নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আরউইন শ্রোডিঙ্গার

আজ ১২ আগস্ট আরউইন শ্রোডিঙ্গারের জন্মদিন। অস্ট্রেলিয়ার আরএমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব হেলথ অ্যান্ড বায়োমেডিকেল সায়েন্সেসের শিক্ষক ও গবেষক প্রদীপ দেবের কলমে জানুন তাঁর জীবন ও বিজ্ঞান নিয়ে।

মহাবিশ্বের প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করার জন্য পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দশটি সমীকরণের একটি শ্রোডিঙ্গারের তরঙ্গ সমীকরণ। বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার কোয়ান্টাম মেকানিকস। বলা হয় কোয়ান্টাম মেকানিকস তরুণ পদার্থবিজ্ঞানীদের ক্ষেত্র। কারণ কোয়ান্টাম মেকানিকসের প্রধান স্থপতিদের সবাই ছিলেন বয়সে তরুণ। সে তুলনায় আরউইন শ্রোডিঙ্গারের বয়স কিছুটা বেশি ছিল। ১৯২৬ সালে শ্রোডিঙ্গার যখন তরঙ্গ-সমীকরণ আবিষ্কার করেন , তখন তাঁর বয়স প্রায় চল্লিশ। কোয়ান্টাম মেকানিকসে অবদানের জন্য তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯৩৩ সালে, পল ডিরাকের সঙ্গে যৌথভাবে। কোয়ান্টাম মেকানিকসে তাঁর গবেষণা এবং আবিষ্কার ছিল অনেকটাই হঠাৎ করে করে ফেলার মতো, অসুস্থ হয়ে গৃহবন্দী অবস্থায়।

আরউইন শ্রোডিঙ্গারের জন্ম ১৮৮৭ সালের ১২ আগস্ট অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায়। তাঁর বাবা রুডল্‌ফ শ্রোডিঙ্গার এবং মা জর্জিন শ্রোডিঙ্গারের একমাত্র সন্তান ছিলেন তিনি। আরউইনের বাবা রুডল্‌ফ উত্তরাধিকারসূত্রে কাপড়ের কলের মালিক হয়েছিলেন। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় পরিমাণে উপার্জন হচ্ছিল। তাতেই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন। নিজের আগ্রহ ছিল ছবি আঁকা ও বিজ্ঞানে। বিশেষ করে উদ্ভিদবিজ্ঞান ও রসায়নের প্রতি। একমাত্র ছেলের সাথে তিনি বন্ধুর মতো মিশতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করতেন বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে।

আরউইনের মা বেশ হাসিখুশি প্রাণবন্ত ছিলেন, কিন্তু প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। আরউইনের মায়ের-মা ইংরেজ। তাঁর কাছ থেকে আরউইন ছোটবেলা থেকেই ইংরেজি শিখেছেন এবং তাঁর সংগীদের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন ইংরেজিতে।

প্রাথমিক পড়াশোনা বাড়িতেই শুরু হয় আরউইনের। এগারো বছর বয়সে ১৮৯৮ সালে ভর্তি হলো ভিয়েনার জিমনেশিয়ামে (হাই স্কুল)। ১৯০৬ সালে ম্যাট্রিকুলেশান পাস করেন (উচ্চ-মাধ্যমিকের সমতুল্য)। স্কুলে খুবই ভালো ফল করেছিলেন তিনি। স্কুলের বিষয়গুলি ছিল বেশিরভাগই ইতিহাস, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ ভাষা। গণিত ও বিজ্ঞান ছিল খুবই সামান্য।

