রসায়নের খুব মজার কিছু ব্যাপার দেখা যেতে পারে পিঠা কিংবা কেক বানানোর মধ্যে। অধিকাংশ পিঠা বা কেকের মূল উপাদান মোটামুটি চারটি। চাল ও গমের আটা অথবা ময়দা, তেল বা ঘি, চিনি, ডিম। ঠিক এগুলো দিয়েই নানাভাবে বানানো যায় ফুলে ওঠা পিঠা বা কেক, মচমচে সুস্বাদু খাবার, আর কখনো স্তরে স্তরে গড়ে ওঠা পেস্ট্রি। এসবকে ফোলানোর জন্য আমরা নানা উপাদান ব্যবহার করে থাকি। এতে ভেতরে গ্যাস তৈরি হয় কিংবা তাপে প্রসারিত হয়। এ কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় খাবার সোডা নামে পরিচিত সোডিয়াম বাই কার্বনেট। এটি খামিরে থাকা পানির সঙ্গে বিক্রিয়া করে তৈরি করে কার্বন ডাই-অক্সাইড। আর সেগুলো ফুলে কেক কিংবা পাউরুটিতে রূপ নেয়। তবে এই সোডা মেশাতে হয় খুব হিসাব করে। একটু বেশি মেশালে ফুলে উঠে বুদ্বুদগুলো ফেটে যাবে, আর কম হলে তো বুদবুদই হবে না।
বুদবুদ তৈরি করে সেগুলোকে পাউরুটি কিংবা পিঠা-পুলির মধ্যে আটকে রাখার পেছনে কাজ করে এক মজার রসায়ন। এসব জিনিস আমরা সাধারণত তৈরি করি গমের আটা বা ময়দা দিয়ে। এর গঠনে আছে স্টার্চ দানা, যাকে ঘিরে রাখে গ্লুটেনিন আর গ্লিয়াডিন নামের দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন (protein)। এগুলোকে পানির সঙ্গে মেশালেই প্রোটিন দুটো নিজেদের মধ্যে একটি সংযোগ তৈরি করে একটি নতুন প্রোটিনে রূপ নেয়, যার নাম গ্লুটেন। গ্লুটেন হলো একটি ‘সুপার-প্রোটিন’, যেটি আচরণ করে রাবারের মতো। আর এই গ্লুটেন দুটি স্টার্চ দানার মধ্যে কাজ করে সেতুর মতো। এ জন্যই আটায় পানি মেশালে গুঁড়ো থেকে সেটি রূপ নেয় খামিরে।
পরোটা কিংবা পেস্ট্রি বানানোর সময় খেয়াল রাখতে হয় যেন বাতাস জমে ফুলে না ওঠে। এর জন্য আটা বা ময়দায় প্রথমে তেল বা মাখন মাখা হয়, যাতে স্টার্চ দানার চারপাশে স্নেহজাতীয় পদার্থের একটা আবরণ পড়ে ও প্রোটিন দুটো সংস্পর্শে এসে প্রসারণক্ষম গ্লুটেন তৈরি করতে না পারে।
তেল মেশানো খামিরে বুদ্বুদ তৈরি করা যায় চিনি দিয়েও। চিনির স্ফটিকাকার দানার সূক্ষ্ম কণাগুলোই সাহায্য করতে পারে ছোট ছোট বুদ্বুদ তৈরিতে। এটি খামিরকে রূপ দেয় ফ্যাকাশে হলুদ রঙে। কেকের মতো হালকা খামিরে বুদ্বুদ তৈরিতে ব্যবহার করা হয় এই পদ্ধতি।
চিনি মেশালে অন্য আরেকটি জিনিস আবার ভাবতে হয়। এটি বাতাস থেকে আর্দ্রতা টেনে নেয়। এ ক্ষেত্রে সাদা চিনির চেয়ে লাল চিনির পানি শোষণের প্রবণতা বেশি। এটি খামিরের আর্দ্রতায়ও প্রভাব ফেলে। তাই রেসিপি তৈরির সময় দুই রকম চিনি দিয়েই পরীক্ষা করে দেখতে হয়, কোনটা কতটুকু দিলে খামিরের আর্দ্রতা ঠিক থাকে।
এই মজার রসায়ন কাজ করে মাংসের স্বাদের পেছনেও। মাংসের ৭০ শতাংশই পানি। এ ছাড়া আছে আমিষ আর স্নেহ (Fat)। মাংসে থাকে কোলাজেন, একধরনের তন্তুময় প্রোটিন। এই প্রোটিনটি বেশি দেখা যায় চামড়া, টেন্ডন আর সংযোগ টিস্যুতে। কোলাজেন যত বেশি থাকবে, মাংস হবে তত বেশি শক্ত। কম বয়সী পশুর মাংসের দাম হয় বেশি, কারণ এতে কোলাজেন থাকে কম। তাতে এটি সেদ্ধ হয় দ্রুত, আর খেতেও তাই ভালো লাগে।
তাপ দিলে মাংসে এমন কী ঘটে, যাতে সেটা খাওয়ার উপযোগী হয়ে যায়? পেশি-প্রোটিন মায়োসিন ভেঙে যায় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। সঙ্গে কিছু ক্রস লিংক তৈরি করে মাংসের গঠন ধরে রাখতে। এই অবস্থায় মাংসের পানির কণাগুলোও বেরিয়ে আসতে শুরু করে। আর ৬০ ডিগ্রিতে পৌঁছে মাংসের লাল রঙের জন্য দায়ী মায়োগ্লোবিন ভেঙে রূপ নেয় হেমিক্রোমে। ফলে রান্না করা মাংস অনেকটা বাদামি হয়। আরও তাপ দিলে কোলাজেন চুপসে যেতে থাকে, আর মাংস থেকে পানি দূর করে মাংস হয় শুষ্ক ও চর্বণযোগ্য। আর তাপ দেওয়া হলে সেটা ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে গেলে কোলাজেন দ্রবীভূত হয়ে রূপ নেয় জিলাটিনে। মাংসের প্রোটিনগুলো তন্তুময়, যাতে এর খানিকটা কুড়মুড়ে-জাতীয় হওয়ার কথা। কিন্তু জিলাটিনের কারণেই মাংস মুখে দিলে গলে যাওয়ার মতো অনুভূতি হয়। এটি পিচ্ছিলকারকের মতো কাজ করে।
কাঁচা মাংস, রান্না মাংস, ঝলসানো মাংস, ব্রেড-টোস্ট এসবের বাদামি রঙের পেছনে মেইলার্ড বিক্রিয়া নামের এক প্রক্রিয়া কাজ করে। আমিষের মূল উপাদান অ্যামিনো অ্যাসিডগুলো চিনির সঙ্গে বিক্রিয়া করে শত শত ফ্লেভার তৈরি করে। নানা রকম ফ্লেভার তৈরি হওয়ার ব্যাপারটা আসলে কাজ করে খাবারে উপস্থিত নানা রকম অ্যামিনো অ্যাসিডের পরিমাণ আর ধরনের ওপর।
লেখক: শিক্ষার্থী, খাদ্য ও পুষ্টি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: হাউ ইট ওয়াকর্স
*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত