সেনাপতিকে যেভাবে পুরস্কার দিলেন রাজা

মাথা খাটাতে কে না পছন্দ করে! আর গল্পোচ্ছলে মজার বুদ্ধির ব্যায়াম হলে তো কথাই নেই। এরকমই একটি বই অঙ্কের খেলা। এটি রুশ গণিতবিদ ইয়াকভ পেরেলমানের নামকরা বই ফিগারস ফর ফান: স্টোরিজ, পাজলস অ্যান্ড কোনান্ড্রামস-এর বাংলা অনুবাদ। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) প্রগতি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছিল বিমলেন্দু সেনগুপ্তের অনুবাদে। সম্পাদক ছিলেন নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা।

অঙ্কের মজার সব হেঁয়ালি, বুদ্ধির খেলাসহ মাথা খাটানোর মতো দারুণ সব ধাঁধা নিয়ে বইটি। মগজে শান দিতে যা অতুলনীয়। এ বই পড়ে দেশের অনেকে এককালে গণিতে আগ্রহী হয়েছে, সমস্যা সমাধান শিখেছে, মুগ্ধ হয়েছে, প্রেমে পড়েছে গণিতের। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে।

সম্রাটও তাঁকে খুব সমাদর করে গ্রহণ করে সাম্রাজ্যের জন্য তিনি যা করেছেন সেজন্য ধন্যবাদ জানালেন

পুরনো রোমের সেই উপকথার ঘটনাটা বলছি এখানে।*

রোমান সেনাপতি তেরেনতিয়াস এক বিজয় অভিযান থেকে অনেক ধনরত্ন নিয়ে দেশে ফিরে একবার সম্রাটের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন।

সম্রাটও তাঁকে খুব সমাদর করে গ্রহণ করে সাম্রাজ্যের জন্য তিনি যা করেছেন সেজন্য ধন্যবাদ জানালেন। সিনেটে তাঁর সম্মানের উপযুক্ত একটি পদ দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলেন।

কিন্তু তেরেনতিয়াস এই পুরস্কার চাননি। তিনি বললেন, ‘আপনার সুনাম আর ক্ষমতা বিস্তারের জন্য আমি অনেক যুদ্ধ জয় করেছি, মৃত্যুকেও আমি ভয় করিনি। যদি আমার একাধিক প্রাণ থাকত, তাহলে তাও আপনার জন্য স্বেচ্ছায় আমি উৎসর্গ করতাম। কিন্তু যুদ্ধ করে করে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। সে বয়স এখন আর আমার নেই। শিরার রক্তেও আর তেজ নেই। এখন আমার পৈত্রিক বাড়িতে ফিরে গিয়ে জীবন কাটাবার সময় হয়েছে।’

‘তেরেনতিয়াস, বল, তুমি কী চাও?’ সম্রাট প্রশ্ন করলেন।

‘হে সম্রাট! আমি চাই আপনার অনুগ্রহ। প্রায় সারা জীবনই আমি যুদ্ধে কাটিয়েছি, রক্তরঞ্জিত করেছি আমার তরবারি, কিন্তু নিজের সৌভাগ্য গড়ার কোন সময়ই আমি পাইনি। আমি দরিদ্র...’

‘সাহসী তেরেনতিয়াস, বল, বল!’ সম্রাট বলে উঠলেন।

উৎসাহ পেয়ে সেনাপতি বললেন, ‘আপনার অনুচরকে যদি পুরস্কারই দেবেন, তাহলে অনুগ্রহ করে জীবনের শেষ কয়েকটা দিন শান্তি ও প্রাচুর্যের মধ্যে বাস করতে সাহায্য করুন। আমি সম্মান চাই না, চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী সিনেটেও কোন উঁচু পদের আকাঙ্ক্ষা আমার নেই। ক্ষমতা এবং সমাজ থেকে সরে গিয়ে আমি শান্তিতে বসবাস করতে চাই। হে সম্রাট, জীবনের বাকি দিনগুলো সুখে কাটাবার উপযুক্ত অর্থ আমাকে দিন।’

গল্পে আছে, সম্রাট দয়ালু ছিলেন না। আসলে তিনি ছিলেন কৃপণ। টাকা দিতে প্রাণে লাগে তাঁর। সেনাপতিকে উত্তর দেবার আগে একমুহূর্ত ভেবে নিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত তিনি জিজ্ঞেস করলেন:

‘কত টাকা হলে চলবে বলে মনে কর?’