দুই

১৯০৬ সালের শেষের দিকে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন আরউইন শ্রোডিঙ্গার। ভিয়েনার পদার্থবিজ্ঞানী লুডভিগ বোলজম্যানের কথা শ্রোডিঙ্গার শুনে আসছেন ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরপরই মানসিক অবসাদে ভুগে আত্মহত্যা করেন বোলজম্যান। শ্রোডিঙ্গারকে খুব নাড়া দেয় এই ঘটনা। বোলজম্যান যেমন প্রতিভাবান বিজ্ঞানী ছিলেন, তেমনি ছিলেন চমৎকার শিক্ষক। ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক পদার্থবিজ্ঞানীর ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তিনি। ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে বোলজম্যানের পর তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হয়েছিলেন ফ্রেডরিক হাসনল। অচিরেই ফ্রেডরিকের পড়ানো আর পদার্থবিজ্ঞান-ভাবনায় মুগ্ধ হন শ্রোডিঙ্গার।

ফ্রেডরিক ছিলেন গতানুগতিক প্রফেসরদের চেয়ে আলাদা। তিনি কোন নোট বা বই দেখে পড়াতেন না। ক্লাসে পদার্থবিজ্ঞানের যুক্তির পর যুক্তি সাজিয়ে পড়াতেন। ছাত্রদের সাথে তাঁর সম্পর্ক শুধুমাত্র ক্লাসরুমেই সীমাবদ্ধ থাকতো না। তিনি ছাত্রদেরকে তাঁর বাড়িতেও নিয়ে যেতেন। ছাত্রদের সাথে পাহাড়ে চড়তেন, স্কি করতেন। শ্রোডিঙ্গার এসব খুবই পছন্দ করতেন। পরবর্তী জীবনে শ্রোডিঙ্গার নিজেও পড়ানোর সময় ফ্রেডরিকের পদ্ধতি অনুসরণ করতেন।

১৯১০ সালে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডির পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বিনা বেতনে কিছু ক্লাস নিতে শুরু করলেন ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু সেই সময় তার মিলিটারি সার্ভিসের ডাক এলো। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তখন পুরুষদের জন্য এক বা দুই বছরের মিলিটারি সার্ভিস বাধ্যতামূলক ছিল।

এক বছরের মিলিটারি সার্ভিস শেষ করে ১৯১১ সালে শ্রোডিঙ্গার ফ্রাঞ্জ এক্সনারের সহকারী হিসেবে যোগ দেন ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শ্রোডিঙ্গারের দায়িত্ব ছিল ফার্স্ট ইয়ারের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে পরীক্ষণ বুঝিয়ে দেয়া। প্রদর্শকের কাজ। ক্লাসরুমে অনেকগুলি ছাত্র, পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি নেই—তাছাড়া পরীক্ষণ দেখানোর প্রতি তেমন কোন আগ্রহও নেই শ্রোডিঙ্গারের। তাই তিনি খুব একটা উৎসাহ পাচ্ছিলেন না কাজে। কিন্তু সেই সময় পদার্থবিজ্ঞানের অন্য কোন চাকরিও নেই অস্ট্রিয়ার কোথাও। পাশের দেশ জার্মানিতে পদার্থবিজ্ঞানীদের জন্য অনেক চাকরি। কিন্তু শ্রোডিঙ্গার জার্মানদের সাথে প্রতিযোগিতা করে চাকরি পাবেন কি না জানেন না।

যুবক বয়সে আরউইন শ্রোডিঙ্গার
ছবি: উইকিপিডিয়া

তখন ইউরোপের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে গেলে পিএইচডি থিসিসের মতো একটা থিসিস জমা দিতে হতো হ্যাবিলিটেশন কমিটির কাছে। এই কমিটি যাচাই করে দেখত বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনভাবে পড়ানোর মতো যোগ্যতা প্রার্থীর আছে কি না। শ্রোডিঙ্গার তাঁর গবেষণাপত্র জমা দিলেন। তিনি তখন গবেষণা করছিলেন কাইনেটিক থিওরি অব ম্যাগনেটিজম বা চুম্বকত্বের গতিতত্ত্ব এবং কাইনেটিক্‌স অব ডাই-ইলেকট্রিক্‌সের ওপর। কমিটি তাঁর গবেষণাকর্মস দেখে মোটামুটি সন্তুষ্ট হয়। এপরে আসে দ্বিতীয় ধাপ—বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা দেয়া। হ্যাবিলিটেশন কমিটি শ্রোডিঙ্গারকে চুম্বকত্বের ওপর বক্তৃতা দেবার সুযোগ দেয়। কিন্তু কমিটি তাঁর বক্তৃতায় খুব একটা সন্তুষ্ট হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরোপুরি অধ্যাপক হওয়া সম্ভব হলো না শ্রোডিঙ্গারের। পেলেন ডেমেনেস্ট্রটর বা প্রদর্শকের পথ। যাদের কাজ শিক্ষার্থীদের ল্যাবরেটরিতে সহযোগিতা করা।

