বিজ্ঞানচিন্তায় আপনাকে স্বাগত। কেমন আছেন?
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: আমি ভালো আছি। ধন্যবাদ।
দীর্ঘদিন বাংলাদেশে গণিত অলিম্পিয়াড করছেন। আইডিয়াটা কীভাবে মাথায় এল? কেন চাইলেন যে বাংলাদেশে এমন একটা অলিম্পিয়াড হওয়া উচিত?
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: কীভাবে মাথায় এসেছে, তা আসলে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমার বিশ্বাস, আমাদের অনেকেই এগুলো নিয়ে চিন্তা করেছেন। বাংলাদেশে ইতিবাচক সংস্কৃতির খুব অভাব। পড়ালেখায় উৎকর্ষ অর্জনের জন্য তেমন ব্যবস্থাও নেই।
আজ থেকে ১২৫ বছর আগে স্যার জগদীশচন্দ্র বসু রেডিও আবিষ্কার করেছিলেন। সারা পৃথিবীর অন্তত তিনজন আবিষ্কারকের একজন ছিলেন তিনি। কত বড় মাপের আবিষ্কার ছিল সেটা! মুন্সিগঞ্জের একজন বাঙালি সেটা করেছিলেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানে, এমনকি মহাপরাধীন ভারতবর্ষে আমাদের যে শ্রেষ্ঠত্ব ছিল, তা আমরা ভুলতে বসেছি। আরেকটা অনুপ্রেরণার কথা বলি। দুই বন্ধু সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও মেঘনাদ সাহা। সদ্য স্নাতক এই দুজন সেই সময় যথেষ্ট দুর্বোধ্য আইনস্টাইনের ‘আপেক্ষিকতা তত্ত্ব’ জার্মান ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। প্রশান্ত মহলানবিশের ঐতিহাসিক অবতারণিকাসহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ২০২০ সালে সেটা আবার প্রকাশ করেছে। ওটাই ছিল প্রথম ইংরেজি অনুবাদ। মজার বিষয় হলো, ইংরেজিতে অনুবাদের জন্য তো জার্মান ভাষা জানতে হবে। আবার আপেক্ষিকতা তত্ত্বও বুঝতে হবে ভালোভাবে। এটা মোটেও সহজ কাজ ছিল না। আর কোনো ইংরেজও তখন সে কাজ করেননি। এটাই ছিল বাঙালির শ্রেষ্ঠত্ব।
এখন আমাদের দেশে প্রকৃত পড়ালেখার আগ্রহ কমে আসছে। আগ্রহ বৃদ্ধির কোনো প্রণোদনাও নেই। তাই আমরা ভাবলাম, কিছু একটা করতে হবে, করা উচিত। তখন আমরা অনেকে গণিত অলিম্পিয়াডের কথা ভাবলাম। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড হয় প্রতিবছর। আমি যখন রাশিয়ায় পড়তাম, তখন বিভিন্ন বিষয়ে অলিম্পিয়াড হতো। গণিত অলিম্পিয়াড, পদার্থবিজ্ঞান অলিম্পিয়াড, রসায়ন অলিম্পিয়াড ইত্যাদি। এমনকি গণিতের শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, এমন অনেক অলিম্পিয়াডও আয়োজিত হতো। অন্যান্য বিষয়ের জন্যও এমন অলিম্পিয়াড হতো। সেটা আমাকে দারুণভাবে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। আমি দেশে আসার পরে একটু চেষ্টা করলাম অলিম্পিয়াড করার। তখন সফল হতে পারিনি। পরে মুহম্মদ জাফর ইকবাল দেশে এলেন। আসার সঙ্গে সঙ্গে ওনাকে কথাটা বললাম। উনি লুফে নিলেন।
আমরা দুজন মতি ভাইয়ের (প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান) অফিসে গেলাম। পুরো বিষয়টা ওনাকে বুঝিয়ে বললাম। মতি ভাই ঠান্ডা মাথার মানুষ। বললেন, ‘ঠিক আছে। আপনারা কী চান?’
