মজার গণিত
বিনা পয়সার ভোজ
মাথা খাটাতে কে না পছন্দ করে! আর গল্পোচ্ছলে মজার বুদ্ধির ব্যায়াম হলে তো কথাই নেই। এরকমই একটি বই ‘অঙ্কের খেলা’। এটি রুশ গণিতবিদ ইয়াকভ পেরেলমানের নামকরা বই ‘ফিগারস ফর ফান: স্টোরিজ, পাজলস অ্যান্ড কোনান্ড্রামস’-এর বাংলা অনুবাদ। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) প্রগতি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছিল বিমলেন্দু সেনগুপ্তের অনুবাদে। সম্পাদক ছিলেন নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা।
অঙ্কের মজার সব হেঁয়ালি, বুদ্ধির খেলাসহ মাথা খাটানোর মতো দারুণ সব ধাঁধা নিয়ে বইটি। মগজে শান দিতে যা অতুলনীয়। এ বই পড়ে দেশের অনেকে এককালে গণিতে আগ্রহী হয়েছে, সমস্যা সমাধান শিখেছে, মুগ্ধ হয়েছে, প্রেমে পড়েছে গণিতের। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে।
মাধ্যমিক পরীক্ষা-উত্তীর্ণ দশজন তরুণ ঠিক করল একটা রেস্তোরাঁয় ভোজের উৎসব করবে তারা। সবাই এসে পৌঁছানোর পর যখন প্রথম খাবারের থালা পরিবেশন করা হলো, তখন কোন আসনে কে বসবে এই নিয়ে তর্কাতর্কি শুরু হলো। একজন প্রস্তাব করল নামের অক্ষর অনুযায়ী বসা যাক। অন্যরা বসতে চাইল বয়েস হিসেবে। আবার অন্য অনেকে বলল, বসতে হবে উচ্চতা অনুযায়ী। তাদের মধ্যে একজন আবার প্রস্তাব করল যে, পরীক্ষা পাশের নম্বর অনুসারে বসা হোক। তর্কটা চলতে লাগল। খাবার জুড়িয়ে জল হয়ে গেল, তবু কেউ বসল না। পরিবেশক মীমাংসা করে দিল সমস্যাটার।
সে বলল, ‘তরুণ বন্ধুরা, তর্কটা থামিয়ে আমার কথা শুনুন। যে যেখানে আছেন সেখানেই বসে আমার বক্তব্যটা শুনুন।’
‘আপনারা এখন যেভাবে বসে আছেন, আপনাদের কেউ সেটা লিখে নিন। কাল আবার এসে অন্য কোনোভাবে বসুন। যতদিন সবরকমভাবে বসা না হচ্ছে, আপনারা এভাবে আসতে থাকুন। এখন যেভাবে বসে আছেন আবার যখন সেভাবে বসবার সময় আসবে, তখন আমি কথা দিচ্ছি, প্রতিদিন আপনারা যে কোনো ভাল খাবার খেতে চাইবেন, তা আমি বিনা পয়সায় খাওয়াব আপনাদের।’
প্রস্তাবটা খুবই লোভনীয়। ঠিক হলো প্রতিদিন তারা রেস্তোরাঁয় আসবে আর যতরকমভাবে বসা সম্ভব সবরকমে বসা হবে, যাতে পরিবেশকের কথামতো বিনা পয়সায় খাবার খাওয়া যায়।
বিন্যাসের সংখ্যাটা কত হতে পারে সে হিসেবটা করতে হবে সবচেয়ে আগে। এটাকে যথা সম্ভব সহজ করার জন্য তিনটে জিনিস নিয়ে শুরু করা যাক। এদের নাম দিচ্ছি আমরা ‘ক’, ‘খ’ আর ‘গ’।
সে দিনটা কিন্তু আর কোনদিনই এলো না। কারণ, এই নয় যে পরিবেশক তার কথা রাখতে পারল না। কারণটা হলো, টেবিলে দশজন মানুষ বসার অনেক ধরন ছিল। সত্যি বলতে কি ৩৬ লাখ ২৮ হাজার ৮০০ ধরনে তা হতে পারত। তোমরা দেখতে পাবে, সবরকমভাবে বসে দেখতে গেলে প্রায় ১০ হাজার বছর লেগে যাবে। দশজন মানুষ যে এত ধরনে একটা টেবিলে বসতে পারে তা হয়তো বিশ্বাস করছ না তোমরা। নিজেরাই হিসেব করে দেখতে পার।