প্রদর্শক হিসেবে তাঁর খুব একটা ভালো লাগছিলো না। অনেক বেশি যোগ্যতা নিয়ে নিচুপদে কাজ করতে হলে এক ধরনের আত্মগ্লানী তৈরি হয়। শ্রোডিঙ্গারেরও হচ্ছিল।

আরও পড়ুন
পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে দ্রুতই সুনাম ছড়িয়ে পড়ে শ্রোডিঙ্গারের। অস্ট্রিয়া ও জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর ডাক আসে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেওয়ার।

তিন

১৯১৩ সালে ভিয়েনায় বেশ বড় একটি পদার্থবিজ্ঞান সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় সাত হাজার বিজ্ঞান-প্রতিনিধি অংশ নিয়েছিলেন সেখানে। আইনস্টাইনসহ ইউরোপের অনেক খ্যাতনামা পদার্থবিজ্ঞানী সেই সম্মেলনে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। আইনস্টাইন তখন ইউরোপের সেরা পদার্থবিজ্ঞানী। তিনি সেখানে মহাকর্ষ বলের তখনকার অবস্থা সম্পর্কে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব নিয়ে কাজ করছিলেন তখন তিনি।

শ্রোডিঙ্গার আইনস্টাইনের বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে মহাকর্ষ ও বিদ্যুৎচুম্বক বলের সমন্বয় নিয়ে গবেষণা করতে উদ্বুদ্ধ হলেন। পরের এক বছর নিবিষ্ট চিত্তে গবেষণা করেন। তারপর একটা গবেষণাপত্র লেখেন। নাম অন দ্য ডাইনামিকস অব ইলাস্টিক্যালি কাপল পয়েন্ট। সেটা পাঠালেন জামার্নির বিখ্যাত জার্নাল এনালেন ডার ফিজিক-এ। এই পেপারে প্রথম শ্রোডিঙ্গারের গভীর গাণিতিক দক্ষতা ও দার্শনিকতার প্রমাণ পাওয়া যায়।

ওই সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে ডাক পড়ে শ্রোডিঙ্গারের। রণাঙ্গনে বসেই জানতে পারেন আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব প্রকাশের খবর। শ্রোডিঙ্গার যুদ্ধরত অবস্থায় এই তত্ত্ব পড়ার সুযোগ পাননি। ১৯১৭ সালে তাঁর পোস্টিং হয় ভিয়েনায়। তখন তিনি কিছুটা সময় এবং সুযোগ পান বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিয়ে ভাবার। আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির পাঠ তাঁকে আবার নতুনভাবে উদ্বুদ্ধ করে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার দিকে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৮ সালে শ্রোডিঙ্গার আবার যোগ দিলেন আগের প্রদর্শক পদে। কিন্তু অন্য জায়গায় ভালো চাকরি খুঁজছিলেন। একটা সুযোগ এলো জার্মানির ইনা (Jena) বিশ্ববিদ্যালয়ে। পদটা যদিও এখনো খুব একটা উঁচুমানের নয়। তবু শ্রোডিঙ্গার যোগ দিলেন সেখানে।