তখন আমরা বললাম, সপ্তাহে চার-পাঁচটা গাণিতিক সমস্যা দেব, সেগুলো প্রথম আলোয় ছাপান। তারপর পত্রিকায় ছাপা হতে শুরু করল। জাফর ভাই (মুহম্মদ জাফর ইকবাল) ওটার নাম দিলেন ‘নিউরনে অনুরণন’। তখন মুনির হাসান (বর্তমানে গণিত অলিম্পিয়াডের সাধারণ সম্পাদক) এর পেছনে নামল। পরে দেখলাম, সমস্যাগুলো শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বড়রাও সমাধান করছে। এটা অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক ছিল। তারপর এক পর্যায়ে আমরা সরাসরি গণিত অলিম্পিয়াড আয়োজন করি। সেটা তখন কারওয়ান বাজারে সিএ ভবনের অডিটরিয়ামে হয়েছিল। কিন্তু এখন এটা অনেক বড় রূপ নিয়েছে। আমাদের সবার জন্য এটি অনেক উৎসাহব্যঞ্জক। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, ইনফরমেটিকস, রোবোটিকস অলিম্পিয়াড—প্রায় সবই এখন হচ্ছে।
একসময় গণিতের বইগুলো অনেক জটিল ছিল। পাতাগুলো ছিল নিম্নমানের। এখন গণিত বই রঙিন হওয়ার পাশাপাশি অনেক সহজ হয়েছে। এ পরিস্থিতিকে আপনি কীভাবে দেখেন? কিংবা এখানে আমাদের করার মতো আরও কিছু আছে কি না?
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: আমাদের পাঠ্যবইগুলোয় অনেক সমস্যা আছে। কারণ, খুব কম সময়ের মধ্যে বইগুলো তৈরি করা হয়েছে। বিশেষ করে শুরুর পর্যায়ের পাঠ্যবইগুলোয় অহরহ পরিবর্তন করার কোনো মানে নেই। অনেক পরিবর্তন করার মানে হচ্ছে, আমরা খুব বেশি সময় নিয়ে চিন্তাভাবনা করে বইটা তৈরি করিনি।
আমার মনে হয়, পাঠ্যবই রচনার জন্য গবেষণার সময় আরও বাড়ানো উচিত। এটা টেন্ডার দিয়ে করে লাভ নেই। আমাদের এটা বুঝতে হবে যে সম্পূর্ণ জাতির জন্য একটাই পাঠ্যবই। এ বইটা পড়ে জাতি শিক্ষিত হবে। কাজেই তাড়াহুড়া করে লাভ হবে না। ৫০ বছরে যেহেতু আমরা স্ট্যান্ডার্ড একটা পাঠ্যবই রচনা করতে পারিনি, সেহেতু আরও ১০ বছর লাগুক। এতেও কোনো সমস্যা নেই; বরং অনেকগুলো সুবিধা আছে। একটা ভালো পাঠ্যবই পাওয়া যাবে। সেটার আকার নিয়ে আমরা উচ্চবাচ্য করব না। আমাদের লক্ষ রাখতে হবে, পাঠ্যবই পড়ে যেন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের একজন শিক্ষার্থীও বুঝতে পারে এবং আনন্দ পায়। পড়ালেখার প্রতি যেন উৎসাহী হয়। কোনো স্কুলের শিক্ষক তেমন ভালো না হলেও যেন শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই পড়ে বুঝতে পারে, পড়ার প্রতি তাদের আগ্রহ জাগে। এটা বাস্তবায়ন হলে গোটা জাতির জন্য অসাধারণ একটা ব্যাপার হবে। এর জন্য বিনিয়োগ খুব বেশি বাড়াতে হবে না। প্রতি বইতে লেখকের জন্য আমরা ১ কোটি টাকা সম্মানী দিতে পারি। প্রতিবছর ২০ লাখ শিক্ষার্থী বইটি পড়লে, আর বইটি যদি ৩০ বছর ধরে পড়ানো হয়, তবে ৬ কোটি শিক্ষার্থী পড়তে পারবে। সে তুলনায় বারবার পাঠ্যপুস্তক নতুন করে ছাপালে বিনিয়োগও বেশি লাগে।
একটি চৈনিক প্রবাদ আছে, ‘এক বছরের জন্য বিনিয়োগ করতে চাইলে ফসল ফলাও, দশ বছরের জন্য বিনিয়োগ করতে চাইলে বৃক্ষরোপণ করো, কিন্তু শত বছরের কথা ভাবলে শিক্ষায় বিনিয়োগ করো।’ আমাদের শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করাটা খুব জরুরি। এটা এখনো পর্যাপ্ত গুরুত্ব পাচ্ছে না। এখন শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হলো জিডিপির ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ, যেখানে সুপারিশ হয় ৬ শতাংশ। শুধু যুদ্ধ-বিদ্ধস্ত বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে ৪ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। আমাদের শিক্ষার্থীদের বিশ্ব পর্যায়ে উন্নীত করতে হলে তাদের বিশ্ব মাপের শিক্ষাব্যবস্থা দিতে হবে।
আপনারা একসময় বিদেশে পড়াশোনা করেছেন। পরে দেশে ফিরে শিক্ষকতা, গবেষণা বা অন্য কাজে যুক্ত হয়েছেন। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের বেশির ভাগই বিদেশে পড়তে গেলে আর দেশে ফিরছে না। এটার কারণ কী বলে মনে করেন?
