার করেছিলেন তাঁর ইচ্ছেমতো পুরস্কারটা রাখতে হলে ১,২০,০০,০০,০০,০০,০০০ ঘন মিটার বা ১২,০০০ ঘন কিলোমিটারের কাছাকাছি আয়তনের গোলা দরকার। যদি এমন একটা গোলাঘর হয় যা ৪ মিটার উচু আর পাশে ১০ মিটার, তাহলে এর দৈর্ঘ্য হবে ৩০ কোটি কিলোমিটার, অর্থাৎ পৃথিবী থেকে সূর্যের যা দূরত্ব তার দ্বিগুণ।

রাজা সেসার প্রার্থনা রাখতে পারলেন না। কিন্তু অঙ্কে একটু মাথা থাকলেই তিনি এমন বিরাট পুরস্কার দেওয়াটাকে এড়িয়ে যেতে পারতেন। সেসাকেই একটা একটা করে দানা গুনে নিয়ে যেতে বললেই চলত। সত্যিই সেসা যদি সারা দিনরাত একেবারে না থেমে শস্যের দানা গুনে যেতেন, প্রতিটি দানা গুনতে যদি তাঁর সময় লাগত এক সেকেন্ড, তাহলে প্রথম দিনে তিনি গুনতেন ৮৬,৪০০টা দানা। দশ লক্ষ শস্যদানা ১০ দিনের কমে গুনতে পারতেন না। এক ঘন মিটারে যতটা গম ধরে তা গুনতে তাঁর লাগত প্রায় ছয় মাস। একবারও না থেমে ১০ বছর ধরে গুনে গেলে তিনি ৫৫০ বুশেল গোনা শেষ করতেন। তাহলে দেখতেই পাচ্ছ, সেসা যদি শস্য গোনার কাজে তাঁর জীবনের বাকি সবগুলো দিন লাগাতেন তাহলেও পুরষ্কারের একটা নগণ্য অংশই পেতেন তিনি।

‘অঙ্কের খেলা’ বই থেকে আরও পড়ুন