বিন্যাসের সংখ্যাটা কত হতে পারে সে হিসেবটা করতে হবে সবচেয়ে আগে। এটাকে যথা সম্ভব সহজ করার জন্য তিনটে জিনিস নিয়ে শুরু করা যাক। এদের নাম দিচ্ছি আমরা ‘ক’, ‘খ’ আর ‘গ’।
আমাদের যা বের করতে হবে তা হলো এই জিনিসগুলো কত বিভিন্ন ধরনে সাজানো যায়। প্রথমে ‘গ’ আলাদা করে রেখে মাত্র দুটো জিনিস নিয়েই এটা করা যাক। আমরা দেখছি যে এদের সাজানোর মাত্র দুটিই উপায় আছে।
এখন এই দুটোর প্রত্যেকটার সঙ্গে ‘গ’ যোগ করছি। এটা করা যায় তিনটে বিভিন্নভাবে:
(১) ‘গ’ আমরা ওই জোড়াটার পেছনে বসাতে পারি
(২) সামনে বসাতে পারি
(৩) দুটো জিনিসের মাঝে বসাতে পারি।
দেখা যাচ্ছে, আর কোনোভাবে এটাকে বসানো যায় না। এখন আমাদের আছে দুই জোড়া জিনিস, ‘ক’ ‘খ’ আর ‘খ’ ‘ক’, তাহলে দাঁড়াচ্ছে: জিনিসগুলোকে সাজানোর ২ × ৩ = ৬টা উপায় হতে পারে।
৫৩নং ছবিতে এ সাজানোটা দেখানো হয়েছে।
হিসেবটা আরও জটিল হতো যদি এদের অর্ধেক হতো মেয়ে, আর তারা প্রত্যেকে পালা করে প্রত্যেকটি ছেলের সঙ্গে বসতে চাইত। যদিও এক্ষেত্রে বসার ব্যবস্থার সংখ্যাটা হতো আরও ছোট, তাহলেও হিসেবটা হতো কঠিন।
‘ক’ ‘খ’ ‘গ’ আর ‘ঘ’—এই চারটে জিনিস নিয়ে শুরু করা যাক। এখনকার মতো আমরা ‘ঘ’ আলাদা করে রেখে তিনটা জিনিস নিয়েই সবরকমভাবে সাজাব। ছয় রকমভাবে তা করা যায় আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি। তিনটে জিনিসের ৬ রকমভাবে সাজানোতে কত রকমভাবে চতুর্থ জিনিস ‘ঘ’ বসানো যায়? সেটা দেখা যাক। আমরা ‘ঘ’-কে
(১) তিনটা জিনিসের আগে বসাতে পারি
(২) পরে বসাতে পারি
(৩) প্রথম ও দ্বিতীয় জিনিসের মাঝে বসাতে পারি
(৪) দ্বিতীয় এবং তৃতীয় জিনিসটার ভেতর বসাতে পারি
তাহলে আমরা পাচ্ছি: ৬ × ৪ = ২৪ রকমের সাজানো যায়।
যেহেতু ৬ = ২ × ৩ আর ২ = ১ × ২, তাহলে সবরকমের বিন্যাসের সংখ্যাটা এভাবে লেখা যায়: ১ × ২ × ৩ × ৪ = ২৪
এখন যদি ওই একই নিয়মে পাঁচটা জিনিসকে সাজানো যায়, তাহলে আমরা পাব: ১ × ২ × ৩ × ৪ × ৫ = ১২০
ছয়টা জিনিস হলে ১ × ২ × ৩ × ৪ × ৫ × ৬ = ৭২০ ইত্যাদি।
দশজন তরুণের কাহিনিতে আবার ফেরা যাক। এক্ষেত্রে একটু কষ্ট করে যদি হিসেবটা করি, তাহলে যত ধরনে তাদের বসানো যায় তার সংখ্যা হলো: ১ × ২ × ৩ × ৪ × ৫ × ৬ × ৭ × ৮ × ৯ × ১০
এর উত্তর হবে: ৩,৬২৮,৮০০
হিসেবটা আরও জটিল হতো যদি এদের অর্ধেক হতো মেয়ে, আর তারা প্রত্যেকে পালা করে প্রত্যেকটি ছেলের সঙ্গে বসতে চাইত। যদিও এক্ষেত্রে বসার ব্যবস্থার সংখ্যাটা হতো আরও ছোট, তাহলেও হিসেবটা হতো কঠিন।
ছেলেদের একজনকে সে যেখানে বসতে চায় সেখানেই তাকে বসতে দেওয়া যাক। অন্য চারজন তাদের মাঝে মাঝে মেয়েদের জন্য আসন খালি রেখে বসতে পারে ১ × ২ × ৩ × ৪ = ২৪ রকমভাবে। চেয়ার আছে দশটা, তাহলে প্রথম ছেলেটি বসতে পারে দশটা বিভিন্ন জায়গায়। তাহলে ১০ × ২৪ = ২৪০ রকম উপায়ে ছেলেরা টেবিলের চারপাশে বসতে পারছে।
ছেলেদের মাঝে মাঝে খালি জায়গাগুলোতে মেয়েরা কতরকমভাবে বসতে পারে? স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে ১ × ২ × ৩ × ৪ × ৫ = ১২০ রকমভাবে। ছেলেদের ২৪০ ধরনের বসার সঙ্গে মেয়েদের ১২০ ধরনের বসাকে একত্র করলেই আমরা বসার সম্ভাব্য সংখ্যাটা পেয়ে যাব। তা হলো: ২৪০ × ১২০ = ২৮,৮০০