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: আমার দেশে ফেরার পেছনে মনে হয় না দেশপ্রেম বা অন্য কারণ ছিল। ভালো চাকরি পেলে হয়তো বিদেশে থেকে যেতাম। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা দেশে বিনা পয়সায় পড়াশোনা করে বিদেশে গিয়ে চাকরি করে। এতে খারাপ কিছু দেখি না। কেউ কেউ বিদেশে থাকতেই পারে। তার যদি দুর্বলতা থাকে, আবার দেশপ্রেম না থাকে, দেশে ঠিকঠাক সুযোগ-সুবিধা না পায়, তাহলে বিদেশে গিয়ে নিজের ভবিষ্যৎ তৈরি করলে তো তাকে দোষারোপ করতে পারি না।
ঢাকার চারপাশ দিয়ে যদি আমরা একটা গোলাকার জলাশয় তৈরি করতে পারতাম এবং তার চারদিক দিয়ে একটা রাস্তা হলে রাজধানীর জলবায়ু ও আবহাওয়া ভালো হতো। সেই পানিপথে অনেক নৌযান চলতে পারত। চিত্তবিনোদনের অনেক ব্যবস্থা হতো।
অনেকে তো একে এক মেধা পাচার বলে মনে করেন। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: এখন বিশ্বায়নের যুগ। একজনের পর্যাপ্ত বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ যদি দেশে না থাকে, তাকে তো দেশে থাকতে বলতে পারি না। একজন মানুষ শুধু দেশের নাগরিক নন, বিশ্ব নাগরিকও বটে। আমরা তো তাদের মেধার সম্মানটাও করতে পারছি না। তবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশপ্রেমের বীজ বপন করা গেলে ওরা কোনো না কোনোভাবে দেশকে সাহায্য করবেই, যেটা ভারতে হয়। বিদেশে থাকলেও তারা নানাভাবে ভারতকে সহযোগিতা করে। যেমন অনেক ছাত্রের জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করে। ভারতীয় একজন প্রফেসর আরেকজন প্রফেসরকে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে নেন। এ রকম বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাসহ নানাভাবে তাঁরা একজন অপরজনকে সাহায্য করেন। আমাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি এখনো এতটা এমন নয়। এমনটা হওয়ার জন্য আমাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে দেশপ্রেমের বীজ বপন করতে হবে। যেমন কোরিয়ায় দেশের জন্য সেবা দিতে হয়। বিভিন্ন দেশে এই নিয়ম চালু আছে। জাপানেও আছে। দেশসেবার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারলে আমাদের কিশোর-তরুণ-যুবকদের মধ্যে দেশের প্রতি মমত্ববোধ তৈরি হতো।
এ ধরনের উদ্যোগ খুব কঠিন নয়। ঢাকা শহরের চারদিকে প্রাকৃতিকভাবে জলাশয় ছিল। সেটা এখন নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক ক্ষমতাবান মানুষ এগুলো দখল করে নিয়েছেন। ঢাকার চারপাশ দিয়ে যদি আমরা একটা গোলাকার জলাশয় তৈরি করতে পারতাম এবং তার চারদিক দিয়ে একটা রাস্তা হলে রাজধানীর জলবায়ু ও আবহাওয়া ভালো হতো। সেই পানিপথে অনেক নৌযান চলতে পারত। চিত্তবিনোদনের অনেক ব্যবস্থা হতো। যাতায়াতব্যবস্থাও হতে পারত। চক্রাকার রাস্তা তৈরি করতে আমরা স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা নিতে পারতাম। হয়তো তারা মাটি তুলে দিতে পারত। মাটি তুললে মানুষ মারা যায় না। এর মাধ্যমে স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থীদের সরাসরি দেশপ্রেমের বোধটুকু তৈরিতে সহায়তা করতে পারতাম। রাজনৈতিক দলগুলোও এটা করে দেখাতে পারত। তাহলে দেশের প্রতি তাদের মমত্ববোধ আমরা উপলব্ধি করতে পারতাম। নানা জাতীয় দিবসেও আমরা ইতিবাচক সংস্কৃতি সূচনার মাধ্যমে, ছুটি ও ভোজনবিলাসে ব্যস্ত থেকে নয়, দেশের অগ্রগতিতে অবদান রাখতে পারতাম। প্রিয় নেতাদের জন্ম ও মৃত্যু দিবসকে কেন্দ্র করে দেশকে ছুটি ও ভোগের মাধ্যমে পেছনে ঠেলে দেওয়ার কোনো অর্থ নেই।