‘হে সম্রাট, দশ লাখ দিনারী (স্বর্ণমুদ্রা)।’ সম্রাট আবার চুপ হয়ে গেলেন। সেনাপতি মাথা নীচু করে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

শেষ পর্যন্ত সম্রাট বললেন: ‘সাহসী তেরেনতিয়াস, তুমি একজন বিরাট সেনাপতি। সত্যি সত্যিই তোমার কীর্তির উপযুক্ত পুরস্কার দেওয়া উচিত। ধনদৌলত আমি দেব তোমাকে। আমি যা ঠিক করি কাল দুপুরে জানতে পাবে।’

নমস্কার জানিয়ে বিদায় নিলেন তেরেনতিয়াস।

আমার ধনাগারে ৫০ লাখ পেতলের মুদ্রা আছে, যার দাম হলো দশ লাখ দিনারী। এবার খেয়াল করে শোনো। তুমি আমার ধনাগারে গিয়ে একটা মুদ্রা এখানে নিয়ে আসবে। পরদিন আবার ধনাগারে গিয়ে প্রথমটার দ্বিগুণ দামের মুদ্রা এনে প্রথমটার পাশে রাখবে।
আরও পড়ুন

দুই

পরদিন রাজপ্রাসাদে এলেন তেরেনতিয়াস।

‘এই যে সাহসী তেরেনতিয়াস!’ সম্রাট আওভান জানালেন।

শ্রদ্ধা জানিয়ে মাথা নোয়ালেন সেনাপতি।

‘সম্রাট, আমি আপনার মতামত জানতে এসেছি। আপনি অনুগ্রহ করে আমাকে পুরস্কার দেবেন কথা দিয়েছেন।’

সম্রাট উত্তর দিলেন, ‘নিশ্চয়ই, তোমার মতো একজন মহান যোদ্ধাকে আমি সামান্য কোনো প্রতিদান দিতে চাই না। দেখ, আমার ধনাগারে ৫০ লাখ পেতলের মুদ্রা আছে, যার দাম হলো দশ লাখ দিনারী। এবার খেয়াল করে শোনো। তুমি আমার ধনাগারে গিয়ে একটা মুদ্রা এখানে নিয়ে আসবে। পরদিন আবার ধনাগারে গিয়ে প্রথমটার দ্বিগুণ দামের মুদ্রা এনে প্রথমটার পাশে রাখবে। তৃতীয় দিনে পাবে প্রথমটার চার গুণ, চতুর্থ দিনে আট গুণ, পঞ্চম দিনে ষোলো গুণ করে মুদ্রা। এইভাবেই চলতে থাকবে। তোমার জন্য প্রতিদিন উপযুক্ত দামের মুদ্রা তৈরির আদেশ দিয়ে রাখব। যতদিন পর্যন্ত ক্ষমতা থাকবে তোমার, তুমি আমার কোষাগার থেকে মুদ্রা নিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু কারও সাহায্য না নিয়ে কাজটা একাই করতে হবে তোমাকে। আর যখন তুমি আর মুদ্রা তুলতে পারবে না, তখন থামবে। আমাদের চুক্তি শেষ হবে তখন। যা কিছু মুদ্রা তুমি নিয়ে আসবে, তাই হবে তোমার পুরস্কার।’

খুব আগ্রহ নিয়ে সম্রাটের কথা শুনলেন তেরেনতিয়াস। রাজকোষ থেকে বিরাট ধন নিয়ে আসার কল্পনায় তাঁর চোখ তখন স্বপ্নিল।

‘হে সম্রাট, আপনার বদান্যতায় আমি কৃতজ্ঞ।আপনার পুরস্কার সত্যিই অপূর্ব!’ সানন্দে উত্তর দিলেন তেরেনতিয়াস।

আরও পড়ুন
পার হয়ে এল পনেরো দিন। বোঝাটা এত ভারী হয়নি আর কখনও। প্রথম মুদ্রাটা থেকে ১৬,৩৮৪ গুণ দামী একটা মুদ্রা বয়ে নিয়ে তেরেনতিয়াস ধীরে ধীরে এসে ঢুকলেন দরবারে। এর ব্যাস ছিল ৫৩ সেন্টিমিটার আর ওজন ৮০ কিলোগ্রাম।