এটা অবশ্য ছেলেদের ৩,৬২৮,৮০০ উপায়ে বসার সংখ্যার চেয়ে অনেক কম, আর তাতে ৭৯ বছরের কিছু কম সময় লাগবে। তার মানে হলো, ছেলেরা যদি ১০০ বছর বয়স অবধি বাঁচে, তাহলে তারা বিনা পয়সায় খাওয়াটা পরিবেশকের কাছ থেকে না পেলেও পাবে তার উত্তরাধিকারীর কাছ থেকে।
এখন কি করে বিন্যাসের সংখ্যাটা বের করতে হয় তা আমরা শিখেছি। তাহলে ‘পনেরোর ধাঁধার’ বাক্সতে ঘুঁটি সাজানোর সংখ্যাটাও বের করতে পারি আমরা। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, এই খেলায় কোনো খেলোয়াড়কে যতরকমের ধাঁধার মুখোমুখি হতে হবে তা আমরা সমাধান করতে পারব। এটা সহজেই দেখা যাচ্ছে যে কাজটা হলো এই ১৫টা ঘুঁটিকে কত রকমে সাজানো যায়, তা বের করা। এটা করতে হলে, আমরা জানি যে নিচের গুণটা করতে হবে:
১ × ২ × ৩ × ৪ × ৫ × ৬ × ৭ × ৮ × ৯ × ১০ × ১১ × ১২ × ১৩ × ১৪ × ১৫।
উত্তর হলো: ১,৩০৭,৬৭৪,৩৬৫,০০০
এই বিরাট সংখ্যার ধাঁধাগুলোর অর্ধেকই সমাধান করা যায় না। তাহলেই ৬০,০০০ কোটির ওপর সমস্যা আছে যার কোনো সমাধান নেই। লোকেরা যে এটা সন্দেহও করেনি, তাতেই বোঝা যায় ‘পনেরোর ধাঁধার’ জন্য তারা কেন এত পাগল হয়ে উঠেছিল।
এর জন্য সময় বাঁচাবার উপায় যা আছে তা হলো গুণকগুলোকে ঠিকমতো সাজানো। ফল হবে বিরাট। এতে থাকবে ২৬টা সংখ্যা। এটা এত অদ্ভুত বড় যে তা ধারণা করা আমাদের ক্ষমতার বাইরে।
এটাও দেখা যাক, যদি প্রতি সেকেন্ডে একটি করে ঘুঁটি সাজানো যেত, তাহলে সব সম্ভাব্য উপায়ে সাজাতে ৪০ হাজার বছরেরও বেশি লাগত। আর তা-ও হতো যদি কেউ একেবারে না থেমে কাজটা করত।
সাজানোর ব্যাপারে আলোচনা প্রায় শেষ করে এনেছি আমরা। স্কুল জীবনের একটা ধাঁধা এবার সমাধান করা যাক।
ধরা যাক, একটা ক্লাসে ২৫ জন ছাত্র আছে। কতরকমভাবে বসানো যায় তাদের?
ওপরের যে ধাঁধাটা বলা হলো তা যারা ভাল করে বুঝেছ, এটা সমাধান করতে তাদের কোন মুশকিল হবে না। যে কাজটা করতে হবে তা হলো ২৫টা সংখ্যাকে এভাবে গুণ করতে হবে:
১ × ২ × ৩ × ৪ × ৫ × ৬ ×... × ২০ × ২৪ × ২৫
অনেক ব্যাপার সহজে করার অনেক উপায় আছে গণিতে। কিন্তু ওপরে যেটা বলা হলো, তার জন্য কোনো সোজা উপায় নেই। ঠিকভাবে এটাকে করার একটিমাত্র উপায় আছে, তা হলো সবগুলোকে গুণ করা।
এর জন্য সময় বাঁচাবার উপায় যা আছে তা হলো গুণকগুলোকে ঠিকমতো সাজানো। ফল হবে বিরাট। এতে থাকবে ২৬টা সংখ্যা। এটা এত অদ্ভুত বড় যে তা ধারণা করা আমাদের ক্ষমতার বাইরে। সংখ্যাটা হলো: ১৫,৫১১,২১০,০৪৩,৩৩০,৯৮৫,৯৮৪,০০০,০০০
এ পর্যন্ত যত সংখ্যা আমরা দেখেছি তার ভেতর এটাই সবচেয়ে বড়। এ জন্যই একে একটি ‘দানবীয় সংখ্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। এর সঙ্গে তুলনায় সব সমুদ্র আর মহাসাগরে যত জলবিন্দু আছে তা-ও অনেক কম।
* এক্ষেত্রে খালি ঘরটা সবসময়ই থাকবে ডানদিকের নিচের কোণে।