আমি রাশিয়ায় পড়ার সময় গ্রীষ্মের ছুটি ছিল চার মাস। এই চার মাসে শিক্ষার্থীরা সাইবেরিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেত শহর বানানোর জন্য। ওখানে যাওয়াটাই কঠিন, দুর্গম পথ। হয়তো সেখানে তারা রাস্তা তৈরি করত, রেলপথ তৈরি করত। নতুন করে একটা শহর গড়ে তুলত। আমার সহপাঠীরাও গর্ব করে বলত যে ওই শহরটা আমরা তৈরি করেছি। আমাদের এমনভাবে গর্ব করার কিছু নেই।
এবার জানতে চাই, আপনার শৈশব-কৈশোর সম্পর্কে জানতে চাই। জন্ম, কীভাবে বেড়ে উঠলেন—এসব।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: আমি মানিকগঞ্জের ছেলে। জন্মের সময় সেটা ঢাকা জেলা ছিল, মানিকগঞ্জ ছিল মহকুমা। এখন মানিকগঞ্জ জেলা হয়েছে। কালীগঙ্গা নদীর ওপর তরা ব্রিজ থেকে দুই কিলোমিটার দূরে নদীর পাড়ে আমার বাড়ি। অসাধারণ সুন্দর জায়গা ছিল। কালীগঙ্গা নদী তখন খুব প্রমত্ত। প্রায়ই নৌকাডুবি হতো। জাহাজডুবিও হতো। ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখার অনেক আগ্রহ ছিল। কিন্তু জীবনে যা হতে চেয়েছি, তা হতে পারিনি। পড়ালেখা করেছি জাবরা ১নং প্রি প্রাইমারি স্কুলে। তারপর সেখান থেকে মানিকগঞ্জ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়। কিছুদিন বানিয়াজুরী উচ্চবিদ্যালয়, অর্থাৎ গ্রামের যে উচ্চবিদ্যালয়, সেখানেও পড়েছি। তারপর মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজে। ১৯৭২ সালের ব্যাচ ছিলাম। ১৯৭৩ সালে পাস করে রাশিয়ায় পড়তে গেলাম স্টেট মেরিটাইম ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে পড়লাম অটোমেটেড ম্যানেজমেন্ট অব মেরিন ট্রান্সপোর্ট। সেখানেই কম্পিউটারের ব্যবহার শিখলাম। জাহাজ কোম্পানিতে কীভাবে কাজকর্ম করতে হয়, এগুলো ছিল মূল বিষয়। তারপর দেশে ফিরলাম।
দেশে ফিরে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনে চাকরি নিলাম। সেখানে কিছুদিন চাকরি করার পর থাইল্যান্ডের এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশনস টেকনোলজি বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করি। তারপর রাশিয়া গেলাম সাউথ অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড শহরে ফ্লিন্ডার্স ইউনিভার্সিটি অব সাউথ অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানে পড়ালেখা করে আবার দেশে ফিরি। ওখানে স্কুল অব অ্যাডভান্স টেকনোলজি নিয়ে পড়াশোনা করেছিলাম। দেশে আসার পরে অ্যাটমিক এনার্জি রিসার্চ এস্টাব্লিশমেন্ট ও ইনস্টিটিউট অব কম্পিউটার সায়েন্সে জয়েন করি। ওখানে থাকতেই খণ্ডকালীন শিক্ষকতা শুরু করি বুয়েটের সিএসই ডিপার্টমেন্টে। তখন নতুন শুরু হয়েছিল এ বিভাগ। ১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে আমি এখানে ফুল টাইম শিক্ষক হলাম। তারপর তো এখানেই পড়াশোনা করে অবসরে আসা। এখন আমি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আছি।
কখন ভাবলেন, কম্পিউটারবিজ্ঞানী হবেন?