জার্মানির ইনা বিশ্ববিদ্যাল
ছবি: উইকিডাটা

চার

১৯১৮ সালে শ্রোডিঙ্গার বিয়ে করলেন আনামেরি বার্টেলকে। আনামেরির বয়স তখন তেইশ, শ্রোডিঙ্গারের বত্রিশ। শ্রোডিঙ্গারের সাথে আনামেরির কোন বিষয়েই মিল ছিল না। আনামেরি লেখাপড়া তেমনকিছু করেননি। বিজ্ঞানের কিছুই বোঝেন না। শ্রোডিঙ্গারের গভীর দর্শনেরও সঙ্গী তিনি নন।

১৯১৮ সালে ইনা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার পর শ্রোডিঙ্গারকে যথাযথ সম্মান দেখানো হলো। কাজে যোগ দিয়েই তিনি পরমাণুর তত্ত্ব সম্পর্কে খুব চমৎকার একটি বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা দিলেন। তাঁর বক্তৃতায় ইনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি এতটাই খুশি হলেন যে, শ্রোডিঙ্গারকে দ্রুত প্রমোশন দিয়ে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর করে ফেলা হলো। কিন্তু পদটি ছিল অস্থায়ী। স্থায়ী হতে কতদিন লাগবে শ্রোডিঙ্গার জানেন না। তাই তিনি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী পদের জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখলেন। চার মাস পরেই সুযোগ এলো স্টুটগার্ট ইউনিভার্সিটি থেকে। শ্রোডিঙ্গার সেখানে যোগ দিলেন অ্যাসোসিয়েট প্রফেসরের স্থায়ী পদে।

ইতোমধ্যে শ্রোডিঙ্গারের মায়ের স্বাস্থ্য আরো খারাপ হয়েছে। ১৯১৯ সালে স্তন ক্যান্সারে মারা যান তিনি। এর কিছুদিন পর ১৯১৯ সালের শেষের দিকে শ্রোডিঙ্গারের বাবাও মারা যান। মা-বাবা দুজনকে হারিয়ে পারিবারিকভাবে একেবারে একা হয়ে পড়েন শ্রোডিঙ্গার।

পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে দ্রুতই সুনাম ছড়িয়ে পড়ে শ্রোডিঙ্গারের। অস্ট্রিয়া ও জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর ডাক আসে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেওয়ার। অনেক ভেবেচিন্তে তিনি যোগ দিলেন জার্মানির ব্রেসলাউ বিশ্ববিদ্যালয়ে (এটা এখন পোলান্ডে)। কিন্তু এখানেও তিনি বেশিদিন ছিলেন না। কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি ডাক পেলেন সুইজারল্যান্ডের জুরিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন স্বয়ং আইনস্টাইন। শ্রোডিঙ্গারের কাছে এর মর্যাদাই আলাদা। খুব খুশিমনে তিনি জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন অধ্যাপক হিসেবে।

চৌত্রিশ বছর বয়সেই অধ্যাপক হয়ে যান শ্রোডিঙ্গার। কিন্তু হিসেব করে দেখতে গেলে তাঁর তখনো পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোন বৈজ্ঞানিক কাজ নেই।

সুইজারল্যান্ডে একটু গুছিয়ে বসতে না বসতেই শ্রোডিঙ্গারের শরীর খারাপ হতে শুরু করে। পরীক্ষা করে দেখা গেল যক্ষা বাসা বেঁধেছে তাঁর শরীরে। সুস্থ্য হওয়ার জন্য পরিবর্তনের জন্য তাঁকে আরুজা পর্বতমালার পাদদেশে একটি স্বাস্থ্যনিবাসে থাকতে হলো। এখানেই তিনি লিখে ফেলেন তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রগুলির একটি—অন আ রিমার্কেবল প্রোপার্টি অব কোয়ান্টাইজড অরবিটস অ্যান ইলেকট্রন।

১৯২১ থেকে ১৯২৭ । এই ছয় বছর জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন শ্রোডিঙ্গার। এর মধ্যেই তিনি আবিষ্কার করেছেন কোয়ান্টাম মেকানিকসের মূল সমীকরণ, শ্রোডিঙ্গার ইকোয়েশন অব ওয়েভস।

জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে শ্রোডিঙ্গারের সুনাম ছড়িয়ে পড়লো দ্রুত। তিনি ছাত্রদের সাথে তাঁর শিক্ষক ফ্রেডরিকের শিক্ষণ-পদ্ধতি অনুসারে পড়াতে লাগলেন। সেই সময় অধ্যাপকেরা পড়াতেন লেকচার নোট দেখে দেখে। কিন্তু শ্রোডিঙ্গার ক্লাসে কোন ধরনের বই বা নোট ব্যবহার না করে—সবকিছু তৎক্ষণাৎ ক্লাসেই ব্ল্যাকবোর্ডে তৈরি করতেন যুক্তি দিতে দিতে। এভাবে চোখের সামনে সমীকরণ তৈরি হতে দেখে ছাত্ররা খুবই উৎসাহিত হত। অনেক সময় তিনি সমুদ্রের তীরে নিয়ে যেতেন ছাত্রদের। সেখানে সৈকতে ব্ল্যাকবোর্ড রেখে সেখানেই পড়াতেন।

১৯২৭ সালে শ্রোডিঙ্গার জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের প্রধান অধ্যাপকের পদে যোগ দেন।

পাঁচ

কোয়ান্টাম মেকানিকসের ধারণা প্রথম দিয়েছিলেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ১৯০০ সালে। তাপীয় বিকিরণ বিশ্লেষণ করে ক্রমে ফোটনের ধারণা পাওয়া যায়। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন আলো এবং শক্তির সমন্বয়ক সূত্র প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৩ সালে নীলস বোর পরমাণুর কোয়ান্টাম মডেল দেন। ১৯২০ সালে ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ পরমাণুর ইলেকট্রনের কক্ষপথের ম্যাট্রিক্স মেকানিকস আবিষ্কার করেন। যেটা দিয়ে পরমাণুর কক্ষপথে ইলেকট্রনের গাণিতিক বর্ণনা দেয়া যায়। ১৯২৪ সালে লুই দ্য ব্রগলি ম্যাটার ওয়েভ বা বস্তু-তরঙ্গের ধারণা দেন। শুরুতে আইনস্টাইন ছাড়া ব্রগলিকে কেউ তেমনভাবে সমর্থন করেননি। আইনস্টাইনের বর্ণনা পড়ে শ্রোডিঙ্গারেরও মনে হয়েছিল, দ্য ব্রগলির ধারণা সঠিক হতে পারে। ফোটনের মতো করে ইলেকট্রনের তরঙ্গের গাণিতিক সমীকরণও লেখা সম্ভব। ১৯২৫ সালে শ্রোডিঙ্গার তাঁর বিখ্যাত সমীকরণটি তৈরি করে ফেললেন। ১৯২৬ সালে এনালেন ডার ফিজিক-এ ধারাবাহিকভাবে চারটি গবেষণাপত্রে শ্রোডিঙ্গার তাঁর সমীকরণ প্রকাশ করেন। শ্রোডিঙ্গারের তরঙ্গ সমীকরণ আর হাইজেনবার্গের ম্যাট্রিক্স বৈজ্ঞানিকভাবে একই বিষয়ের দুটি ভিন্ন প্রকাশ।

১৯২৭ সালে শ্রোডিঙ্গার জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের প্রধান অধ্যাপকের পদে যোগ দেন। ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক এই পদে ছিলেন। প্ল্যাঙ্ক অবসর নেয়ার সময় নিজেই শ্রোডিঙ্গারকে পছন্দ করেন এই পদের জন্য। এই পদে যোগ দেয়ার কারণে শ্রোডিঙ্গার জার্মানির নাগরিকত্ব পান এবং প্রুশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সের সদস্য মনোনীত হন।