তিন

সম্রাটের দরবার-ঘরের কাছেই কোষাগার। এভাবে প্রতিদিন সেখানে যেতে শুরু করলেন তেরেনতিয়াস। প্রথম মুদ্রা দরবার ঘরে নিয়ে আসা কঠিন হলো না।

প্রথম দিন যে ছোট্ট মুদ্রাটি তেরেনতিয়াস নিয়ে এলেন তার ব্যাস হলো ২১ মিলিমিটার আর ওজন ৫ গ্রাম।

দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম আর ষষ্ঠ মুদ্রাগুলো বয়ে নিয়ে আসাও বেশ সহজ হলো। ওগুলোর ওজন ছিল যথাক্রমে ১০, ২০, ৪০, ৮০ আর ১৬০ গ্রাম।

সপ্তম মুদ্রার ওজন হলো ৩২০ গ্রাম আর তার ব্যাস হলো ৮.৫০ সেন্টিমিটার (অথবা ঠিকঠিক বলতে গেলে ৮৪ মিলিমিটার*)।

……………………………………………………………………..………………..…………

* প্রথম মুদ্রা থেকে ব্যাস আর পুরুত্বে চার গুণ বেশি হলেই মুদ্রাটা ৬৪ গুণ ভারী হয়ে যায়, কারণ ৪ × ৪ × ৪ = ৬৪। গল্পের শেষে যখন আমরা মুদ্রার আকার হিসেব করব তখন কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে।

……………………………………………………………..………………..………..……….

অষ্টম দিনে তেরেনতিয়াসকে যে মুদ্রাটা নিতে হলো তার দাম ছিল প্রথম মুদ্রার ১২৮ গুণ, এর ওজন হলো ৬৪০ গ্রাম, আর ব্যাস হলো প্রায় ১০ সেন্টিমিটার।

নবম দিনে তিনি সম্রাটের কাছে যে মুদ্রাটা নিয়ে এলেন তার দাম হলো প্রথম মুদ্রার ২৫৬ গুণ, ওজন হলো ১.২৫০ কিলোগ্রামেরও বেশি। আর ব্যাস হলো ১৩ সেন্টিমিটার।

বারো দিনের মুদ্রাটার ব্যাস হলো প্রায় ২৭ সেন্টিমিটার, আর ওজন দাঁড়াল ১০.২৫০ কিলোগ্রাম।

সম্রাট প্রতিদিন সাদর অভ্যর্থনা জানাতেন তেরেনতিয়াসকে। জয়ের আনন্দ আর লুকিয়ে রাখতে পারলেন না তিনি। তিনি দেখলেন যে, তেরেনতিয়াস তাঁর কোষাগারে গিয়েছেন ১২ বার, আর এনেছেন ২০০০ পেতলের মুদ্রার কিছু বেশী মাত্র।

১৩ দিনের দিন তেরেনতিয়াস পেলেন প্রথম মুদ্রাটা থেকে ৪০৯৬ গুণ দামী মুদ্রা। এর ব্যাস ছিল ৩৪ সেন্টিমিটার আর ওজন ২০.৫০০ কিলোগ্রাম।

এর পরদিনের মুদ্রাটা হলো আরও বড় আর আরও ভারী। ওজন হলো ৪১ কিলোগ্রাম, ব্যাস হলো ৪২ সেন্টিমিটার।

আরও পড়ুন
আনন্দের হাসি অতিকষ্টে চাপলেন সম্রাট। সেনাপতিকে একেবারে বোকা বানিয়েছেন তিনি। কোষাধ্যক্ষকে এরপর হিসেব করতে বললেন তিনি: তেরেনতিয়াস রাজকোষ থেকে কত টাকা বের করে এনেছেন।

হাসি না চাপতে পেরে সম্রাট জিজ্ঞেস করলেন, ‘সাহসী তেরেনতিয়াস, তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছ কি?’