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: রাশিয়ায় পড়তে যাওয়ার সময়। পরে যখন আবার গেলাম, তখনো কম্পিউটার সায়েন্স নিয়েই পড়েছি। প্রথমত, গণিতে আগ্রহ ছিল অনেক এবং কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিষয়টাও গণিতের ওপরে। এটা আমার ন্যাচারাল চয়েস ছিল।
একনজরে
জন্ম: ১ মে, ১৯৫৪
বাবা: আনিস উদ্দিন আহমেদ
মা: সাহেরা আহমেদ
স্ত্রী: সালেহা সুলতানা কায়কোবাদ
সন্তান: ২ ছেলে
অবসর: ফেসবুকে বড় দাবাড়ুদের দাবা খেলা দেখা
প্রিয় বই: গল্পগুচ্ছ
প্রিয় মুভি: হীরক রাজার দেশে
প্রিয় কণ্ঠশিল্পী: হেমন্ত মুখোপাধ্যায় , মান্না দে
প্রিয় লেখক: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সৈয়দ মুজতবা আলী
রং: লাল, সবুজ
ছোটবেলায় কী হতে চেয়েছিলেন?
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অনেক পড়ালেখা করব, অনেক বড় হব। পড়ালেখার মধ্যেই থাকার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সেটা হয়নি।
জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার বলতেন, ২০৩০ সালের মধ্যে একজন বাংলাদেশি বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পাবেন। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: একটা সম্ভাবনা হয়তো আছে। সেটা প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে। তবে আমরা যারা দেশে আছি, তারা মনে হয় না ওই উচ্চতায় উঠতে পেরেছি। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এ বিষয়ে অনেক ভালো করছে। আমাদের দেশে শিক্ষার দাম কম। ভারতে এটা অনেক বেশি।
আমি যদি এখন প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা করি এবং প্রথম পুরস্কার দিই এক কোটি টাকা, তাহলে মা–বাবাসহ ছেলেমেয়েরা এই ল্যাঙ্গুয়েজ শিখবে। সেটা চমৎকার একটা প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা হবে। আমরা সেটা বুঝি না। আমরা যদি চাই ছেলেমেয়েরা অঙ্কে ভালো হোক, তাহলে গণিত উৎসবের প্রথম পুরস্কার হওয়া উচিত ২০-৩০ লাখ টাকা। অন্য প্রতিযোগিতায় বড় অঙ্কের টাকা রয়েছে। এখানেও কিন্তু এটা করা যায়। আমরা যেটাকে অনুপ্রাণিত করতে চাই, উৎসাহিত করতে চাই, সেখানে বিনিয়োগ করতে হবে।
আমরা মস্তিষ্কের ওই পরিমাণ চর্চা করি না, যেটা তাঁরা করেছেন। যেমন আলবার্ট আইনস্টাইন খুব চিন্তা করতে পছন্দ করতেন। আমরা তো ও রকম চিন্তা করি না। আমাদের দেশে যত রকম কুইজ কম্পিটিশন আছে, সেগুলোর প্রায় সবই তো মুখস্থবিদ্যা থেকে দিতে হয়।
এককথায় যদি আপনাকে বলতে বলি, তাহলে আপনি কোনটাকে বেছে নেবেন—মেধাবী বিজ্ঞানী নাকি বিনয়ী মানুষ?
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: ভালো মানুষ!
বই পড়া কি আপনাকে কোনোভাবে প্রভাবিত করেছে?