ছয়

১৯৩৩ সালে জার্মানিতে হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি সরকার ক্ষমতায় আসে। ইহুদিদের উপর প্রকাশ্য অত্যাচার শুরু হয়। শ্রোডিঙ্গার নিজে ইহুদি নন, কিন্তু তাঁর ইহুদি সহকর্মীদের উপর নাৎসিদের অত্যাচারের মৌখিক প্রতিবাদ করলেন তিনি। ফলে তাঁর অবস্থানও নড়বড়ে হয়ে যায়। তিনি বার্লিন ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যাবার চেষ্টা শুরু করেন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ম্যাগড্যালেন কলেজে রিসার্চ ফেলো হিসেবে একটি অস্থায়ী পদের ব্যবস্থা করলেন শ্রোডিঙ্গারের বৈজ্ঞানিক সহকর্মীরা।

অক্সফোর্ডে যাবার আগে শ্রোডিঙ্গার ব্রাসেলসে গেলেন সপ্তম সলভে কনফারেন্সে যোগ দিতে। সেখান থেকে ফিরে অক্সফোর্ডে ফিরে জানতে পারেন কোয়ান্টাম মেকানিকসে অবদানের জন্য পল ডিরাক এবং তিনি ১৯৩৩ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

১৯৩৩ থেকে ১৯৩৫ পর্যন্ত শ্রোডিঙ্গার অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ছিলেন। ১৯৩৬ সালে তিনি অস্ট্রিয়ার গ্রাজ ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেন।

১৯৩৬ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত গ্রাজ ইউনিভার্সিটিতে কাজ করেন শ্রোডিঙ্গার। কিন্তু রাজনৈতিক পটভূমি দ্রুত বদলে যায়। হিটলার অস্ট্রিয়া দখল করে নেয়। গ্রাজ ইউনিভার্সিটির সব ইহুদি অধ্যাপককে ছাটাই করা হয়। শ্রোডিঙ্গার ইহুদি না হলেও ইহুদিদের পক্ষে কথা বলেছিলেন, এই খবর নাৎসিদের কাছে আছে। তাঁকে বলা হলো কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে একটি খোলা চিঠি লিখতে। শ্রোডিঙ্গার নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তা লিখলেন। কিন্তু তাতেও কাজ হলো না। ১৯৩৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেয়া হলো। দেশ থেকে চলে যাবার অনুমতি তাকে দেয়া হলো, কিন্তু শর্ত হলো সাথে কোন টাকা-পয়সা নেয়া যাবে না।

এতদিনের জমানো সবকিছু পেছনে ফেলে সামান্য কিছু জিনিসপত্র সাথে নিয়ে তিনি ইতালিতে চলে গেলেন। শ্রোডিঙ্গারের এই দুঃসময়েও তাঁর সঙ্গী ছিলেন স্ত্রী আনামেরি। রোমে বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি তাঁদের অভ্যর্থনা জানালেন এবং টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করলেন। রোম থেকে জেনিভায় গিয়ে আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ইয়ামন দ্য ভ্যালেরি’র সাথে দেখা করলেন শ্রোডিঙ্গার। দ্য ভ্যালেরি তাঁকে জানালেন, তিনি ডাবলিনে ইন্সটিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন। শ্রোডিঙ্গার যদি সেই ইন্সটিটিউটে যোগ দেন তাহলে ভালো হয়। শ্রোডিঙ্গারের সম্মতি ছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি তখনো তৈরি হয়নি। তাই সেখানে যোগ দেয়ার আগে ১৯৩৯ সালে বেলজিয়ামের গেন্ট ইউনিভার্সিটিতে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এখানে বসে অনেকদিন পর আবার একটি গবেষণাপত্র রচনা করেন। এবারের বিষয় মহাবিশ্বের প্রসারণ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শেষ হয়, শ্রোডিঙ্গারের বয়স তখন ষাট। শ্রোডিঙ্গার এই সময় ঘোষণা দেন, তিনি ইউনিফাইড থিওরি আবিষ্কার করে ফেলেছেন।