‘না, সম্রাট,’ ভুরু, কুঁচকে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে উত্তর করলেন সেনাপতি।

পার হয়ে এল পনেরো দিন। বোঝাটা এত ভারী হয়নি আর কখনও। প্রথম মুদ্রাটা থেকে ১৬,৩৮৪ গুণ দামী একটা মুদ্রা বয়ে নিয়ে তেরেনতিয়াস ধীরে ধীরে এসে ঢুকলেন দরবারে। এর ব্যাস ছিল ৫৩ সেন্টিমিটার আর ওজন ৮০ কিলোগ্রাম। ওজনটা একজন দীর্ঘকায় যোদ্ধার ওজনের সমান।

১৬ দিনের দিন বোঝাটা বয়ে আনতে গিয়ে সেনাপতির পা কাঁপতে লাগল। মুদ্রাটার দাম ছিল ৩২,৭৬৮টা মূল মুদ্রার সমান, আর ওজন হলো ১৬৪ কিলোগ্রাম। ব্যাস দাঁড়াল ৬৭ সেন্টিমিটার।

হাঁপাতে হাঁপাতে তেরেনতিয়াস এসে ঢুকলেন দরবার ঘরে। তাঁকে খুবই ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। সম্রাটের সঙ্গে দেখা হলে সম্রাট একটু হেসে তাঁর দিকে তাকালেন...

এর পরদিন সেনাপতি সেখানে আসতেই এক দমকা হাসি অভ্যর্থনা জানাল তাঁকে। মুদ্রাটা আর বয়ে আনতে পারেননি তিনি, সেটাকে গড়িয়ে আনতে হয়েছে। এর ব্যাস ছিল ৮৪ সেন্টিমিটার, ওজন ৩২৮ কিলোগ্রাম আর দাম ৬৫,৫৩৬টি মূল মুদ্রার সমান।

আঠারো দিনটাতেই শেষবারের মতো কিছু ধনসম্পদ বাগাতে পারলেন তিনি। রাজকোষ হয়ে দরবারে যাওয়া শেষ হয়ে গেল তাঁর। এবারের মুদ্রাটার দাম ছিল ১,৩১,০৭২টি মূল মুদ্রার সমান, ব্যাস ১ মিটারেরও বেশি, আর ওজন ৬৫৫ কিলোগ্রাম। তাঁর বর্শাটাকে স্টিয়ারিং-লিভারের মতো করে ধরে মুদ্রাটা গড়িয়ে আনলেন তিনি। সম্রাটের পায়ের কাছে ধপাস করে পড়ল সেটা।

একেবারে দম ফুরিয়ে গেছে তেরেনতিয়াসের। ‘যথেষ্ট... হয়েছে,’ হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন তিনি।

আনন্দের হাসি অতিকষ্টে চাপলেন সম্রাট। সেনাপতিকে একেবারে বোকা বানিয়েছেন তিনি। কোষাধ্যক্ষকে এরপর হিসেব করতে বললেন তিনি: তেরেনতিয়াস রাজকোষ থেকে কত টাকা বের করে এনেছেন।

তাই করলেন কোষাধ্যক্ষ। ‘হে সম্রাট, আপনার সহৃদয়তাকে ধন্যবাদ। সাহসী তেরেনতিয়াস পুরস্কার পেয়েছেন ২,৬২,১৪৩টি পেতলের মুদ্রা।’

এভাবে সেই কৃপণ সম্রাট, সেনাপতি যে দশ লাখ দিনারী চেয়েছিলেন, তার মাত্র কুড়ি ভাগের এক ভাগ দিলেন তাঁকে।

কোষাধ্যক্ষের হিসেব আর মুদ্রাগুলোর ওজন দেখা যাক এবার। রাজকোষ থেকে তেরেনতিয়াস যা নিয়েছিলেন তা হলো:

দ্বিতীয় কলমের সংখ্যাগুলোকে খুব সহজেই যোগ করে ফেলতে জানি আমরা। যোগফলটা এখানে হচ্ছে ২,৬২,১৪৩। তেরেনতিয়াস কিন্তু চেয়েছিলেন ১০ লক্ষ দিনারী, অর্থাৎ ৫০ লক্ষ পেতলের মুদ্রা। তাহলে তিনি পেলেন ৫০,০০,০০০: ২,৬২,১৪৩ ≈ ১৯ ভাগ।

* ব্রিটেনের এক ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারের সংগৃহীত একটি হাতে-লেখা ল্যাটিন পাণ্ডুলিপির স্বচ্ছন্দ অনুবাদ।

‘অঙ্কের খেলা’ বই থেকে আরও পড়ুন