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: হাজার বছর আগে আর্কিমিডিস কীভাবে একটা সমস্যার সমাধান করেছেন, তা আমি এখনো পারি না। অর্থাৎ মানুষ কত মেধাবী হতে পারে, ভাবুন! আমরা মস্তিষ্কের ওই পরিমাণ চর্চা করি না, যেটা তাঁরা করেছেন। যেমন আলবার্ট আইনস্টাইন খুব চিন্তা করতে পছন্দ করতেন। আমরা তো ও রকম চিন্তা করি না। আমাদের দেশে যত রকম কুইজ কম্পিটিশন আছে, সেগুলোর প্রায় সবই তো মুখস্থবিদ্যা থেকে দিতে হয়। যেমন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম হ্রদের নাম কী? ওটার নাম যা–ই হোক, তাতে কী? তাতে কিছু আসে যায়? আমার এই বিদ্যা শিখে কোনো দিন কোনো কাজে লাগবে? বরং যেসব সমস্যার উত্তর চিন্তা করে বের করতে হয়, সেসব চিন্তা করলে মস্তিষ্কের ডেভেলপমেন্ট হয়। কিন্তু সে রকম কুইজ আমরা আয়োজন করি না। আমাদের এমন কুইজ করতে হবে, যাতে কিছুক্ষণ চিন্তা করে উত্তর দিতে হবে। আর চিন্তার অভ্যাস করতেই বই পড়া জরুরি।
এমন একটি বইয়ের নাম বলুন, যা আমাদের ছেলেমেয়েদের অবশ্যই পড়া উচিত।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পগুচ্ছ।
বিজ্ঞানের গন্তব্য বা শেষ কোথায়?
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: বিজ্ঞান মানুষের জীবন, মানুষের ইতিহাস, সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, এটাই আমরা চাইব। মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটবে। মানুষ যন্ত্রচালিত হবে না। মানুষ যন্ত্রকে নিজের কল্যাণে, নিজের সুবিধার্থে ব্যবহার করবে এবং এর ফলে আমাদের মানবিক মূল্যবোধ বিবর্জিত হবে না।
বাংলাদেশ নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী?
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: বাংলাদেশের মানুষ এত সাদামাটা কখনো ছিল না। মহাপরাধীন ভারতে বাংলাদেশের মানুষ প্রমাণ করেছিল তাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা আছে। দক্ষিণ ভারতের রাজনীতিবিদ গোখেল বলেছিলেন, ‘হোয়াট বেঙ্গল থিংকস টুডে, ইন্ডিয়া উইল থিংক টুমোরো’। (অর্থাৎ বাঙালিরা আজ যা ভাববে, ভারত তা ভাববে আগামীকাল।) আমরা বিজ্ঞানমনস্ক জাতি ছিলাম। বিজ্ঞানে আমাদের অবদান আরও অনেক অনেক বাড়বে। এখনকার মতো সাদামাটা থাকবে না এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর ভর করে আমাদের এই ঘনবসতিপূর্ণ দেশ আমাদের স্বপ্ন অনুযায়ী একসময় সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হবে।
আপনি তো শুরু থেকেই বিজ্ঞানচিন্তার উপদেষ্টা। এই ম্যাগাজিন নিয়ে আপনার মতামত কী?
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: বিজ্ঞানচিন্তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। কাইয়ুম ভাইয়ের (বিজ্ঞানচিন্তা সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম) লেখায় তাঁর ঈর্ষণীয় বিজ্ঞানমনস্কতা প্রকাশ পায়। এগুলো পড়ে আমাদের কিশোর-তরুণদের মধ্যেও বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরি হবে বলে আশা করছি।
বিজ্ঞানচিন্তা একটি করে দাবার সমস্যা দেয় প্রতি সংখ্যায়। এটা শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। আমাদের শিক্ষার্থীদের চিন্তা করার ব্যাপ্তি কমে গেছে। আমার মনে হয়, বিজ্ঞানচিন্তা এটাও ভাবতে পারে যে কীভাবে আমাদের ছেলেমেয়েদের একটি দাবা প্রতিযোগিতায় উৎসাহী করা যায় এবং এমন একটা প্রতিযোগিতা কীভাবে আয়োজন করা যায়।
বিজ্ঞানচিন্তার বেশির ভাগ পাঠক কিশোর ও তরুণ। তাদের জন্য অনুপ্রেরণামূলক কিছু বলুন।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: আমার আশা, তারা বিজ্ঞানচিন্তা পড়বে। বিজ্ঞানমনস্ক হবে। বিজ্ঞানের প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়বে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষ না হলে আমাদের দেশটা সমৃদ্ধ হতে পারবে না। সুতরাং দেশকে সমৃদ্ধ করার জন্য, এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিজ্ঞান শেখার কোনো বিকল্প নেই।
আমাদের সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।