১৯৩৯ সালে শ্রোডিঙ্গার এবং আনামেরি ডাবলিনে পৌঁছান। ডাবলিন ইন্সটিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজের কাজকর্ম বেশ দ্রুতই প্রসারিত হতে শুরু করলো শ্রোডিঙ্গারের নেতৃত্বে। শ্রোডিঙ্গার তাঁর গবেষণার বেশিরভাগ মনযোগ দিলেন আইনস্টাইনের মতোই—অভিকর্ষ বল ও তড়িৎচুম্বক বলের সমন্বয়ের সূত্র আবিষ্কারের নেশায়। কিন্তু এই কাজে সাফল্য আসেনি।

তবে শ্রোডিঙ্গার জীববিজ্ঞানের গবেষণায় বেশ সফল হন। ১৯৩৩ সালেই তাঁর মনে প্রশ্ন এসেছিল জীবকোষের মধ্যে এতগুলি পরমাণু কেন? কিন্তু সেই সময় এই ব্যাপারে আর কোন অনুসন্ধান তিনি করেননি। এখন ১৯৪০ সালে এসে তিনি ভাবছেন জীবকোষের ক্রোমোজমে নিশ্চয় জীবনের সংকেত লেখা আছে। শ্রোডিঙ্গারের আগে কেউ কেউ বিচ্ছিন্নভাবে জীবন ও পদার্থবিজ্ঞানের সমন্বয়ের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু শ্রোডিঙ্গার পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে জীবনের অর্থ কী হতে পারে সে ব্যাপারে বিস্তারিত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিলেন। ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত হলো তাঁর বই হোয়াট ইজ লাইফ? আয়ারল্যান্ডে তাঁর বইয়ের খুব একটা সমাদর হলো না। কিন্তু শ্রোডিঙ্গারের বইটি খুবই অনুপ্রেরণা জোগায় অণুজীববিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ক্রিককে। পরে ডিএনএ আবিষ্কারে শ্রোডিঙ্গারের বই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

শিগগিরিই আসছে বিজ্ঞানচিন্তা আগস্ট সংখ্যা। এ সংখ্যায় থাকছে:

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শেষ হয়, শ্রোডিঙ্গারের বয়স তখন ষাট। শ্রোডিঙ্গার এই সময় ঘোষণা দেন, তিনি ইউনিফাইড থিওরি আবিষ্কার করে ফেলেছেন। ডাবলিনের সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর সাফল্যের কাহিনি। আইনস্টাইন তখনো চেষ্টা করে যাচ্ছেন এই তত্ত্ব আবিষ্কারের। তিনি প্রিন্সটনে বসে শ্রোডিঙ্গারের গবেষণাপত্র খুব সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারেন শ্রোডিঙ্গারের তত্ত্বে ভুল আছে। তিনি শ্রোডিঙ্গারকে জানালেন কোথায় ভুল আছে। শ্রোডিঙ্গার বুঝতে পেরে খুবই লজ্জিত হন। এতই লজ্জিত হন যে, তিনি পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা ছেড়ে দিয়ে ভারতীয় দর্শন পড়তে শুরু করেন। এই সময় তিনি উপনিষদের যতগুলি বই ইংরেজিতে এবং ইউরোপীয় ভাষায় পাওয়া যায় সব পড়ে ফেলেন একের পর এক। যুদ্ধ-পরবর্তী সলভে যোগ দিয়ে তিনি বুঝতে পারেন, তাঁর গবেষণা সম্পর্কে এখন আর কারও তেমন আগ্রহ নেই। তিনি আরও বেশি করে দর্শনের দিকে ঝুঁকলেন।

১৯৫৬ সালে শ্রোডিঙ্গার ভিয়েনায় ফিরে এলেন। ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর জন্য একটি বিশেষ পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। ১৯৫৭ সালে তাঁকে জার্মান অর্ডার অব মেরিট এবং অস্ট্রিয়ান মেডেল ফর আর্টস এন্ড সায়েন্স দেয়া হয়।

শ্রোডিঙ্গারের শরীর ক্রমশ খারাপ হতে শুরু করেছে। তাঁর হৃৎপিণ্ড এবং ফুসফুসের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে হতে ১৯৬১ সালের ৪ জানুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়।